শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


আজ শায়খুল হাদিস আল্লামা পালনপুরী রহ. এর চলে যাওয়ার ১ বছর

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মোস্তফা ওয়াদুদ: দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদিস ও বিশ্বখ্যাত আলেমেদীন আল্লামা সাইদ আহমদ পালনপুরী মৃত্যুবরণ করেছিলেন আজ। গতবছরের ২৫ রমজান মঙ্গলবার, ১৪৪১ হিজরি মোতাবিক ১৯ মে ২০২০ সালে তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। তিনি ছিলেন যুগের মহীরুহ। লক্ষ উস্তাদের উস্তাদ। কালজয়ী ক্ষণজন্মা মনীষী। নির্মোহ এক বিদ্যাসাগর ও জ্ঞানতাপস।

প্রাচীন ঐতিহ্যের ইলমি শহর হিন্দুস্তানের গুজরাট প্রদেশের পালনপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৌলভি মো. ইউসুফ রহ.। জন্ম তারিখ নির্দষ্টভাবে অসংরক্ষিত হলেও পারিবারিক সূত্রে যতটুকু জানা যায়, তার জন্ম তারিখ হিজরি সনের ১৩৬০ হি. ধরা হয়। আর এমনি মনে করতেন হজরতের ওয়ালিদে মুহতারাম। পিতা মৌলভি ইউসুফ রহ. এর কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা দীক্ষা অর্জন করেন। শুরুতেই তাঁকে গ্রামের মক্তবে ধর্মীয় তালিম তরবিয়তের জন্য বসিয়ে দিয়ে পাঠগ্রহণের সূচনা করা হয়। তাঁর পিতা ছিলেন ইবনে হাজরে হিন্দ আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. এর একনিষ্ট শাগরিদ বদরে আলম মিরাঠি র.-এর কাছের শিষ্য৷ তিনি তখন গুজরাটের ডাবিল মাদ্রাসার ছাত্র। ঐ সময় উক্ত মাদ্রাসায় আল্লামা শিব্বীর আহমদ ওসমানী এবং ইউসুফ বানূরি রহ. এর মতো মহান মনীষীগণ দারস তাদরিসের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন।

জন্মের সময় পিতা ইউসুফ রহ. ও মোহতারামা আম্মাজান তাঁর নাম রাখেন ‘আহমাদ’৷ এর পেছনেও রয়েছে একটা উদ্দেশ্য ও রহস্য। সেটা হলো-তাঁর ছিল একজন মা-শরিক ভাই, যে শৈশবকালে মারা যায়। নাম ছিল আহমাদ। তার স্মরণকে তাজা রাখার জন্য তাঁরও নাম রাখা হয় ‘আহমদ’৷

পরবর্তীতে কোন এক সময় নিজেই নিজের নামের সাথে সাঈদ যোগ করে সাঈদ আহমাদ হয়ে যান। আজো এ নামে প্রসিদ্ধ। কর্ম জীবনের শুরুতে নিজের নামের সাথে বাপের দিকে নেসবত করে ইউসুফি যোগ করেন। কোন কারণে নামের সাথে নিজের জন্মস্থান ‘পালনপুর’ এর দিকে সম্পৃক্ত করে পালনপুরি হয়ে যান। আজ অবধি সাঈদ আহমদ পালনপুরি নামে দেশে বিদেশে পরিচিত। ‍এ নামেই বিখ্যাত এ মনীষী।

মাজাহিরুল উলুম, সাহারানপুরে ভর্তি-
লেখাপড়ার হাতেখড়ি নিজ এলাকা পালনপুর থেকে সূচনা হয়। পরবর্তীতে তিনি ১৩৭৭ হিজরিতে সাহারানপুরের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠে ভর্তি হন। যার সুনাম সুখ্যাতি দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অবশ্যই মাযাহিরুল উলুম মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার বছরই হয়। তবে দারুল উলূম প্রতিষ্ঠা হয় মহররমের পনের তারিখে আর ঐ বৎসরই রজব মাসে মাজাহিরুল উলুম প্রতিষ্ঠিত হয়। পালনপুরেই তিনি শরহে জামী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন৷ তারপরে তিনি মাজাহিরুল উলূম সাহারানপুরে ভর্তি হন। সেখানে তিনি তিন বৎসর গভীর অধ্যয়ন করে সফলতার স্বাক্ষর করেন। সেখানে তিনি মুফতি ইয়াহইয়া সাহারানপুরী ও মাওলানা ইয়ামীন সাহেব এবং ইমামুন নাহব ওয়াল মান্তেক সিদ্দীক আহমদ রহ. প্রমূখ মহামনীষীর কাছে বিভিন্ন ফন পড়েন।

দারুল উলূম দেওবন্দে দাখেলা-
তারপরেই মাওসুফের ভাগ্যাকাশে জীবনান্দের তারকা উদিত হয়। ১৩৮০ হি.তে দারুল উলূম দেওবন্দে সালে শশম (জালালাইন) জামাতে ভর্তি হন। সেখানেও তিনি অত্যন্ত সুনাম সুখ্যাতির সাথে গভীর অধ্যয়নে নিজেকে ধন্য করেন। সময়ের যথাযথ মূল্যায়ণ করে জ্ঞানে গুণে সবার নজর কেড়ে নেন। জীবনের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। ইশকে নবীকে লালন করতেন হৃদয় গহীনে। দারুল উলূমে তিনি হজরত নাছির আহমদ খাঁন রহ. এর কাছে তাফসিরে জালালাইনসহ আল-ফাউযুল কাবীর ইত্যাদি কিতাবাদি দারস গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৩৮২ হি.তে তাকমিলে হাদিস (দাওরা জামাতে) সিহাহ সিত্যাহসহ হাদিসের কিতাবাদি পড়েন।

দারুল ইফতায় ভর্তি-
বাবার ইচ্ছে ছিল সাঈদ আহমাদ শুধু আলেম হয়ে দ্বীনের খেদমত করবে। সেখান থেকে কোন বেতন ইত্যাদি গ্রহণ করবে না। তাই জীবিকা উপার্জনের জন্য ভিন্ন পেশা বেছে নিবে। আর তা হল ‘হাকিম’ হয়ে দারস তাদরিসের পাশাপাশি জীবিকা উপার্জন করবে। তাই বাপের ইচ্ছা ছিল সে জামিয়া তিব্বিয়া, দেওবন্দে ভর্তি হোক৷ কিন্তু হজরত তো ছিলেন ইলমের পাগল। স্বাদ পেয়েছেন কিতাব অধ্যয়নে। তাই তিনি বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন দেওবন্দে৷ এসে ১৩৮৩ তে দারুল উলুমে শু’বায়ে ইফতায় ভর্তি হন। তৎকালীন সময়ে দারুল উলুমের প্রধান মুফতি ছিল সাইয়্যিদ মাহদি হাসান রহ.৷ হজরতের মোতালায়া বা অধ্যয়নের অগাধ আগ্রহ দেখে পরবর্তী বছর তাঁকে দারুল উলুমের মুঈনে মুফতি হিসাবে দারুল উলুমে রেখে দেয়৷ এর আগে দারুল উলুমের ‘মুঈনে মুফতি’র পদে নিয়োগ পদ্ধতি ছিল না।

হাফেজ হওয়ার আগ্রহ-
শৈশবকালে তিনি হিফজ পড়েননি, সুযোগ হয়নি। কিন্ত অন্তরের গহীনে লালন করেছে এক স্বপ্ন। শুধু স্বপ্নই দেখেননি বরং তা পরিপূর্ণ করে বাস্তব রূপও দিয়েছেন। তাই তিনি ইফতার বছরই দারুল উলুম দেওবন্দের এক উস্তাদ যাকে মিশরের জামিয়া আযহার থেকে আরবি পড়ানোর জন্য পাঠানো হয়েছে। তিনি ছিলেন হাফেজ কারী এবং হানাফি মাযহাবের কঠিন মুকাল্লিদ। যার কথা পালনপুরী রহ. প্রায় সময়ই দরসে বলতেন৷ হযরত বলেন যতগুলো নেক আদমি দেখেছি তিনিও তাঁদের মধ্যে একজন৷ আর তিনি হলেন- আল্লামা মাহমুদ আ. ওয়াহহাব রহ.৷ এই হযরতের কাছেই ইফতার বছর হেফজ পড়া শুরু করেন৷ ইফতার মোতালায়ার সাথে সাথে দেড় বছরের মাথায় তিনি পূর্ণ কোরআন হিফজ শেষ করেন৷

দারুল উলুম আশরাফিয়া, রান্দীর খেদমত-
ইফতা শেষ। হজরত রান্দির শহরে দারুল উলুম আশরাফিয়াতে দারসি খেদমত আঞ্জাম দেন৷ সেখানে যাওয়ার সময় হযরতের মাখদুম ইমামুল মা’কুল ওয়াল মানকুল আল্লামা ইবরাহীম বালয়াবি রহ. তাঁকে একটি ভবিষ্যৎ বাণী দেয়। যা নয় বছর পর পরিপূর্ন ভাবে বাস্তবায়ন হয়। আর তা হল- ﻣﻮﻟﻮﻱ ﺻﺎﺣﺐ ! ﮔﺒﮭﺮﺍﺅ ﻧﮩﯿﯽ، ﺍﺱ ﺳﮯ ﺍﭼﮩﮯ ﺁﻭﮮ ﮔﯽ
মৌলুবি! চিন্তা করো না আল্লাহ এর চেয়ে উত্তম বদলা দিবে৷ পরে তিনি আশরাফিয়া সিনিয়র উস্তাদ হিসাবে দ্বীনি খেদমত আঞ্জাম দেয়৷ সেখানে তিনি সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসায়ি, তিরমিজি, মোয়াত্তাইন ইবনে মাজা ও মিশকাত ইত্যাদি হাদিসের কিতাবাদিসহ অনেক কিতাবের দরস প্রদান করেন৷ সেখানে টানা নয় বছর খেদমত করেন৷ ঐ সময় থেকে তিনি লেখালেখি করেন৷ দারুল উলুম আশরাফিয়াতে থাকাকালিন সময়ে তিনি শায়েখ মুহাম্মাদ বিন তাহের পাটনী রহ. এর কিতাব আল মুগনীর আরবী শরাহ ‘তাহযীবুল মুগনি’ লিখেন।

দারুল উলুম দেওবন্দে তালীমি ও তাদরিসী খেদমতে নিয়োগ-
১৩৯৩ হিজরিতে তার উস্তায মাও. মুহাম্মাদ হাশেম রহ. তাকে চিঠির মাধ্যমে জানান যে, দারুল উলুম দেওবন্দে উস্তাদের একটি পদ খালি। একজন ওস্তাদ লাগবে তুমি ইচ্ছা করলে দরখাস্ত দিতে পার৷ অবশ্য তিনি দারুল উলুম আশরাফিয়ার উস্তাদ ছিলেন। হযরত এই খবর শুনে হযরতে অন্য ওস্তাদ মাও. সা’দ রশিদ আজমিরী রহ. এর পরামর্শে রজব মাসেই দারুল উলুমে দরখাস্ত করেন। তখন শা’বান মাসে দারুল উলুমের শুরা সদস্যের মোশওয়ারায় আল্লামা মঞ্জুর আহমদ নোমানি রহ. হজরতের নাম প্রস্তাব করেন। ঐ মজলিসেই সিদ্ধান্ত হয় তিনি দারুল উলুমের ওস্তাদ। পরবর্তিতে তাঁকে জানানোর পর তিনি রমজান মাসেই চলে আসেন৷ তারপর থেকেই তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের উস্তায৷

একদিনের ঘটনা-
ছোট থেকে তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত৷ একদিন তিনি বুখারির দরসে হযরত খিজির আ. এর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন- খিজির আ. এর ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়৷ বাকি আমার খেয়াল হল তিনি হলেন রিজালুল গায়েব বা মালাইকাতুল আরদ্ এর অন্তর্ভূক্ত৷ অর্থাৎ তিনি জমিনের ফেরেস্তা৷ তাঁর উদাহরণে হযরতের একটা কারামাত বর্ণনা করেন৷
ছাত্র জমানার কথা৷ একদিন হযরত মাদ্রাসা থেকে বাড়ীর উদ্দেশে ট্রেনযোগে রওয়ানা করেন ৷ কিন্ত তিনি তাঁর স্টেশনে না নেমে ভুলে অন্য জায়গায় নেমে যান৷ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হযরতের পকেটও সেদিন খালি ছিল। তাই স্টেশন মাষ্টার তাকে বললেন, আপনি টেনশন করবেন না আরেকটা ট্রেন আপনার গন্তব্যে যাওয়ার আছে ৷ আসলে আপনাকে উঠিয়ে দিবো। তাই তিনি রেলস্টেশনে ঘুমিয়ে যান ৷ ঘুম থেকে উঠার পর জনৈক এক ব্যক্তি এসে বলল- বাবা কোথায় যাবে? হুজুর যা বলার বললেন৷ পরে ঐ ব্যক্তি হুজুরকে প্রয়োজন পরিমাণ কিছু রুপি দিলেন। সম্ভবত পাঁচ রুপি৷ এবং বললেন আমি অমুক এলাকার লোক এই রুপিগুলো নাও৷  প্রয়োজন পূরণ করো৷ পরে হুজুর বাড়িতে গিয়ে তাঁর ঋণ আদায়ের জন্য বাবাকে নিয়ে ঐ এলাকায় যান৷ কিন্তু খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায় ঐ এলাকায় কোন মুসলিম পরিবারই নাই৷ পরে হুজুর বলেন- আমার মনে হয় তিনি রিজালুল গায়েবের অন্তর্ভূক্ত৷ এমন আরো বহু কারামাত হজরতের জীবনে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে৷

তাদরিসী খিদমাত-
হযরতের জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতার অন্যতম একটি অমর কীর্তি হল তিনি অর্ধ শতাধিক বছরের দারস তাদরিসের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে নিজেকে ধন্য করেন৷ তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের বয়স যখন পূর্ণ এক বৎসর তথা ১৩৮২ হি. তে দাওরা হাদিস পড়েন৷ ১৩৯৩ তে দারুল উলুম দেওবন্দে তাদরিসের খেদমত আরম্ভ করেন৷ তিনি দারসে নিজামীর প্রায় কিতাবের পাঠদান করেছেন৷ বিশেষত সিহাহ সিত্তাহর সব কিতাবই পড়িয়েছেন৷ তিনি বিশ বছরের মত হুজ্জাতুল্লিহিল বালিগাহর দারস প্রদান করেন৷ শুধু তাই নয় তিনি অনেক কিছুতেই মুমতাজ এক শখছিয়্যাত ছিলেন। তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে প্রায় ত্রিশ বছর উম্মুস সুনান জামে তিরমিজির দারস প্রদান করেন৷ যা আজো সারা দুনিয়ায় আলোচিত৷ ১৪০২ হিজরিতে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে বুখারি সানী দারস প্রদান করেন৷ তৎকালীন সময়ে দারুল উলুমের নাযেমে তালীমাত ছিলেন হযরত মাও. রিয়াসাত আলী বিজনূরী রহ. ৷
১৪০৫ হিজরিতে যখন শাইখুল হাদীস আল্লামা নাছির আহমদ খান রহ. অসুস্থ হয়ে চোখ অপারেশনের জন্য ছুটিতে যান তখন তিনি ঐ বৎসর বুখারী প্রথম খন্ডের দারস দেন৷ তারপর হযরত সুস্থ হলে তিনিই পড়ান ৷ খান সাহেব রহ. এর ইন্তেকালের পর ১৪২৯ হি. তে হযরত পালনপুরী শাইখুল হাদীস হন৷ ঐ বৎসর শূরা সদস্যের সিদ্ধান্তে তিনি দারুল উলুমের সদরুল মুদাররিস পদেও নিযুক্ত হন৷ তখনকার শিক্ষা সচিব ছিলেন হযরতুল উস্তায সায়্যিদ আরশাদ মাদানী।

তা’লিফ, তাছনিফ ও রচনা-
তিনি যেমন একজন যোগ্য খোদাভীরু মুদাররিস ও মুকাররির তেমনি তিনি ছিলেন একজন লেখক গবেষকও৷ এ যাবৎ তিনি প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি ছোট বড় কিতাব রচনা করেছেন৷ যার মধ্যে অন্যতম হল পবিত্র কালামে হাকিমের তাফসীর গ্রন্থ হেদায়াতুল কোরআন৷

১৷ ﻫﺪﺍﻳﺔ ﺍﻟﻘﺮﺍﻥ
যার মাকবুলিয়াতের সাক্ষর খোদ স্বপ্ন যুগে পেয়েছেন৷ যা সত্যি এক মাকবুল তাফসীর। যা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য৷ সর্বজনগৃহিত এক সু-সমৃদ্ধ তাফসির গ্রন্থ৷
২৷ ﺭﺣﻤﺔ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﻮﺍﺳﻌﺔ ﺷﺮﺡ ﺣﺠﺔ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﺒﺎﻟﻐﺔ
তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ যার কথা না বললেই নয়৷ হুজ্জাতুল্লিহিল বালিগাহর অমর গ্রন্থ শরাহ৷ মোটা মোটা পাঁচ খণ্ডের এক মাকবুল ব্যাখ্যা গ্রন্থ৷ যার নাম রহমাতিল্লাহিল ওয়াছিয়াহ ৷
৩৷ ﺗﺤﻔﺔ ﺍﻟﻘﺎﺭﻱ ﺷﺮﺡ ﺻﺤﻴﺢ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻱ
তিনি সিহাহ সিত্যাহর ও বহু কিতাবের শরাহ করেছেন৷ যেমন সহিহ বুখারির শরাহ ‘তুহফাতুল কারি’ যা মোটা মোটা বার খণ্ডের এক বিশাল কিতাব৷ যা মাত্র তিন বছরে পূর্ণতায় পৌঁছান৷
৪৷ ﻓﻴﺾ ﺍﻟﻤﻨﻌﻢ ﺷﺮﺡ ﻣﻘﺪﻣﺔ ﺍﻟﻤﺴﻠﻢ
হযরতের মুসলিম শরিফের মুকাদ্দিমার শরাহ ‘ফয়যুল মুনঈম’ থেকে কে আছে উপকৃত হয় না?
৫৷ ﺇﻳﻀﺎﺡ ﺍﻟﻤﺴﻠﻢ
তিনি শুধু মুকাদ্দিমার ব্যাখ্যা লিখেই ক্ষান্ত হন নাই। তিনি মুসলিম শরিফেরও ছয় শত পৃষ্ঠা ব্যাপি এক শরাহ লিখেন যার নাম ‘ইযাহুল মুসলিম’ যেখানে কিতাবুল ঈমানের আলোচনা।
৬৷ ﺗﺤﻔﺔ ﺍﻷﻟﻤﻌﻲ ﺷﺮﺡ ﺳﻨﻦ ﺍﻟﺘﺮﻣﺬﻱ
তিনি উম্মাহাতুস সুনান তিরমিজীর মত কিতাবেরও শরাহ লিখতে পিছপা হননি। দীর্ঘ ত্রিশবছরের তাকরীর সম্মিলিত তিরমিজী শরীফের ব্যখ্যা গ্রন্থ ‘তুহফাতু আলমায়ী’ নামক গ্রন্থ পাঠকের সামনে পেশ করেছেন৷ যা মোট আট খণ্ডের বিশাল কিতাব৷ আহলে ইলমের খেদমতে রেখেছেন এ ধরনের অনেক অমর কীর্তি৷
৭৷ ﺯﺑﺪﺓ ﺍﻟﻤﻘﺼﻮﺩ
তিনি তহাবী শরীফেরও শরাহ লিখেন৷ যার নাম ‘যুবদাতুল মাকছুদ আলা শরহে মায়ানীল আছারি লিত্বাহাবী৷’
হযরতের আরো অনেক এমন কিতাব রয়েছে যা হযরতের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত সদকা জারিয়া হয়ে থাকবে৷ যেমনঃ
৮৷ ইলমী খুতবাত ( দুই খণ্ড)
৯৷ ইফাদাতে নানুতুবী
১০৷ ইফাদাতে রশিদিয়াহ
১১৷ তাহযীবুল মুগনী
১২৷ মিফতাহুত-তাহযীব
১৩৷ কেয়া মুক্তাদী কে লিয়ে ফাতেহা ওয়াজিব হ্যা? (হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতুবী রহ. এর লিখিত কিতাব তাওছিকুল কালাম এর শরাহ)
১৪৷ মাহফুজাত (তিন খণ্ডের,ছোটদের জন্য)
১৫৷ তুহফাতুদ্দুরার শরহে নুখবাতিল ফিকার৷ (উসুলে হাদীসের উপর লিখিত সংক্ষিপ্ত রিসালা)
১৬৷ মাবাদিউল ফালসাফাহ
১৭৷ মুঈনুল ফালসাফাহ
১৮৷ আপ ফতোয়া কাইছে দে
১৯৷ মাশাহির মুহাদ্দীসীন রুয়াতে হাদীস
২০৷ হায়াতে ইমাম আবু দাউদ
২১৷ হায়াতে ইমাম তহাবী
২২৷ ইসলাম তাগায়য়ুর পেযীর দুনিয়া মে৷ (মুসলিম ইউনিভারসিটি, আলীগড় এবং জামিয়া মিল্লিয়াতে প্রদত্ব প্রবন্ধাবলী)
২৩৷ নুবওয়্যত ইনসানিয়্যাত কো কেয়া দিয়া।
২৪৷ দাড়ী আওর আম্বীয়া কি সুন্নতি
২৫৷ তাসহীলে আদীল্লায়ে কামিলা (শাইখুল হিন্দ রহ.-এর লিখিত কিতাব আদিল্লায়ে কামিলার ব্যখ্যা গ্রন্থ)
২৬৷ হাওয়াশী আনাঈনি ঈযাহুল আদিল্লাহ
২৭৷ হাওয়াশী এমদাদুল ফতোয়া
২৮৷ মাবাদিয়ুল উসূল৷(উসূলে ফিকাহর উপর লিখিত ছোট রিসালা)
২৯৷ আল ফাউযুল কাবীর ফি উসূলিততাফসীর৷(শাহ অলিউল্লাহ দেহলবী রহঃর লিখিত কিতাবের আরবীকরন)
৩০৷ আল আউনুল কাবীর
৩১৷আসান নাহব( উর্দ ভাষায়,দুই খন্ড)
৩২৷ আসান ছরফ( উর্দু ভাষায় তিন খন্ডে)
৩৩৷ গুঞ্জায়ে ছরফ শরহে পাঞ্জেগাঞ্জ৷

এমন আরো বহু কিতাবের সফল মুসান্নিফ তিনি। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি দ্বীনের খাতিরে ছুটে গেছেন বিশ্বের আনাচে- কানাচে। অন্য দিকে আবার দারসের এত বেশি পাবন্দ যার নজীর পৃথিবীতে বিরল৷ দারস বন্দ করে তিনি কোন দিন কোন অনুষ্ঠানেও শরিক হন না ৷ এমন কি তিনি দরসের পাবন্দি করতে গিয়ে ওমরার চেয়েও দরসকে তারজীহ দিয়ে থাকেন৷ মানুষের সাথে অযথা মেলামেশা একদমই দেখতে পারতেন না ৷ এমন কি মানুষের বেশি হুজ্জুম হওয়ার কারনে তিনি দারুল দেওবন্দের সাবেক মোহতামিম আল্লামা মরগুবুর রহমান রহ. এর জানাযায়ও শরিক হন নাই৷ তিনি সারা জীবন শুধু ইলমী ও দ্বীনি খেদমতের জন্য ফেদা করে দিয়েছেন৷

কিছুদিনের আগের কথা ২০১৮ আগস্ট মাসে যখন হাটহাজারীর হযরত আল্লামা আহমদ শফি রহ. চিকিৎসার জন্য দিল্লির এ্যাপলো হসপিটাল আসেন৷ ঐ সফরে হজরত দেওবন্দে আসেন৷ তখন হযরতুল উস্তায পালনপুরী রহ. এর সাথে দেখা করতে দারুল উলুমের মেহমান খানায় আসেন৷ উভয় শাইখাইনের মাঝে হাল-পুরছি ও সালাম কালাম হয়৷ এক পর্যায়ে হযরত বলেন ‘এখন তো আমি শুধু ইলমী খেদমতে ফেদা৷ স্ত্রীও নাই যে ঝামেলা আছে!’ সে সময়ে বিশেষত তাফসীরে হেদায়াতুল কুরআনের জন্য বিশেষভাবে দোয়া চান।

তাযকিয়া ও আত্মশুদ্ধির মেহনত-
হজরত যেমন উলুমে জাহেরির মুহাক্কিক আলেম তেমনি তিনি একজন উলুমে বাতেনিরও আধ্যাত্মিক রাহবারে কামেল ছিলেন। ছাত্র জমানা থেকেই তিনি শাইখুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়্যা রহ.-এর সাথে তাযকিয়ার সম্পর্ক করেন৷ তিনি সাহারানপুরে থাকাকালীন আসরের পর আল্লামা আ. ক্বাদের সাহারানপুরি রহ. এর মজলিসে পাবন্দির সাথে শরিক হতেন৷ নিজেই বলেছেন, যখন কোন হাদীস পড়তেন তার উপর আমল করা শুরু করতেন৷ যখন তিনি পোশাকের সুন্নত তরিকা কিতাবে পড়েছেন ঐ দিন থেকেই তিনি নিছফে ছাক্ব পাঞ্জাবি পরিধান করেন৷ দারসে একদিন তো বলেই ফেললেন- আবু দাউদের সবকে যে দিন তিনি মুসাফাহ করে দােয়া পড়ার হাদীস পড়েছেন তার উপর হুজুর ঐদিন থেকে মৃত্যুপর্যন্ত আমল জারী রেখেছেন। সত্যি তিনি একজন সুন্নত প্রেমিক খোদাভীরু আল্লাহওয়ালা মুযাক্কি ও মুসলিহে উমাম৷ তিনি ছিলেন মাজাহিরুল উলুম (ওয়াকফ্) এর মোহতামিম আল্লামা মুযাফ্ফর হুসাইন মাযাহেরী রহঃ এর খলিফা ও বাইয়াতের মুজায।

বাইতুল্লাহর সফর-
১৪০০ হি. মোতাবিক ১৯৮০ তে সর্ব প্রথম নদী পথে নিজের মোহতারামা আহলিয়াকে সাথে নিয়ে ফরজ হজ্ব পালন করেন ৷ ১৪০৬ হিজরিতে দ্বিতীয়বারের মতো বাইতুল্লাহর মুসাফির হন ৷ অবশ্যই সেটা ছিল বদলী হজ্ব। ১৪১০ হিজরিতে এই মহা মনিষী তৃতীয়বারের মতো সৌদি সরকারের মেহমান হয়ে হজ্ব পালন করেন৷।১৪১৪ হিজরিতে তিনি প্রথমবারের মত ওমরার সফর করেন।

তাবলীগি খিদমাত-
হাজারো ব্যস্ততা নিয়ে এই মহান ব্যাক্তি নিজেই নিজেকে দ্বীনের কাজে করেছিলেন পূর্ণ উৎসর্গ। মাদ্রাসা লম্বা ছুটি হলেই বিশেষ করে রমজানের দীর্ঘ ছুটিতে তিনি ছুটে যেতেন দ্বীন প্রচারে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। ইসলামের আলো ছড়িয়ে দেন বিশ্বের গ্রামগঞ্জে। ইউরোপ আমেরিকাসহ বর্তানিয়া, কানাডা, লন্ডন, ডুবাই সুদান ও আরব আমিরাত বাংলাদেশ পাকিস্তান সহ বিশ্বের বহু দেশে সফর করেছেন৷

ফন্নি মাহারাত-
হজরত এমন একজন মানুষ ছিলেন যার মাঝে ছিলো প্রত্যেক ফনেরই দক্ষতা ও মাহারাত। দরসে না বসলে সত্যি তা বুঝানো দুস্কর। যেমনি তিনি একজন ছরফ ও নাহুবীদ তেমনি তিনি একজন উসূলবীদও  ছিলেন। তিনি মান্তেক ফালসাফায়ও পিছিয়ে ছিলেন না। হযরত নিজেই দরসে বলেছেন, তিনি মান্তেক বুঝার জন্য এক দুইটা নয় প্রায় সতেরটা কিতাব অধ্যয়ন করেছেন। এমন প্রতিটি ফনের মাহের শখছিয়ত খুবই বিরল।

ভাই বোন-
হজরত পালনপুরী রহ. এর পাঁচ ভাই ও চার বোন ৷ তার মধ্যে তাঁর একজন মা-শরিক ভাই যার নাম আহমাদ। হজরতের হাকিকি চার ভাই। তিনিই ছিলেন সবার বড়।
১৷ আ. রহমান। ২৷ আমজাদ। ৩৷ হযরতুল উস্তায আমীন পালনপুরী দা.বা.। যিনি বর্তমানে দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দীস।
৪। হাবীবুর রহমান ৷

হজরতের সন্তান সন্তুতি-
হযরত রহ.-এর এগারো ছেলে আর তিন মেয়ে। তার মধ্যে এক ছেলে মাও. রশিদ আহমাদ গাড়ী এক্সিড্ন্ট হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। আর এক মেয়ে শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। বর্তমানে তার সন্তানদের সবাই হফেজে কোরআন। ছেলেরা সবাই আলেম। দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত।

অবশেষে বলি এমন একজন মহান মানুষকে পেয়ে নিজেকে আনন্দিত মনে করছি। নগন্য একজন ছাত্র হিসাবে বলতে পারি- সত্যি আপনাকে দিল থেকে মহব্বত করি।  আমার মতো আপনার এমন হাজারো ছাত্র আছে যারা সরাসরি বলতে পারেনি যে, আপনাকে লিল্লাহিয়াতের সাথে মহব্বতের করি। সত্যি করে বলি আপনার মাঝে জামাল কামাল নাওয়ালের ভরপূর সমাহার ছিলো। কতজন-ই-না আপনার সোনালী জীবন রচনা করেছে। আমিতো তাদের মাঝে নগন্য একজন। আল্লাহ তায়ালা এ মহান মনিষীকে জান্নাতের আলা মাকাম দান করুন। আমিন।

-উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন উর্দু দৈনিকে প্রকাশিত জীবনী অবলম্বনে।

এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ