বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১০ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫


নেট মানে জাল, জাল মানে ফাঁদ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ
লেখক ও মাদানী নিসাবের প্রবর্তক

বহু পাঠক আমার এ লেখা পড়বে কালো কালির হরফে! কিছু পাঠকের জন্য আমার এ লেখা অশ্রুর নোনা হরফে! আর খুব সামান্য ক’জন পাঠকের জন্য আমার এ লেখা হলো হৃদয় থেকে ঝরা রক্তের আঁচড়ে! তবে সবার কাছে আমার একটি মিনতি, এ লেখার যে বার্তা ও পায়গাম তা যেন হৃদয় দিয়ে সবাই অনুভব করে এবং পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মুসাফিরের মত গ্রহণ করে, যে বুঝতে পারে না, কোনটি তার পথ! কোন পথ তাকে নিয়ে যাবে সঠিক গন্তব্যে, আর কোন পথের শেষে রয়েছে ধ্বংসের খাদ! এটা অস্বীকার করার উপায় নেই এবং আমরা অস্বীকার করিও না যে, আজকের যুগ প্রযুক্তির অখণ্ড প্রতাপ ও প্রতিপত্তির যুগ।

বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ এখন প্রযুক্তির হাতে! যদি বলি, মানবজাতি আজ প্রযুক্তির হাতে বন্দী, অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না। প্রযুক্তির বিস্তার এখন শুধু জীবনের বাইরে এবং জীবনের চারপাশে নয়, বরং জীবনের ভিতরে এবং জীবনের গভীরে। যদি বলি, জীবনের যতটা গভীরে মানুষের সবচে’ নিকটজনেরও প্রবেশাধিকার নেই, মানুষের তৈরী প্রযুক্তি সেখানেও পৌঁছে যায় সহজে এবং অবাধে; যদি বলি, ভুল হবে না। মা-বাবা নিজেও জানেন না, প্রযুক্তির স্রোতে তাদের সন্তান কোথায় ভেসে চলেছে! শিক্ষকের জানা নেই, ছাত্রের জীবন, চিন্তা, চেতনা ও গতিবিধি কতটা তাঁর নিয়ন্ত্রণে, আর কতটা প্রযুক্তির দখলে! এপর্যন্ত সম্ভবত কারোই দ্বিমত প্রকাশ করার অবকাশ নেই। কারণ এটা তো চোখের দেখা উন্মুক্ত সত্য এবং জীবনের অঙ্গনে ঘটে যাওয়া নির্মম বাস্তবতা!

আলোচনার জটিল মোড় শুরু হয় এখান থেকে যে, জীবনের জন্য প্রযুক্তি উপকারী না ক্ষতিকর? কল্যাণের পথ না ধ্বংসের গহ্বর?
প্রযুক্তির যাত্রা তো শুরু হয়েছে বহু যুগ আগে। জীবনের সুযোগ সুবিধা, আরাম আয়েশ ও আনন্দ-বিনোদনের যাবতীয় আয়োজন; জীবনের গতি ও গতিবিধির ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টিকারী যাবতীয় উপায় উপকরণ, এমনকি যুদ্ধের ভয়াবহ বিস্তারে এবং মারণাস্ত্রের বিশ্ববিধ্বংসী শক্তির উদ্ভবের পিছনেও রয়েছে প্রযুক্তির ‘দান ও অবদান’।

তবে এসব কিছুকে ছাড়িয়ে প্রযুক্তি এখন এগিয়ে গিয়েছে আরো বহু দূর। সুতরাং প্রযুক্তির এই সব ‘পিছনে ফেলে আসা’ বিষয় নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। আজকের যুগে প্রযুক্তির উন্নতি ও অগ্রগতির সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে মোবাইল, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আমার বর্তমান আলোচনার বিষয়ও এটাই। এ প্রশ্নেরই আমি আজ মুখোমুখি হতে চাই, স্মার্টফোন উপকারী, না ক্ষতিকর? ইন্টারনেটের ব্যবহার কল্যাণকর, না বিপর্যয় সৃষ্টিকারী? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবিধা গ্রহণ আমাদের উন্নতির পথে নিয়ে যায়, না ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে?

এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানতে চাই শুধু তাদের কাছে, বিবেক যাদের এখনো জীবিত এবং জীবন্ত; নীতি ও নৈতিকতা এবং চরিত্র ও হৃদয়বৃত্তি এখনো যাদের কাছে মূল্যবান; সর্বোপরি নতুন প্রজন্মের, আজকের তরুণশক্তির শিক্ষা-দীক্ষা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সত্যি সত্যি যারা চিন্তিত ও বিচলিত; আমার প্রশ্ন শুধু তাদের কাছে।

বিষয়টা আমাকে সবচে’ বেশী বিচলিত করেছিলো সেদিন যখন একটা বহুজাতিক সংস্থার বিজ্ঞাপন দেখি, যার ভাষা ছিলো- ‘ইন্টারনেট এখন আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দোরগোড়ায়! ইন্টারনেটের পথ ধরে জ্ঞানের সীমাহীন রাজ্যে প্রবেশ করুন এবং উপভোগ করুন।’ আরেকটা বিজ্ঞাপন ছিলো এরকম- ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সমস্ত দূরত্বকে সাগরে নিক্ষেপ করেছে, সবাইকে এত নিকটে নিয়ে এসেছে যে, ঘরে বসেও হাত বাড়িয়ে আপনজনকে পেতে পারেন আপনার পাশে।’

বলাবাহুল্য, সামাজিক প্রযুক্তির পক্ষে এ বিজ্ঞাপন ছিলো সত্যের অর্ধেক; বাকি অর্ধেকটা বাণিজ্যিক মুনাফার লোভে গোপন রাখা হয়েছে সযত্নে। কিন্তু সত্য তো সত্যই! সত্যের প্রকৃত চেহারা গোপন করার সাধ্য নেই কারো, বরং গোপন করে রাখার অপরাধে সত্য একসময় এমনভাবে ফুঁসে ওঠে যে, তার ভয়াবহ বাস্তবতা সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটেছে। পানি যখন মাথার উপর দিয়ে চলে গিয়েছে তখন কিছুটা যেন হুঁশ হয়েছে জাতির চিন্তাশীল সমাজের।
দ্বিতীয়বার বিচলিত হলাম ঠিক একই মাত্রায় যখন একটি প্রচারপত্র দেখলাম, ‘অন্তত আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত স্মার্টফোন থেকে আপনার সন্তানকে দূরে রাখুন…।’

তারপর কী হবে তা অবশ্য বলা হয়নি এবং বলা হয়নি একথাও যে, ঘরে আমাদের সন্তান এবং বিদ্যালয়ে আমাদের ছাত্ররা কি এখন আমাদের এতটা নিয়ন্ত্রণে আছে! আসল সত্য কি এ নয় যে, মা-বাবা ও শিক্ষক, আমরা সবাই এখন আগামী প্রজন্মের হাতে অসহায় যিম্মী?! তরুণ-শক্তির ধ্বংস ও বরবাদির নীরব সাক্ষী?! আরেকটি প্রচারপত্র সম্ভবত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে- ‘ফেসবুক- আসক্তি মাদকাসক্তির চেয়ে ভয়াবহ; সর্বশক্তি ব্যবহার করে তরুণ-প্রজন্মকে এ ভয়াবহতার হাত থেকে রক্ষা করুন!’ ভালো কথা! কিন্তু কীভাবে, কোন্ উপায়ে তাদের রক্ষা করা হবে, তা তো বলা হয়নি?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মহা আলোড়ন সৃষ্টিকারী ব্যক্তি স্বীকার করেছেন, ফেসবুক-সহ প্রতিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে! আমাদের স্বপ্ন, আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের প্রতিটি সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’
বাস্তবতার বড় তিক্ত স্বীকারোক্তি! কিন্তু কথা হলো, সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর এ স্বীকারোক্তির ‘বাজারমূল্য’ কতটুকু?!
আরো নির্মম রসিকতা করেছেন, গুগলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত ফেইসবুক থেকে তরুণ-তরুণিদের অবশ্যই দূরে রাখা আমাদের কর্তব্য। আমি তো আমার ভাতিজাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছি ফেসবুকের ত্রিসীমায় প্রবেশ করতে?!’ ভালো কথা, কিন্তু আমরা যা মনে করি, আমাদের ‘ভাতিজারা’ কি তা মনে করে? আমাদের ‘কঠোর নিষেধাজ্ঞা’ তারা কি মানতে প্রস্তুত? যতই আমরা আত্মপ্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করি, নির্মম বাস্তবতা এই যে, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অনলাইন এক্টিভিটিজ হচ্ছে বোতল থেকে বের হওয়া সেই দৈত্য যাকে বোতলে ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব নয়; সবকিছু ধ্বংস করে, সবকিছু ছারখার করে তারপরই হয়ত ক্ষান্ত হবে এ দৈত্য। কিংবা এটা হচ্ছে বিপথগামী প্রতিভা ফ্রাঙ্কস্টাইনের সেই অপসৃষ্টি যা নিজের স্রষ্টাকেই সংহার করতে উদ্যত!

অসহায়ভাবে নিজেদের কর্মফল প্রত্যক্ষ করা ছাড়া সম্ভবত এখন আমাদের কোন উপায়ও নেই; শুধু এই যে, বিশ্বজাহানের স্রষ্টা, মানবজাতির স্রষ্টা রাব্বুল আলামীন যদি মানবজাতির রক্ষার কোন উপায় করে দেন। হতাশার চোরাবালিতে আটকে গিয়ে এখন আমরা সর্বান্তকরণে কামনা করি, মহান করুণাময় তাই যেন করেন! এবার আমার আলোচনার বিষয় হলো দ্বীনী মহল ও মাদরাসাপ্রাঙ্গণ। আলেম সমাজের তরুণ প্রজন্ম, তাদের উদ্যম, উদ্দীপনা, তাদের উষ্ণ রক্ত ও তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে আমি শ্রদ্ধা করি। কারণ এটাই হলো কাজ করার, কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং গন্তব্যের পথে শুধু এগিয়ে যাওয়ার নয়, বরং দৌড়ে যাওয়ার উপযুক্ত সময়। এটা আমি ঠিকমতই উপলব্ধি করি। কারণ শৈশব থেকে সরাসরি আমি বার্ধক্যে এসে পড়িনি। আমিও তারুণ্যের ভেলায় ভেসে পাড়ি দিয়েছি জীবন সাগরের দীর্ঘ পথ।

সাগরের উর্মিমালা ও ঝঞ্ঝাবিক্ষোভের সঙ্গে আমার যথেষ্ট পরিচয় আছে। তাই আমি সতর্ক করে বলতে চাই, সামাজিক প্রযুক্তির উদ্ভাবকরা শুরুতে যে ভাষায় কথা বলেছেন, আলিম-সমাজের তরুণ প্রজন্ম এখন ঠিক যেন সে ভাষায় কথা বলছেন। অর্থাৎ তাদের বক্তব্যটাও সত্যের অর্ধেক। বাকি অর্ধেক, আমি বলবো না, তারা গোপন করছেন, বলবো, বাকি অর্ধেক তাদের অজানা রয়ে গেছে। তারা শুধু বলছেন, দ্বীনের দাওয়াত ও প্রচারের মাধ্যমরূপে এবং সত্যের পক্ষে ও বাতিলের বিরুদ্ধে কার্যকর অস্ত্ররূপে সামাজিক প্রযুক্তি ও অনলাইন এক্টিভিটিজের ভূমিকা ও অবদানের কথা। এটা হলো সত্যের অর্ধেক।

বাকি অর্ধেক হলো, এ পথ বড় ঝুঁকিবহুল ও পিচ্ছিল। এ পথের বাঁকে বাঁকে রয়েছে ধ্বংসের গহ্বর; রয়েছে বিষধর সাপের উদ্যত ফণা ও মরণছোবল! এ পথ কাঁচা বয়সের কাঁচা চিন্তার সৌখিন পথচারীর জন্য নয়। নিজের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে আমি বেখবর নই। আমি জানি, আমার কথা… তবু এ সম্পর্কে আমি আমার বক্তব্য স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই- দ্বীনের প্রয়োজনে সামাজিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরোধী আমি নই, বরং…।

তবে শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন স্তরে যারা শিক্ষারত তাদের কান যদি আমার আওয়ায শোনার জন্য খোলা থাকে তাহলে আমি হৃদয়ের সবটুকু দরদ-ব্যথা ঢেলে দিয়ে বলতে চাই, ‘এটা হলো বিষধর সাপ। সাধারণ মানুষ যদি হাত বাড়ায়, ছোবলে মৃত্যু নিশ্চিত।
সাপ ধরার অধিকার আছে শুধু সর্পরাজের; এমনকি সর্পরাজও নিরাপদ নন! সাভারের সর্পরাজ তার ঝাঁপির ভিতরে থাকা ধরে আনা সাপের ছোবলেই মর্মান্তিভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। কারণ সর্পরাজ অনেক কিছু জানতেন, জানতেন না যে, বিষদাঁত তুলে ফেলার ছয়মাসের মাথায় নতুন বিষদাঁত গজায়! শিক্ষাজীবনের সবটুকু সময় আল্লাহর ওয়াস্তে ‘সাপের দেখতে সুন্দর এই উদ্যত ফণা’ থেকে দূরে থাকো। বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ রাহবারের তত্ত্বাবধানে শুধু অধ্যয়ন, শুধু চরিত্রের উন্নয়ন এবং শুধু চিন্তার উৎকর্ষ সাধনের পরিমণ্ডলে নিজেকে নিয়োজিত রাখো এবং আবদ্ধ রাখো।

শিক্ষাজীবন শেষে কর্মের অঙ্গনে প্রবেশের পর কোন বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তির পূর্ণ তত্ত্বাবধানেই শুধু এই ঝুঁকিপূর্ণ পথে অগ্রসর হতে পারো, যাতে তোমার পথচলার সবটুকু দায়দায়িত্ব থাকে তাঁর কাঁধে; তুমি যেন থাকো পূর্ণ দায়মুক্ত। তুমি যেন বলতে পারো হাশরে আল্লাহর সামনে, ‘আমি তো রাহবারের নির্দেশনায় পথ চলেছি!’ মনের কথাগুলো হয়ত গুছিয়ে বলতে পারিনি, তবু নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে কিছু কথা বলতে পেরে। হে আকাশের চাঁদ-সূর্য, সাক্ষী থাকো, সত্যের ডাক, হকের আওয়ায আমি আমার কাউমকে পৌঁছে দিয়েছি! ﻓﺴﺘﺬﻛﺮﻭﻥ ﻣﺎ ﺃﻗﻮﻝ ﻟﻜﻢ، ﻭﺃﻓﻮﺽ ﺃﻣﺮﻱ ﺇﻟﻰ ﺍﻟﻠﻪ

এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ