শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


একজন মুসলিমের দৈনন্দিন রুটিন যেমন হওয়া উচিত!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মূল: ড. ইউসুফ আল-কারজাবি হাফি.
অনুবাদ: ওমর আলফারুক

আমাদের সবার জীবন সয়লাব হয়ে আছে অযাচিত ব্যস্ততা আর অনর্থ কোলাহলে। এই ভুল ব্যস্ততার পেছনে পড়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষিত অমল ধবল জীবন কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আর এর কারণ হল আমাদের দিনের শুরুই হয় ভুলভাবে। রাত বারোটার পরে ঘুমানো আর দিনের দশটা বাজিয়ে ঘুম উঠা আমাদের নৈমত্তিক রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভুল রুটিনের কারণে বরকতশূন্য হয়ে পড়েছে আমাদের জীবন।

জীবনে বরকত লাভ, সুষম সমন্বয় এবং সত্যিকারের শৃঙ্খলা অর্জনের জন্য ইসলামের বর্ণিত দৈনন্দিন রুটিন অনুসরণ করা উচিত আমাদের সবার। ইসলামের বর্ণিত সেই রুটিন হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বাতানো পদ্ধতিতে নবীজির অনুসৃত জীবনযাপনের তরিকা বাস্তবায়ন।
আর ইসলাম আমাদের আগে ঘুমাতে এবং আগে জাগতে উৎসাহিত করে।

একজন মুসলমানের দিনের সূচনা হবে সুবহে সাদিক থেকে, নিদেনপক্ষে সূর্য উঠার আগে। এভাবে সে ফজরের নামাজান্তে ভোরের শুভ্র হাওয়া এবং নির্মল প্রাকৃতিক সজীবতা গায়ে মাখতে পারে। সকালের পরিবেশ এত সতেজ থাকার রহস্য হলো, সকালের সম্পূর্ণ সময়টাই মুনাফিকমুক্ত থাকে। মুনাফিকদের দিনের শুরুই হয় সকাল শেষ হওয়ার পর।

তাছাড়া যারা সকালে ঘুম থেকে উঠে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য বরকতের দুআ করেছেন, “হে আল্লাহ! আমার উম্মতের মধ্যে যারা ভোরে জাগে, তাদের জীবনে বরকত দান করুন”। (মুসনাদে আহমদ, সহিহ ইবনে হিব্বান)। দুখের বিষয় হলো আমাদের লাইফস্টাইল একদমই এর বিপরীত।

আমরা অযথাই রাত অনেক রাত করে ঘুমাই, ফোলে ফজরের নামাজ অক্তমতো পড়া আমাদের নসিব হয় না। আমাদের সালাফেরা বলতেন, “যারা সূর্য উঠার পর ফজরের নামাজ পড়ে, তারা কীভাবে আল্লাহর কাছে রিজিক আশা করে আমাদের বুঝে আসে না”। আবু হুরাইরা রাজিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমরা ঘুমালে শয়তান তোমাদের ঘাড়ে তিনটা গিট্টু দেয়, প্রতিটা গিট্টুতে ‘রাত এখনো অনেক লম্বা, তুমি ঘুমাও’ বলে শয়তান ফুঁ দেয়।

ঘুম থেকে উঠে কেউ আল্লাহর নাম নিলে প্রথম গিট্টু খুলে যায়। এরপর অজু করলে দ্বিতীয় গিট্টু খুলে যায়। এরপর যদি নামাজ আদায় করে তাহলে তৃতীয় গিট্টুটিও খুলে যায়। ফলে তার দিনের শুরুটা হয় কর্মময় এবং প্রশান্ত চিত্তে। অন্যতায় তার সকাল শুরু হয় অলস এবং মনমরা অবস্থায়”। (সহিহ বুখারি)

এরপর রয়েছে নবীজি কর্তৃক পঠিত সকালের অনিন্দ্য সুন্দর দুআগুলো। এই দুআগুলো পড়লে একজন পাঠকের মন ভালো না হয়ে পারে না। এই সব দুআর বৈজ্ঞানিক কার্যক্ষমতা আমরা হয়তো হাজার বছর ধরেও বুঝিনি। সম্প্রতি মেডিটেশনে এর চেয়ে কম পাওয়ারফুল শব্দগুলোই ‘অ্যাফারমেশন’ নামে ব্যবহৃত হচ্ছে।

মাসনুন দুআ আদায় করে কিছুক্ষণ অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করে কুরআন তিলাওয়াত করবে। এরপর সকালের নাস্তা সেরে দিনের কাজের জন্য বের হবে। এবং জীবীকার তালাশে যেকোনো হালাল পেশায় যুক্ত হবে।

এখানে মনে রাখতে হবে যে ইসলাম সুদকে হারাম করেছে। কারণ, সুদের মাধ্যমে কোন রকমের কষ্ট, অংশিদারিত্ব এবং রিস্ক ব্যতিরেখেই শুধু টাকা দিয়ে টাকা উপার্জন করা হয়। এভাবে যার অনেক টাকা সে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবে আর টাকা দিয়ে টাকা কামাবে। কোন রকম মেহনত ছাড়া এই সুদি উপার্জন ইসলামি দর্শন বিরোধী। আল্লাহ তাআলা মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করে তাতে তাদের বসবাস করতে দিয়েছেন যাতে তারা পৃথিবীকে আরও সমৃদ্ধ করে।

জীবন থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গ্রহণ করার মতই মানুষের উচিত, পৃথিবীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা। পৃথিবীর যে পরিমাণ জিনিস আমরা ব্যবহার করি। আমাদের উচিত ওই পরিমাণ জিনিস সৃষ্টি করা। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম সুন্দর একটা পৃথিবী পেতে পারে। কোনো মুসলমানের জন্যই অযথা বেকার থেকে সময় এবং জীবন নষ্ট করা উচিত নয়। কোনো কাজ না করে খেয়ে আর ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করা ইসলামের আদর্শের বিপরীত। এমনকি এই কর্মহীনতা যদি এবাদতের নামে হয়, তবু ইসলাম এর অনুমেদন দেয় না। কারণ, ইসলামে সন্ন্যাসবাদ নেই।

ইমাম বাইহাকি আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাজিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণনা করেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেন, ‘দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো বেকারত্ব।

আল্লামা মুনাভি রহ. এর সাথে আরও যুক্ত করে তার ফয়জুল কাদিরে লিখেন, ‘কোন ব্যক্তি যখন বেকার বসে থাকে। তখন তার অন্তরে বিবিধ কুমন্ত্রণা সৃষ্টি হয়। কারণ বাহ্যিকভাবে বেকার থাকা গেলেও মানুষের অন্তর কখনই বেকার থাকে না। বরং অন্তরকে কাজ দিয়ে না রাখলে সেখানে শয়তানের কুমন্ত্রণা প্রাধান্য লাভ করে। এবং শয়তানের ধোঁকায় পড়ে মানুষ এমন সব কাজে জড়িয়ে পড়ে, যাতে ক্ষতি ছাড়া কারও কোন উপকার হয় না।

একবার ওমর রাজিয়াল্লাহু আনহু বাহ্যিক বেশভূষা দেখে এক ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই ব্যক্তির কি কোন পেশা আছে? ‘তার কোন পেশা নেই’ শুনার সাথে সাথে তিনি চোখ ফিরিয়ে নেন।

এই নিন্দা হলো কোন রকমের কাজকর্ম না করে নিজের সম্পদ খেয়ে ধ্বংস করার ব্যাপারে। আর যারা নিজেরা কাজ না করে অন্যের সম্পদ খেয়ে শেষ করে তারা তো আরও অধিক নিন্দার যোগ্য। এইজন্য সুফিয়ানে কেরাম পেশাহীন ব্যক্তিকে ধ্বংসস্তূপে বাস করা পেঁচার সাথে তুলনা করেন, যাতে কারওই কোনো ফায়দা নেই।

মুসলমান বিশুদ্ধ নিয়ত এবং সঠিক পন্থায় যে জাগতিক কাজকর্ম করে, সেগুলোও এবাদত এবং জিহাদ হিসেবে গণ্য হয়। কারণ প্রতিটি কাজ সঠিকভাবে আদায় করা মুসলমানের ওপর অর্পিত দায়িত্ব। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেন, ‘আল্লাহ প্রতিটি জিসিসের ওপর ‘এহসান’ আবশ্যক করেছেন। আর এহসান হলো প্রতিটি জিনিস সুন্দর এবং সুচারুরূপে সম্পন্ন করা। যেমন অন্য হাদিসে নবীজি বলেন, ‘তোমরা যখন কোন কাজ করবে, তা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করবে’। (বাইহাকি)

দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্যে একজন মুসলমানের জন্য যে বিষয়টি কখনই ভুলে যাওয়া উচিত নয় তা হলো, মানুষকে সাহায্য করা এবং সমাজ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা। কারণ এসব তার আমলনামায় সাদাকা হিসাবে গণ্য হয়।

নবীজি বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের ওপর সাদাকা আবশ্যক। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, কেউ যদি সাদাকা করার মতো কিছু না পায়? নবীজি বললেন, সে নিজ হাতে কামাই করবে। এতে সে নিজেও লাভবান হবে, সাদাকাও করতে পারবে। তারা বললেন, যদি তা করতে সক্ষম না হয়? তিনি বললেন, গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করবে। তারা বললেন, যদি তা করতে না পারে? তিনি বললেন, সৎ কাজের আদেশ করবে। তারা বললেন, যদি তাও করতে না পারে? নবীজি বললেন, তাহলে সে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকবে, এটাই তার জন্য সাদাকা হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৬০২২)

হাদিসে উল্লেখিত এই সাদাকা এবং সমাজের প্রতি ব্যক্তির দায় প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এই কর্তব্য সমাজের প্রতিটি সদস্যের। ইসলাম রহমতের ধর্ম। সেই হিসেবে প্রতিটি মুসলমানের উচিত সমাজের জন্য রহমতস্বরূপ হওয়া। ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করলে প্রত্যেক মুসলমান হয়ে উঠবে কল্যাণের একেকটি অনিঃশেষ ঝর্নাধারা। যা তার চার পাশের সজীবতা বৃদ্ধিতে অবিরত বয়ে চলবে।
হজরত আবু হুরাইরা রাজিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত নবীজি বলেন, ‘যত দিন সূর্য উঠবে, তত দিন প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতিটি গ্রন্থির ওপর রয়েছে সাদাকা। (শুধু দান করাই সাদাকা নয়।) দুজন ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া সাদাকা। কাউকে বাহনের ওপর উঠতে বা তার সামান উঠাতে সহায়তা সাহায্য করা সাদাকা।

উত্তম কথা বলা সাদাকা। নামাজের জন্য মসজিদের দিকে উঠানো প্রতিটি পদক্ষেপ সাদাকা। রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরানোও সাদাকা’। আল্লাহ তাআলা মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। এই জন্য মানুষের উচিত এসবের শুকরিয়া আদায় করা। আর শুকরিয়া আদায়ের তরিকা হলো, স্রষ্টার আনুগত্য এবং সৃষ্টির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা।

সূর্য হেলে পড়লে জোহরের আজান দেওয়া হয়। প্রথম অক্তেই জোহরের নামাজ জামাতের সাথে আদায়ের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। কারণ প্রথম অক্তে আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে। আল্লাহ তাআলা ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করতে বলেছেন। আর নবীজি জামাতে পশ্চাদগামীদের ঘর জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছেন।

তাছাড়া একা নামাজ পড়ার চেয়ে মসজিদে জামাতে নামাজে সাতাশ গুণ বেশি সুয়াবের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
মুসলমান দ্বিপ্রহরে আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক থেকে সীমাহীন অপচয় এবং সীমাহীন সংযম ব্যতিরেখে মধ্যম পন্থায় দুপুরের খাবার গ্রহণ করবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! প্রত্যেক নামাজের সময় সাজসজ্জা গ্রহণ কর এবং পানাহার কর, তবে অপচয় কর না। আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না’। (সুরা আরাফ, আয়াত ৩২) গরমের সময় বিশেষত গ্রীষ্মকালে দুপুরের পানাহারের পর কিছু সময় কাইলুলা (বিশ্রাম) করার প্রয়োজন হয়, এতে শেষ রাতে উঠা সহজ হয়। সুরা নুরের ৫৮ নং আয়াতে কইলুলার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে।
আসরের অক্ত শুরু হলে কাইলুলা বা অন্যসব ব্যস্ততা রেখে সবাই মসজিদের দিকে যাবে। আসরের নামাজে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। এই নামাজকে ‘মধ্যবর্তী নামাজ’ হিসেবে উল্লেখ করে কুরআনে আলাদাভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাই ব্যস্ততা, বাণিজ্য বা খেল-তামাশায় মত্ত থেকে এই নামাজকে অবহেলা করা যাবে না। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের মধ্যে রয়েছে এমন মানুষ, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে বিরত রাখতে পারে না’। (সুরা নুর, আয়াত ৩৮)

তাই কোন মুসলমানের উচিত নয় আসরের নামাজকে পিছিয়ে একদম শেষ অক্তে আদায় করা। কারণ আসরের নামাজ একদম শেষ অক্তে সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করলে মুনাফিকরাই কেবল আদায় করে থাকে। যেমন নবীজি বলেন, ‘ওই নামাজ হলো মুনাফিকের নামাজ, যে বসে বসে সূর্যের দিকে তাকাতে থাকে আর যখন তা অস্থপ্রায় হয়ে যায় তখন উঠে গিয়ে চারবার ঠোকর মেরে আসে। এভাবে সে আল্লাহকে কমই স্মরণ করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১২৯৯)

সূর্য ডুবে গেলে মুসলমানগণ দ্রুত মসজিদের দিকে ধাবমান হবে এবং মাগরিবের নামাজ প্রথম অক্তেই পড়বে। কেননা মাগরিবের অক্ত খুবই সংক্ষিপ্ত। মাগরিবের নামাজের পর সকালের মতো মাসনুন দুআ এবং জিকির আদায় করবে।

একজন মুসলিম রাতের খাবার পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করবে। এরপর সুন্নত সহকারে এশার নামাজ পড়বে। শেষ রাতে উঠার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হলে বিতির রেখে দেবে, অন্যতায় তখনই পড়ে নেবে। প্রয়োজনে রাতের খাবার এশার পরও খাওয়া যেতে পারে, তবে রাতের খাবারের পরেই এশার নামাজ আদায় করা উচিত। রাতের খাবার এবং এশার নামাজ একই সাথে হাজির হলে আগে খাবার খেয়ে নেবে। বুখারি-মুসলিমের হাদিসে এমনটাই এসেছে। খেয়ে নামাজ পড়ার কারণ হলো, যাতে নামাজে পরিপূর্ণ মনোযোগ দেওয়া যায়। ঘুমের আগে নির্দিষ্ট কোনো কাজ থাকলে তা করবে, যেমন কারও সাথে দেখা করা, কোনো বিশেষ কাজ সম্পন্ন করা।

দৈনন্দিন রুটিনে কিছুটা সময় নিজের অধ্যয়নের জন্য রাখা উচিত। যাতে নিজেকে সমৃদ্ধ করা যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা নবীজিকে বলেছেন, ‘হে নবী আপনি বলুন, প্রভু! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন’। নিজের দুনিয়া এবং আখেরাত সজ্জিত করার জন্য তাই দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় নির্বাচিত কিতাবাদি পড়ার জন্য বরাদ্দ করা উচিত। জনৈক জ্ঞানী সুন্দর বলেছেন, ‘তুমি যা পড় তা যদি আমাকে বল, তাহলে তুমি যে আসলে কে তা আমি তোমাকে বলে দিতে পারব!’

দিনের কিছু সময় বৈধ খেলাধুলা এবং শরিয়ত-সম্মত বিনোদনে ব্যয় করা দোষের কিছু নয়। তবে কাজ, ঘুম, বিশ্রাম, নিজের শরীর, পরিবারের হক, আত্মীয়-স্বজনের হকসহ যেকোনো হক সর্বোপরি আল্লাহর হক তথা এবাদতে অবহেলা করে তা কখনই করা যাবে না। এসকল দায়িত্ব যথাযথ আদায়ের পরই খেলাধুলা এবং বিনোদনের কথা আসে।

অবশ্য এসব হক আদায় করতে গিয়েও বাড়াবাড়ি করা যাবে না। কারণ, একদিকে সময় বেশি দিলে আবশ্যিকভাবেই অন্যদিকে সময় কম পড়বে। এই জন্য সময় এবং কার কতটুকু হক এই ব্যাপারে সবার পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত। কুরআনুল কারিমের এই আয়াতও সুষম বণ্টনের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা মাপের ব্যাপারে অন্যায় করো না। ন্যায়ের সাথে মাপ ঠিক রেখো এবং মাপে কম দিয়ো না।’ (সুরা রাহমান, আয়াত ৮-৯)

আল্লাহ তাআলা কুরআনে যে দশটি হকের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর ব্যাপারে মুসলমানদের কখনোই বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর তোমরা আল্লাহর এবাদত করো, তার সাথে কোনো কিছু শরিক করো না, পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো এবং আত্মীয়-স্বজন, এতিম-মিসকিন, কাছের প্রতিবেশি, দূরের প্রতিবেশি, ঘনিষ্ট সহচর, পথিকজন, তোমাদের দাস-দাসীর সাথেও (ভালো ব্যাবহার করো)। (সুরা নিসা, আয়াত ৩৬)

এখানে উল্লেখিত দশটি হকের মধ্যে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হক হলো সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, সকল কিছুর মালিক, জীবন-মৃত্যু এবং যাবতীয় নেয়ামত দাতা আল্লাহ তাআলার হক। কারণ, ‘প্রতিটি নেয়ামতই আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে’। অতএব আল্লাহ তাআলার হকের ব্যাপারে কোনো রকম অবহেলা এবং গাফলতির সুযোগ নেই।

আর আল্লাহ তাআলার হকের মধ্যে দৈনন্দিন আদায়যোগ্য প্রকাশ্য হক হলো নামাজ। এই জন্য নামাজের খুশু-খুজু মুমিনের প্রথম-প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তারা খুশু-খুজুর সাথে নামাজ আদায় করে’। নামাজের প্রতি যত্নশীলতাকে মুমিনের বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘আর তারা নামাজের প্রতি যত্নশীল’।

আর যারা নামাজে অলসতা প্রদর্শন করে, তাদের ধ্বংসের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘দুর্ভোগ সেই নামাজিদের জন্য, যারা নামাজ আদায়ের ব্যাপারে অমনোযোগী’।

দ্বিতীয় প্রধান হক হলো মাতাপিতার। তাওহিদ এবং আল্লাহর এবাদতের পর কুরআনে সবচেয়ে গুরুত্বসহকারে মাতাপিতার হকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন-সুন্নায় বিশেষত মায়ের হকের ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে, ‘তার মা তাকে কষ্ট করে গর্বে ধারণ করেছে এবং কষ্ট করে প্রসব করেছে। তাকে গর্বে ধারণ এবং দুধ ছাড়াতে ত্রিশ মাস সময় লেগেছে’। (সুরা আহকাফ, আয়াত ১৫)

বছরের নির্দিষ্ট কোনো দিনে ‘মাতৃদিবস’ পালন করে দায়মুক্তির আধুনিক আনুষ্ঠানিকতাকে ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলাম বরং বছরের প্রতিটি দিনকেই মাতৃদিবসের মর্যাদা দিতে বলে।

পিতামাতার হকের পর আসে ভাইবোন, চাচা-ফুফু, মামা-খালা, ছেলে-মেয়েসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের হক। সমাজের একজন সদস্য হিসাবে এতিম-মিসকিন, কাছের প্রতিবেশি, দূরের প্রতিবেশি, ঘনিষ্ট সহচর, পথিকজন, দাস-দাসীর হক যথাযথ আদায়ের পর চার পাশের জীবনমান উন্নয়নের দায়ও তার ওপর বর্তায়। মোটকথা ইসলাম তার অনুসারীদের জীবন ও জগতের মানোন্নয়নের নির্দেশ দেয়।

দিনশেষে একজন মুসলমান যখন বিছানায় ঘুমানোর জন্য যাবে, তখন তার জন্য উত্তম হলো অজু করে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নেওয়া। এরপর আল্লাহর জিকির এবং ঘুমের মাসনুন দুআ পড়ে ডান কাতে শুয়ে পড়বে।

আমাদের পূর্বসূরী উলামায়ে কেরাম দিবস-রজনীর আমল বিষয়ক যে সব কিতাবাদি লিখেছেন, প্রত্যেকের উচিত সাধ্যমতো সেগুলো পাঠ করা এবং তদোনুযায়ী আমল করা। দিন-রাতের আমল বিষয়ে ইমাম নাসাঈর ‘আমালুল ইয়াউমি ওয়াল লাইলাতি’ একই শিরোনামে নাসাঈর ছাত্র ইবনুস সুন্নির গ্রন্থ, ইমাম নববির ‘আল-আজকার’, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার ‘আল-কালিমুত তায়্যিব’, তার ছাত্র ইমাম ইবনুল কায়্যিমের ‘আল-ওয়াবিলুস সুয়াইব’, ইমাম ইবনুল জাওজির ‘আল-হিসনুল হাসিন’ ইমাম শাওকানির ব্যাখ্যাগ্রন্থসহ সমকালীন উলামায়ে কেরামের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রয়েছে। সেগুলো থেকে সবার উপকৃত হওয়া উচিত।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ