বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


মুসলমানদের উদারতা ও গোমাংসের রাজনীতি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ফারুক ফেরদৌস

ছাত্রজীবনে সিলেটে গিয়ে শাহ পরান রহ.-এর মাজারে এক রাত থেকে ছিলাম। রাত বারোটার দিকে সম্ভবত খাবার দেওয়া হয়েছিলো। দুইটা কুকুর, কয়েকজন ভিক্ষুক আর দিনমজুর মানুষের সাথে এক সারিতে বসে খাবার খেয়েছিলাম। খাবারের আইটেম ছিলো মুরগির গোশত আর ভাত। তখন মাজারের খাদেমদের সাথে কথা বলে জেনেছিলাম মাজারের খাবারে কখনও গরুর গোশত দেওয়া হয় না।

মাজারে যেহেতু হিন্দু ভক্তরাও আসেন, তাদের অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে গরুর গোশত বাদ রাখা হয়। বহুকাল ধরেই নাকি এই রীতি চলে আসছে। হতে পারে পীর সাহেব নিজেই এই নিয়ম করে গেছেন। শাসনক্ষমতা, অর্থ বিত্তসহ সর্বক্ষেত্রে মুসলমানদের যখন একক প্রভাব প্রতিপত্তি ছিলো, হিন্দুরা যখন একেবারেই শক্তিহীন ছিলো এবং কথিত ধর্ম নিরপেক্ষতার যখন কোনো বালাই ছিলো না, তখন মুসলমান সুফি সাধক, দরবেশরা উদারতা ও সম্প্রীতির এ রকম অপূর্ব নজির স্থাপন করেছেন। এই অঞ্চলে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিলো তাদের এই অনুপম উদারতা, আচরণ-মাধুর্য আর ভালোবাসার জোরেই।

মুসলিম সুফি সাধক ও দরবেশদের কাছে হিন্দু জনসাধারণের অবাধ যাতায়াত ছিলো। দীঘি খনন, অতিথিশালা নির্মাণসহ জনকল্যাণমূলক কাজগুলো কিন্তু প্রথমত তারা করেছিলেন দরিদ্র হিন্দুদের জন্যই। ধীরে ধীরে তাদের এই কাজগুলো হিন্দুদের মনে প্রভাব বিস্তার করেছে। এটা এক দুই দিনে হয়নাই, দীর্ঘ দিন লেগেছে।

খান জাহান আলী রহ. -এর একটা ঘটনা পড়েছিলাম, এক রোজার দিনে একজন হিন্দু তার কাছে এলো। দেখলো তার হাতে একটা গোলাপ, তিনি ঘ্রাণ নিচ্ছেন। হিন্দু লোকটি বললো, হুজুর আপনি না রোজা আছেন? তিনি বললেন হ্যাঁ আমি তো রোজা। হিন্দু বললো, আমাদের শাস্ত্রে বলে, ঘ্রাণেই অর্ধভোজন।

আপনি গোলাপের ঘ্রাণ নিচ্ছেন, আপনার তো রোজা ভেঙে গেছে! এই কথা শুনে খান জাহান আলী রহ. শুধু মুচকি হাসলেন, কিছু বললেন না। আরেকদিন ওই হিন্দু তার কাছে এলে তিনি বললেন, খাবার রান্না হচ্ছে ঘ্রাণ পাচ্ছ? হিন্দু লোকটি বললো, হ্যাঁ বেশ সুঘ্রাণ বেরুচ্ছে! কী রান্না হচ্ছে আজকে? খান জাহান আলী রহ. বললেন, গরুর গোশত রান্না হচ্ছে। তোমাদের শাস্ত্র অনুযায়ী তুমি তো অর্ধেক মুসলমান হয়ে গেলে! হিন্দু বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। আর কোনো কথা না বলেই সে চলে গেলো। পরদিন এসে সে ইসলাম গ্রহণ করলো।

যা হোক, যে প্রসঙ্গের অবতারণা করতে গিয়ে এত কথা বললাম সেটা হলো, গত কয়েক বছর ধরে গোমাংস বার বার খবরের শিরোনাম হচ্ছিলো আমাদের পাশ্ববর্তী দেশে, কিছুদিন আগে দেখলাম আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকায়ও গোমাংস সম্পর্কিত একটা খবর। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ক্যান্টিনে নাকি গরুর মাংস রান্না করা হয়েছে এবং এটার প্রতিবাদ জানিয়েছে সুপ্রিমকোর্ট বার শাখা আইনজীবী ঐক্য পরিষদ। গরুর মাংস রান্না বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।

এরপর থেকে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চলছে। অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেহেতু মুসলমান, আইনজীবি সমিতিরও বেশিরভাগ সদস্য মুসলামান, তাই ক্যান্টিনের খাবার মেনুতে তাদের খাবারের কিছুটা প্রাধান্য তো থাকতেই পারে। কারো ধর্মে নিষেধ থাকলে তারা অন্য খাবার খাবে। যুক্তিটা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবে আমি মনে করি স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো প্রতিষ্ঠানে যদি হিন্দু মুসলমান দুই ধর্মের মানুষ থাকে, তাদের যৌথ ক্যান্টিনের খাবার মেনুতে গরুর গোশত না রাখার বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের ঔদার্য হিসেবে এ রকম নিয়ম হতে পারে। মুসলমানদের এ রকম উদারতা দেখানোর নজীর আছে।

সমস্যা হলো, উপমহাদেশজুড়েই ‘গরুর গোশত’ একটা রাজনীতির মধ্যে পড়ে গেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মুসলমানরা নিজের বাসা বাড়িতেও গরুর গোশত রান্না করে খেতে পারছে না। গরুর গোশত বহনের অপরাধে মুসলমানদের নিষ্ঠুর নির্যাতন এমন কি পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। এই প্রেক্ষাপটে এই দেশের হিন্দুদের পক্ষ থেকে যখন এই সংক্রান্ত দাবি দাওয়া উত্থাপিত হয়, তখন অনিবার্যভাবেই ওই অমানবিক দুঃখজনক ঘটনাগুলো নতুন করে আমাদের মনে পড়ে। আমাদের প্রতিক্রিয়ায় এর একটা প্রভাব থাকেই। এটা এড়ানোর সুযোগ নাই। এই দেশের মুসলমানদের কাছে সম্প্রীতিপূর্ণ আচরণ আশা করলে পার্শ্ববর্তী দেশেও শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে, জুলুম নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।

মৌলবাদী শাসনের এত অপবাদ মুসলমানদের দেওয়া হয়, অথচ মুসলমানরা কখনও অন্য ধর্মের মানুষের ব্যক্তিগত খাবার, ধর্মাচার ইত্যাদিতে হস্তক্ষেপ করেনাই। ইসলামে মদ, শুকরের মাংস ইত্যাদি নিষিদ্ধ। কিন্তু খেলাফত আমলেও কখনও অমুসলিমদের মদ বা শুকরের মাংস খাওয়া, কেনাবেচা, লেনদেনে বাঁধা সৃষ্টি করা হয়নাই।

লেখক: তরুণ লেখক, প্রবন্ধিক।

-এটি


সম্পর্কিত খবর