শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


অনলাইন হাটের তত্ত্বাবধানে পশু কেনাকাটা ও জবাই: কোরবানি আদায় হবে কি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নুরুদ্দীন তাসলিম।।

এবারও করোনা মহামারীর মধ্যেই পালিত হবে মুসলমানদের দ্বিতীয় খুশি- ঈদুল আযহা। কোরাবানির ঈদকে ঘিরে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে অনলাইনে ডিজিটাল গরুর হাট উদ্বোধন করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

রোববার (৪ জুলাই) ডিজিটাল গরুর হাটের উদ্বোধন করেছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। এবারের হাটে মোট ১ লাখ গরু বেচাকেনার লক্ষ্যমাত্রা আছে উল্লেখ করে তিনি জানান, ১০ জুলাই এর মধ্যে যারা গরু কিনবেন তাদের মধ্যে ১ হাজার জন ডিজিটাল হাটের তত্ত্বাবধানে পশু জবাই করিয়ে নিতে পারবেন।

অনলাইনে ডিজিটাল গরুর হাট ও ডিজিটাল হাটের তত্ত্বাবধানে পশু জবাই- বিষয়টি নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন দেখা গেছে জনমনে। কেউ প্রশ্ন তুলেছেন; অনলাইনে কোরবানীর পশুর হাট শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা বৈধ, কেউবা প্রশ্ন করছেন, ডিজিটাল হাটের তত্ত্বাবধানে জবাই করা পশুর ক্ষেত্রে শরীয়ত নির্ধারিত রীতিনীতিই বা পালন করা হবে কতটুকু? গোস্তের পরিমাণ ঠিক থাকবে এ বিষয়টির নিশ্চয়তাই বা কতটুকু?

জনমনে দেখা দেওয়া প্রশ্ন নিয়ে আওয়ার ইসলাম মুখোমুখি হয়েছিল দেশের অন্যতম ফিকহ বিশেষজ্ঞ, রাজধানীর শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদের সাথে।

তিনি আওয়ার ইসলামকে বলেছেন, অনলাইনে বেচাকেনা শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ। তবে অনলাইন থেকে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে মূল বিষয় হচ্ছে- দেখে পণ্য ক্রয় করা। অনলাইন থেকে পণ্য দেখে কেনার পর সেই পণ্য যদি দেখা পণ্য সাথে না মিলে তাহলে এ পণ্য ফেরত যোগ্য কিনা এ নিয়ে ইমামদের মাঝে বিভিন্ন মত রয়েছে।

এক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা ও মুহাম্মদ রহ.-এর মতামত হলো, যদি কোন পণ্য কেনার পরে যেভাবে অর্ডার দেওয়া হয়েছিল তেমন না হয় এর মাঝে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, সে ক্ষেত্রে ক্রেতার ইচ্ছাধিকার রয়েছে; তিনি চাইলে পণ্য রাখতে পারেন অথবা ফেরত দিতে পারবেন।

উদাহরণ দিতে গিয়ে মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলছেন, অনলাইনে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে অনেক সময় এমন হয়ে থাকে, যে ধরনের কাপড় আমরা অর্ডার করে থাকি হাতে পাওয়ার পর দেখা যায় তার রঙ সুতা অথবা বিভিন্ন জিনিসের কিছুটা গরমিল থাকে; এক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা ও মুহাম্মদ রহ. এর মতামত উপরে বর্ণনা করা হয়েছে।

তবে এক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবের অন্যতম ইমাম, হযরত ইউসুফ রহ.-এর মতামত কিছুটা ভিন্ন এবং তার মতের ওপরই পরবর্তীতে চার মাযহাবের ইমামরা ঐক্যমত পোষণ করেছেন।

তার মতে, যদি কোনো পণ্য অর্ডার করে হাতে পাওয়ার পর তার গুণাগুণ মোটামুটি সব কিছু ঠিক থাকে; কিন্তু পণ্য ক্রেতার কিছুটা অপছন্দ হয়, তাহলে এক্ষেত্রে অপছন্দ হলেও পণ্যকে নিজের কাছে রাখতে হবে, ফেরত দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। পরবর্তীতে ইমাম আবু ইউসুফ রহ.- এর এ মতকেই সবাই মেনে নিয়েছেন।

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ বলেছেন, ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর এই মতামতই অধিক যুক্তিযুক্ত। অন্যথায় বিশ্বব্যাপী অনলাইনে বেচাকেনার যে বৃহৎ বাজার রয়েছে এতে এক ধরনের নৈরাজ্যের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট।

উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলছেন, ধরুন কেউ জাপান থেকে অনলাইনে কোন একটা জিনিস অর্ডার করলো। হাতে পাওয়ার পর তিনি দেখলেন পণ্যটি সবকিছু ঠিক আছে; কিন্তু তিনি যেমন দেখেছিলেন ঠিক তেমনটা পাচ্ছেন না। তার পছন্দ হচ্ছে না; এখন তিনি এটা ফেরত দিতে চাইলে নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। ক্রেতা-বিক্রেতা উপহারের মাঝে এক ধরনের মনোমালিন্যও সৃষ্টি হতে পারে। বেচাকেনার বৃহত্তম বাজারও মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রকট বলছেন মিজানুর রহমান সাঈদ।

তিনি আরো স্পষ্ট করতে গিয়ে বলেন; ইমাম আবু ইউসুফ রহ.-এর মতামত হল আপনি যে পণ্যটি অর্ডার করেছেন; অর্থাৎ দূর থেকে যে পণ্যটি আপনাকে দেখানো হচ্ছে তার গুণমান ঠিক থাকলে আপনার কিছুটা অপছন্দ হলেও তা ফেরত যোগ্য হবে না। তবে যদি কোনো মানে পরিবর্তন আসে তাহলে সে পণ্য অবশ্যই ফেরত দেওয়ার ইচ্ছাধীকার থাকবে ক্রেতার।

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদের ভাষায়, বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ইমাম আবু ইউসুফ রহ.- এর এই ফতোয়াকে হানাফী মাযহাবের সমস্ত আলেম এবং অন্যান্য বাকি তিন মাযহাবের আলেমরাও মেনে নিয়েছেন। এর মাধ্যমে অনলাইনে বেচাকেনার বিষয়টি স্পষ্ট এবং শরীয়তে এর বৈধতার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, তা বোঝা গেল।

দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে, ডিজিটাল হাটের তত্ত্বাবধানে পশু জবাই-এর ক্ষেত্রে শরয়ী রীতিনীতি কতটা পালন হবে?  বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গোস্তের  পরিমাণ ঠিক থাকবে কিনা?

এ বিষয়ে মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ এর বক্তব্য হল, পশু জবাই হালাল হওয়ার জন্য বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবর' বলা শর্ত। তবে কুরবানীর পশুর ক্ষেত্রে বয়স পূর্ণ হওয়া, নির্দিষ্ট কিছু দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা- এসব সঠিকভাবে পালন হচ্ছে কিনা এ নিয়ে যে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে এক্ষেত্রে তিনি বুখারী শরীফের কিতাবুল বুয়ু’র (ক্রয়-বিক্রয় অধ্যায়) একটি হাদিস; যা বর্ণনা করেছেন আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা; যেখানে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র যুগে কিছু লোক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র কাছে অভিযোগ করেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কিছু লোক মদিনার পার্শ্ববর্তী এক এলাকা থেকে পশু জবাই করে তা মদিনার বাজারে বিক্রি করে। আমরা তাদের সেই গোস্ত ক্রয় করে খাই। তবে আমাদের মনে সন্দেহ তৈরি হয় যে, তারা পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে বিধি-বিধান ঠিকমত পালন করে কি না! তাদের এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা খাও এবং খাওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বল।

মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলছেন, হাদিস বিশারদগণ- এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম এখানে খাওয়ার অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে বুঝিয়েছেন যে, মুসলিম জনপদ থেকে কোন পশু জবাই হলে এক্ষেত্রে সন্দেহ করা ঠিক হবে না। কারণ তারাও মুসলিম জনপদের এবং আল্লাহ তালার প্রতি তাদের ভীতি রয়েছে এমন ধারণা করাটাই উত্তম।

তিনি বলেন, হাদিস বিশারদগণ এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আরো বলেছেন, যদি মুসলিম প্রধান জনপদ না হতো তাহলে অবশ্যই রাসুল সাল্লাহু সাল্লাম তা খাওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই এর কথা বলতেন এবং না খেতেই উৎসাহিত করতেন।

তবে ডিজিটাল হাটে পশু ক্রেতাদের মধ্যে জবাই করা পশু বাসায় পৌঁছে দেয়ার যে সুযোগ রাখা হয়েছে- এতে যাদের মাধ্যমে পশু জবাই করা হবে, তারা কতটুুকু শরীয়তের রীতি মানছেন, এই বিষয়টি ডিএনসিসির পক্ষ থেকে জনগণকে নিশ্চিত করা কর্তব্য বলে মনে করেন মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ