শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


কুরবানীর ইতিহাস ও তাৎপর্য

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ইসমাঈল হাবীব ।। কুরবানি।ভেতরে লুকিয়ে আছে পিতা পুত্রের অসীম ত্যাগের ইতিহাস।ঐশীপ্রেমের মালা গাঁথার অতুলনীয় এক বিরল দৃষ্টান্ত রয়েছে এই ইতিহাসে।

শাশ্বত চেতনার এই কুরবানি যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহর চেতনাকে শানিত করেছে।এখনো পৃথিবীর সবখানে এই পুণ্যের বিধান সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

ইতিহাসের পাতায় একটু নজর দেওয়া যাক।জীবন সায়াহ্নবেলায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে তার প্রিয় খলীল ইবরাহিম আলাইহিস সালাম আকুল আবেগে একটি পুত্রসন্তানের মিনতি জানালেন।আল্লাহ তায়ালা তার হৃদয়ের আকুলভরা মিনতি কবুল করলেন।দান করলেন তাকে সুবুদ্ধির একটি পুত্রসন্তান।পবিত্র কোরআনে সে কথাই বর্ণিত হয়েছে কী সুন্দর ধাপে ধাপে। ইবরাহিম বলল; হে' আমার প্রতিপালক! আমাকে একজন সৎকর্মপরায়ণ সুসন্তান দান করুন।অতঃপর আমি তাকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। (সূরা সাফফাত; ১০০- ১০১)

বার্ধক্যের অমন জরাজীর্ণ সময়ে ইবরাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য পুত্র সন্তানের সুসংবাদ সত্যিই আকাশপুষ্ট নেয়ামত ছিল। বিবি হাজেরার মাতৃগর্ভে জন্ম নিলো ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান।

ইবরাহিম আলাইহিস সালাম চোখভরে পুত্রের দিকে তাকিয়ে দেখেন।তবুও মনের ব্যকুল আশ মিটে না।দু'চোখ কেবল নির্বাক হয়ে তাকিয়েই থাকে।হৃদয়ের মানিককে বুকে জড়িয়ে আটকে রাখেন।পরম আদরে ক্ষণে ক্ষণে কপালে চুমু দেন।

পুত্রস্নেহের এমন আনন্দঘন মুর্হূতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো—তিনি যেন স্ত্রী ও সন্তানকে নির্বাসনের জন্য সবুজহীন উপত্যকায় রেখে আসেন।

ইবরাহিম ভাবনায় পড়ে যান এতটুকু শিশুকে কীভাবে বিজন মরুভূমিতে রেখে আসবেন! তবুও আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা যাবে না, মানতেই হবে।মনের প্রবল ইচ্ছেটুকু আল্লাহর জন্য সঁপে দিয়ে বিবি হাজেরা ও আদুরে ইসমাঈলকে উটের পিঠে নিয়ে রওনা হোন।চলতে চলতে 'ফারান' মরুপ্রান্তরে আসেন।

চোখের সামনে আদিগন্ত বৃক্ষহীন ধূ—ধূ প্রান্তর রাশি রাশি বালু চিকচিক করছে। আল্লাহর নির্দেশের সামনে মনের ব্যকুল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিবি হাজেরা ও ইসমাঈলকে সেখানেই রেখে এলেন।

জীবনের চঞ্চল শৈশবে শিশু ইসমাঈল ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগল।তারপর যখন একটু আধটু উপলব্ধির বয়সে উপনীত হলো।তখন একদিন ইবরাহিম আলাইহিস সালাম স্বপ্নে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদৃষ্ট হোন—তিনি যেন সবচে' প্রিয় বস্তুকে কুরবানী করেন।নবীদের স্বপ্ন ছিল।তাই নবীগণ স্বপ্নে যা দেখতেন, সেটা ওহী হিসেবে গণ্য হতো। স্বপ্ন দেখার পর তিনি বুঝে ফেললেন—সবচে' প্রিয়বস্তু কোনটি? কুরআন সে কথা বলেছে—পিতা পুত্রের কথোপকথন। 'তারপর সে যখন তার পিতার সঙ্গে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম বললেন; পুত্র আমার! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে জবাই করছি।একটু ভেবেচিন্তে বলো, তোমার কী অভিমত! পুত্র বললো; আপনাকে স্বপ্নে যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আপনি তাই করুন।আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। (সূরা সাফফাত; ১০২)

আহা, পিতাপুত্রের কী অমায়িক ভালবাসা ছিলো।পিতা আল্লাহর হুকুমের কাছে সর্মপিত।পুত্র সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজ থেকেই অর্পিত—আগুয়ান।পিতার প্রতি আনুগত্যের এমন উপমা পৃথিবীর আর কোন কালে ছিল কী? ধীরে ধীরে চলে এলো কাঙ্ক্ষিত দিন। 'জিলহজ্জের দশতারিখ' আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নে পিতাপুত্র চলে গেলেন মিনাপ্রাঙ্গণে।

এবার স্বপ্নাদিষ্ট হুকুমকে পূর্ণতা দেবার পালা।ইবরাহিম আলাইহিস সালাম সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। এক্ষুণি প্রিয়পুত্রের গলায় ছুরি চালাবেন। প্রিয় পাঠক! আপনাকে এখানে একটু থামাতে চাই।ইবরাহীম আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই অসীম ত্যাগ কার জন্য?

সকল মায়া ভালবাসা ছেড়ে নিজের সবচে' প্রিয়বস্তুকে আল্লাহর সামনে অর্পন করলেন। কিসের জন্য এত এত মায়া—মুহব্বত বিসর্জন দিলেন। আমরা কেন এমন হতে পারি না! চেষ্টা করি না ইবরাহিমের মতো আত্মত্যাগী হতে!

আজ এখানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করি। ইবরাহিমী চেতনায় উদ্দীপ্ত হতে পারি। আকাশ পৃথিবী সেসময় কি একটু থেমে গিয়ে ছিলো? অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো, পিতাপুত্র অবিস্মরণীয় ইতিহাসের দিকে?!

আল্লাহ তায়ালা পিতাপুত্রের এই কুরবানি কবুল করলেও বালক ইসমাঈলের জীবন কবুল করলেন না।বেহেশত থেকে একটি দুম্বা পাঠিয়ে দিয়ে তাকে প্রাণমুক্ত করে করে পিতার কাছে ফিরিয়ে দেন।

কুরআনে বর্ণিত ভাষায়— যখন তারা উভয়ে আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করল এবং ইবরাহিম তার পুত্রকে কাত করে যমীনে শায়িত করল, তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম। হে' ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে! এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি।নিশ্চয় এ ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।

আমি তাকে পুত্র ইসমাঈলকে মুক্ত করলাম।একটি কোরবানির বিনিময়ে। আর আমি এটাকে ঈদুল আযহাতে কোরবানি করার রীতি প্রবর্তন করে পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। (সূরা সাফফাত; ১০৩- ১০৮)

আল্লাহ তায়ালা পিতাপুত্রের এই অসীম ত্যাগ ও আনুগত্যের চেতনাদীপ্ত শিক্ষাকে পৃথিবীর বুকে চিরন্তর করে রাখতে চাইলেন।যুগের ধারাবাহিকতায় পশু কুরবানিকে মুসলিম উম্মাহের জন্য তাদের আত্মসমর্পনের শিক্ষা বানালেন।

কুরবানীর তাৎপর্য ও ফযীলত; এক হাদীসে আছে, সাহাবী হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, একবার সাহাবীগণ আরজ করলেন; ইয়া রাসুলুল্লাহ! কুরবানির রহস্য কী? নবীজি বললেন; এটা তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সুন্নত।
তারা বললেন; এতে আমাদের লাভ কী?

নবীজি বললেন; কুরবানি পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে তোমরা একটি করে নেকি পাবে। তারা পুনরায় বললেন; ছাগল—ভেড়ার পশমের কী বিধান কী? তিনি বললেন; এগুলোর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি পাবে!

কত বড় ফযীলতের কথা হাদিস শরীফে উল্লেখিত হয়েছে।নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হিজরতের পর মদীনায় দশ বছর ছিলেন, সেখানে অবস্থানকালে প্রতিবছরই কুরবানি করতেন।ইন্তেকালের পূর্বে হযরত আলি রাদিআল্লাহু আনহু এর কাছে অসিয়ত করে গিয়েছিলেন, যাতে প্রতিবছর তার পক্ষ থেকে কুরবানি করা হয়।

তাইতো নবীজির তিরোধানের পর প্রতিবার যখন কুরবানির সময় আসতো তখন হযরত আলী রাদিআল্লাহু আনহু দুটি ভেড়া জবাই করতেন।একটি ছিল স্বয়ং নিজের পক্ষ থেকে, অপরটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম—এর পক্ষ থেকে।

প্রিয় মুসলিমবন্ধু! কুরবানির ইতিহাস, রাসুলের হাদিস, ও তার সীরাত থেকে কুরবানির ফযীলতের শিক্ষাটুকু আমাদের জীবনে ধারণ করি। সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা কুরবানি করে গরীর দুঃখিদের সাথে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের কুরবানীসহ সকল নেক আমলগুলো কবুল করুন—আমিন।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ