বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


সম্প্রীতির অযুহাতে গরু কোরবানি পরিহারের দাবি, ইসলাম কী বলে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মাহমুদ হাসান।।

কিছু খাবার বা পোশাক রয়েছে যা বিশেষ কোনো ধর্মের প্রতীক নয়, বরং সব ধর্মের লোকেরাই তা নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করে থাকে। যথা: আটা, চাউল, দুধ, দধি ইত্যাদি খাবার, সুতি কাপড় পরিধান ইত্যাদি- এগুলো ব্যবহার করা না করা উভয়ইি সমান। কেননা এগুলোর সাথে কোনো ধর্মের নিদর্শনমূলক বা প্রতীকি সম্পর্ক নেই। কিন্তু কিছু কর্ম এবং খাবার বা পোশাকের সাথে নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতীকি সম্পর্ক রয়েছে। যেমন: পৈতা বাঁধা, মাথায় টিকলী রাখা, গরুকে উপাস্য বিশ্বাস রেখে সম্মান করা এবং সম্মানার্থে জবাই না করা ইত্যাদি হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতীক। তদ্রুপ খতনা করা, গরু কোরবানি করা বা গরুর গোশত খাওয়া এবং গরু জবাইকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অপছন্দ না করা ইত্যাদি ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতীক।

গরুর গোশতের বৈধতায় কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা

বিভিন্ন ইস্যুতে মুশরিকদের পশু জবাই নিষিদ্ধকরণের সমালোচনা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর চতুষ্পদ জন্তু থেকে (কিছুকে সৃষ্টি করেছেন) বহনকারী ও ক্ষুদ্রাকৃতির। তোমরা আহার কর তা থেকে, যা আল্লাহ তোমাদেরকে রিজিক দিয়েছেন এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের জন্য স্পষ্ট শত্রু। (তিনি সৃষ্টি করেছেন) আট প্রকারের জোড়া। মেষ থেকে দু’টি, ছাগল থেকে দু’টি। বল, ‘নর দু’টিকে তিনি হারাম করেছেন নাকি মাদি দু’টিকে? নাকি তা, যা মাদি দু’টির পেটে আছে?

তোমরা জেনে-শুনে আমাকে জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।’ আর উট থেকে দু’টি ও গাভী থেকে দু’টি। বল, ‘নর দু’টিকে তিনি হারাম করেছেন নাকি মাদি দু’টিকে? নাকি তা, যা মাদি দু’টির পেটে আছে? অথবা তোমরা কি হাজির ছিলে, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে এর নির্দেশ দিয়েছিলেন?’ সুতরাং তার চেয়ে অধিক যালিম কে, যে না জেনে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আল্লাহর উপর মিথ্যা অপবাদ দেয়? নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না।” (সুরা আনআম : আয়াত ১৪২-১৪৪)

উক্ত আয়াতে গরু-সহ অন্যান্য হালাল প্রাণী জবাই ও সেগুলোর গোশত খাওয়া বৈধ করা হয়েছে এবং নিষিদ্ধকারীদেরকে তিরষ্কার করা হয়েছে। এমনকি নিষিদ্ধকারীদের পক্ষাবলম্বনকে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ সাব্যস্ত করেছেন।

হাদিসেও রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবা রা.-গণের গরু জবাই ও তার গোশতের বৈধতা সম্বন্ধে আলোচনা রয়েছে।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় স্ত্রীগণের পক্ষ থেকে গাভী দ্বারা কোরবানি করেছেন। (বোখারি হাঃ ২৯৪, মুসলিম হাঃ ১১৯)

বিশুদ্ধ সূত্রে জাবের (রা.)-এর বর্ণনা- আমরা (সাহাবিগণ) হুদাইবিয়ার বছর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে কোরবানি করেছি, একেকটি উট সাত অংশীদারে এবং একেকটি গাভীও সাত অংশীদারে। (মুসলিম হাঃ ১৩১৮, আবু দাউদ হাঃ ২৮০৯)

আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে গরুর গোশত পরিবেশন করে বলা হলো যে, এটি বারীরাকে প্রদত্ত সদকার গোশত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, এগুলো বারীরার জন্য সদকা হলেও আমাদের ক্ষেত্রে হাদিয়াস্বরুপ। (মুসলিম হাঃ ১০৭৫)

উক্ত হাদিস সমূহের দ্বারা গরু জবাই ও তার গোশতের বৈধতা সাব্যস্ত হয়েছে।

গরু জবাই ইসলামের নিদর্শন ও প্রতীক

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর কুরবানীর উট ও গরুকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন বানিয়েছি; তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে কল্যাণ। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থায় সেগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর, যখন সেগুলি কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে খাও। যে অভাবী, মানুষের কাছে হাত পাতে না এবং যে অভাবী চেয়ে বেড়ায়-তাদেরকে খেতে দাও।” (সুরা হজ : আয়াত ৩৬)

উক্ত আয়াতে ‘আলবুদনা’ শব্দের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কোরবানির উট ও গরু। (তাফসীরে তাবারি ১৮/৬৩০, মাদারিকুত্তানযীল ২/৪৪১)

তদ্রুপ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলিমদের জবাইকৃত পশু খাওয়াকে ইসলামের নিদর্শন আখ্যা দিয়েছেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের নামাজ আদায় করবে, আমাদের কেবলা অনুসরণ করবে এবং আমাদের জবাইকৃত পশু খাবে, সে হলো মুসলিম।” (বোখারি হাঃ ৩৯১, মুসলিম হাঃ ১৯৬১)

উক্ত হাদিসে মুসলিমদের জবাইকৃত পশু খাওয়াটা ইসলামের নিদর্শন ও প্রতীক হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে।

গরুকে উপাস্য বানিয়ে সম্মান করা মুশরিকদের ঐতিহ্য

আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরায়েলের গোবাছুর পূজার ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

“আর বনি ইসরাইলকে আমি সমুদ্র পার করিয়ে দিলাম। অতঃপর তারা আসল এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে যারা নিজদের মূর্তিগুলোর পূজায় রত ছিল। তারা বলল, ‘হে মূসা, তাদের যেমন উপাস্য আছে আমাদের জন্য তেমনি উপাস্য নির্ধারণ করে দাও। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই তোমরা এমন এক কওম যারা মূর্খ’।” (সুরা আ’রাফ : আয়াত ১৩৮)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে জুরাইজ রহ. বলেন, ওই জাতির মূর্তিগুলো ছিল গরুর মূর্তি। (তাফসিরে তাবারি ১৩/৮০, তাফসিরে কাবীর ১৪/৩৫০)

গোবাছুর পূজাকারীর উপর আল্লাহ তায়ালা অভিশাপ দিয়ে বলেন,  “নিশ্চয়ই যারা গো-বাছুরকে (উপাস্য হিসাবে) গ্রহণ করেছে, দুনিয়ার জীবনে তাদেরকে আক্রান্ত করবে তাদের রবের পক্ষ থেকে গজব ও লাঞ্ছনা।” (সুরা আ’রাফ : আয়াত ১৫২)

অমুসলিমদের সাথে সৌজন্য ব্যবহার বৈধ হলেও তোষামোদ অবৈধ

অমুসলিমদের সাথে সৌজন্য ব্যবহার এবং সদাচার বৈধ হলেও তোষামোদ অবৈধ। এতটুকু সৌজন্যতার অনুমতি রয়েছে যার দরুণ ইসলামের কোনো প্রতীককে পরিত্যাগ করতে না হয়। অমুসলিমদের সাথে গভীর বন্ধুত্ব বা এমন সম্প্রীতি যার দরুণ শরীয়তের বিধান পালনে কোনো বাঁধা হয়- তা সম্পূর্ণ হারাম।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করো না, অথচ তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে তা তারা অস্বীকার করেছে এবং রাসূলকে ও তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে এজন্য যে, তোমরা তোমাদের রব আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছ।” (সুরা মুমতাহিনা : আয়াত ১)

অমুসলিমদের সৌজন্যে ইসলামের প্রতীক বর্জন নিষিদ্ধ

এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রা. যিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইহুদী আলেম ও ধর্মগুরু ছিলেন- তাঁর প্রসিদ্ধ ঘটনা রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোরআনে কারিমের আয়াতও নাজিল হয়। ঘটনাটি নিম্নরূপ :

ইবনে আব্বাস রা. সূত্রে বর্ণিত, যখন আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রা. ও তাঁর সঙ্গীগণ ইহুদী ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করলেন, তখন পূর্বের ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ হজরত মূসা আ.-এর আনীত তাওরাতের কিছু বিধান যথা: উটের গোশত ও দুধ নিষিদ্ধ হওয়া এবং শনিবারকে এবাদতের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদির প্রতি পূর্বের বিশ্বাস ও অভ্যাস অনুসারে কিছুটা ঝোঁক ছিল। তাঁরা চিন্তা করেছিলেন যে, উটের গোশত খাওয়া ইসলামে অনুমোদিত হলেও খাওয়া আবশ্যকীয় নয়, তাই তাঁরা তা থেকে বিরত থাকার ইচ্ছা করলেন। কিন্তু ইহুদি ধর্মের প্রতি তাঁদের এই অনুরাগ আল্লাহ তায়ালা অপছন্দ করলেন এবং এটিকে পূর্ণাঙ্গ ইসলামে প্রবেশের পথে অন্তরায় ও শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ সাব্যস্ত করে নিম্নোক্ত আয়াতটি নাজিল করলেন। (তাফসিরে রূহুল মাআনি ১/৪৯২)

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে মুমিনগণ, তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না।” (সুরা বাকারা : আয়াত ২০৮)

চিন্তার বিষয় যে, একটি এমন বিধান যা পূর্বে আল্লাহর নির্দেশ ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে আল্লাহ তায়ালা রহিত করে নতুন বিধান দিয়েছেন- এরূপ ক্ষেত্রেও পূর্বের বিধানের প্রতি দূর্বলতা ও ঝোঁককে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ বলে ধমকী দিলেন। তাহলে মূর্তিপূজক মুশরিকদের ধর্মীয় রীতির প্রতি লক্ষ্য করে কোনো বৈধ জিনিস যা ইসলাম ও মুসলিমদের একটি প্রতীকও বটে, তা পরিত্যাগ করার অনুমতি কিভাবে হতে পারে ?

একটি সংশয় ও তার সমাধান

সংশয়: কোনো কোনো ভাই একটি হাদিস উল্লেখ করে গরুর গোশত না খাওয়ার প্রমাণ ইসলামে আছে বলে দাবী করেন। হাদিসটি হলো- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “গরুর দুধের মধ্যে সুস্থতা এবং তার ঘী-তে ঔষধ রয়েছে, আর তার গোশতে রয়েছে অসুখ। (মু’জামে তাবারানি, হাদিস ৭৯)

সমাধান : হাদিসটির সূত্রের বিশুদ্ধতায় অনেক হাদিসবিশারদগণ সন্দেহ পোষণ করেছেন। আর গরুর গোশতের বৈধতার বিষয়ে কোরআনে কারিম ও একাধিক বিশুদ্ধ হাদিসের প্রমাণ রয়েছে, তাই সেগুলোর মোকাবেলায় এটি গ্রহণযোগ্য নয়।

তা ছাড়া হাদিসটির পাঠের দিকে দৃষ্টি দিলেই দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয় যে, হাদিসটি কোনো শরয়ী বিধান নয়, বরং তা চিকিৎসামূলক একটি পরামর্শ, তার সাথে শরয়ী বিধানের সম্পর্ক নেই। অনেক হাদিসব্যাখ্যাকারগণও এ কথাটি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, এটি ব্যক্তি ও পরিবেশবিশেষ চিকিৎসামূলক পরামর্শ। নতুবা খোদ রাসুলুল্লাহ (সা.), তাঁর পরিবারবর্গ এবং সাহাবায়ে কেরামও গরু জবাই করে খেতেন, যার বিবরণ পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।

উপসংহার

কেউ যদি কোনো অসুস্থতা বা কারো মুখরোচক না হওয়ার কারণে জীবনে কোনো দিন গরুর গোশত না খায়, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। এতে ধর্মীয় কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তদ্রুপ গরু দ্বারাই কোরবানি করা আবশ্যকীয় নয়। বরং বকরি, ভেড়া, দুম্বা, মহিষ, উট দ্বারাও কোরবানি শুদ্ধ হয়। এগুলোর মধ্যে যার যেটি দ্বারা সুবিধা তা দিয়ে কোরবানি করলেই শুদ্ধ হয়ে যায়, গরু দ্বারাই কোরবানি আবশ্যকীয় নয়। তবে শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সন্তুষ্টির জন্য বা তাদের সাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে গরু কোরবানি ছেড়ে দেওয়া বা স্বাভাবিক অবস্থায়ও গরু জবাই না করা এবং গরুর গোশত পরিত্যাগ করা হলো শরিয়তের মূল আপত্তির বিষয়। কেননা কোরবানির জন্য হোক বা এমনিতেই খাওয়ার জন্য সর্বাবস্থায়ই গরু জবাই ইসলাম ও মুসলিমদের নিদর্শন ও প্রতীক। আর গরু জবাই না করা ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে তা অপছন্দ করা কুফুর ও কাফেরদের প্রতীক। ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতীককে পরিত্যাগ করে কাফেরদের প্রতীক গ্রহণ করা বা এর দিকে মানুষকে আহবান করা দীনে ইসলামের প্রতি শীথিলতা ও অশ্রদ্ধার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

লেখক: ফতোয়া গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, বসুন্ধরা, ঢাকা।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ