শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


কেন বারবার হামলার শিকার হচ্ছেন আল্লামা তাকি উসমানী? দায়ী কারা?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।কাউসার লাবীব।।

পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা তাকী উসমানীর উপর হামলার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তিনি নিরাপদ রয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার করাচীর দারুল উলুম কোরঙ্গীতে ফজরের নামাজের পর তার ওপর হামলার চেষ্টা করা হয়।

ফজরের নামাজের পর হামলাকারী মুফতি তকি উসমানীর সঙ্গে কথা বলার জন্য আসেন। কথা বলার সময় হামলাকারী পকেট থেকে ছুরি বের করেন। মুফতি তাকি উসমানীর সাথে থাকা গার্ড তাৎক্ষনিক হামলাকারীকে ধরে ফেলে এবং তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে।

এ ঘটনার পরপরই এক অডিও বার্তায় বলেন, ‘ফজরের পরে একজন এসেছিলেন আমার সাথে একান্তে সাক্ষাত করতে। কথা বলার জন্য আমি তার নিকটবর্তী হলে সে পকেট থেকে চাকু বের করে , এসময় আমার আশপাশের লোকেরা তাকে আটক করেন। আল্লাহর শুকরিয়া আমার কিছু হয়নি, আমি নিরাপদ আছি’।

‘আক্রমণকারীর ব্যাপারে তদন্ত চলছে, সে কে ছিল, কেন এসেছিল, তদন্ত শেষেই স্পষ্ট জানা যাবে তার আক্রমণের উদ্দেশ্য কী ছিল?- বলেন আল্লামা তাকি উসমানী।

এর আগে ২০১৯ সালের ২২ মার্চ শুক্রবার জুমায় যাওয়ার সময় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার মুখে পড়েছিলেন শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী। গাড়িতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী, এক নাতী ও এক নাতনী। তাদের গাড়ি লক্ষ করে বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষিত হলেও আল্লাহ তাআলা তাদের হেফাযত করেছেন। ঐ হামলায় তার সঙ্গীদের মধ্যে দুইজন নিহত ও দুইজন আহত হয়েছেন।

পাকিস্তানে এর আগেও বিখ্যাত আলিমগণকে টার্গেট করা হয়েছে। তাদের অনেকেই শহীদ হয়েছেন। এইসব ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার তেমন কোনো তদন্ত ও বিচার হতে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি আল্লামা মুহাম্মাদ তাকী উসমানীর ওপর ২০১৯ সালের হামলার কোনো বিচার হতে।

আল্লামা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। নিরবে-নিভৃতে দিনরাত গবেষণা করেন মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের জন্য। তবুও কেন তিনি সন্ত্রাসীদের টার্গেট হচ্ছেন? কারা এর পেছনে দায়ী?

এ বিষয়ে তার স্বনামধন্য শাগরেদ, দেশের প্রথিতযশা আলেমেদ্বীন মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ বলেন, শাইখুল ইসলামের ওপর গতকাল যে ঘটনাটি ঘটলো তার এখনো তদন্ত চলছে। লোকটি কেন? কার ইশারায় এ কাজে নিজেকে জড়িয়েছে; আশাকরছি তা বেরিয়ে আসবে। তবে আমার কাছে মনে এসব হামলার পেছনে কয়েকটি বিষয় থাকতে পারে।

‘আল্লামা তাকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহ মুসলিম বিশ্বের ভিন্নএক আবেগের জায়গা। একটি মহল চাচ্ছে তাকে সরিয়ে দিয়ে মুসলিম জাতিকে নেতৃত্ব শুন্য করতে। কেননা তিনি বেশ কয়েকবছর ধরেই মুসলিম উম্মাহর অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় রয়েছেন। তাই এসব পেছনে থাকতে পারে অমুসলিম কিছু দেশের গোপন গোয়েন্দা সংস্থা। আমি সেগুলোর নাম বলতে চাই না। তবে আমরা সবাই জানি এসব গোয়েন্দা সংস্থা এর আগেও পৃথিবীর প্রথিতযশা অনেক আলেমকে হত্যা করেছে’- বলেন মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ।

তার মতে, শাইখুল ইসলামের ওপর হামলার পেছনে শিয়া সন্ত্রাসীদের হাতও থাকতে পারে। শিয়ারা যেভাবে তালিকা তৈরি করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত অনুসারী আলেমদেরকে বহু বছর ধরে হত্যা করে আসছে; শায়খুল ইসলাম আল্লামা তাকি উসমানির উপর হামলার পেছনে তারা দায়ী কিনা? সে বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা এর আগে তারা পাকিস্তানের জামিয়া ফারুকিয়ার ড. আদেশ রাহিমাহুল্লাহসহ অনেককেই শহীদ করেছে। তাদের টার্গেট থাকতে পারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের এমন একজন গবেষককে যদি দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া যায়; তাহলে জাতিগতভাবে লাভবান হবে।

‘এছাড়া পাঠানসহ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ একটি মহল আছে যারা সব সময় দেশে বিভিন্ন নৈরাজ্য তৈরি করে নিজেদের প্রভাবের জানান দিতে চায়। এর জন্য তারা যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত। তাই তারা হয়তো শাইখুল ইসলামের কোন ক্ষতি করে তাদের সে প্রভাবের জানান দিতে চাচ্ছে’- বলেন মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ।

তবে তিনি প্রভূর ওপর ভরসা করে বলেন, তারা শাইখুল ইসলামের যতই ক্ষতি করতে চাক না কেন! মুসলিম উম্মাহর অনন্য এ সম্পদকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজ কুদরতি হাতে হেফাজত করবেন বলে মন থেকে বিশ্বাস করি এবং হৃদয়ের গভীর থেকে দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে সবসময় নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখেন।

বারবার হামলার শিকার হওয়ার পরেও সাইফুল ইসলামের এই হামলার বিষয়গুলো নিয়ে সঠিক তদন্ত ও বিচার না হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তাঁর প্রিয় শাগরেদ প্রথিতযশা ফিকহবীদ মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ। তিনি বলেন, একটি মুসলিম দেশে একজন শায়খুল ইসলাম এভাবে বারবার হামলার শিকার হবে আর তার বিচার হবে না এটি সত্যিই কষ্টের।

তবে ২০১৯ সালের ২২ মার্চ শুক্রবারের হামলার পর দারুল উলূম করাচিতে ফিরে সমবেত ছাত্র-শিক্ষক ও ভক্ত-অনুরক্তদের উদ্দেশে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি, আপনারা আজকের ঘটনায় চিন্তিত ও পেরেশান। আমি আপনাদেরকে সংক্ষেপে ঘটনাটি বর্ণনা করছি। আমি বায়তুল মোকাররমে জুমা পড়াই। সে উদ্দেশ্যেই বের হয়েছিলাম। আমার সাথে আমার স্ত্রী এবং এক পৌত্র ও এক পৌত্রি ছিল। ছয়-সাত বছরের শিশু। একজন নিরাপত্তাকর্মী, যিনি পুলিশের পক্ষ থেকে আসেন, তিনি আমার সামনের সিটে বসা ছিলেন। আমার ড্রাইভার হাবিব ড্রাইভিং সিটে বসা ছিল।

যখন আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছই হঠাৎ বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হল। আমাদের গাড়ি লক্ষ্য করেই গুলি ছোড়া হচ্ছিল। সামনের দিক থেকে, ডান ও বাম দিক থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ চলতে থাকল। আমার ড্রাইভারের শরীরের এখানে এবং এখানে (হাতের ইশারায় দেখান) দুটি গুলি লাগে। নিরাপত্তাকর্মীরও এখানে গুলি লাগে। আল্লাহর দয়া, আমার শরীরে, আমার স্ত্রী ও বাচ্চাদের গায়ে ভেঙ্গে আসা কাঁচের টুকরোর আঘাত ছাড়া তেমন কোনো আঘাত লাগেনি।

হামলাকারীরা আক্রমণ করে সামনের দিকে চলে যায়। তাদের হয়তো খেয়াল হয় যাকে তারা লক্ষ্য বানাতে চেয়েছিল তাকে লক্ষ্যে পরিণত করতে পারেনি, তখন আবার ফিরে আসে এবং আবারো চতুর্দিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। আমার নিরাপত্তাকর্মী আবারও গুলিবিদ্ধ হন এবং শহীদ হয়ে যান। আমার ড্রাইভারের ডান হাত গুলির আঘাতে অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু সে বাম হাত দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়। সে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জীবনবাজি রেখে গাড়ি চালাতে থাকে।

আমি তাকে বলেছিলাম, তোমার হাতে আঘাত লেগেছে। তুমি পেছনে এসো। আমি গাড়ি চালাই। কিন্তু সে রাজি হয়নি। সে বলল, হযরত! আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি এমনটি করবেন না। ওরা আপনার উপর দ্বিতীয়বার হামলা করেছে। সম্ভাবনা আছে ওরা তৃতীয়বারের মতো হামলা চালাবে। আপনি পেছনে বসুন এবং মাথা নিচু করে বসুন যেন আপনার শরীরে গুলি না লাগে।

তার হাত গুলির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ছিল, রক্ত ঝরছিল, এই অবস্থায় সে নিপা চৌরাঙ্গি থেকে লিয়াকত ন্যাশনাল হাসপাতালে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর আমি তাকে গাড়ি থেকে নামাই। ড্রাইভার ও নিরাপত্তা কর্মীকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।

আমরা আশা করেছিলাম, নিরাপত্তা কর্মী বেঁচে যাবেন। কিন্তু ডাক্তাররা জানালেন, হাসপাতালে যাওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। ড্রাইভারের কথা বলল, এর চিকিৎসা সম্ভব। চিকিৎসা করলে সে বেঁচে যাবে এবং সুস্থ হয়ে উঠবে।

আমাদের পেছনের গাড়িতে একজন ড্রাইভার ও নিরাপত্তা কর্মী ছিল। গুলির আঘাতে নিরাপত্তা কর্মী শহীদ হয়ে যান এবং ড্রাইভার মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তিনি হাসপাতালে ভর্তি। তার অপারেশন হবে।

আল্লাহর তায়ালার কুদরত যে, তিনি আমাকে রক্ষা করেছেন। আপনাদের দোয়া ছিল, আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ ছিল। আল্লাহ তায়ালা আমাকে কীভাবে রক্ষা করলেন তার ব্যাখ্যা আমি জাগতিক কোনো উপায়ের দ্বারা করতে পারব না। আল্লাহর দয়ায় আমি পরিপূর্ণ সুস্থ আছি। ভালো আছি। আমি ভয়ও পাইনি এবং চিন্তিতও নই। কিন্তু আমার দুইজন সাথী শহীদ হয়েছেন। তাদের জন্য আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। তাদের পরিবারের প্রতি আমার দোয়া ও সমবেদনা। দুইজন আহত হয়েছেন। তার মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরিপূর্ণ ও দ্রুত আরোগ্য দান করুন। আমীন।”

এই ভয়াবহ হামলার মুখে তাঁকে নিরাপদ রাখার জন্য আমরা আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করছি- আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকল মুরব্বী ও উলামাকে নিরাপদ রাখুন এবং তাদের মাধ্যমে উম্মাহকে বেশি থেকে বেশি উপকৃত করুন।

মৃত্যু তখনই আসবে যখন তা আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে রেখেছেন। তার আগেও না, তার পরেও না। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ কত সত্য- ‘সকল সৃষ্টি যদি তোমার ক্ষতিসাধনে একজোট হয়ে যায় তবুও তারা তোমার ঐটুকু ক্ষতিই করতে পারবে, যা আল্লাহ তোমার বিষয়ে লিখে রেখেছেন।’

আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহর অনন্য এ সম্পদকে নিরাপদে রাখুক।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ