শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


‘দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়াতের আদর্শের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোষহীন’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন
শ্রুতিলিখন-কাউসার লাবীব

দারুল উলুম দেওবন্দের আরবি সাহিত্য বিভাগের প্রধান মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনী রহ.। দারুল উলুম দেওবন্দের ইতিহাসে তিনি ছিলেন আরবদের কাছে স্বীকৃত একমাত্র গদ্যশিল্পী। তিনি ছিলেন আমার প্রিয় উস্তাদদের একজন। দেশে আসার পরও তার কথা ক্ষণে ক্ষণেই মনে পড়তো। দেওবন্দে পড়ালেখার জন্য যাওয়ার পর দাওরায়ে হাদিস শেষ করে পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৯২ সালে আরবি সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হই। তখন থেকেই পেতে শুরু করি প্রিয় উস্তাদ মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনী’র ভাষাশৈলির সুবাস। তার কাছে পড়ার সুযোগ হয়েছিল আন-নাসরুল জাদীদ ও মুখতারাত।

মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনী রহিমাহুল্লাহর উস্তাদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানবী। মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানবী তার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন। আমরা সবাই জানি যে, মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানবী ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। তার নিপুণ হাতেই তৈরি হোন মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনী। মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানবীর রেখে যাওয়া আরবি ভাষার খেদমতের পতাকা বহন করেন মৃত্যু অবদি।

No description available.

মাওলানা নুর আলম খলীল আমিনী রহ. জীবনের প্রথম দিকে দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা’র শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু দারুল উলুম দেওবন্দ নিজেদের মাদ্রাসায় আরবি সাহিত্যের জন্য একজন শিক্ষকের প্রয়োজন বোধ করলে তখন দেওবন্দের কর্তৃপক্ষ নদওয়াতুল উলামায় গিয়ে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী’র কাছে মাওলানা নুর আলম খলীল আমিনীকে শিক্ষক হিসাবে  পেতে চায়। মাওলানা নদভী সাহেবের কাছে কথা বলার পর তিনি বলেন যে, আমার মাদ্রাসার তিনজন প্রধান আরবি সাহিত্যিকদের মধ্যে মাওলানা নুর আলম খলীল আমিনী একজন। তাকে আমার মাদ্রাসায় খুবই প্রয়োজন। কিন্তু তিনি যদি দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষক হিসেবে যান, তাহলে দেওবন্দের অনেক উপকার হবে। দেওবন্দের উপকারের দিকে তাকিয়ে আমি তাকে দিয়ে দিচ্ছি। আসলে মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী’র সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল নিবিড়। মাওলানা নদভী’র উর্দু কিতাবের বেশিরভাগ আরবি অনুবাদ করেছেন মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনী

এছাড়া মাওলানা মনজুর নোমানী’র বেশকিছু উর্দু কিতাবের আরবি অনুবাদও তিনি করেছেন। বলা যায় আরবদের কাছে মাওলানা মনজুর নোমানীকে যে ব্যক্তি পরিচিত করে তুলেছেন, তিনি হলেন নুর আলম খলিল আমিনী। তার মাধ্যমে আরবরা মাওলানা মনজুর নোমানীকে পড়তে শিখে, বুঝতে শিখে এবং জানতে শিখে। মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনীর মাঝে দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়াতের আদর্শের যে আপোষহীনতা ছিল, তা সবার কাছেই স্বীকৃত এবং তার ইলমের যে গভীরতা তা অনস্বীকার্য।

মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী রাহিমাহুল্লাহ যখন হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ আরবি ব্যাখ্যাগ্রন্থ (শরাহ) লিখেন; তখন এর একটি মোকাদ্দমা লিখিয়ে নিয়েছিলেন মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনী’র মাধ্যমে। সেই সূত্র ধরে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’র শরাহ’র কোনো এক জায়গায় মাওলানা পালনপুরী রহ. মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনী সম্পর্কে মূল্যায়ন পেশ করতে গিয়ে ‘আল্লামা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আর মাওলানা পালনপুরী সাহেব কাউকে কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করার ক্ষেত্রে খুবই সাবধান ব্যক্তি ছিলেন। যে সিফত তার মাঝে নেই, সে গুনে কাউকে তিনি বিশেষায়িত করতেন না। এটি অনেক বড় একটি বিষয় যে, মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী’র মত একজন সচেতন ব্যক্তি তাকে অন্যান্য উপাধির সঙ্গে আল্লামা শব্দ দিয়ে বিশেষায়িত করেছেন।

No description available.

মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনীর অন্যতম একটি প্ল্যাটফর্ম ছিল আদ-দাঈ পত্রিকা। পত্রিকাটি আরবদের কাছে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এমন কি আদ-দাঈ পত্রিকায় মাওলানা নুর আলম খলিল আমিনীর প্রকাশিত কলামগুলো আরবদের মর্যাদাশীল বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম হিসেবে ছাপা হতো। এছাড়া তিনি যখন আরব দেশগুলোতে সফরে যেতেন; তখন সেখানকার সাংবাদিকরা তার কাছ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়ে এক-দেড় পৃষ্ঠা সাক্ষাৎকারমূলক কলাম ছাপাতেন তাদের পত্রিকায়। আমরা যখন দেওবন্দে তার কাছে পড়ি তখনকার একটি কথা মনে পড়ে; তিনি একবার দুবাই সফরে গিয়েছিলেন। দুবাই সফরে যাওয়ার পর ‘আল-মুসলিমুন’ পত্রিকা তার কাছ থেকে একটি সাক্ষাৎকার নেন এবং প্রায় দুই পৃষ্ঠা ব্যাপী তা ছাপান।

আদ-দাঈ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি আরব বিশ্বের কাছে দেওবন্দের যে মর্যাদাশীল ইতিহাস তুলে ধরেছেন; তা কোন একটি দলের মাধ্যমেও সম্ভব হতো কিনা আমার জানা নেই। তার মতো করে দেওবন্দকে এর আগে কেউ আরবদের কাছে উপস্থাপন করতে পারেনি এবং হয়তো ভবিষ্যতেও পারবে না। এমন একজন মনীষীকে হারিয়ে আমরা সত্যিই মর্মাহত।

সবশেষে তার দুটি উপদেশের কথা বলে ইতি টানবো:-

এক- তিনি আমাদেরকে ক্লাসে প্রায় সময় বলতেন, লেখাপড়ার পর কী করবে? এটা আগে থেকেই ঠিক করে নাও। তিনি বলতেন যে, যেকোন একটা বিষয়কে নিজের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করো। কারো জন্য এটা উচিত নয় যে, সে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করবে। কেউ অনেকগুলো বিষয় জানতে পারে জানার আগ্রহ থেকে। কিন্তু কাজ করবে যেকোন একটি বিষয় নিয়ে এবং এর মাধ্যমে বিপ্লব সাধন এর পথে এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর নিজের জীবনের প্রসঙ্গ টেনে বলতেন যে, তার ফিকহা, মানতেক এবং বিভিন্ন শাস্ত্র নিয়ে কাজ করার আগ্রহ ছিল। কিন্তু মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান কিরানবীর সঙ্গে যখন তার দেখা হয় এবং তার কাছে যখন তিনি পড়েন; তখন তিনি পরিপূর্ণভাবে আরবির সঙ্গে লেগে যান এবং আরবি ভাষাকে নিয়ে কাজ শুরু করেন।

দুই- তিনি আমাদের উদ্দেশ্যে আরেকটি কথা বলতেন যে, কিছু সন্তান এমন হওয়া চাই; যারা দারুল উলুম দেওবন্দের জন্য কাজ করবে, দারুল উলুমকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে এবং এই স্বপ্ন নিয়েই তারা বাঁচবে। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে তারা নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিবে।

-কেএল


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ