শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


ঢাকা কলেজের অন্যরকম প্রিন্সিপাল: দ্বীনের পথে চলার অনিঃশেষ প্রেরণা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ওমর আল ফারুক
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ>

ঢাকা কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল প্রফেসর নূরুল হক মিয়ার ইন্তেকালের পরেই আমি তার ব্যাপারে সবিস্তারে জানার সুযোগ পাই। এর আগে তার ব্যাপারে অল্প-বিস্তর জানলে তার বৈচিত্রময় জীবনের প্রায় পুরোটাই ছিল আমার অজানা। এজন্যই হয়তো বলা হয়, কাদরুণ নিয়ামত বাদাজ্জাওয়াল। তার ইন্তেকালের পর বিভিন্ন পত্রিকায় তাকে তার জীবনের নানাদিক নিয়ে বেশকিছু লেখা আসে।

পত্রিকায় প্রকাশিত সেসব ফিচার পড়ে তার জীবনের অবাক হওয়ার মতো অনেক অজানা তত্ত্ব ও তথ্য সম্পর্কে জানতে পারি। এর আগে আমি শুধু এতটুকু জানতাম যে, হজরত শাইখুল হাদীস রাহমাতুল্লাহি আলাইহির এক জামাতা ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন।

ঢাকা কলেজের একজন রানিং স্টুডেন্ট হিসেবে ওই নিউজগুলো পড়ে আমি তার জীবন সম্পর্কে যতই জানছিলাম, ততই অবাক হচ্ছিলাম। একদিকে তিনি ছিলেন দেশের সবচেয়ে আধুনিক একটা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুনামধন্য জামাতা। তার ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের প্রতি দৃষ্টি দিলে তিনি যে শাইখুল হাদীসের জামাতা হওয়ার কতটা উপযুক্ত ছিলেন, তা খুব প্রবলভাবে নজেরে আসে। দ্বীন এবং দুনিয়ার এমন অভূতপূর্ব সমন্বয় খুব কম মানুষের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়।

দ্বীন এবং দুনিয়া বিষয়ে কিছু ভুল বুঝাবুঝি আমাদের সমাজে প্রায় প্রতিষ্ঠিত। আমাদের অনেকের বর্ণনা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাহ্যিকভাবে বুঝা যায় দ্বীন ও দুনিয়া যেন বিপরীতধর্মী কিছু। একটা গ্রহণ করলে আরেকটা যেন বর্জন করা অপরিহার্য। দ্বীন ও দুনিয়ার সুষম সমন্বয় সাধিত তার এই অনন্যসাধারণ জীবনযাবনের মধ্য দিয়ে সামজে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণার অন্তসারঃশূন্যতা প্রকাশিত এবং এতদুভয় সম্পর্কে ইসলামের অকৃত্রিম দৃষ্টিভঙ্গি সুচারুরূপে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

যখন জানলাম ঢাকা কলেজের ইতিহাসে তিনিই প্রথম প্রিন্সিপাল যিনি আপাদমস্তক একজন হুজুর। তখন তাকে জানার আগ্রহের সাথে সাথে হৃদয়ে গভীর শ্রদ্ধা ও গর্ব অনুভব করলাম। আমাদের দেশে বিনোদন ও খেলা-বিষয়ক নিউজের অভাব না থাকলেও ভালো মানুষের জীবনের ইতিবাচক অভিজ্ঞতা তুলে ধরার মতো কার্যক্রম খুবই অপ্রতুল। আর ওই ব্যক্তিটি যদি ইসলাম-ঘেষা হয়, তা হলে তো কোনো কথাই নেই। এজন্যই দেশের উলামায়ে কেরামের ইতিবাচক কাজগুলোর আলোচনা অনলাইনে নেই বললেই চলে। সঙ্গত কারণেই ঢাকা কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল প্রফেসর নূরুল হক মিয়া সম্পর্কে অনলাইনে আমি খুব বেশি তথ্য পাইনি।

তার ইন্তেকালের পর জাতীয় দৈনিকসহ বেশ কিছু ইসলামি নিউজ পোর্টাল প্রাথমিক পরিচিতি ও ব্যক্তিজীবন তুলে ধরার প্রয়াস পায়। এমন কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসলামি নিউজ পোর্টালগুলোর উপযোগিতা খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। মিডিয়ায় ইসলাম-বৈরিতার এই সময়ে এসব পোর্টাল আমাদের যথেষ্ট কাজে আসে।

ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন খুবই সাদাসিদে। সহজ-সরল। তার এই সহজ-সরল জীবন-যাপন তার ক্যারিয়ারের পথের অন্তরায় ছিল না। বরং জীবন ও জগৎ বিষয়ক উচ্চাকাঙ্খা না-থাকায় শিক্ষকতায় একান্ত আত্মনিয়োগ করা তার জন্য সহজ হয়েছিল। তিনি দেশের নামকরা সব বিদ্যাপীঠে অধ্যাপনা করেছেন। তার শিক্ষকতার প্রথম দিকের সময়ে রসায়ন বিষয়ে তার লেখা বইপত্র ছিল ছাত্রদের কাছে বিকল্পহীন আশ্রয়। দুহাজার সালের আগে তার লেখালেখিই ছিল লাগাতার বেস্ট সেলার। ওই সময়ে রসায়নে তার চেয়ে জনপ্রিয় লেখক আর কেউ ছিল না।

হজরত শাইখুল হাদীস রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই পরশ পাথর। তার সোহবত অসংখ্য মানুষের জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছে। তাদের মধ্যে আমাদের এই সাবেক প্রিন্সিপাল সাহেব অন্যতম। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে আজীবন তিনি দাওয়াতে তাবলিগের সাথে যুক্ত ছিলেন। সারা বছর অধ্যাপনার কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি চিল্লায় যাওয়ার জন্য রমজানের সময়কে বেচে নিতেন। রিটায়ার্মেন্টের পর অনেক অফার আসলেও দাওয়াতে তাবলিগে সংযুক্ত থাকার জন্য তিনি সেসব অফার প্রত্যাখান করেন।

তার পরিবারেও তিনি সম্পূর্ণ দীনি পরিবেশ তৈরি করেন। তার দুই ছেলে এবং ছয় মেয়ের প্রত্যেকে হাফেজে কুরআন। দ্বিতীয় প্রজন্মসহ তার ফ্যামিলিতেই রয়েছে পঁচিশ জন হাফেজ-হাফেজা। তিনি নিজে আধুনিক শিক্ষিত হয়েও পরিবারের সবাইকেই হাফেজ-আলেম বানানোসহ দ্বীনের পথে অটল রাখবার এইযে প্রাণান্তক প্রচেষ্টা, তা শুধু আধুনিক শিক্ষিত মানুষ নয়; ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষদেরও অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

তিনি ছিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল। চাইলেন তিনি ভারমুক্ত হতে পারতেন। কিন্তু রকমারি তদবির করতে হবে বলে তিনি সে পথে আগাননি। সরকারি চাকরিজীবীরা যে সব সুবিধা গ্রহণ করে, তিনি তার কোনোটাই গ্রহণ করেননি। তিনি সরকারি গাড়ি নেননি। পায়ে হেঁটে কলেজে আসতেন। সরকারি বাড়ি নেননি। নিজের বাসায় থাকতেন। এমনকি সরকারি ফোন পর্যন্ত তিনি ব্যবহার করেননি। এভাবে দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকুরিজীবী হয়েও তিনি জুহদ ও তাকওয়ার এক অনতিক্রমণ্য উপমা তৈরি করে যান।

আমরা যারা মাদরাসা ব্যগ্রাউন্ড থেকে বিলং করি, তাদের জন্য জগতের চাকচিক্য এবং কথিত আধুনিক শিক্ষা ছেড়ে আসা যতটা সহজ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন প্রফেসারের জন্য বিষয়টা মোটেও এত সহজ নয়। কারণ তার সাথি-সঙ্গী এবং বন্ধু-বান্ধব সবাই তো দুনিয়াবি শিক্ষায় শিক্ষিত। তার সন্তানদের সবাইকে মাদরাসা লাইনে শিক্ষিত করতে দিলে অনেকের কথাই তাকে শুনতে হয়। কিন্তু এসবের তিনি থোড়াই কেয়ার করতেন। তিনি মানুষের যাবতীয় কানকথা উপেক্ষা করে সারাজীবন নিজে দ্বীনের পথে অটল থেকেছেন এবং পরিবারের সবাইকে এ পথেই পরিচালিত করেছেন। আশার কথা হলো, তার ফ্যামিলির প্রতিটি সদস্যের মন-মনন গড়ে উঠছে তারই মানসা মোতাবেক। এ পরিবারের প্রতিটি সদস্যই তাই ইসলামের রঙে রঙিন। ওহির আলোয় আলোকিত সবার জীবন।

তার জীবনের প্রতিটি বাকঁ নিজস্ব অনন্যতায় স্বাতন্ত্রমণ্ডিত। আমাদের এই প্রিন্সিপাল তাই আর দশজন প্রিন্সিপালের থেকে জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই আলাদা। প্রিন্সিপাল হয়ে ধরাবাঁধা নিয়ম মেনে চলার যে নিয়ম চলে আসছিল, তিনি তাতে নিজের মতো করে অনেক নিয়ম সংযোজন করেন। পথ না থাকলে পথ করে নিতে হয়। তার সহজ-সরল অথচ মহাজাগতিক লক্ষ্যে অবিচল জীবনযাপন আমাদের আটপৌরে জীবনের পাথেয় হিসেবে কাজ করবে।

তিনি হয়তো খুব বেশি বৈভব রেখে যাননি; তবে সবার জন্য রেখে গেছেন এক অনুপম আদর্শ। সরল-সঠিক-পূণ্য-পন্থায় অবিচল থাকার অনিঃশেষ প্রাণনা।

‘মেরা তরিক আমিরি নেহি; ফকিরি হ্যায়
খুদি না বেচ; গরিবি মে নাম পয়দা কার’
বিত্ত নয়; দুনিয়াবিমুখতাই আমার পথ
হৃদয় বেচো না; দারিদ্রেই সুনাম অর্জন করো।

ওআই/আবদুল্লাহ তামিম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ