বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১১ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


মুফতি মুহাম্মদ ওয়াককাস: স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দেওবন্দী এমপি ও মন্ত্রী

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি এনায়েতুল্লাহ
সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

মুফতি ওয়াক্কাস, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দেওবন্দী এমপি ও মন্ত্রী। অর্থ উপার্জন নয়, তার রাজনীতি ইসলাম-মুসলমানের কল্যাণে। একটি খবর উদ্ধৃত করে লেখা শুরু করছি। কয়েকদিনের মধ্যে পাঁচটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে। উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী হতে দলীয় ফরম সংগ্রহ করেছেন ১৪১ জন। প্রতি আসনে গড়ে আগ্রহী প্রার্থী ২৮ জন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা জয়ী হন। বাকি ১৪৭ আসনের প্রতিটিতে গড়ে ১৭ জন দলীয় ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে প্রতি আসনের বিপরীতে ১৪ জন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। চলতি বছরের শুরুতে হওয়া ৫টি আসনের উপনির্বাচনে প্রতি আসনে গড়ে প্রার্থী ছিল ১৫ জন।

অধিক প্রার্থী প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলছেন, সাংসদ হওয়া এখন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। সরকারি দল হলে জয়ের নিশ্চয়তাও আছে। আর জয়ী হলে এ পদ ব্যবহার করে অনেক-অনেক কিছু করা যায়। যদিও বিধি মোতাবেক আইন প্রণয়নই একজন এমপির মূল কাজ। তারপরও সবাই নিজের খেয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে কেন এমপি হতে চান? এ বিষয়ে সাধারণ মানুষই আপনাকে অসাধারণ সব ব্যাখ্যা দেবে। তাদের কথার সারমর্ম, এমপি হলে নির্বাচনী এলাকার সব আপনার; আপনিই রাজা-বাদশা। নিজের ও বউ-বাচ্চার নামে অথবা বেনামে গাড়ি, প্লট, বাড়ি ব্যাংক ব্যালেন্স থেকে শুরু করে অনেক কিছু করতে পারবেন। সঙ্গে মেলে আরও অনেক সুকীর্তি-কুকীর্তি করার লাইসেন্স।

এই পরিস্থিতির মাঝে আজ এমন একজন রাজনীতিবিদ সম্পর্কে আলোচনা করবো, যিনি তিন-তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। একবার প্রতিমন্ত্রী ও হুইপের দায়িত্ব পালন করেছেন। আরও মজার তথ্য হলো, প্রত্যেকবারই তিনি এমপি হয়েছেন এমন সময়, যখন তার দল কিংবা জোট ক্ষমতায়। তার পরও এখন তিনি চলেন ভাড়া গাড়ীতে। তার নিজের কোনো গাড়ী নেই, ঢাকায় কোনো বাড়ি, প্লট কিংবা ফ্ল্যাট নেই। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দেওবন্দী ধারার আলেম ও মুফতি, যিনি সংসদ সদস্য-মন্ত্রী-হুইপের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস।

কওমি অঙ্গনের এই তপ্ত-উত্তপ্ত সময়ে মুফতি ওয়াক্কাস একটি আলোচিত নাম। হেফাজতে ইসলামের শীর্ষস্থানীয় যে কয়জন নেতা কারাবরণ করেছেন তিনি তাদের অন্যতম। তিনি একজন সাহসী অভিভাবক, বিদগ্ধ শায়খুল হাদিস ও শিক্ষাবিদ। মেধাবী, সৎ, স্পষ্টভাষী এবং অত্যন্ত আশাবাদী একজন মানুষ। সেই সঙ্গে তিনি অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী এক বটবৃক্ষ। যে বৃক্ষের সাহচর্যে থেকে অসংখ্য মানুষ জ্ঞান আহরণ করেছেন ও করছেন। তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এবং দেওবন্দী আদর্শে বিশ্বাসী আলেম। হক ও হক্কানিয়্যাত তার ধ্যানজ্ঞান।

সমকালীন সময়ে এটা অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায়, অনেক রাজনীতিবিদ সত্য কথা বলতে ভয় পান। কিন্তু তিনি নির্ভয়ে কথা বলেন। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে নীতি ও আদর্শে তিনি অটল। তিনি আমাদের মুফতি ওয়াক্কাস।

সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিষয় নিয়ে প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ ও আলেম কিছুটা বিরক্ত এবং হতাশ। একান্ত আলাপচারিতায় এ বিষয়ে তাকে আফসোস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। চলমান সময়ের অস্থিরতা নিরসনে তার ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে।
কথা ও ভাষায় কিছুটা কড়া স্বভাবের মুফতি ওয়াক্কাস কওমি সমাজের জন্য আলোকবর্তিকা। এমপি হিসেবে তিনি ছিলেন সব ধরনের লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে। এমপিদের বিরুদ্ধে কত রকমের অভিযোগ থাকে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কখনও কোনো অভিযোগ উঠেনি। এমনকি তার সময়কার অনেকে এমপি দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেছেন, সম্পদের হিসাব নিয়ে বিভিন্ন অফিসে হাজিরা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে মুফতি ওয়াক্কাস ব্যতিক্রম। তাকে এসব স্পর্শ করেনি। এই মহীরুহের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে রয়েছে তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছু।

মুফতি ওয়াক্কাস যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার বিজয়রামপুর গ্রামে ১৯৪৮ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। সংসারের কনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে মো. ইসমাইল মোড়ল-নূর জাহান বেগম দম্পতির স্নেহ একটু বেশিই পেয়েছেন। যেমন এখন পান সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও শাগরেদদের অবারিত শ্রদ্ধা।

স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখার সূচনা। শিক্ষাজীবনে তিনি যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তার রীতিমতো বিস্ময়কর। মাদরাসা বোর্ড থেকে দাখিলে (১৯৬৫) সম্মিলিত মেধা তালিকায় ৩য়, আলিমে (১৯৬৭) সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১ম, ফাজিলে (১৯৬৯) মাদরাসা বোর্ডে প্রথম শ্রেণিতে মেধা তালিকায় ৩য় ও কামিলে (১৯৭১) মাদরাসা বোর্ডে প্রথম শ্রেণিতে মেধা তালিকায় ৩য় স্থান অর্জন করেন। দাখিল পরীক্ষার অবসরে মাত্র ৩ মাসে কোরআনে কারিম হিফজ করেন। ১৯৭২ সালে মণিরামপুর মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাশ করেন।

এরপর মুফতি ওয়াক্কাস তার মুরুব্বি ও মুর্শিদ হজরত মাওলানা তজম্মুল আলী রহমাতুল্লাহি আলাইহির নির্দেশে দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করেন ও সেখানে ৪ বছর অধ্যায়ন করেন। ১৯৭৩ সালে ১ম বিভাগে মওকুফ আলাইহি, ১৯৭৪ সালে দাওরায়ে হাদিস (মেধা তালিকায় ৪র্থ), ১৯৭৫ সালে তাকমিল দ্বীনিয়াত (মেধা তালিকায় ১ম) ও ১৯৭৬ সালে ইফতা (মেধা তালিকায় ১ম) শেষ করে মুফতি সনদ লাভ করেন। সময়ের হিসেবে তিনি দেওবন্দে পড়াশোনার সময় শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও শিক্ষকদের পেয়েছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি শায়খ তজম্মুল আলী রহ. এর হাতে বায়াত হন এবং ১৯৮৪ সালে খেলাফত লাভ করেন।

দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দেশে ফিরে শায়খ তজম্মুল আলী রহ. এর পরামর্শে হেড মাওলানা হিসাবে লাউড়ী কামিল মাদরাসায় যোগ দিয়ে ২ বছর শিক্ষকতা করেন। পরে দারুল উলুম খুলনায় (১৯৭৮-১৯৮৬) ৮ বছর শায়খুল হাদিস, নাজেমে তালিমাত ও প্রধান মুফতির দায়িত্ব পালন করেন। মাঝে কিছুদিন ঢাকা মালিবাগের মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস ছিলেন। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত যশোরের জামেয়া এজাজিয়া রেলষ্টেশন মাদরাসার শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া নিজের প্রতিষ্ঠিত জামেয়া ইমদাদিয়া মাদানীনগরের মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস। ১৯৮২ সালে জামেয়া ইমদাদিয়া মাদানীনগর প্রতিষ্ঠা করেন মুফতি ওয়াক্কাস। ১৯৮৯ সালে এর বালিকা শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৫ সালে বালিকা শাখায় দাওরায়ে হাদিস এবং ২০০৩ সালে বালক শাখায় দাওরায়ে হাদিস চালু হয়। ২০০৯ সালে ইফতা ও ২০১৪ সনে আরবি বিভাগ খোলা হয়। প্রতিষ্ঠানটি দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রায় দুই হাজার ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়া করছে।

পাকিস্তান আমলেই শায়খ তজম্মুল আলী রহ. এর তত্ত্বাবধানে জমিয়তের রাজনীতিতে যুক্ত হন। বাহাদুরপুর কামিল মাদরাসায় পড়াশোনার সময় জমিয়তে তলাবায়ে আরাবিয়া বাহাদুরপুর শাখার ভিপি ছিলেন। স্বাধীনতার পর শায়খে কৌড়িয়া রহ. ও শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিুল হক রহ. জমিয়তের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে মুফতি ওয়াক্কাস খুলনা বিভাগে জমিয়তের নাজেমের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে দলমত নির্বিশেষে এলাকাবাসীর অনুরোধে স্বতন্ত্রপ্রার্থী (মটরগাড়ী প্রতীক) হিসেবে যশোর-৫ আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে বিপুল ভোটে সরকার দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করেন।

নির্বাচনে এলাকাবাসীর স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সম্পূর্ণ বিনাখরচে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যা রাজনীতিতে বিরল ঘটনা। পরে এলাকার উন্নয়নের কথা চিন্তা করে এলাকাবাসী ও জমিয়তের নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন মুফতি ওয়াক্কাস। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হন ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। নানা কারণে মন্ত্রিত্বের পদে বেশিদিন থাকা হয়নি। এর পর তিনি এরশাদ সরকারের শেষদিন পর্যন্ত জাতীয় সংসদের হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদ সরকারের পতনের পর মুফতি ওয়াক্কাস আবার সক্রিয় হন জমিয়তের রাজনীতিতে। ১৯৯১ সালে আরজাবাদ মাদরাসায় অনুষ্ঠিত জমিয়তের জাতীয় কাউন্সিলে তাকে সর্বসম্মতিক্রমে জমিয়তের মহাসচিব নির্বাচিত করা হয়।

মুফতি ওয়াক্কাস ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। তন্মধ্যে ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ২০০১ সালে যশোর-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদীয় কমিটি ১৯৯১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস বাংলাদেশ তথা ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। দল পরিচালনার নানা বিষয় নিয়ে জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতারা মতবিরোধে জড়িয়ে যান। ফলে ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি আলাদা কনভেনশন করে মুফতি ওয়াক্কাসকে জমিয়তের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

মুফতি ওয়াক্কাস রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন থেকে শুরু করে ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কাদিয়ানী বিরোধী আন্দোলনের মাইলফলক ১৯৯৪ সালের আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত আহুত মহাসমাবেশে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া মুসলিম পারিবারিক আইনে কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী ধারা বাতিল, এনজিওদের ধর্মান্তরের কাজের প্রতিবাদে হওয়া আন্দোলনেও তিনি বিশাল ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৯৫ সালে ‘ঈমান বাঁচাও দেশ বাঁচাও’ কমিটি এবং ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও নাজমুন আরা সুলতানার ‘সব ধরনের ফতওয়া নিষিদ্ধ’ রায়ের প্রতিবাদে সব ইসলামি দল নিয়ে গঠিত ‘ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি’র মহাসচিব ছিলেন মুফতি ওয়াক্কাস।

ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম অধ্যায়। ফতোয়া বিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে জন্ম নেওয়া সংগঠনটি কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী নারী উন্নয়ন নীতিমালা এবং সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর থেকে আস্থা ও বিসমিল্লাহ উঠিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এভাবে মুফতি ফজলুল হক আমিনী ও মুফতি ওয়াক্কাস হয়ে উঠেন বাংলাদেশের ইসলামি আন্দোলনের দুই মহীরুহ।

মুফতি ওয়াক্কাস ১৯৮৭ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে, ১৯৮৮ সালে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে দলনেতা হিসেবে হজপালন করেন। সেবার সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে তাকে বায়তুল্লাহ শরিফের মহামূল্যবান গিলাফ উপহার দেওয়া হয় এবং পবিত্র কাবা ঘরে প্রবেশ করে নফল নামাজ আদায়ের সুযোগ পান। এরপর তিনি আরও অনেকবার হজ-উমরা পালন করেছেন। রাষ্ট্রীয় কাজে সৌদি আরব, ইরাক, লিবিয়া ও মৌরিতানিয়া সফর করেছেন। এছাড়া ব্রিটেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত ও পাকিস্তান সফর করেছেন।

মুফতি ওয়াক্কাস ‘শরীয়তের আলোকে মুসলিম পারিবারিক আইন’ ও ‘ইসলামী আইন বনাম প্রচলিত আইন’ নামে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বই রচনা করেছেন।

২০১৩ সালে কথিত শাহবাগ জাগরণের নামে ধর্ম অবমাননা, আল্লাহ ও তার রাসূল সম্পর্কে কটূক্তি এবং কোরআন-হাদিস, আলেম-উলামা ও ইসলামি পোশাক নিয়ে বহুমুখী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এমতাবস্থায় হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীর আহবানে ২০১৩ সালের ৯ মার্চ হাটহাজারীতে বাংলাদেশের শীর্ষ আলেমরা উপস্থিত হন। গঠিত হয় অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।

মুফতি ওয়াক্কাস হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির নির্বাচিত হন। শুরু হয় ইসলাম অবমাননাকারীদের শাস্তির চেয়ে ১৩ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন। হেফাজতের ডাকে সভা-সমাবেশ, লংমার্চ (২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত হয়। হেফাজত আন্দোলনের কথা বিশ্ব মিডিয়ায় বিশেষভাবে জায়গা করে নেয়। অবশেষে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে এ আন্দোলন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। হেফাজত নেতাকর্মীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়, শুরু হয় জেল-জুলুম-মামলা হুঁলিয়া। অসংখ্য আলেম, মাদরাসার ছাত্র ধর্মপ্রাণ মানুষ গ্রেফতার হন। হেফাজত আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি ওয়াক্কাস ২০১৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর চৌধুরীপাড়া থেকে গ্রেফতার হন। তার বিরুদ্ধে রুজু হয় একে একে ২৪টি মামলা। দীর্ঘ ৯ মাস কারাভোগের পর ২০১৪ সালের ৯ জুন তিনি জামিনে মুক্তি পান।

আমি মুফতি ওয়াক্কাসের কাছের কেউ না। তার ছাত্র কিংবা দলীয় কর্মীও নই। তারপরও এটা নির্দ্ধিধায় বলতে পারি, আকাবিরদের অনুকরণে পরিচালিত দল জমিয়তের পেছনে তার অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর ক্ষমতাসীন দলের এমপি হয়েও তার ঢাকার মাথাগোঁজার ঠাঁই না থাকার কারণ তার সততা ও নিলোর্ভী মানসিকতা। আরজাবাদ মাদরাসায় পড়ার সময় খুব কাছে থেকে দেখেছি, খেয়ে না খেয়ে তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচি সফল করতে ব্যস্ত। সে ইতিহাস অন্য কোনো সময়।

চোয়াত্তরের বেশি বয়স তার। এই বয়সেও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং কওমি মাদরাসার সবোর্চ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হাইয়াতুল উলইয়ার কো-চেয়ারম্যান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। হাদিসের দরস, ওয়াজ-মাহফিল, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও ইসলামি মাহফিলে নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন। তার সাত সন্তানই দ্বীনী শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেছে। তিন ছেলেই দেওবন্দ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। মেয়েরাও দাওরায়ে হাদিস পাশ করে হাদিসের খেদমত করছে।

বয়সের ভার আর নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন গত ২০ মার্চ। অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি উম্মাহর প্রয়োজনে ছুটে চলেছেন। হাদিসের দরস, বেফাক-হাইয়ার মিটিং আর জমিয়তের কর্মসূচির মাঝে নিয়ম করে তাকে মামলার হাজিরা দিতে হয়েছে। এটা নিয়ে তার বিরক্তি ছিলো না।

হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের সিংহভাগই মামলা নিয়ে রাজনীতি ও প্রাত্যহিক সব কাজ করতে পারলেও এক্ষেত্রে মুফতি ওয়াক্কাস ব্যতিক্রম। কেন আইনের এমন বৈষম্য এর উত্তর তিনি খুঁজে পাননি। এরই মাঝে খবর পেলাম (৩১ আগস্ট রাতে) মুফতি ওয়াক্কাস কিছুটা অসুস্থ। মুফতি ওয়াক্কাসের জীবনের প্রথম নির্বাচনী লড়াইয়ের প্রতীক ছিল মটরগাড়ী। সেই মটরগাড়ীর নিয়ে একটি প্রবাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করবো।

প্রবাদে আছে, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ী-ঘোড়ায় চড়ে সে।’ আপনি একে একে সাতবার নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। মুফতি ওয়াক্কাস কে? মানুষকে এটা চেনানোর জন্য একবারও কোনো পোস্টারে আপনার ছবি দিতে হয়নি। এটাই প্রমাণ করে আপনার জনপ্রিয়তা। এখন তো অনেকে এমপি হওয়ার আগেই ছবি, পোস্টার, ব্যানার আর ফেস্টুনে ভরিয়ে ফেলে রাজপথ থেকে অলিগলি।

লোকে বলাবলি করে, এখন একবার এমপি হলে চৌদ্দ পুরুষের চলার ব্যবস্থা হয়ে যায়, সেখানে আপনি তিন বার এমপি হয়েছেন। কিন্তু এখনও ঢাকায় এলে আপনাকে থাকতে হয় কোনো না কোনো মাদরাসায়। এই যে আপনার ত্যাগ, এই যে আপনার মানসিকতা, আপনার আদর্শ-এটা এখনও বিলানো শেষ হয়নি। নববী আদর্শ আর দেওবন্দের যে মশাল আপনি বইছেন, সেটার বহন করার মতো মেরুদণ্ড এখনও আমাদের হয়নি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি, হাইয়াতুল উলইয়ার কো-চেয়ারম্যান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি ও সাবেক ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস আজ বুধবার ৩১ মার্চ ভোর ৪.৩০মিনিটে রাজধানী ঢাকার মহাখালী শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪বছর। তিনি ৩ ছেলে ও ৪ মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। জানাজার নামাজ আজ বাদ মাগরিব তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া ইমদাদিয়া মনিরামপুর, যশোরে অনুষ্ঠিত হবে।

লেখক: প্রধান ইসলাম বিভাগ, বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকম

এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর