মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫


আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আমাদের করণীয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী।।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দান। কবি ফররুখ আহমদ গানে গানে বলেছেন- “ও আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা
খোদার সেরা দান
বিশ্বভাষার সবই তোমার
রূপ যে অনির্বাণ।”

প্রত্যেক জাতিরই কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য আছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের যে এক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন, তা হল আমাদের নিখাদ মাতৃভাষা প্রীতি। ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেয়া, এভাবে রক্ত দিয়ে ভাষার প্রেমকে কালজয়ী করা যেন মাতৃপ্রেমেরই জ্বলন্ত প্রকাশ। মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- ‘আমি কোনো নবীই এমন পাঠাইনি, যে তাঁর জাতির মাতৃভাষায় আমার বাণী তাদের কাছে পৌঁছায়নি, যাতে করে সে তাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারে।’ (সূরা ইবরাহীম, আয়াত নং-৪)।

১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের অর্জন যে বিশ্বের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন এটা আজ আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। জাতিসংঘের অন্যতম অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কো আমাদের ভাষা আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর সব দেশেই উদযাপিত হচ্ছে নিজ নিজ মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলা দাবি করায় তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক যাদের শহীদ করা হলো তারা হলেন- রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত প্রমুখ। আমাদের জানা মতে, তারা সবাই ছিলেন মুসলিম, যাদের নাম আমরা অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করে থাকি, এরা মুসলিম ও মজলুম হওয়ার কারণে আমরা তাদের শহীদ হিসেবে অভিহিত করে থাকি। শুধু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে সন্তুষ্ট করার জন্য জীবন দিলে বা মজলুম অবস্থায় ঘাতকের হাতে কোনো মুসলিম জীবন দিলেই কেবল তাকে ইসলামী পরিভাষায় শহীদ বলা হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের ভাষা আন্দোলনের এ কৃতী সন্তানরা শহীদ, আর তাই তাদের স্মরণে যে স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হল তাকে ‘শহীদ মিনার’ বলে থাকি।

গোটা বাংলাদেশে আনুমানিক হাজারদশেক শহীদ মিনার আছে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে দু’একটা শহীদ মিনার গড়ে উঠেনি। ভাষাকে নিয়ে এ ধরনের নজির পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই, কখনওই ছিল না। কিন্তু নবীর সবচেয়ে বড় ওয়ারিশ আমাদের দেশের জনসাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র ওলামায়ে কিরাম এ ভাষা দিবস উদযাপনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছেন না, এটি একটি অস্বস্তির বিষয়। কত সাধারণ কারণে ও তুচ্ছ ঘটনায় নিহতদের স্মরণে আমাদের ওলামায়ে কিরাম কুরআনখানি, মিলাদ মাহফিল, দোয়া-মোনাজাত করে থাকেন। কিন্তু ভাষা শহীদদের জন্য কি আমাদের ওলামায়ে কিরাম এমনটি করতে পারেন না? এ শহীদদের ত্যাগ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তাই আমাদের সকলের উচিত কুরআনখানি, আলোচনা সভা, দোয়া ও মুনাজাত করে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করা। আমাদের ভাষা শহীদরা তাদের টগবগে যৌবনকে বিসর্জন দিয়ে, ইহকালীন সব ভোগ-বিলাসকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আমাদের প্রিয় বাংলাভাষার জন্য তাজা জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাই তারা আমাদের সম্মানিত ওলামায়ে কিরাম ও মুসলমানদের দোয়া পাওয়ার যোগ্য।

যদি আমরা ভাষাদিবস উদযাপনের প্রতীকী দিকগুলোকে শরিয়ত গর্হিত কাজ বলে এর প্রতি অনাগ্রহ দেখান, তাহলে বলবো এর জন্যও আমাদের ওলামায়ে কিরামই দায়ী। কেননা ভাষা শহীদদের প্রাপ্য পরিশোধে ওলামায়ে কিরামের অমনোযোগী হওয়ার সুযোগে শূন্য ময়দানে শরিয়ত গর্হিত কাজগুলো স্থান করে নিয়েছে। অথচ আমরা আমাদের মৃত পূর্ব পুরুষদের জন্য ঠিকই কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত, দোয়া ইত্যাদি করে থাকি। পক্ষান্তরে ভাষা শহীদদের প্রতি জুলুম করেই যাচ্ছি। যা তাদের সঙ্গে একরকম বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। আমাদের ভাবতে হবে পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরাম মাতৃভাষার জন্য কী অবদান রেখে গেছেন। এ ব্যাপারে মরহুম মাওলানা আকরাম খাঁর কথা গর্বভরে উচ্চরণ করা যায়। তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সফল করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন। তাছাড়া হজরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. ও ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। সুতরাং আমাদের ওলামায়ে কিরাম ভাষা শহীদদের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবেন এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।

পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশের সব শহীদ মিনারে কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও মুনাজাত ইত্যাদি অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়া উচিত। আমাদের দেশের সব সরকার প্রধান তাদের আপনজনদের জন্য কুরআন তিলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল ও দোয়া-মুনাজাত ইত্যাদির মাধ্যমে মাগফিরাত কামনা করে থাকেন। তবে ভাষা শহীদদের মাগফিরাতের জন্য অবশ্যই এসব কাজে সরকার প্রধান সহযোগিতা করবেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম এ দেশের ওলামায়ে কিরামকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বিশ্বাস দেশের শহীদ মিনারগুলোতে একবার পবিত্র কুরআনুল কারিমের আওয়াজ তুলতে পারলে তা প্রতি বছরই চলতে থাকবে এবং তা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা লাভ করবে। সমর্থন বাড়বে সাধারণ মানুষের এবং তারাও এ মহৎ কাজে শরিক হবেন। গোটা দেশ একসঙ্গে পবিত্র কুরআন মাজিদের সুর তুলবে।

এভাবেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সত্যিকার চেতনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এ ছাড়াও আমাদের ওলামায়ে কিরাম ভাষা শহীদদের জন্য সাওয়াব রেসানিমূলক অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন। মাতৃভাষা দিবসে দেশের প্রতিটি মাদ্রাসায় মাতৃভাষার ওপর আলোচনা সভা, রচনা প্রতিযোগিতা ও ইসলামী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করা যেতে পারে। বস্তুত মহান ভাষা আন্দোলন ও মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পেছনে যে সত্যিকার চেতনা তার বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত বাংলাদেশ ও তার ১৮ কোটি মানুষের নাজাতের মহামন্ত্র। ভাষাদিবসকে নিয়ে বাড়াবাড়ি বা অপসংস্কৃতি যেমন কাম্য নয়, তেমনি কাম্য নয় গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে প্রতিহত করাও।

পরিশেষে এ দেশের ওলামায়ে কিরামের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আসুন না এ দেশের জনগণের ভালোবাসার প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে দেশের সব শহীদ মিনারে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শহীদদের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে মাগফিরাত কামনা করি। তবে সাধারণ মুসলমান বিভিন্ন ইসলাম গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকতে উৎসাহবোধ করবেন এবং সর্বক্ষেত্রে ওলামায়ে কিরামের নেতৃত্ব মেনে নিতে আগ্রহ দেখাবেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সেই তওফিক দান করুন আমিন!

লেখক: আলেম, প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক্র

-এএ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ