শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


মাসজিদুল আকসার অজানা ইতিহাস

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।কাউসার লাবীব।।

আল-আকসা মসজিদ, আল-মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস। ঐতিহাসিক জেরুসালেমে অবস্থিত ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থাপনা। এর সাথে একই প্রাঙ্গণে অবস্থিত কুব্বাতুস সাখরা, কুব্বাতুস সিলসিলা ও কুব্বাতুন নবীসহ বেশকিছু স্থাপনা। স্থাপনাগুলোসহ এই পুরো স্থানটিকে বলা হয় হারাম আশ শরিফ। এছাড়াও স্থানটি "টেম্পল মাউন্ট" বলে পরিচত। এ স্থানটির পবিত্রতার কথা বর্ণিত হয়েছে প্রায় সব আসমানী ধর্মে। সহিহ বর্ণনা অনুযায়ী মানবতার নবী হযরত মুহাম্মদ সা. মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেছিলেন।

আল মাসজিদুল আকসা নিয়ে বিস্তারিত জানার পূর্বে আমরা জেনে নিবো এর পাশে অবস্থিত অন্যান্য স্থাপনা যেমন, কুব্বাতুস সাখরা, কুব্বাতুস সিলসিলা ও কুব্বাতুন নবী সম্পর্কে কিছু কথা। বিশেষ করে কুব্বাতুস সাখরা নিয়ে আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো। কেননা এটিকে অনেকেই মাসজিদুল আকসা মনে করে থাকেন।

কুব্বাতুস সিলসিলা। এটি কুব্বাতুস সাখরার পূর্ব পাশে অবস্থিত একটি গম্বুজ। হারাম আশ শরিফের অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা। এটি কোনো মসজিদ নয়। তবে এটিকে মুসল্লা বা সালাতের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উমাইয়া শাসন আমলে এটি নির্মাণ করা হয়। ক্রুসেডারদের সময় এটি একটি খ্রিষ্টান চ্যাপল হিসেবে ব্যবহার করা হত। সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী রাহিমাহুল্লাহ পুনরায় এটিকে সালাতের স্থানে রূপান্তর করেন। পরবর্তীতে মামলুক, উসমানীয় ও ফিলিস্তিন ভিত্তিক ওয়াকফ এই স্থাপনার সংস্কার করে।

কুব্বাতুন নবী। হারাম আশ শরিফে অবস্থিত একটি গম্বুজ। এটি উসমানীয় আমলে নির্মিত হয়। ১৫৩৮ সালে জেরুসালেমের উসমানীয় গভর্নর মুহাম্মদ বে এই গম্বুজ নির্মাণ করেন। ১৬২০ সালে তৎকালীন গভর্নর ফারুক বে তা পূনরায় সংস্কার করেন। এটি মানবতার নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্মরণে নির্মিত হয়েছে। ১৮৪৫ সালে এতে কিছু অংশ যোগ করা হয়। আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি রাহিমাহুল্লাহসহ বেশকিছু গবেষকদের মতে এই স্থানে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সা. অন্যান্য নবী ও ফেরেশতাদের নিয়ে মিরাজের রাতে সালাত আদায় করেছিলেন।

কুব্বাতুন নবী স্থাপনাটি অষ্টভুজাকার এবং এর আটটি স্তম্ভ ধূসর মার্বেলে নির্মিত। গম্বুজটি অর্ধবৃত্তাকার এবং তা সূচালো আর্চ দ্বারা ধরে রাখা হয়েছে। এর অলংকরণে লাল, কালো ও সাদা পাথর ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাচীন মিহরাবটি মেঝেতে সাদা মার্বেল গেঁথে নির্মিত। এর পাশ লাল পাথর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।

কুব্বাতুস সাখরা। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘ডোম অব দ্য রক’। অনেকেই ভুলবশত এটিকে আল মাসজিদুল আকসা বলে মনে করে থাকেন। এটি আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে অবস্থিত একটি গম্বুজ। গম্বুজটির ব্যাস ২০.২০ মিটার ও উচ্চতা ২০.৪৮ মিটার। এ গম্বুজটির নিচে রয়েছে ‘সাখরা’ নামক একটি পাথর। এ পাথরের কারণে স্থানটি ধর্মীয় দিক দিয়ে গুরুত্ববহ। কুব্বাতুস সাখরা উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের আদেশে ৬৮৯ থেকে ৬৯১ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়। এ গম্বুজের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কাঠামো চার্চ অব দ্য হলি সেপালকারের মত। ধারণা করা হয়, স্থাপনাটি তৈরী করার সময় চার্চ অব দ্য হলি সেপালকারের মাপঝোক ব্যবহার করা হয়েছিল।

জানা যায়, ১০৯৯ সালে ক্রুসেডাররা জেরুসালেম দখন করে নেয়ার পর কুব্বাতুস সাখরা অগাস্টিনিয়ানদের দিয়ে দেয়া হয়। তারা এটিকে গির্জায় রূপান্তর করে এবং আল-আকসা মসজিদকে রাজকীয় প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। নাইটস টেম্পলাররা কুব্বাতুস সাখরার স্থানটিকে সুলায়মান (আ) কর্তৃক নির্মিত স্থাপনা বলে বিশ্বাস করত। তবে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, মাসজিদুল আকসার সম্পূর্ণ ইবাদাতের স্থানটিই নবী সুলাইমান (আলাইহিস সালাম) তৈরি করেছিলেন যা পরবর্তীতে সময়ের ব্যবধানে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

মাসজিদুল আকসা। আল্লামা ইবনে তাহমিয়ার রাহিমাহুল্লার মতে, সুলায়মান আ. এর তৈরি স্থাপনার সম্পূর্ণ স্থানটির নামই হল আল মসজিদুল আকসা। বায়তুল আকসা নির্মাণের পর থেকে ঈসা আ. সহ অনেক নবীর দ্বারা এক আল্লাহর ইবাদাতের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এই স্থান মুসলমানদের প্রথম কিবলা। হিজরতের পর কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণে বায়তুল্লাহ নতুন কিবলা হয়। বর্তমানে ‘আল-আকসা’ মসজিদ বলতে বোঝায় কিবলি মসজিদ, মারওয়ানি মসজিদ ও বুরাক মসজিদ এ ৩টির সমন্বয়; যা ‘হারাম আশ শরীফ’ এর চার দেয়াল এর মধ্যেই অবস্থিত।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি. বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে তার পুত্র খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়। ৭৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে তার উত্তরসুরি আল মাহদি এর পুনর্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলি জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে।

বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদটিতে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙ্গিনা, মিম্বর, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো। বর্তমানে জেরুসালেম দখলদার ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মসজিদটি রয়েছে জর্ডা‌নি/ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন ইসলামি ওয়াকফের তত্ত্বাবধানে।

ঐতিহাসিক এ স্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আমাদের নানা স্মৃতি। এখানেই শুয়ে আছেন হযরত ইব্রাহিম এবং মুসা আ. সহ অসংখ্য নবী রাসুল। এখানেই মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. সকল নবী রাসুল এবং ফেরেস্তাদের নিয়ে নামাজ পড়ছিলেন। সেই জামাতের ইমাম ছিলেন মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই। এখান থেকেই হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোরাকে করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিলেন। এই মসজিদ নির্মাণের সাথে জড়িয়ে আছে হজরত আদম আলাইহিস সালাম, হযরত সুলাইমান আলাইহিসসালাম এর নাম। জড়িয়ে আছে প্রায় অর্ধ জাহানের শাসক হজরত উমর (রা), দ্যা গ্রেট সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীসহ অসংখ্য বীরদের নাম। এই মসজিদে ২ রাকাআত নামাজ আদায় করলে একজনের আমল নামায় ৫ শত রাকাআত নামাজের সমপরিমাণ সওয়াব লিখা হয়। পবিত্র কোরআনের প্রায় ৭০ জায়গায় উচ্চারিত হয়েছে এ মসজিদের কথা।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ