শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


বায়তুল্লাহর পথে, জান্নাতের ছায়ায়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সত্য ঘটনা অবলম্বনে- একটি হৃদয়ছোঁয়া হজ্বের গল্প!

সাখাওয়াত রাহাত।।

পবিত্র হজ্ব আদায় শেষে ফিরতি ফ্লাইটের জন্য 'সাঈদ' জেদ্দা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁর পাশের সিটেই বসেছিলেন আরেকজন হাজী সাহেব।

সালাম বিনিময়ের পর পাশের লোকটি বললেন: আমি একজন ঠিকাদার। আল্লাহ তায়ালা আমাকে দশম হজ্ব পালনের তাওফিক প্রদানের মাধ্যমে ধন্য করেছেন।

সাঈদ তাঁকে বললেন: মাশাআল্লাহ! আল্লাহ আপনার হজ্ব কবুল করুন এবং আপনার সকল অপরাধ ক্ষমা করুন।

লোকটি হেসে বললেন: আমিন। এরপর সাঈদকে জিজ্ঞেস করলেন: আপনি কি এবারের আগে আর কখনো হজ্ব করেছেন?

সাঈদ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দ্বিধা করছিলেন। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করার পর বললেন: আল্লাহর কসম! এটি বেশ লম্বা ঘটনা; এবং আমি চাইনা আমার কথা শুনতে শুনতে আপনি বিরক্ত হয়ে যান।

লোকটি হেসে বললেন: দয়া করে বলুন। আমি ঘটনাটা শুনতে চাই। তাছাড়া এখন তো আমাদের কোনো কাজও নেই। আমরা তো বসে বসে অপেক্ষাই করছি।

সাঈদ হাসি দিয়ে বললেন: হ্যাঁ, আমার গল্পের শুরুটা অপেক্ষা দিয়েই। আমি হজ্বের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছি।

একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিরিশ বছর ফিজিওথেরাপিস্ট হিসাবে কাজ করার পর আমি হজ্বের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সাশ্রয় করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

একই দিন আমি আমার বেতন আনতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পর এক মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়; যার পক্ষাঘাতগ্রস্থ ছেলের চিকিৎসা আমি দীর্ঘদিন ধরে করছিলাম। আমি তাকে খুব চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন দেখতে পেলাম।

তিনি আমাকে বললেন: সাঈদ ভাই! আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। এই হাসপাতালে এটাই আমাদের শেষ দেখা।

আমি তার কথায় অবাক হলাম। ভাবলাম- তিনি হয়তো আমার চিকিৎসায় সন্তুষ্ট নন; তাই ছেলেকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছেন। আমি তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

তিনি আমাকে বললেন: না সাঈদ ভাই, আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি- আপনি একজন বাবার মতোই আমার ছেলের পাশে ছিলেন। আমরা যখন আশা হারিয়ে ফেলেছিলাম; তখন আপনিই তার চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে আবার আমাদের মনে আশা জাগিয়ে তুলেছিলেন।

তারপর তিনি খুব দুঃখিত ও ব্যথিত মনে আমার সামনে থেকে চলে গেলেন।

পাশের লোকটি এবার সাঈদের করার মাঝখানে বলে ওঠলেন: আশ্চর্য! তিনি যদি আপনার চিকিৎসায় সন্তুষ্ট হন এবং তার ছেলেরও উন্নতি হয় তবে তিনি কেন চলে গেলেন?

সাঈদ উত্তর দিলেন: আমিও এটাই ভেবেছিলাম, তাই প্রকৃত ঘটনা জানতে আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েছিলাম।

কর্তৃপক্ষ আমাকে জানিয়েছিল- সম্প্রতি ছেলেটির বাবা চাকরি হারিয়েছে; এজন্য ছেলের চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে তারা অক্ষম।

পাশের লোকটি বললেন: খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আল্লাহ ছাড়া গরিব অসহায়দেরকে আর কেউ নেই। আপনি তাদের জন্য কিছু করেননি?

সাঈদ বললেন: আমি ম্যানেজারের কাছে গিয়ে হাসপাতালের ব্যয় খাত থেকে ছেলেটির চিকিৎসার খরচ চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তীব্রভাবে এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন- ‘এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান; কোনো দাতব্য সংস্থা নয়’।

আমি সেই পরিবারের জন্য কোনো কিছু করতে না পেরে দুঃখিত হলাম। ব্যথিত মন নিয়ে ম্যানেজারের রুম ত্যাগ করলাম।

তারপর হঠাৎ আমার হাত চলে গেল পকেটে; যেখানে হজ্বের জন্য জমানো টাকাগুলো রেখেছিলাম।

আমি কিছুক্ষণ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর মাথা উপরে তুলে আমার রবকে বললাম

হে আল্লাহ! এই মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা কী তাতো আপনি ভালো করেই জানেন। এবং আপনি এ-ও জানেন- আপনার ঘরে গিয়ে হজ্ব করা এবং আপনার রাসূলের মসজিদটি স্বচক্ষে দেখার চেয়ে আমার কাছে প্রিয় আর কিছুই নেই।

আপনি জানেন- এই প্রিয় কাজটি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আমি সারাজীবন কাজ করে যাচ্ছি। একটু একটু সঞ্চয় করছি গত তিরিশটা বছর। আপনার কসম করে বলছি- আমি এই দরিদ্র মহিলা এবং তার ছেলেকে নিজের চেয়ে বেশি পছন্দ করি। সুতরাং আমাকে আপনার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করবেন না।

আমি অ্যাকাউন্টস ডেস্কে গিয়ে তার চিকিৎসার জন্য আমার হজ্বের জমানো সব টাকা দিয়ে দিলাম। এতে পরবর্তী ছয় মাস তার চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ হলো।

আমি হিসাবরক্ষককে অনুরোধ করলাম মহিলাটিকে জানাতে যে, এটি হাসপাতালের বিশেষ ব্যয় খাত থেকে এসেছে।

তিনি এতে আপ্লুত হয়েছিলেন এবং চোখের জল ছেড়ে বলেছিলেন- আল্লাহ তায়ালা আপনার এবং আপনার মতো লোকদের সবকিছুতে বরকত দান করুন।

তাঁর পাশের লোকটি তখন জিজ্ঞেস করলেন: যদি আপনি আপনার সমস্ত অর্থ দান করেন, তবে হজ্বে গেলেন কীভাবে?

সাঈদ বললেন: আজীবনের জন্য হজ্বের সুযোগ হারিয়ে আমি সেদিন দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফিরে গেলাম। তবে মুহূর্তেই আমার হৃদয় খুশিতে ভরে ওঠল! কেননা আমি ভদ্রমহিলা এবং তার ছেলের একটি ঝামেলা মেটাতে পেরেছিলাম।

সেই রাতে আনন্দাশ্রু নিয়ে আমি ঘুমিয়েছিলাম।

গভীর ঘুমে স্বপ্নে দেখলাম- পবিত্র কাবার চারপাশে আমি তাওয়াফ করছিলাম এবং লোকেরা আমাকে সালাম দিচ্ছিল‌। তারা আমাকে বলছিল: ‘হাজ্জুন মাবরুর হে সাঈদ! কেননা আপনি পৃথিবীতে হজ্ব করার আগে জান্নাতে হজ্ব করেছেন’!

আমি সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠলাম এবং অবর্ণনীয় সুখ অনুভব করলাম। আমি সমস্ত কিছুর জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রশংসা করলাম এবং এই সুখানুভূতি প্রদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম।

সকালে আমি যখন ঘুম থেকে উঠি তখন আমার ফোনটিও বেজে ওঠে। দেখি আমার হাসপাতালের ম্যানেজার ফোন দিয়েছেন।

তিনি আমাকে জানান- হাসপাতালের মালিক এই বছর হজ্বে যেতে চান এবং তিনি তাঁর ব্যক্তিগত থেরাপিস্ট ছাড়া যেতে পারবেন না।

তবে সমস্যা হলো থেরাপিস্টের স্ত্রী সন্তানসম্ভবা এবং তিনি গর্ভাবস্থার শেষ দিনগুলিতে পৌঁছেছেন। তাই স্ত্রীকে এই অবস্থায় রেখে তিনি কিছুতেই যেতে পারবেন না।

এরপর তিনি আমাকে অনুনয় বিনয় করে বললেন- আপনি কি আমার একটু উপকার করবেন? আপনি কি দয়া করে মালিকের সঙ্গে হজ্বে যাবেন?

আমি সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করে সিজদা দিলাম। এবং যেমনটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন- আল্লাহ তায়ালা আমাকে কোনো টাকা-পয়সা খরচ করা ছাড়াই তাঁর ঘরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। আমি হজ্বে যেতে সম্মতি জানানোর পর হাসপাতালের মালিক আমাকে তাঁর সঙ্গ দেওয়ার খুশিতে আমার কোনো বিশেষ চাওয়া পূর্ণ করে দেওয়ার জন্য জোর করছিলেন।

আমি তাকে ভদ্রমহিলা এবং তার ছেলের গল্পটি বলেছিলাম। তিনি নিজের ব্যক্তিগত ব্যয় থেকে ছেলেটিকে হাসপাতালে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করে দিলেন। শুধু তাই নয়- অভাবী রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে একটি 'অনুদানের বাক্স' স্থাপন করালেন। এবং সর্বোপরি ছেলের বাবাকে তিনি নিজের একটি সংস্থায় ভালো চাকরি দিয়ে দিলেন। এমনকি ছেলেটির চিকিৎসার জন্য আমি প্রথমে যে অর্থ ব্যয় করেছিলাম তার পুরোটাই তিনি আমাকে ফিরিয়ে দিলেন।

আপনি কি আমার রবের অনুগ্রহের চেয়ে মহান অনুগ্রহ দেখেছেন? সুবহানাল্লাহ..

পাশের লোকটি তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন: আল্লাহর কসম! আমি এখন যেমন লজ্জা অনুভব করছি ইতোপূর্বে কখনও আমি এই ধরণের লজ্জা অনুভব করিনি।

প্রতিবছর হজ্ব করার পর আমি ভাবতাম- আমি দুর্দান্ত কিছু করেছি। আমি কতো ভাগ্যবান যে, এতোবার আল্লাহর ঘরে আসতে পেরেছি। নিশ্চয় এর মাধ্যমে আল্লাহ আমার মর্যাদা অনেক উন্নত করেছেন।

তবে আমি এখন বুঝতে পেরেছি- আপনার হজ্ব আমার হাজারটা হজ্বের সমান। কেননা আমি নিজে আল্লাহর ঘরে গিয়েছি, কিন্তু আল্লাহ আপনাকে তাঁর ঘরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এবং তাঁর ঘরের মেহমান হওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি নিজেই করে দিয়েছেন। আল্লাহু আকবার। আল্লাহ আপনার হজ্ব কবুল করুন।

সর্বদা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে ভালো চিন্তা করুন। বিশ্বাস রাখুন- তিনি সব কিছু করতে সক্ষম। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন এবং আমরা যা কিছু আমল করি তা কবুল করুন।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ