শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


কৃতজ্ঞতা-বোধ ও আল্লার করুণার স্বীকৃতি দান ইমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কাজী ওয়াদুদ নওয়াজ

আল-কোরানের প্রথম সূরা ‘আল-ফাতিহা’র শুরু আল্লার প্রশংসা ও মাহাত্ম্য ঘোষনার মধ্য দিয়ে।সমগ্র সৃষ্টি-জগতের স্রষ্টা ও পালন-কর্তা হিসাবে আল্লার আধিপত্য ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি প্রদান আল-কোরান মানবজাতির জন্য বাধ্যতামূলক করেছে।

প্রকৃতিগত ভাবে অধিকাংশ মানুষই আত্ম-সর্বস্ব, অকৃতজ্ঞ ও স্বার্থপর। উপকারীর উপকার স্বীকার করতে সে কুণ্ঠা বোধ করে। নিজের যোগ্যতার বাইরেও সে সবসময় অন্যদের প্রশংসা ও স্বীকৃতির কাঙাল। কিন্তু অপরের ক্ষেত্রে সে বড়ই কৃপন। যার কাছে সে সবচেয়ে বেশী ঋণী তাকেই সে সবচেয়ে বেশী তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার চেষ্টা করে।বিশ্ব-নিয়ন্তা আল্লার করুণা ও রহমতের সাগরে সবসময় ডুবে থাকলেও তাঁকে স্বীকৃতি দান ও তাঁর ঋণ স্বীকারে তার বড়ই অনীহা!

সূরা আয-যুমারের ৬৭ নং আয়াতে আল-কোরানের সুস্পষ্ট অভিযোগ, মানুষ আল্লার সঠিক মূল্যায়ন করেনা ও তাঁর যথাযোগ্য সম্মান স্বীকৃতিও তাঁকে দেয়না।

আল্লার গুনাবলী ও তাঁর নিদর্শন সমূহের যথাযোগ্য স্বীকৃতি দান বিশ্বাসীদের ইমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।মানুষের সঠিক উপলব্ধির জন্য কোরান তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি আয়াতে আল্লার গুনাবলী ও নিদর্শন সমূহের বিশদ ও যুক্তি-সংগত ব্যাখ্যা দান করেছে।

কোরান তার প্রতিটি আয়াতের মাধ্যমে স্রষ্টা, ও সৃষ্টি-জগতের প্রভু ও পালনকর্তা হিসাবে আল্লার নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের যৌক্তিক-ভিত্তি প্রতিষঠা করার প্রয়াস পেয়েছে এবং সুস্পষ্টভাবে ঘোষনা করেছে এর নি৪শর্ত স্বীকৃতি মানুষের জন্য ইমানের অংগই শুধু নয় তার নৈতিক দায়িত্বও বটে।আমি কোনো কিছুর স্রষ্টা না হয়েও তাঁর সমস্ত নেয়ামত ভোগ করবো অথচ তাঁর স্বীকৃতি দেবোনা এর থেকে অকৃতজ্ঞতা ও অনৈতিক কাজ আর কি হতে পারে?

মানুষ তার জীবনে প্রতিটি পদক্ষেপে,প্রতিটি মুহূর্তে আল্লার অগুনতি নিদর্শনের মুখোমুখি হয় যেগুলি তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতই সত্য ও বাস্তব।এমনকি তার সমগ্র অস্তিত্বই যে, স্রষ্টার সৃষ্টি নৈপুণ্যের সব থেকে বড় নিদর্শন একথা সে ভুলে কি করে!! অবিশ্বাসী ও বস্তু-বাদী চিন্তা-ধারার অনুসারীরা আল্লার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার লক্ষ্যে বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হন। কিন্তু বিজ্ঞান তার অগ্র-যাত্রায় প্রতিটি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে স্রষ্টা হিসাবে তাঁর মহিমাকেই সমুন্নত করে।

এখন প্রশ্ন হলো, “কিভাবে আমরা আল্লার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারি? আল্লার সঠিক মূল্যায়নের সবচেয়ে শক্তিশালী আত্মিক হাতিয়ার হলো আল-কোরান। আর বিজ্ঞান হলো আল্লার মহিমা ও বিশ্ব-নিয়ন্ত্রনে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাস্তব সত্য উদ্ঘাটনের মাধ্যম। কোরান ও বিজ্ঞান সমন্বিত ভাবে বিশ্বাসীর বিশ্বাসের ভিত্তিকে আরো মজবুত করে তোলে।

পৃথিবীতে আল্লার প্রতিনিধি হিসাবে মানুষের দায়িত্ব বিশ্ব-সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আল্লার প্রশংসা ও মহিমা কীর্তন করা।তিনি চিরন্তন সত্য-তিনিই আদি, তিনিই অন্ত।তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন।

আকাশ, ভূমণ্ডল এবং এ উভয়ের মধ্যে দৃশ্য-অদৃশ্য যা কিছু আছে সব কিছুরই স্রষ্টা তিনি।বস্তু ও আধ্যাত্মিক জগতের সর্ব-নিয়ন্তা অধিপতিও তিনি।তিনিই সত্য ও ন্যায়-বিচারের মাধ্যমে বিশ্ব-জগত শাসন করেন। মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে পৃথিবীতে তিনি সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি জীবন –মৃত্যুর স্রষ্টা।ক্ষয় ও ধ্বংসকে তিনি তাঁর সৃষ্টি-কৌশলের অমোঘ নিয়মে পরিনত করেছেন। মানুষকে সহজ সরল পথ দেখানোর জন্য তিনি নবী-রসুল ও কেতাব প্রেরন করেছেন।

বিশ্ব নিয়ন্ত্রনে ন্যায়-বিচার ও ভারসাম্য রক্ষাকল্পে প্রাকৃতিক নিয়মের যৌক্তিক ভিত্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।তিনি মানুষকে কথা বলার ক্ষমতা, মেধা ও চিন্তা-শক্তি দান করেছেন। তিনি মানুষকে বিচার-বুদ্ধি ও ভালো-মন্দ জ্ঞান দিয়েছেন।তিনি উদ্ভিদ ও প্রাণী-জগতে বংশ-বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি রাত-দিন ও আলো-ছায়া সৃষ্টি করেছেন।তিনিই আকাশ থেকে বৃষ্টির ধারা বর্ষন করে মৃত মাটিকে সজীব করে তুলেন।তিনিই সকল শক্তি, জ্ঞান ওআলোর উৎস। আকাশ ও ভূমণ্ডলের সকল শক্তি ওশক্তির উৎস সমূহ তাঁরই আয়ত্বাধীন।[সূরা আল-ফাতহ্ঃ আয়াত-৭]

‘বিচার-দিবসে’র তিনিই মালিক,তিনিই বিচারক।কিন্তু করুণা ও ক্ষমাকে তিনি ন্যায়-বিচারের প্রধান কৌশল ও মানদণ্ড হিসাবে ঘোষণা করেছেন।[সূরা আয-যুমারঃআয়াত৫৩, সূরা আল-ফাতহ্ঃ আয়াত- ১৪, সূরা আল-আন’আম: আয়াত-১২]

এই অপার করুণা-ধারায় স্নাত আল্লার প্রতিনিধি হিসাবে আমরা কেমন করে সেই সর্ব-ব্যাপী, সীমাহীন সত্ত্বাকে অস্বীকার করবো? পরিপূর্ণ আত্ম-নিবেদনের প্রতীক স্বরূপ আমরা কেন তাঁকে সিজদা করবোনা? সমগ্র বিশ্ব- জগত যাকে সিজদা করে আমরা কেন তাঁর কাছে আমাদের মস্তক অবনত করবোনা? বিশ্বাস,নৈতিকতা কোনও দিক থেকেই এর পেছনে কোনও যুক্তি থাকতে পারেকি?[সূরা আর-রাদঃ আয়াত-১৫]

আল-কোরান বারবার আমাদের বিবেকের কাছে আবেদন রেখেছে এই সত্য উপলব্ধি করতে এবং মানুষের প্রতি তাঁর অফুরন্ত দয়া ও করুনার স্বীকৃতি স্বরূপ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও সিজদা করতে।

এই প্রেক্ষিতে আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি বিখ্যাত উক্তি বিশেষ প্রনিধান যোগ্য। “প্রতিটি বস্তুই সেই সব শক্তি দ্বারা নির্ধারিত যার উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রন নাই । ক্ষুদ্র পতঙ্গ থেকে শুরু করে নক্ষত্রলোক,মানু্‌ষ,উদ্ভিদ-জগত,বিশ্ব-জাগতিক ধূলি-কণা সহ আমরা সবাই দূরবর্তী এক অদৃশ্য বংশীবাদকের বাঁশীর রহস্যময় সুরের তালে তালে নেচে চলেছি”। [G.S Viereck কর্তৃক আইনস্টাইনের সাক্ষাতকার,অক্টোবর ২৬,১৯২৯।অনুবাদ লেখক]

যে সমস্ত শক্তি ও তার উৎস সমূহ মানুষের নাগালের বাইরে তা অদৃশ্য বংশীবাদক আল্লারই নিয়ন্ত্রনাধীন যার বাঁশীর রহস্যময় সুরের মূর্ছনা কোরানের প্রতিটি আয়াতে অনুরনিত।

তথ্য-সূত্রঃ
১) “আসলে এ অজ্ঞ লোকগুলো আল্লাহ্ পাকের সেভাবে মূল্যায়নই করেনি যেভাবে তাঁর মূল্যায়ন করা উচিত ছিলো,কেয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আসমানগুলো একে একে ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে;পবিত্র ও মহান তিনি,ওরা তাঁর সাথে যা কিছু শিরক করে তা থেকে তিনি অনেক উর্দ্ধে।”[সূরা আয-যুমার:আয়াত-৬৭]

২)“আসমান ও যমীনের সমুদয় শক্তিই তো আল্লার হাতে এবং তিনিই পরাক্রমশালী ও প্রবল প্রজ্ঞাময়।”[সূরা আল-ফাতহ্:আয়াত-৭]
৩)“হে নবী আপনি তাদের বলুন,হে আমার বান্দারা! তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছো,তোমরা আল্লা পাকের রহমত থেকে কখনও নিরাশ হয়োনা; অবশ্যই আল্লা পাক মানুষের সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দিবেন,তিনি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু” ।[সূরা আয-যুমারঃআয়াত৫৩]

৪)“আকাশমণ্ডলী ওপৃথিবীর যাবতীয় সার্বভৌমত্ব তো এককভাবে তাঁরই জন্য (নির্দিষ্ট,অতএব);তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে মাফ করেন আবার যাকে ইচ্ছা তাকে শাস্তি প্রদান করেন; আল্লাহ পাক একান্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু”।[সূরা আল-ফাতহ্ঃ আয়াত-১৪]

৫)“(হে নবী!) আপনি তাদের জিজ্ঞেস করুন, আসমানসমূহ যমীনে যা আছে তা কার?আপনি বলুন,(এর সব কিছুই) আল্লা পাকের জন্য;(মানুষদের ওপর) দয়া করাটা তিনি তাঁর নিজের ওপর(কর্তব্য বলে) স্থির করে নিয়েছেন।কেয়ামতের দিন তিনি তোমাদের অবশ্যই জড়ো করবেন,এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই,সত্য অস্বীকার করে যারা নিজেরাই নিজের ক্ষতি সাধন করেছে,তারা এমন একটি দিনের আগমনকে কখনও বিশ্বাস করেনা।[সূরা আল-আন’আম: আয়াত-১২]

৬) “আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে তারা সবাই ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, আল্লাহ্ তায়ালাকে সেজদা করে চলেছে,এমনকি সকাল-সন্ধ্যায় তাদের ছায়া গুলোও তাদের প্রভুকে সিজদা করছে”।[সূরা আর-রাদঃ আয়াত-১৫]

-এটি


সম্পর্কিত খবর