বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিরোনাম :

শাইখুল কোরআন মাওলানা বেলায়েত হুসাইন রহ.; আমরা হাঁটছি সে স্বর্ণবৃক্ষের ছায়ায়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

।।মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন।।

কারী বেলায়েত হুসাইন রহ.- শিক্ষা আলো আশীর্বাদের সোনা ফলানো এক অমর কৃষকের নাম। এই বাংলার কোমল মাটিতে লক্ষ-কোটি সোনার চারা ছড়িয়ে- মাটির ঘরে নিদ্রাবিভোর। রহমতের শিশির আর বেহেশতের পুষ্প সুবাসে পূর্ণ রেখো হে আল্লাহ, তার কবরখানি। আমিন।

মূর্খতা অভিশাপ, শিক্ষা আশীর্বাদ। মূর্খতা অন্ধকার, শিক্ষা আলো। মূর্খতা মানবতার বিষ, শিক্ষা মানবতার প্রাণ। পাপ কলুষ ও আঁধার যখন গিলে ফেলতে উদ্যত হয় মানব ও মানবতার বসতি এই পৃথিবীকে- শিক্ষার রুদ্র মন্ত্রেই তখন রুখে দাঁড়ায় পৃথিবী সব সর্বনাশা অমানিশার বিরুদ্ধে। যুগে যুগে নবীগণ শিক্ষার এই নিরাপস রুদ্র মশাল হাতেই আগমন করেছেন এই মাটির পৃথিবীতে। এ পথের শেষ আলোর সম্রাট বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর সত্য সুন্দর কল্যাণ ও অন্তহীন আশীর্বাদের সর্বশেষ আলোর মশাল আল কুরআন- কুরআন মাজীদ। পীর মনীষী ও সাধক মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন রহ. ছিলেন এই অন্তহীন আশীর্বাদের দরদী ফেরিওলা। চঞ্চল যৌবন থেকে ক্লান্ত বার্ধক্য অবধি এই বাংলার নগর শহর গ্রাম ও বঞ্চিত অবহেলিত জনপদ ঘুরে ঘুরে বিলিয়েছেন এই অব্যর্থ আলো; বুনেছেন শিক্ষা ও রহমতের শাশ্বত চারা! ধন্য তার জীবন, ধন্য তার সাধনা!

দুই.
দীনি ও শিশুশিক্ষার এক সহজ ও মোহন পথ নূরানী শিক্ষা পদ্ধতি। এই পদ্ধতির আবিষ্কারক কারী বেলায়েত হুসাইন। এই দেশে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তার ও নিরক্ষরতা দূরীকরণে তাঁর অবদান অনন্য বরং সামগ্রিক বিচারে অতুলনীয়। একজন ব্যক্তি কোন সংগঠন সংস্থা শিল্পপতি কিংবা সরকারি দান ও পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে দাঁড়িয়ে দেশের যে সংখ্যক শিশু ও বুড়োকে মৌলিক দীনিশিক্ষা ও আলোকিত অক্ষর জ্ঞানে দীপিত করে গেছেন তার কোন উদাহরন এ দেশের ইতিহাসে আক্ষরিক অর্থেই নেই। শেকড়ে শিক্ষা বিস্তারে তার এই অনুপম অবদান এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র দেখতে ও উপলব্ধি করতে পারেনি- এটা ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’ প্রবচনের ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত! বেদনার কথা, আমাদের ঐতিহ্যের অনেক বটবৃক্ষ এভাবেই বনসাই হয়ে পড়ে থাকে কূপমন্ডুকের টেবিলে।

তিন.
কী এই নূরানী শিক্ষা পদ্ধতি- অন্তত যাদের সন্তান আছে তাদের অবশ্যই জানা দরকার। কারণ, মা-বাবা মাত্রই সন্তানের সহজ সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চান। নূরানী শিক্ষা পদ্ধতির সবচাইতে মোহন বৈশিষ্ট্য হলো দীনি ও আধুনিক শিক্ষার সহজতম সমন্বয়। প্রশিক্ষিত শিক্ষকগণ মাত্র তিন বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে একজন নয়-দশ বছরের শিশুকে-

এক. তাজবীদসহ পূর্ণ বিশুদ্ধরূপে পুরো কোরআন পড়িয়ে দেন।
দুই. কণ্ঠস্থ করিয়ে দেন ফযিলতের কতিপয় সূরা।
তিন. প্রয়োজনীয় মাসয়ালাসহ পূর্ণাঙ্গ নামাজ এমনভাবে শিখিয়ে দেন- ওই শিশু যেকোনো স্থানে দাঁড়িয়ে ইমামত করতে পারে।
চার. জুমা ও ঈদের এবং জানাজার নামাজ পড়াবার মত প্র্যাক্টিক্যাল শিক্ষা!
পাঁচ. দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় দোয়াগুলো মুখস্ত করিয়ে দেন।
ছয়. জীবনপথের অব্যর্থ দিশারী স্বরূপ প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চল্লিশখানা হাদিস তরজমাসহ মুখস্ত করিয়ে দেন।
সাত. সরাসরি তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে একজন খাঁটি-পূর্ণাঙ্গ মুমিনজীবনে অভ্যস্ত করে তুলেন এই তিন বছরের বরাবর অনুশীলনে।
সেই সঙ্গে-
আট. তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা অংক ইংরেজি ভূগোল- এমনভাবে পাঠদান করা হয়- এই কোর্স শেষ করার পর সহজেই স্কুলে গিয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারে।
নয়. পাঠদান পদ্ধতি যূথবদ্ধ হওয়ার কারণে সঠিক ও স্পষ্ট উচ্চারণে শিশুরা অভ্যস্ত হয়ে উঠে- যা পরবর্তী জীবনে স্পষ্টভাষায় মনের ভাব প্রকাশে সাহায্য করে।

দশ. হাতের লেখা। এটা নূরানী পদ্ধতির অনন্য বৈশিষ্ট্য। একইসঙ্গে সাত-আট বছরের একজন শিশু-
ক. আরবি বাংলা অংক ইংরেজির মনোহর হাতের লেখায় সিদ্ধ হয়ে উঠে।
খ. বলা ও লেখায় সমান অনুশীলনের ফলে হাতের লেখা বলার মতোই শুদ্ধ ও দ্রুত গতিশীল হয়ে উঠে।
গ. ভবিষ্যৎ -শিক্ষাজীবন- এমন কি কর্মজীবনেও বোর্ড ও খাতার পিঠে করা এই নিয়মিত অনুশীলন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও সফল জীবন নির্মাণে সাহায্য করে। সাহায্য করে প্রতিযোগিতাপূর্ণ শিক্ষাজীবনে অনন্য ফলাফল অর্জনে!
তাই স্বপ্নচারী সচেতন মা-বাবা তাদের আত্মার ধন পুত্র-কন্যাকে সহজ দ্যুতিময় এই সর্বজয়ী সফল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করবেন কেন ? এইখানে সবিশেষ বলবার কথা হলো, এই যে জীবনের প্রভাতকালে স্বল্পসময়ের সফলতা ও সার্থকতার মূলমন্ত্রে শানিয়ে দিয়ে দিচ্ছে আমাদের সন্তানদের হৃদয় -মানস- এই কৃতিত্ব এই বাংলারই একজন ক্ষণজন্মা মহা পুরুষের। তার নাম কারী বেলায়েত হুসাইন রহ.।

চার.
এই কোর্স পূর্ণ করার পর পথ খোলা। কেউ চাইলে এবং প্রখর মেধা শক্তি থাকলে প্রবেশ করতে পারে হিফজুল কোরআনের পবিত্র আসরে এবং নাম লেখাতে পারে চির সৌভাগ্যের খাতায়। হিফজুুল কুরআন অতঃপর কোরআন ও হাদিসের পূর্ণ পূণ্য ইলম আহরণ করে নবীগণের উত্তরাধিকারী হওয়ার মত সাহসও কপাল তো আর সবার হবে না- এটাই স্বাভাবিক। তাই চাইলে কেউ সাধারণ শিক্ষায়ও যেতে পারে। তারপরও মনে রাখবার কথা- শুরু থেকে একজন শিশু স্কুলে না পড়ে নূরানী মক্তবে পড়ে যদি পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে স্কুলে ভর্তি হয় তাতেও তার আল অনেক লাভ ! খুলে বলি-
এক. আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে কোরআন মাজীদ শিখে এবং শেখায়!’ তিন বছর নূরানী পড়ার কারণে তার নাম উঠে গেল সর্বোত্তমদের স্বর্ণ তালিকায়! এর মূল্য হাজার পৃথিবীর চে’ বেশি।
দুই. এই শিশু সারাজীবন নামাজ পড়বে এবং শুদ্ধ নিয়মে পড়বে। শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই বুঝেন- পরীক্ষার খাতায় অশুদ্ধ লেখা আর না লেখা সমান কথা! বিষয়টি মোটেই অবহেলা করার মত নয়।
তিন. কর্মক্ষেত্রে, নিজের ঘরে অফিসে- প্রয়োজনে ইমাম হতে পারবে, জামাতে নামাজ আদায় করতে পারবে। আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বলেছেন- ‘একাকী নামাজের চাইতে জামাতের নামাজের নেকি সাতাশ গুন বেশি।’
চার. এই পৃথিবীতে মানুষের কাছে মানুষের শেষ অধিকার ‘জানাযা’। জানাযা অর্থ দোয়া ও প্রার্থনা। আমরা জানি, এই নামাজের বিশেষ নিয়ম ও দোয়া আছে। এও জানি, বিদ্বান ও অবিদ্বান নির্বিশেষে এই সমাজের অধিকাংশ মানুষ- এমনকি নামাজিদেরও বিরাট অংশ যথানিয়মে জানাযা পড়তে জানেন না! আর যদি বিষয়টা এইভাবে দেখি- এক পিতা। বিপুল অর্থ ব্যয় করে পুত্রকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন। মৃত্যু বরণ করেছেন পিতা। পিতার জন্য শেষ প্রার্থনার আয়োজন ‘জানাযায়’ পুত্র নীরব। কারণ সে পিতার জন্যে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা ও মুক্তির যে দোয়া ও প্রার্থনা আছে- তা সে জানে না! পিতার জন্যে ইমামের আসনে দাঁড়িয়ে যিনি ওই মুনাজাত পাঠ করছেন তিনি এই পিতা-পুত্রের কেউ নন। এরচে’ বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে!
যদি এই পুত্র অন্তত নূরানী কোর্সটি পড়ে থাকত আজ নিজে ইমাম হয়ে প্রাণ খুলে বিগলিত প্রার্থনায় পিতার জানাযা পড়তে পারতো!
পাঁচ. যৌবনের উত্তাপ ও চঞ্চলতা যখন নেমে যায় কবর হাশর পুলসিরাত ও বেহেশতের ভাবনা তখন অনেককেই নাড়া দেয়। একা হলেই কবর ডাক দেয়- ‘কবে আসবি ভাই?’ জানাজার যেকোনো দৃশ্য সর্বাঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে দেয়। অবাধ্যতা ও অনিয়মে ক্লান্ত মন খোঁচা দেয়- ‘আয়না এবার খানিক ধর্ম-কর্ম করি।’ যাদের দীন-ধর্মের বিন্দুবিসর্গ জানা নেই তারা তখন খেই খুঁজে পান না- কিভাবে পা দিই ধর্মের ঘরে। শিশু-কালে যাদের নূরানী কোর্স পড়া থাকে, শয়তানের প্ররোচনায় এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করলেও মোহ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসতে পারে শান্তি মুক্তি উদার অসীম ক্ষমার দরবারে। বুড়ো বয়সে যারা এক লাইনের একটি দোয়া মুখস্থ করতে গিয়ে অবশেষে হাল ছেড়ে দেন তারা বুঝেন- সত্যিই এই পার্থক্য বিশাল!
ছয়. শিশু-কালে দীন শেখা না শেখার শেষ পার্থক্যটা বলি। আমরা জানি, যার জীবনে আয়-ব্যয় আছে তার জীবন সচল। আয় বেশি হলে ভাগ্যবান, ব্যয়ের পাল্লা ভারী হলে- আনুপাতিক হারে বাড়ে দুঃখ-দুর্দশার মাত্রা। আর যার জীবনে কোনো আয় নেই- কেবলি ব্যয়, সমাজ-সংসারে এই হতভাগার জীবন শুধুই যন্ত্রনা।

বলি, যারা ধর্ম-কর্ম জানেন, বুঝেন, করেন; আবার শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে অন্যায় অপরাধও করেন- দিনের শেষে তাদের পাপ-পুণ্যের একটা হিসাব আছে। আছে মুক্তির আশা। আর যারা ধর্মকর্ম জানেনই না, করেনও না, আর করলেও নিয়ম-নীতির বাইরে- তাদের সামনে আশার আলো কতটুকু শুনি?

একটি উদাহরণ দিই, রমজানুল মোবারক! এই মাসের শ্রেষ্ঠত্বের মূলে হলো আল কোরআন। এই মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে তাই সকল মাসের সেরা এই মাস। কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে লাইলাতুল কদরে। তাই লাইলাতুল কদরের মূল্য হাজার মাসের চেয়ে বেশি। যারা একদা শিশুকালের সহীহ শুদ্ধ করে কোরআন তেলাওয়াত শিখেছেন, তেলাওয়াত তাদের গতিশীল- তারা আইন চিকিৎসা প্রকৌশল ব্যবসা চাকুরি- যে পেশাতেই থাকুন না কেন, কাজের ফাঁকে ফাঁকে কয়েক খতম কোরআন পড়বেন। নিজের মা বাবার কথা ভেবে ইফতারপূর্ব মোনাজাতে অশ্রুকাতর হবেন। তাঁর ও তাঁর মা-বাবার জীবন রমজানের রহমত মাগফেরাত ও মুক্তির আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। এইজন্যই তো সন্তান!

বলি, যারা শিশুবেলায় কোরআন শিখেননি, নামাজ শিখেননি, দোয়া শিখেননি, আলোয় আশায় সমুজ্জ্বল এই আশীর্বাদ তারা কোথায় পাবেন?

এদেশের সৌভাগ্য, এই দেশে সৌভাগ্যের এই মন্ত্র ছড়াতে, ঘরে ঘরে খোদার আসীষ বিলাতে জন্মেছিলেন মাওলানা বেলায়েত হুসাইন রহ.। যারা তাঁর সাধনার পরশ পেয়েছেন তারা কোনদিন ভুলতে পারবেন না এই নাম।

পাচ.
১৯১০ সালে জন্মেছিলেন এই সাধক সংস্কারক কর্মবীর। চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার কৃষ্ণপুর তার জন্মস্থান। তাঁকে ভালবেসে মানুষ কৃষ্ণপুরকে নাম দিয়েছে বেলায়েত নগর। তাঁর বাবা মুন্সি আবদুল জলিল ছিলেন আল্লাহভীরু এক সম্ভ্রান্ত সমাজসেবক। পবিত্র কোরআনের প্রতি ছিল তার প্রাণের টান। দুই কন্যা সন্তানের পর আল্লাহ তায়ালার দরবারে দীর্ঘ মোনাজাত ও কান্নাকাটির ১৮ বছর পর জন্ম লাভ করেন পুত্র বেলায়েত হুসাইন। তিনি তার প্রিয় পুত্রের জন্য পবিত্র কোরআনের বিখ্যাত তাফসির ‘মারিফুল কোরআন’ সংগ্রহ করেছিলেন- পুত্র বড় হয়ে কোরআন পড়বে, তাফসীর পড়বে- এই স্বপ্নে। শিশু বেলায়েত হুসাইনকে এতিম করে বাবা চলে গেলেও পুত্র তার পিতার স্বপ্নের মান রেখেছেন। জগতে এমন ভাগ্যবান পিতা ও পুত্র ক’জন হয়?

মাওলানা বেলায়েত হুসাইন রহ. এর ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। জীবনকে সোনা বানাবার জন্য তিনি পরশ পেয়েছিলেন বেশ ক'জন পরশপাথরের। ঢাকার প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ বড় কাটারা মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন মুজাহিদে আজম মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, আমীরে শরীয়ত মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জীহুজুর এবং মাওলানা আবদুল ওয়াহ্হাব পীরজীহুজুর রহ. এর মত মহাপুরুষদের। শক্তিমান দীক্ষাগুরু মুহাদ্দিস ও শাস্ত্রজ্ঞ মাওলানা সালাউদ্দিন শেখদী রহ.ও তাঁর ঘনিষ্ঠ উস্তাদ। জগতে পরশপাথরতুল্য শিক্ষক তো অনেকেই পান। শিক্ষকের আদর্শ জ্ঞান ও বুকের পাঁজরে লালিত এলাহি প্রেমের ময়ূখমন্ত্র শূষে নিতে পারেন ক’জন? মাওলানা বেলায়েত হুসাইন সাহেবের কৃতিত্ব তিনি জ্ঞান আদর্শ ও প্রেমের মহুয়া শূষে নিতে পেরেছিলেন হৃদয়ের মঞ্জুষায়! তিনি তার সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলির সংস্পর্শে এসে সবচে’ বড় যে সম্পদ লাভ করেছিলেন তা হলো মানুষের প্রতি প্রেম ও দরদ। বিশেষ করে সমাজের যে শ্রেণিটি মাদরাসা শিক্ষা থেকে যোজন যোজন দূরে তাদের আত্মায় কীভাবে তুলে দেয়া যায় কোরআনের নূর, দীনিশিক্ষার মাহক!? কোরআন মাজীদ ও দীনের জরুরি শিক্ষা ছাড়া তো পরকালে মুক্তির কোনো উপায় থাকবে না!

মানবমুক্তির এই যন্ত্রণা তাঁকে ক্রমে অস্থির করে তুলে। প্রভুর দরবারে রাতের নিশুতি প্রহরে কেঁদে সিক্ত করেন জায়নামাজ। ভাবেন এবং ভাবেন। মুসলমানদের শতভাগ সন্তানকে কোরআনের স্বর্ণ-সুতোয় বেঁধে চির শান্তির বেহেশতে নিয়ে যেতে তাঁর হৃদয়ে বাসা বেঁধেছিল যে দহন- তার প্রসবিত বৃক্ষই দীন শেখার নূরানী পদ্ধতি। ১৩ বছরের নিরিবিলি শিক্ষকতা, মুহতামিমের খ্যাতি ও পদ পেছনে ফেলে নেমে আসেন মুসলমানদের শিশুদের দীন শেখানোর কঠোর সংগ্রামে। সহায় সম্বলহীন ছুটে বেড়িয়েছেন দ্বারে দ্বারে। অবশ্য পীর ও মুর্শিদ হযরত হাফেজ্জীহুজুরের ছায়া ও দোয়া ছিল সর্বসময়ের সঙ্গী। হাফেজ্জীহুজুর তার এই সংগ্রামকে অনেক বড় করে দেখতেন। হাফেজ্জীহুজুরের আদেশ ও পরামর্শেই ইংরেজি ভাষাকে এই সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয় পূর্ণ গুরুত্বের সঙ্গে। উদ্দেশ্য, সামান্য দুনিয়া হারাবার ভয়ে যেন কোনো দুর্বলচিত্ত মুমিন তার সন্তানকে বঞ্চিত না করেন শিক্ষার এই অথৈ কল্যাণ থেকে। গুরু-শিষ্যের এই চিন্তা ব্যর্থ হয়নি। বরং আজ ফলে ফুলে প্রস্ফুটিত।

ছয়.
১৯৯০ সাল হবে হয়তো। দেশে মোটামুটি কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয়েছে। কোরআন শিক্ষার নূরানী পদ্ধতি বইখানা কম্পিউটার কম্পোজ করা হয়। কিন্তু সমস্যা হল, কম্পিউটারে আরবী নেই; কিংবা তখনো এর ব্যবহার আবিষ্কার হয়নি এখানে। বাংলার ফাঁকে ফাঁকে বাদপড়া আরবীগুলো লিখতে হবে হাতে। তখন বারিধারা মাদরাসায় পড়ি। সম্ভবত হযরতের সাহেবজাদা ফয়জুল্লাহ সাহেব বারিধারা মাদরাসায় এসে এই সংকটের কথা আলোচনা করলে আমার ডাক পড়েছিল। নূরানী প্রশিক্ষণের মূলকেন্দ্র মোহাম্মদপুরে গিয়ে রাত থেকে এই মহৎ ও মোবারক কাজটুকু সম্পাদন করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। রাতে এবং সকালে হযরত কারী বেলায়েত সাহেব রহ. এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। খুশি হয়ে দোয়া দিয়েছিলেন। যখন এই ঘটনা মনে পড়ে অসামান্য তৃপ্তি বোধ হয়।

একজন দরদী মানুষ। উম্মতের ব্যথায় কোনরূপ উপায়-উপকরণহীন পথে নেমে এসেছেন আবেগ দায়িত্বানুভূতি ও ভালোবাসার টানে। শপথ একটাই; এদেশের শতভাগ মুসলমানকে কোরআনের বাণী শেখাবো। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নূরানী তা'লীমুল কুরআন বোর্ড। এই বোর্ডের অধীনে এবং নূরানী সিলেবাসে স্বাধীন পরিচালনায় তখন ১৯ হাজার নূরানী মাদরাসা বিলাচ্ছে সেই নূর। এই বোর্ডের আটটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষিত এক লাখ ১৯ হাজার শিক্ষক কাজ করছেন দেশময়। এই বোর্ডের একটি জরিপে দেখা গেছে- এ পর্যন্ত ৯০ লাখ শিক্ষার্থী এই সিলেবাসে পড়াশোনা করে পবিত্র কোরআন জরুরি দীন ও আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছেন। আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমির প্রতিটি শহর গ্রাম ও অবহেলিত-সুবিধাবঞ্চিত জনপদের ঘুম ভাঙে এখন পবিত্র-প্রাণ শিশুশিক্ষার্থীদের দলবদ্ধ পাঠের মধুময় উচ্চারণে! বার্ষিক মাহফিলে ঈদ জুমা কিংবা জানাযার কল্পিত ইমামের আসনে এসে যখন দাঁড়ায় আট-নয় বছরের শিশু দীপ্ত পদে; কিংবা যখন ব্লাকবোর্ডে লিখে যায় আরবি বাংলা ইংরেজি মুক্তোর মতো বর্ণে- দর্শকের চোখ মন অনুভূতি চুম্বকের মত আটকে থাকে ওই পবিত্র দৃশ্যে। আল্লাহ দয়াময়ের কী অসীম কুদরত! তার একান্ত দয়া ও অনুগ্রহে তার এক বান্দা দেশময় ছড়িয়ে দিয়েছেন শূচি শুভ্র এক আদর্শ শিক্ষার সমূহ স্বর্ণবৃক্ষ! আমরা সকলে আজ সন্তানের হাত ধরে হাঁটছি ওই বৃক্ষের ছায়ায়! তার নিবাস হোক জান্নাতুল ফেরদাউসে। আমীন।।

-কেএল

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ