মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৭ শাওয়াল ১৪৪৫


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রচার বিমুখ এক প্রবীণ আলেমে দ্বিন মাওলানা আবুল কালাম হুসাইনি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শাহাদত হুসাইন।।

মাওলানা আবুল কালাম হুসাইনি মুহাম্মাদ আশেক এলাহি।সদরে মুহতামিম, শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইউনুসিয়া বিবাড়িয়া।

আবুল কালাম হুসাইনি মুহাম্মদ আশেকে ইলাহি। টুমচরে আমার এ নাম দিয়েছিলো। জন্মের পর রাখা হয় আশেকে এলাহী। আদর করে এ নাম রেখেছে। সূফি সদরুদ্দিন সাব ছিলেন। যশোরের। ইন্ডিয়াতে পড়েছে জায়গাটা এখন। তিনি আমাদের মামার বাড়িতে আসতেন। তার ভাগিনার নাম ছিলো আশেকে এলাহি। এ জন্য আমার নামও রাখে আশেকে এলাহি।

মা-বাবা এবং শৈশব, কৈশোর।
আমার বাবা ছিলেন আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ: এর শাগরেদ। দেওবন্দে যখন বিপ্লব হলো তখন তিনি দেওবন্দ থেকে চলে গেলেন। হযরত শাব্বির আহমদ উসমানি রহ: তার সাথি ছিলেন। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আব্বা তাফসির করতেন। সাথে যেতাম আমি। সখ করে সাথে যেতাম। বসে থাকতাম। আর তাফসির শুনতাম। আমার মা ছিলেন খুব অমায়িক। ভালো। সাবার সাথে মিলেমিশে চলতেন।

আমি থাকতাম আমার মামার বাড়ি। পড়া লেখা করেছি সেখানে। পড়ার জন্য মামারা তদারকি করতো। ক্লাস ফোর পর্যন্ত মামার বাড়ি ছিলাম। প্রাথমিক পড়া লেখা মামার বাড়িতেই হয়েছে। তখন কিছু হলে শাসন করতো মামারাই।

বাবা স্নেহ করতেন। কোনো আবদার করলে খুব সহজে পূরণ করতেন। কোনো বাহানা করলে পূর্ণ করতেন। আমি হলাম শান্ত স্বভাবের। স্বভাবের মধ্যে কোনো চঞ্চলতা ছিল না। বাবা যা বলতেন শুনতাম। মানতাম। বাবার বিপরীতে যাইনি। পড়তে বলেছে পড়েছি। মনোযোগ দিয়ে। নিজ থেকে। আগ্রহ নিয়ে। পড়ালেখার জন্য কখনো মারতে হয়নি। পড়া লেখা থেকে কখনো আমার মন ছুটেওনি। নিজ আগ্রহেই পড়ালেখা করেছি। ক্লাস ওয়ান, টু, থ্রী পড়েছি দেশ ভাগের আগে। ক্লাস ফোর দিয়েছি ১৯৪৮ সালে। আমার বাবা দারুল উলূম দেওবন্দের ফাযেল। চাচারা দারুল উলূম দেওবন্দের ফাযেল। বংশের মধ্যে দ্বীনের একটা আবহ ছিল। সবাই মাদরাসা, মাসজিদ মুখি। মাদরাসার প্রতি ভিন্ন অনুরাগ, ভালোবাসা এবং প্রীতি ছিল। সবাই ধার্মিক। সবাই নামাজ পড়ে। মাথায় টুপি। গায়ে পাঞ্জাবি। চলনে, বলনে সুন্নাতের ছাপ। আর সবার মতো

আমারও মাদরাসার প্রতি টান ছিলো। ভিন্ন এক ভালোলাগা ছিল। এক অনুভূতি কাজ করতো। তাই আমার মাদরাসাতেই পড়া হয়।

ছাত্র জীবন।
কচুয়া থানায় মনপুরা পুনিয়ার কওমি মাদরাসা আছে। ভালো এবং প্রসিদ্ধ। প্রথম আমি ভর্তি হই সেখানে। দাহম জামাতে। এরপর উজানি মাদরাসায় লেখা পড়া করি। সেখান থেকে যাই নোয়াখালি লক্ষীপুরের টুমচর মাদরাসায়। পড়া লেখা করি।

১৯৫২ সালে দাখেল পরিক্ষা দেই। টুমচর থেকে নোয়াখালি টাউনে লেখা পড়া করেছি। সেখানে ফাযিল পর্যন্ত ছিলো। পড়েছি সবগুলো। আলিমে পরিক্ষা দিয়েছি। থাডিশন পেয়েছি। এরপর আসলো ফাজিলের বছর। পাকিস্তান আমল। পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট ভালো হলো না। পাস করেছি কিন্তু বৃত্তি পাইনি। অভিমান হলো আমার। খারাপ লাগলো। সে অভিমান, আর খারাপ লাগায় চলে গেলাম হাটহাজারি মাদরাসায়। তখন ১৯৫৮ সন। ভর্তি হলাম সরাসরি শরহে জামি জামাতে। পাঁচ
বছর ছিলাম হাটহাজারি মাদরাসায়। পাঁচ বছর। দাওরা পর্যন্ত পড়লাম। রমজানের আগে দাওরায় পরিক্ষা দিলাম। রমজানের পর আবার নোয়াখালি সরকারি আলিয়াতে কামেল দিলাম। এবার স্টান করেছি। সেকেন্ড স্টান। বায়তুল মুকাররমের খতিব সালাহুদ্দিন ছিলো না? সেও আমার সাথে কামেল পরিক্ষা দিয়েছে। সে ফাস্ট হয়েছে আমি সেকেন্ড হয়েছি।

পড়া লেখার পদ্ধতি।
আমাদের দরস করার পন্থা ছিল তখন ভিন্ন। খুব সুন্দর এক পদ্ধতিতে আমরা দরস করতাম। উস্তাদগণ বসে থাকতেন। একটা নির্দিষ্ট স্থানে। নির্দিষ্ট কামরায়। ঘন্টা পড়তো। কিতাব, খাতা বুকে নিয়ে আমরা সে উস্তাদের কাছে যেতাম। আমাদের পড়াতেন। ঘন্টা শেষ হলে আবার উঠে আসতাম।

ভিন্ন জামাতের ছাত্ররা কিতাব নিয়ে আসতো আবার। আমাদের পর তারা পড়বে। উস্তাদ বসেই থাকতেন। ছাত্ররা মোতালাআ করতো বেশি। অহেতুক সময় নষ্ট করতো না। মোতালাআ কে গুরুত্ব দিতো। কিতাব নিয়ে বসে থাকতো। কোনো মাসআলা না বুঝলে অন্যের থেকে বুঝে নিত। উস্তাদের কাছে যেত। উস্তাদ থেকে মাসআলা বুঝে আসতো। সবার ধ্যান ছিল কিতাবে। আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কিতাব। আমি সরকারি মাদরাসায় পড়েছি। সেখানে উর্দূর চর্চা ছিল। পরীক্ষা হতো উর্দূতে। রচনাসহ অন্যান্য বিষয় দিতাম উর্দূ ভাষায়। তাই উর্দূ লেখায় আমার কলম ভালো ছিলো। খুব ভালো লিখতে পারতাম। হাটহাজারিতে পড়ি। প্রতিযোগিতার ঘোষনা দিল। রচনা প্রতিযোগিতার। আমি অংশগ্রহণ করলাম। উর্দূতে লিখে জমা দিলাম। ফার্স্ট হয়ে গেলাম।

প্রিয় উস্তাদ এবং সহপাঠি
হাটহাজারি মাদরাসায় আমার প্রিয় উস্তাদ ছিলেন আল্লামা আহমদ শফি সাহেব দা:বা। মুহতামিম সাহেব মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব সাহেব খুব ভালোবাসতেন আমাকে। টুমচরে ছিলেন মাওলানা আব্দুল মতিন সাহেব। তার খেদমত করেছি আমি। আমার সহপাঠিরা খুব ভালো ছিলো। তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জি সাহেব ছিলেন আমার সহপাঠি। মাওলানা রফিকুল্লাহ, নোয়াখালির চৌমুহনি বাড়ি। আমার সাথী ছিলেন। সবাই খুব আন্তরিক ছিলেন। মহব্বতের সাথে লেখা পড়া করেছি। কখনো কোনো ঝামেলা হয়নি। কোনো বিষয়ে মতানৈক্য হয়নি। মিলেমিশে থেকেছি।

খেদমত এবং বিয়ে।
পড়া শেষ করার পর আমি মাদরাসায় খেদমতে ঢুকি। আলিয়া মাদরাসায়। সেকেন্ড মুহাদ্দিস হিসেবে। পাত্রি দেখা শুরু হয়ে গেছে। বিয়ের জন্য। সবাই দেখছে সব দিকে। বড় ভাই মাওলানা আবুল বারাকাত সাহেব একদিন ফরিদপুর চলে গেলেন। পাত্রি দেখতে। পাত্রি দেখে আসলেন। ফেনির হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, "মাওলানা! আপনি কালকে কই ছিলেন?

বলল, গিয়েছিলাম ফরিদপুর। মেয়ে দেখতে।
ফরিদপুরী হুজুর বললেন, মেয়ের বাপ কী করে?
আমি বললাম, ব্যবসায়ী, মেয়ের বাবা ব্যবসা করে।
বলল, আপনি আলেম হয়ে ব্যবসায়ীর মেয়ে বিয়ে করবেন?
দেন, আমি আপনার বিয়ে করিয়ে দিচ্ছি। যান, একটা ইনভেলাপ নিয়ে আসেন।

একটা ইনভেলাপ আনলাম। একটা চিঠি লিখলেন। মাওলানা ফখরে বাঙ্গাল রহ: এর কাছে। আমার পরিচয় দিলেন।আশেকে এলাহী। হাটহাজারি মাদরাসা থেকে দাওরা পাস করেছে। এখন আমাদের মাদরাসায় সেকেন্ড মুহাদ্দিস হিসেবে আছে। ভালো। ভদ্র। ফখরে বাঙ্গাল রহঃ চিঠি পেলেন। পড়লেন। এবং রাজি হয়ে গেলেন। ১৯৬৫ সাল। বিয়ে ঠিক হলো। তারিখ নির্ধারণ হলো। আমরা আসবো বিবাড়িয়া। আমরা আসছি। গাড়ি দিয়ে। আসার সময় এক্সিডেন্ট হলো আমাদের গাড়ি। বিলম্ব হলো। অনেকটা সময় বসে থাকতে হলো। ঠিক ভাবে আসলে আসরের সময় আসতাম। সেখানে আসলাম এশার সময়। পরনে লুঙ্গি। মাথা খালি। পাগড়ি নেই। মুফতি নুরুল্লাহ সাহেব রহ: একটা পাগড়ি পরিয়ে দিলেন। এবং বিয়ে হলো।

স্ত্রীর সাথে পরিবারের সম্পর্ক।
আমার স্ত্রীর সাথে আমার পরিবারের সম্পর্ক ভালো ছিল। কখনো কারো সাথে মনোমালিন্য হয়নি। বেশিরভাগ সময় আমি এখানে ছিলাম। দুজনের মধ্যে মানুষ হিসেবে একটু আধটু মনোমালিন্য হতো। সেটা বেশি গড়াতো না। দুজনের ভালোবাসা মিল মহব্বতে চলে গেছে। ছেলে মেয়েকে লেখা পড়ার জন্য তালিম দিয়েছি। তাদের শেখানোর চেষ্টা করেছি। দিক নির্দেশনা দিয়েছি। পড়া লেখায় উদ্বুদ্ধ করেছি। বাবা হিসেবে যতটুকু দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। তাদের আবদার, ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে সচেষ্ট থেকেছি।

জামিয়া ইউনুসিয়ায় যোগদান।
সংগ্রামের সময় আমি এখানে চলে আসি। মাদরাসাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। আমি বেকার হয়ে যাই। অবসর থাকি। ফখরে বাঙ্গাল রহঃ তখন আমাকে একটা খেদমত দেন। মসজিদের খেদমত। আন্দর বাজার মসজিদের খেদমত। সাথে যুক্ত হই জামিয়া ইউনুসিয়াতে। দরস করি এখানে। বড় ছোট মিলিয়ে বেশ কয়েকটা দরসই করতাম। দাওরা ক্লাস পাইনি। মুফাসসির সাহেব হুজুর একদিন আমাকে ডাকলেন। আমার সাথে কথা বললেন। এবং দায়িত্ব দিলেন।

বললেন, বুখারি শরীফের প্রশ্ন পত্র তৈরি কর। তোমার প্রশ্ন দেখেই ছাত্ররা পরীক্ষা দেবে।
বুখারি শরীফ নিলাম। প্রশ্ন তৈরি শুরু করলাম। সুন্দর একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করলাম। হুজুর খুশি হলেন। সবাই বিস্মিত হলো। আমার প্রশ্ন করার ধরন, আর গভীরতা দেখে। কারণ আমি দাওরার শিক্ষক নই।

ছাত্রদের থেকে উস্তাদ কী চায়?
একজন উস্তাদ তার ছাত্র থেকে কেবল লেখা পড়া চায়। উস্তাদ ছাত্রের সম্পর্ক লেখা পড়ায়। ইলমি সম্পর্ক। অন্য কিছু না। ভালো পড়া লেখা পেলেই উস্তাদ খুশি। উস্তাদ আনন্দিত। এতেই উস্তাদের স্বার্থকতা।

লেখকের ‘আকর সেতারা’ বই থেকে সংক্ষেপিত

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ