শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


‘দৃষ্টিনন্দন গিলাফে আচ্ছাদিত কায়দা বাগদাদিতে আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জামিয়া দারুল উলুম করাচির মুখপাত্র ‘ماہنامہ البلاغ মাহনামা আল-বালাগ’ এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিশ্বনন্দিত আলেম, স্কলার আল্লামা তাকি উসমানির আত্মজীবনী আওয়ার ইসলামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ।

এ বিষয়ে আল্লামা তাকি উসমানি আনুষ্ঠানকিভাবে আওয়ার ইসলামকে ভাষান্তর করে প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন। গত ২ জানুয়ারি জামিয়া দারুল উলুম করাচির তাখাসসুস ফিল ইফতার শিক্ষার্থী, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের শুভাকাঙ্ক্ষি উমর ফারুক ইবরাহীমীর মাধ্যমে আল্লামা তাকি উসমানি ও পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মজীবনী ‘ইয়াদে’ অনুবাদের অনুমতি চাওয়া হলে তারা খুশি মনে রাজি হন এবং আওয়ার ইসলামকে ধন্যবাদ জানান বাংলাভাষায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য।

আল্লামা তাকি উসমানির নতুন ধারাবাহিক আত্মজীবনী “یادیں ইয়াদেঁ ” মাহনামা আল-বালাগে সফর ১৪৩৯ হিজরি, নভেম্বর ২০১৭ ইংরেজি মাস থেকে। আওয়ার ইসলামে লেখাটি প্রতি রোববার ও বুধবার প্রকাশ হবে ইনশাল্লাহ। আজ ছাপা হলো ২৭ তম কিস্তি। অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ উমর ফারুক ইবরাহীমী।]


পূর্ব প্রকাশের পর: হযরত শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাব্বির আহমাদ উসমানি রহ. এর করাচিতে কোন নিজস্ব আবাসস্থল ছিলোনা। তবে জামশেদ রোডস্থ আমেল কলোনিতে মুসলিমলীগের নেতা এইচ এম কুরাইশি সাহেবের একটি বাংলো ছিলো। কুরাইশি সাহেব আবদার করেছিলেন, হযরত যেনো তার বাড়িতেই থাকেন।

সে সুবাদে হযরত সেখানেই থাকতেন। এবং আব্বাজান রহ. করাচি আসার পর পাকিস্তানের নিত্যনতুন সংকটে পরামর্শের জন্য হযরতের কাছে ছুটে যেতেন। হযরত থেকে দোয়া নেয়ার জন্য মাঝেমধ্যে আমাকেও সঙ্গেকরে নিয়ে যেতেন। আমার মনে পড়ে, একবার আমি একটি দৃষ্টিনন্দন গিলাফে আচ্ছাদিত কায়দা বাগদাদি নিয়ে তার সামনে বসা ছিলাম। খুবসম্ভব তখন আব্বাজান আমাকে হযরত থেকে "বিসমিল্লাহ" করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন।

এদিকে হযরত মাওলানা ইহতিশামুল হক সাহেব রহ. জ্যাকব লাইনে একটি মসজিদ বানিয়ে নিয়েছিলেন। তখন এর ছাদ ছিলো টিনের। মসজিদের সাথেই তার বাসা ছিলো। সেই মসজিদে তিনি একটি ছোট্ট মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাদরাসাটি তখন শুধু হিফজ এবং নাযেরা বিভাগ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো।

আব্বাজান আমার বড়ভাইদেরকে ওখানেই ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। মুহতারাম বড়ভাই জনাব মুহাম্মদ ওলি রাযি সাহেব পড়তেন কারী মুহাম্মদ যাকারিয়া রহ. এর কাছে। আর হযরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ রফি উসমানি সাহেব পড়তেন জনাব হাফেজ নাযির আহমাদ সাহেব রহ. এর কাছে।

বয়স সল্পতার কারণে আব্বাজান আমাকে তখন আর ওখানে ভর্তি করাননি। ফলে আমি ঘরেই হযরত মাওলানা নূর আহমাদ রহ. কাছে কায়দা বাগদাদি পড়া শুরু করে দিয়েছিলাম।

তখনো কায়দা শেষ হয়নি। বরং তার সিংহভাগই বাকি। এমতাবস্থায় একদিন দেওবন্দ থেকে চিঠি মারফত জানতে পারলাম,আমার ভাগ্নি যে বয়সে আমার চেয়ে একবছরের বড় ছিলো- আলিফ, লাম,মিম পারা শুরু করে দিয়েছে। আমি পূর্বে বলেছি, হযরত মাওলানা নূর আহমাদ সাহেব কঠিনতম কাজ নিমিষেই করে ফেলতে পারতেন।

তিনি যখন জানতে পারলেন, আমার সমবয়সী ভাগ্নি দেওবন্দে আলিফ, লাম, মিম পারা শুরু করে দিয়েছে,তিনি বললেন-
তুমি কায়দা অনেক পড়ে ফেলেছো। এবার তোমাকে আমপারা শুরু করিয়ে দিচ্ছি।

এমনটাই হলো। কায়দা শেষ করবার আগেই আমপারা শুরু করে দিলাম। মাওলানা নূর আহমাদ সাহেব এভাবেই আমাকে নাযেরা কুরআন শরিফ পড়াতে থাকলেন। দেখতে দেখতে আমার সাত পারা পূর্ণ হয়ে গেলো।

এরপর তিনি আমাকে বললেন- এখন তো তুমি আরবী অক্ষরের সাথে পরিচিত হয়ে গেছো, তাই অবশিষ্ট অংশ নিজে নিজেই পড়ে শেষ করো। তারপর দ্রুত বেহেশতি জেওরের উর্দু ব্যকরণ পাঠ চুকিয়ে বেহেশতি গওহার শুরু করে দিয়েছিলাম।

মনে পড়ছে, আমি বেহেশতি গওহার শুরু করার পর এর প্রথম বাক্য ছিলো, یہ عالم شروع میں ناپید تھا
এখানে "ناپید" এর মতলব বা উদ্দেশ্য বুঝতে আমাকে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এর উদ্দেশ্য বুঝার জন্য স্বীয় উস্তাযে মুহতারামকে বারবার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়েছে।

যাইহোক! সবেমাত্র অল্পকিছু পাঠ শেষ করেছি,হযরত মাওলানা ইহতিশামুল হক সাহেব নিজ মাদরাসায় দরস শুরু করে দিয়েছিলেন। ধীরেধীরে ওখানেই আমার ধারাবাহিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়ে গেলো। সেখানে হযরত মাওলানা বদরে আলম সাহেবের মতো ব্যক্তিও দরস দিয়েছেন। সম্ভবত আব্বাজান রহ. ও কিছু সময় দরস দিয়েছেন। হযরত মাওলানা নূর আহমাদ সাহেবও ওখানে শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন।

আমি বেহেশতি গাওহার, সিরাতে খাতামুল আম্বিয়ার কিছু অংশ আমার আম্মাজানের কাছে পড়া শুরু করেছিলাম। আর এটাই আমার উর্দু ভাষা শিক্ষার শুরু-শেষ।

এই দু কিতাব ছাড়া আমি উর্দু ভাষা শেখার জন্য ভিন্ন কোন কিতাব পড়িনি। অপরদিকে প্রতিদিন আমি নিজে নিজেই কুরআন শরীফের কিছু অংশ পড়তাম।

কুরআন শরীফকে বালিশের উপর রেখে চৌকিতে বসেবসে পড়তাম। কখনো আম্মাজান বা ঘরের ভাইবোনদের কাউকে শুনিয়ে নিতাম। এভাবে নিজে পড়েই কোন এক সাতসকালে আমার নাযেরা পূর্ণ হয়েছিলো আলহামদুলিল্লাহ।

আমি দেখতাম, বাচ্চারা কুরআন শরীফ নাযেরা বা হিফজ সম্পূর্ণ করার পর ব্যাপকভাবে তাদের জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেটাকে আমীন অনুষ্ঠান বলা হতো।

আবার কখনো মিষ্টি বিলিয়ে আনন্দ উদযাপন করা হতো। কিন্তু আমি যেদিন নিজে নিজে পড়ে নাযেরা খতম করেছিলাম,কারো জানাও ছিলোনা যে আজ আমার কুরআন খতম হচ্ছে। একাকী কামরায় বসে শেষ আয়াত পড়ে আমি কুরআন বন্ধ করে রেখে দিয়েছিলাম। আমার দিলের সেই আক্ষেপ আজও আমাকে পোড়ায়। না কেউ দেখার মতো ছিলো,না শোনার মতো। না কোন অনুষ্ঠান ছিলো,না কোন সম্মিলন।

পরিশেষে আমি আব্বাজানকে বললাম, আজ আমার কুরআন শরীফ খতম হয়েছে। এটা শুনে তার যেনো খুশি ধরেনা! আব্বাজান আমাকে পুরস্কৃত করার জন্য আমার বড় দুইভাই মাওলানা মুহাম্মদ ওলী রাজি এবং হযরত মুহাম্মদ রফি উসমানি (মাদ্দাযিল্লুহুমা) কে মার্কেটে পাঠিয়েছেন।

আমি ঘরের বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে তাদের ফিরে আসার প্রহর গুনছিলাম। দূর থেকে তাদের আবছায়া দেখেই আমার কচিমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। তখন তাদের হাতে নীলরঙের একটি খেলনা গাড়ি ছিলো। সেটা তারা নিজেরাও খেলতে খেলতে নিয়ে আসছিলেন। হাতে পেয়ে আমার আর খুশির সীমা রইলোনা।

গাড়িটি ছিলো খুবই সাধারণ কিন্তু দেখতে চমৎকার ছিলো। আমার ছোট্ট ভূবনে তখন এটিই ছিলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এখন অনুভব করি,মানুষ তার ক্ষনিকের জীবনের পরতে পরতে যে জিনিসের মোহে অন্ধ, বধির হয়ে থাকে, পরবর্তীকালে তার কথা ভেবেও হাসি পায়। এভাবেই এমন এক সময় আসবে, যখন এই অঢেল জায়গা-জমি,টাকা-পয়সাও মিথ্যে,ছলনা মনে হবে।

بدنامئ دو روزے نہ بود پیش.
آں ہم بتوکیل چہ گویم چساں گذشت
یک روز وقف بستن دل شود بہ ایں و آں
روز دگر بہ گندن دل زیں و آں گذشت

(ভাবানুবাদ)
জীবনের ব্যাপ্তি তো একটি দিন,
বসুন শোনাই গল্প তার!
গাঁঠরি বেঁধে দিবস শেষ,
খুলতে বাঁধন রাত কাবার!

আল্লামা তাকি উসমানির ধারাবাহিক আত্মজীবনী ইয়াদেঁ এর সকল পর্ব

ওআই/আবদুল্লাহ তামিম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ