বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


রসিকতা হোক পরিমিত

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

উসমান বিন আ.আলিম।।

মানুষের মনকে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজন আনন্দময় জীবন। আর আনন্দময় জীবনের জন্য প্রয়োজন হাস্য-রসিকতা। জ্ঞানীরা বলেন, আনন্দ ও চিত্ত বিনোদন মানুষকে জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে সহায়তা করে এবং এর মাধ্যমে পার্থিব বিষয়ে অনেক সাফল্য পাওয়া যায়।

আজকাল মনোবিজ্ঞানীরাও মানুষের সুস্থতার জন্য আনন্দ ও চিত্ত-বিনোদনকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন।তবে এটা যেকোন ব্যক্তির সাথে হতে পারে; ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-পড়শীরসহ যেকোন ব্যক্তির সাথে।একজনের হাস্যোজ্বল বা রসিকতাপূর্ণ চেহারা একজন গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারাটাও আনন্দময় হয়ে ওঠে।এককথায় একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকার জন্য রসিকতার প্রয়োজনীয়তা অন্যরকম।এ রসিকতা করতে কোনও বাধা নেই। অন্তত স্বভাবধর্ম ইসলাম মানবপ্রকৃতির এ প্রবণতায় বাধ সাধে না। তবে হাঁ, ইসলাম যেহেতু ভারসাম্যের ধর্ম এবং সব কিছুতে পরিমিতিবোধ ও মাত্রাজ্ঞানের তালিম তার অনন্য বৈশিষ্ট্য, তাই এখানেও তার শিক্ষা হল, তুমি রঙ্গ-রসিকতা কর ঠিক আছে, কিন্তু সাবধান মাত্রা ছাড়িয়ে যেও না। সীমার মধ্যে থাকার চেষ্টা কর। অর্থাৎ রসিকতার অনুমতিও দিয়েছে, ক্ষেত্রবিশেষে উৎসাহও দিয়েছে, কিন্তু বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করতে নিষেধ করেছে।

রসিকতা করার অনুমতি যে ইসলামে আছে, তার বড় প্রমাণ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই।আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি কখনও কখনও রসিকতা করেছেন। হাদীসগ্রন্থসমূহে এর একাধিক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

যেমন, হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. বর্ণনা করেন যে, একবার এক ব্যক্তি এসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একটা 'বাহনজন্তু' চাইল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ, আমরা তোমাকে একটা উটনীর বাচ্চা দেব। লোকটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি উটনীর বাচ্চা দিয়ে কী করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আরে উটেরা সব উটনীদেরই বাচ্চা নয় কি? (-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৯৮)

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ জাতীয় রসিকতার ঘটনা আরও আছে। একটা ঘটনা বড় চমৎকার রয়েছে যা না বললে নয়।সেটি হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, যাহির নামক এক গ্রাম্যবাসী সাহাবী গ্রামের বিভিন্ন জিনিস নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাদিয়া দিতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে শহরের বিভিন্ন জিনিস দিয়ে বিদায় করতেন। তিনি বলতেন, যাহির হল আমাদের গ্রাম, আমরা তার নগর। তিনি তাঁকে খুবই ভালবাসতেন। তো একদিনের কথা। হযরত যাহির রা. বাজারে তার পণ্য বিক্রি করছিলেন। এ অবস্থায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে উপস্থিত।

তিনি পেছন দিক থেকে প্রিয় সাহাবীকে জড়িয়ে ধরলেন। হযরত যাহির রা. তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি (বিরক্ত হয়ে) বলে উঠলেন, এই কে? আমাকে ছেড়ে দাও। তারপর পেছন ফিরে তাকালেন। দেখলেন তিনি যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। (প্রিয় নবীর এ রসিকতা যে তার বুকের ভেতর ভালোবাসার কি ঝড় বইয়ে দিয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং সে ঝড়ের কবলে তিনি নিজেকে সঁপেই দিলেন)। কালবিলম্ব না করে নিজেকে আরও পেছন দিকে নিয়ে যেতে থাকলেন। এভাবে একদম সেঁটে গেলেন পরম প্রিয়ের বুকের সাথে। নবীজীও তাঁকে বুকে ধরে রাখলেন। তারপর রসিকতার মাত্রা যোগ করলেন। বললেন, কে কিনবে? এই গোলামটি বিক্রি করব। হযরত যাহির দেখতে সুশ্রী ছিলেন না। বলে উঠলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! দাম সস্তা হবে।আমাকে কেউ কিনতে চাবে না। প্রিয় নবী (সান্ত¡না দিলেন এবং আসল কথাটিই) বললেন, কিন্তু আল্লাহর কাছে তুমি সস্তা নও। তাঁর কাছে তোমার দাম অনেক। (শামায়েলে-তিরমিজি; ২৩০)

অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে; রাসুল সা.-এর কাছে এক বৃদ্ধা এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন তিনি আমাকে জান্নাত দান করেন। তখন রাসুল (সা.) (রসিকতা করে) বলেন, ‘হে অমুকের মা! কোনো বৃদ্ধা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এই কথা শুনে বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যাচ্ছিলেন। তখন রাসুল (সা.) সাহাবাদের বললেন, তাকে গিয়ে বলো- বরং সে যুবতী ও চিরকুমারী হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস : ২৪১)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও রসিকতা করতেন, যেমনটা পূর্বে বলা হয়েছে, কিন্তু তার রসিকতায় মিথ্যার কোন ছোঁয়া থাকত না। একবার তো সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্নই করে বসলেন যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যে আমাদের সাথে রসিকতা করেন (অথচ এক হাদীসে আপনি আমাদেরকে এটা করতে নিষেধ করেছেন)? তিনি বললেন, হাঁ, তবে আমি (রসিকতাচ্ছলেও মিথ্যা বলি না) কেবল সত্যই বলি। (জামে তিরমিযী, ১৯৯০)

তাঁর প্রতিটি রসিকতার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে মিথ্যার লেশমাত্র নেই। যেমন একবার তিনি হযরত আনাস রা.-কে বলেছিলেন, ‘ওহে দু’কানওয়ালা’! (শামায়েলে তিরমিজি-হাদীস ২৩৫)

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আমাদের সমাজে এরকম অনেক ব্যক্তিকে দেখা যায়,যারা এই রসিকতাকে সামনে রেখে কতো মিথ্যা-বানোয়াট কথা বলে ফেলে।যা কখনো একজন মোমেনের জন্য শোভনীয় নয়।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সা. বলেন, ‘ইচ্ছা বা কৌতুক কোনোভাবেই মিথ্যা গ্রহণযোগ্য হয় না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪৬)

অন্য এক হাদীসে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন মানুষকে হাসানোর জন্য যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস, তার জন্য ধ্বংস। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৯০)

অর্থাৎ এই মিথ্যা আপনাকে পাপের দিকে নিয়ে যায়,আর এই পাপ আপনাকে জাহান্নামে ঠেলে দিবে।হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে,‘তোমরা মিথ্যা পরিহার করো। কেননা মিথ্যা পাপের পথে পরিচালিত করে। আর পাপ মানুষকে জাহান্নামে পৌঁছে দেয়।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৯৭১)

আবার আমরা দেখতে পাই আল্লাহর রাসুল (সা.) অনেক সময় ছোট শিশুদের সঙ্গেও মজা করতেন। যেমন, হজরত আনাস (রা.) বলেন মহানবী (সা.) আমাদের সঙ্গে অবাধে মিশতেন। এমনকি তিনি আমার ছোট ভাইকে কৌতুক করে বলতেন- ‘আবু উমায়ের কী করে নুগাইর।’ অর্থাৎ তোমার নুগাইর পাখিটার কী অবস্থা? আবু উমায়েরের খেলার পাখিটা মারা গেলে সে অনেক কষ্ট পায়। তাই তার মনোরঞ্জনের জন্য রাসুল (সা.) তাকে সান্ত¡না দেওয়ার জন্য পাখিটির অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করেন। এভাবে রাসুল কারিম (সা.) তার সঙ্গে কথা বলার কারণে তার দুঃখ দূর হয়, সে আনন্দ পায়।(শামায়েলে তিরমিজি-২২৮)

তবে শিশুদের সঙ্গে আমাদের রসিকতা করতে গিয়ে মিথ্যা বা এরকম কোন রসিকতা করা যাবেনা যার দ্বারা বাচ্চারা ভুল শিক্ষা পায়।সমাজে অনেককে দেখা যায়,যারা শিশুদের সঙ্গে রসিকতা করে কাছে ডাকতে গিয়ে বিভিন্ন কিছু দেব বলে, কিন্তু দেখা যায় কিছু দেওয়া হয় না। তাই এটা ধোঁকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ইসলামে নিষিদ্ধ। এতে প্রথমত ধোঁকার গুনাহ হয়। দ্বিতীয়ত এই শিশুটি একটা অনৈতিক শিক্ষা পায়। রাসুল (সা.) বলেন,‘যে ব্যক্তি কোনো শিশুকে ডাকল, এদিকে এসো! (কিছু দেওয়ার জন্য) অতঃপর তা দিল না, তবে তা মিথ্যা।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৯৮৩৬)

তাই হাসি-মজা বা রসিকতা হতে হবে সম্পূর্ণ মিথ্যাহীন ও ধোঁকামুক্ত। মআবার অনেককে দেখা যায়,কমেডি করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি কিংবা জাতি-গোষ্ঠীকে ট্রল করে বসে। যা ইসলামে নিষিদ্ধ। একদিন আয়েশা (রা.) হাসির ছলে নবী (সা.)-কে জনৈক ব্যক্তির চালচলন নকল করে দেখালেন। রাসুল (সা.) তাতে বিরক্তি প্রকাশ করেন। (তিরমিজি, হাদিস : ২৫০২)

এর দ্বারা বুঝা যায়, আপনি রসিকতা করতে পারবেন, রসিকতা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়,তবে সেই রসিকতার মধ্যে কোন ধরনের মিথ্যা থাকতে পারবেনা। কাউকে কষ্ট বা কোন ব্যক্তি বিশেষকে উদ্দেশ্য করে রসিকতা করা যাবেনা। এতে সেই ব্যক্তি কষ্ট পায়।

মোটকথা, রসিকতাকে সব রকম ক্ষতি থেকে রক্ষা করে সুফলদায়ী করে তোলার জন্য কর্তব্য, স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় রেখে ভাষা, পরিমাণ বিষয়বস্তু ধরণ-ধারণ ইত্যাদিতে পরিমিতিবোধের পরিচয় দেওয়া।

অন্যথায় এরকম ইসলাম সমর্থিত সুন্দর একটা জিনিস আপনার জন্য জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়া’লা আমাদেরকে সঠিক বুঝার ও সঠিকভাবে আমল করার তৌফিক দান করুক আমিন।

লেখক গবেষক, মোহাদ্দেস, দারুলউলুম মোহাম্মদপুর কওমী মাদ্রাসা, চাটমোহর, পাবনা।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ