শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


হারিয়ে যাচ্ছে বখতিয়ার খিলজির স্মৃতিবিজরিত সেই ‘বখতিয়ারি মসজিদটি’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আন্দামান নওশাদ, প্রতিনিধি: সংরক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে রংপুরের মাহিগঞ্জ এলাকার এতিহ্যবাহী তিন গম্বুজ মসজিদ। এই মসজিদটি স্থানীয়দের কাছে বখতিয়ারি মসজিদ নামে পরিচিত।

মসজিদের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে সুইপার কলোনি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবশিষ্ট জায়গাটুকুও দখল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তালিকাভুক্ত না হওয়া এবং এটি সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটি।

এ মসজিদটি প্রতিষ্ঠার সময়কাল নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও মুঘল ও সুলতানী আমলের নির্মাণ সামগ্রী, গম্বুজের নিচের ত্রিকোণাকৃতির পেন্ডেন্টিভ নকশা, ড্রামহীন গম্বুজ, ছাদের সমতল বুরুজ ও ছোট আকার মসজিদের প্রাচীনত্ব এবং পাশে ইসলাম প্রচারক শাহ জালাল বুখারী রহ. এর মাজার দেখে এটি মুঘলপূর্ব যুগের মসজিদ বলে মনে করেন ইতিহাস গবেষকরা।

jagonews24

বড় রংপুর কারামতিয়া কামিল মাদরাসার ফেকাহ বিভাগের প্রধান ড. মো. আজিজুল ইসলাম তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের (গবেষণাকর্ম) (বৃহত্তর রংপুর জেলায় ইসলামী দাওয়াহ) ১২৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, গোলাকার তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদের ভেতরের দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট, প্রস্থ ১৪ ফুট এবং উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। এর চারকোণায় অষ্টভূজাকার কিউপলাযুক্ত কর্নার টাওয়ার রয়েছে। পূর্ব দিকের দেয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধবৃত্তাকার খিলানবিশিষ্ট প্রবেশপথ। যার উচ্চতা ৬ ফুট এবং প্রস্থ ৩ ফুট। দরজাগুলো বহুভাজ বিশিষ্ট খিলানাকৃতি ছিল এবং উভয় দিকে প্রতিটি দেয়ালজুড়ে পলেস্তারার ব্যবহার ছিল।

এছাড়াও পশ্চিম দেয়ালের ভেতরে (মধ্যভাগে) মিহরাবসহ তার উভয়দিকে গভীর খিলানের চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। ১০-৬-১ ইঞ্চি, ১২-৭-২ ইঞ্চি, ১১-৬-১.৫ ইঞ্চি, ১২-৬-২ ইঞ্চি ও ৬-৬-১ ইঞ্চি পরিমাপের বিভিন্ন ইট দিয়ে চুন সুড়কির সমন্বয়ে নির্মিত এ মসজিদে এক কাতারে ১৮-২০ জন মুসল্লির একসঙ্গে নামাজ আদায় করা সম্ভব।

ওই গবেষণাকর্মে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, এ মসজিদটি ইসলামী দাওয়াহ প্রসারের ক্ষেত্রে নানা অবদান রেখেছে। অমুসলিম অধ্যুসিত মাহিগঞ্জ এলাকায় ইসলাম প্রচারক শাহ জালাল বুখারী রহ. এ মসজিদে বসে দীর্ঘদিন (১৩০৭-১৪০০ খ্রি. এর মধ্যবর্তী সময়ে) ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করেন। মসজিদের দক্ষিণ পাশে তার মাজার রয়েছে। ইসলাম প্রচারের ফলে এখানকার অধিকাংশ মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি রয়েছে যে, মসজিদটি ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির স্মৃতি বিজরিত।

jagonews24

ইতিহাস বলছে, ১২০৪ সালে বঙ্গ বিজয়ের দু’বছর পর বখতিয়ার খলজি তিব্বত অভিযানকালে ঘোড়াঘাট থেকে কামরূপ যাওয়ার জন্য যাত্রাপথে রংপুরের ঘাঘট নদীর পশ্চিম পাড়ে যাত্রা বিরতি করেন। সে ঘটনার সাক্ষী আজও টিকে থাকা ‘বখতিয়ারপুর’ নামের গ্রামটি। ঘাঘট নদী পাড়ের বখতিয়ারপুর গ্রাম থেকে মাহিগঞ্জের বখতিয়ারি মসজিদ কিছুটা দূরে হলেও মধ্যযুগে মাহিগঞ্জ যে রংপুরের প্রাণকেন্দ্র ছিল তা ইতিহাস থেকে জানা যায়। ফলে বঙ্গবিজেতা বখতিয়ার খলজির স্মৃতিবিজড়িত মসজিদ এ অঞ্চলে থাকতেই পারে।

বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের পর রাজ্য বাড়ানোর নমুনা হিসেবে নিজে অথবা তার নিযুক্ত শাসকরা সেসময় এই ছোট্ট মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন বলে এলাকাবাসীর ধারণা। এই মসজিদের পাশেই শাহ জালাল বুখারী রহ. এর মাজারের অস্তিত্ব এটিকে সুলতানী আমলের মসজিদ হিসেবেও বিবেচনায় সহায়তা করে। এ কারণে এটি বখতিয়ারি মসজিদ নামে পরিচিত। আর তা যদি হয়ে থাকে তাহলে সময়ের হিসাবে এটি ৮০০ বছরের প্রাচীন অনন্য স্থাপত্য এবং উত্তরাঞ্চলের দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদ।

দেখা যায়, ইতোমধ্যে গম্বুজের বাইরের অলংকরণ ও কর্নার টাওয়ারগুলোর অলংকরণকৃত বৈশিষ্ট্যগুলো মুছে গেছে। কেবল কর্নার টাওয়ারগুলোর নিচের অংশ যে কলসাকৃতি ছিল তা সহজেই বোঝা যায়। মসজিদটি আগাছায় ঢাকা পড়ে আছে। মেহরাবে চির ধরেছে অনেক আগেই। খসে পড়েছে দেয়ালের ইট, পলেস্তারা।

jagonews24

পূর্ব দিকের প্রবেশপথের মতোই উত্তর ও দক্ষিণের দেয়ালের প্রবেশপথগুলোও। উত্তরের প্রবেশপথটি ছাড়া অন্য পথগুলো ইটের গাঁথুনি দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কালের সাক্ষী এই মসজিদের পাশেই গড়ে উঠেছে সুইপার কলোনি।

জানা যায়, মসজিদের পূর্বদিকের মাঝের প্রবেশপথটির ওপর একটি শিলালিপি ছিল। তবে এখন আর নেই। শিলালিপিটি হারিয়ে যাওয়ায় মসজিদের নির্মাণ তারিখ সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রংপুরের এরিয়া সদর দফতর থেকে ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘আলোকচিত্রে ইতিহাস : বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর’ নামক বইয়ে ছাপানো আছে এ মসজিদের ছবি। এতে মসজিদের নির্মাণকাল ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ উল্লেখ করা আছে।

রংপুর জাদুঘর নামে ওয়েবসাইটে জেলার অসংরক্ষিত প্রত্নস্থলসমূহের তালিকায় বখতিয়ারি মসজিদের সময়কাল আনুমানিক ১৬৮৭ খ্রি. উল্লেখ করা হয়েছে।

মোনালিসা রহমান তার ২০১৩ সালে প্রকাশিত ‘মাহিগঞ্জের কথা’ গ্রন্থে বখতিয়ারি মসজিদের প্রতিষ্ঠাকাল প্রসঙ্গে লিখেছেন, অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ঘোড়াঘাটের ফৌজদার এবাদত খান ১৬৮৭ সালে মসজিদটি নির্মাণ করেন। তবে সে তথ্যের কোনো সূত্র নেই বইটিতে।

jagonews24

মাহিগঞ্জ সাতমাথা এলাকার বাসিন্দা ও রংপুর মডেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক আবু তৈয়ব বলেন, ঐতিহাসিক এই মসজিদটি ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির শাসনামলে নির্মিত হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তবে বিস্তারিত গবেষণার পূর্বে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর কর্তৃক সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে মসজিদটিকে ঘোষণা করা এবং দ্রুত সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তা নাহলে অচিরেই কালের সাক্ষী এই ঐহিত্যবাহী মসজিদটি চিরতরে হারিয়ে যাবে।

বড় রংপুর কারামতিয়া কামিল মাদরাসার ফেকাহ বিভাগের প্রধান ড. মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, এই মসজিদের নির্মাণ শৈলী এবং আনুসাঙ্গিক বিষয় বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে, বখতিয়ারি মসজিদটি মুঘল আমলেরও অনেক আগের মসজিদ।

তিনি আরও বলেন, ১৩০৭-১৪০০ খ্রি. পর্যন্ত সময়কালে এখানে ইসলাম প্রচারক শাহ জালাল বুখারী রহ. এর আগমন হয়েছিল। তিনি ওই মসজিদে অবস্থান নিয়ে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেছিলেন এবং মসজিদের পাশেই তার মাজার রয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির আমলের মসজিদ বলে ধারণা করা হয়। এজন্য এটি বখতিয়ারি মসজিদ নামে পরিচিত।

ওই মসজিদ প্রসঙ্গে রংপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান কাজী মোহাম্মদ জুন্নুন বলেন, আমি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ওখানে একটি স্মৃতিফলক লাগিয়েছিলাম। ১২০০ শতকে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি চীন অভিযানে যাওয়ার সময় রংপুরে আস্তানা গেড়েছিলেন। তখন ওই সমজিদটি নির্মাণ করা হয়।

তিনি আরও বলেন, আমার আমলে মসজিদটি সংস্কারে ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু স্থানীয় কিছু লোকের কারণে সেটি সম্ভব হয়নি।

রংপুর তাজহাট জমিদার বাড়ির কাস্টেডিয়ান এসএম হাসনাত বিন ইসলাম বলেন, আমি ৬ মাস আগে এখানে যোগদান করেছি। এরমধ্যে তিনমাস প্রশিক্ষণে ছিলাম। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আওতায় আনতে সুপারিশ করা হয়েছে কিনা তা জানা নেই। খুব দ্রুত মসজিদটি পরিদর্শন করে যাতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আওতায় নিয়ে আসা যায় সে ব্যবস্থা করা হবে।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা বলেন, মসজিদের অধিকাংশ জায়গাজুড়ে সুইপার কলোনি গড়ে উঠেছে। পরিত্যক্ত এই মসজিদটি সংরক্ষণে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর