বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


গভীর সংকটে মহিলা মাদরাসা: দেখার কেউ নেই

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আন্দামান নওশাদ : মহিলা মাদরাসা। নারী জাতির দীন শিখার উন্মুক্ত পাঠশালা। নারী জাতি মায়ের জাতী। মা শুদ্ধ হলে সমাজ পরিশুদ্ধ হবে। মা দীনদার হলে সমাজের মানুষ হবে মুত্তাকি, পরহেজগার। মা যদি হয় নেককার তাহলে প্রজন্ম হবে সত্যিকারের খোদাভীরু মানুষ।

নেপালিয়ান বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো।’ এই নারী জাতিকে দীনের তালিম প্রদানের জন্য গঠন হয়েছে মহিলা মাদরাসা। বাংলাদেশে প্রচলিত মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯৮৪ সালে। রাজধানীর মিরপুর দারুর রাশাদ মাদরাসার পাশে ‘ক-ব্লক’ এ মাদরাসাটি অবস্থিত। এর মুহতামি মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস। মাদরাসাটি ১৯৮৯ সালে দাওরায়ে হাদিসের দরস চালু করে। এরপর নারায়ণগঞ্জের মাসদাইসরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া’ নামে একটি মহিলা মাদরাসা। যার সাইনবোর্ডে প্রতিষ্ঠাসন লেখা আছে ১৯৯১। মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার ফারেগ, মাওলানা জিয়াউদ্দিন।

বর্তমানে দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য মহিলা মাদরাসা গড়ে ওঠেছে। এক জরিপে ওঠে এসেছে, শুধু ঢাকা শহরেই প্রায় দুই হাজার মহিলা মাদরাসা রয়েছে। দেশব্যাপী যার সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়ে।

রাজধানীর মুগদা থানায় অবস্থিত তা’লীমুল ইসলাম মহিলা মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ফয়েজ উল্যাহ মনে করেন, ‘প্রয়োজনের তুলনায় এ সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। কেননা যেখানে দেশে প্রায় ২ লক্ষ কলেজ আছে। সেখানে তিন হাজারের কৌটা যৎসামান্য। খুবই নগন্য।’

দেশের এসব মহিলা মাদরাসাগুলোর অধিকাংই ভাড়া করা বাড়িতে পরিচালিত। ব্যক্তি-মালিকানা জায়গায় খুব কম মহিলা মাদরাসাই রয়েছে। ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হওয়ায় এসব মাদরাসা ‘প্রাইভেট মাদরাসা’ হিসেবেই বিবেচিত হয়। এখানে সব শ্রেনির মানুষের তাই যাতায়াত কম। তবে তুলনামূলক দীনদার শ্রেনির লোকেরাই তাঁদের মেয়ে সন্তানদের দীন শিখার জন্য এসব মাদরাসায় প্রেরণ করে থাকেন।

বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করা হয় ছাত্রীদের বেতন থেকে। ছাত্রীদের বেতন থেকে শিক্ষকদের বেতনসহ মাদরাসার অন্যান্য যাবতীয় খরচাপাতিও করা হয়। এসব মাদরাসার আয়ের প্রধান উৎসই হলো, শিক্ষার্থীদের বেতন। অন্যান্য এতিমখানার মতো এখানে বাইরের অনুদান কিংবা সাধারণ দান তেমন একটা চোখে পড়ে না। কথাগুলো বলছিলেন, রাজধানীর রামপুরায় অবস্থিত হযরত ফাতিমাতুজ জোহরা রা. মহিলা মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদ জাকির।

তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের একটা ধারণা বদ্যমূল হয়ে গেছে, মহিলা মাদরাসায় কোনো গরীব ছাত্রী পড়ে না। এখানে দানের কোনো ক্ষেত্র নেই। অথচ মেয়েরাও যে এতিম হতে পারে, তারাও যে যাকাত ফেতরা খাওয়ার হকদার; সেটা অনেক মানুষই জানেন না বা জানতেও চান না।’

এদিকে বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। প্রায় পাঁচ মাস যাবত কোনো পড়াশুনা নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। এতে ভাড়া করা বাড়িতে পরিচালিত ব্যক্তি-মালিকানাধীন মাদরাসাগুলো পড়েছে মহাসংকটে। ভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় দেশের অনেক মহিলা মাদরাসা ইতিমধ্যে ‘একবারে বন্ধ’ ঘোষণা করা হয়েছে। মাদরাসার প্রধান ফটকে ঝুলছে তালা। নারায়ণগঞ্জের পাইনাদী এলাকায় অবস্থিত একটি দাওরায়ে হাদিস মহিলা মাদরাসার প্রধান ফটকে তালা ঝুলতে দেখা যায়। মাদরাসার লিফলেট থেকে পরিচালকের নাম্বারে ফোন দিলে তিনি জানান, ‘বাড়িওয়ালা কয়েকবার নোটিশ দিয়েছে বাড়ি ভাড়া পরিশোধের জন্য। কিন্তু মাদরাসা বন্ধ। ছাত্রী নেই। নেই মাদরাসার অন্যকোনো ইনকাম। তাই ভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় মাদরাসা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছি।’

এদিকে মহিলা মাদরাসার এ সংকটের সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকেই তেমন দেখা যাচ্ছে না। কিছুদিন পূর্বে কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) কর্তৃক দেশের পুরুষ মাদরাসাগুলোতে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তাদের ত্রাণের তালিকায় ছিলো না কোনো কওমি মহিলা মাদরাসা।

রামপুরা ফাতিমাতুজ জোহরা রা. মহিলা মাদরাসার পরিচালক মাওলানা মাহমুদ জাকির বেফাকের দায়িত্বশীলদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের মুরুব্বিরা আমাদের দিকে তাকান না। আমাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা করেন না। বেফাক বোর্ডে মহিলা মাদরাসার পক্ষ থেকে নেই কোনো প্রতিনিধি। মহিলা মাদরাসার দুঃখ-বেদনার কথা তুলে ধরার মতো নেই কেউ। তাই বেফাকের অনুদানের লিস্টে কোনো মহিলা মাদরাসার নামও থাকে না।’

বেফাকের কাছে নিজেদের কথা তুলে ধরতে বোর্ড গঠন করেছেন বলে জানালেন মাওলানা মাহমুদ জাকির। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ মহিলা মাদরাসা ফোরাম’ নামে তারা একটি বোর্ড করেছেন। যারা মহিলা মাদরাসার সুবিধা-অসুবিধা ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করবেন।

তবে ভাড়া করা ছাড়া নিজস্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত মহিলা মাদরাসাগুলোতে তেমন হাহাকার নেই। রাজধানীর ডেমরায় জামিয়া ইব্রাহিমিয়া মহিলা মাদরাসার পরিচালক মুফতি ফয়জুল্লাহ মনে করেন, ‘প্রথমে ভাড়া বাড়িতে মাদরাসার কার্যক্রম শুরু করলেও ভাড়া বাড়িতে বসে না থেকে নিজস্ব জায়গার চিন্তা করতে হবে। তখন যে কোনো মহামারীতে সামাল দেয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।’

মহিলা মাদরাসাগুলো দেশের সম্পদ। নিজেদের জন্যই এগুলো টিকিয়ে রাখা জরুরি বলে মনে করেন মাওলানা মুসতাকিম হাসান। চাঁদপুর হযরত আয়েশা রা. মহিলা মাদরাসার এ পরিচালক মনে করেন, ‘এখানে মেয়েরা দীন শেখে। যারা কিছুদিন পর মা হবে। আর মা শিক্ষিত হলে ভবিষ্যত প্রজন্মও শিক্ষিত হবে। আর মা যদি দীনের ছোঁয়া না পায় তাহলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কঠিন অন্ধকার অপেক্ষা করছে। তাই মাকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান মহিলা মাদরাসার দিকে দৃষ্টিদান এখন সময়ের অন্যতম দাবী।’

কথা বলেছিলাম রাজধানীর সায়েদাবাদের আর. কে ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক লুৎফুন্নাহার বেগমের সাথে। তিনি দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি মহিলা মাদরাসাগুলোও টিকিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘মহিলা মাদরাসার সুনাম যেমন আছে। তেমন কিছু কিছু বদনামও সামাজিক মাধ্যমে চোখে পড়ে। কিন্তু সুনামের তুলনায় বদনামের পরিমাণ খুবই কম। আর যেখানে সুনাম আছে। সেখানে একটু কুনাম থাকতেই পারে। এতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ অনেকগুলো ধানের মাঝে দুয়েকটা চিটা থাকলে তাতে কিছু যায় আসে না।’

এমডব্লিউ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ