মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪ ।। ৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ৯ রমজান ১৪৪৫


ময়নামতির শহর কুমিল্লা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবদুল্লাহ তামিম: ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির শহর কুমিল্লা। শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টন্তের নাম কুমিল্লা। প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে এ উপমহাদেশে কুমিল্লার পরিচিতি, নাম ডাকের কথা বলাই বাহুল্য। কুমিল্লার খাদি শিল্প, তাঁত শিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎ ও কারু শিল্প, রসমালাই, মিষ্টি, ময়নামতির শীতল পাটি ইত্যাদি ঐতিহ্যে ভরে আছে কমিল্লা। কালের বিবর্তনের ধারায় এসেছে অনেক কিছুর পরিবর্তন। অনেক কিছু আবার হারিয়ে ও গেছে, তবে হারায়নি এখানকার মানুষের আন্তরিকতাপূর্ণ আতিথেয়তা ও সামাজিক সম্প্রীতি। কুমিল্লা একসময় বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল। ১৭৩৩ সালে বাংলার নবাব শুজাউদ্দিন ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করে এর সমতল অংশ সুবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৭৬৫সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কুমিল্লা দখল করে। ১৭৯০ সালে কোম্পানী শাসনামলে ত্রিপুরা নামের জেলার সৃষ্টি। ১৯৬০ সালে এই জেলার নাম করা হয় কুমিল্লা। যে কোনো দেশ ও জাতির গৌরবময় পরিচয় চোখের সামনে বাস্তব করে তোলে কালের সাক্ষী হয়ে নীরবে জেগে থাকা প্রাচীন প্রত্ন স্থাপনা। বাংলাদেশের প্রত্নস্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন শহর কুমিল্লা। প্রত্নস্থাপনাগুলোর অধিকাংশই কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী স্থান ময়নামতিতে।

কুমিল্লা শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে কোটবাড়ি বা ময়নামতি অবস্থিত। মধ্যযুগে বৌদ্ধ রাজত্বের রাজধানী ছিল এটি। ঐতিহাসিকদের মতে, রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী রাণী ময়নামতির নামানুসারে এই অনুচ্চ পাহাড়ি এলাকার নাম রাখা হয় ময়নামতি। আবার এই কথা ও প্রচলিত আছে, কোন এক রাজার দুটি মেয়ে ছিল। একজনের নাম লালমতি অন্যজনের নাম ময়নামতি। তাদের নামেই দুটি স্থানের নামকরণ করা হয়েছে বলে কেউ কেউ ধারণা করেন। বিপুল প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে এখানে। শালবন বিহার, আনন্দবিহার প্রভৃতি বৌদ্ধ সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ আছে ময়নামতিতেই। ১৯৫৫ সালে এসব নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়। বৌদ্ধধর্ম ছাড়াও এখানে জৈন ও হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিও রয়েছে। নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের জন্য রয়েছে একটি জাদুঘর। ময়নামতি এলাকা লালমাই ও হিলটিয়া নামেও পরিচিত।

উল্লেখযোগ্য কিছু স্থাপনা
শালবন বৌদ্ধ বিহার
অসাধারণ সৌন্দর্যে ইতিহাস লালিত করে শালবন বৌদ্ধ বিহার। শালবন বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। লালমাই-ময়নামতি প্রতœস্থলের অসংখ্য প্রাচীন স্থাপনার একটি এই বৌদ্ধ বিহার। এটি ১২শ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকায় এ বিহারটির অবস্থান। বিহারটির আশপাশে একসময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলে বিহারটির নামকরণ হয়েছিল শালবন বিহার। এখনতো সাজিয়ে অনেক সুন্দর পরিপাটি করা। গেলেই মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

ইটখোলা মুড়া
ময়নামতির কুমিল্লায় আরেকটি অসাধারণ সুন্দর প্রতœতাত্ত্বিক স্থান ইটখোলা মুড়া। একটি গুরুত্বপূর্র্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক সৌধস্থল। সদর উপজেলার কোটবাড়ি সড়কের ওপারে রূপবান মুড়ার উল্টোদিকে অবস্থিত। প্রাচীনকাল থেকেই এই স্থানটি ইট পোড়ানোর খনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ জন্য এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। দেখলেই কেমন অদ্ভূত অদ্ভূত দেখায়। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান দেখতেই দেশ বিদেশ থেকে ছুটে আসে হাজার হাজার দর্শনার্থী।

কোটিলা মুড়া

প্রায় ১ হাজার ২০০ বছরের পুরোনো একটি প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট অধিদপ্তরের ভেতরে অবস্থিত। এটি ১ হাজার ২০০ বছরের পুরোনো প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনটি প্রমাণ করে পূর্বেকার প্রত্নতাত্ত্বিক নির্মাণশেলী কী সুন্দর ও অসাধারণ শৈল্পিক ছিল। খননের ফলে এখানে পাশাপাশি নির্মিত প্রধান তিনটি বৌদ্ধ স্তূপের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এ স্তূপগুলো বৌদ্ধধর্মের ত্রি-রত্নের (বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ) প্রতীক। খননে সাত-আট শতকের দুটি পাথরের মূর্তি, প্রচুর অদগ্ধ সিলমোহর ও নিবেদন স্তূপ ও শেষ আব্বাসীয় খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহর (১২৮২-১২৫৮) একটি স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়া গেছে। তাই স্থাপনাটি সাত শতক থেকে ১৩ শতক পর্যন্ত কার্যকর ছিল বলা যায়। ময়নামহিতর শহর কুমিল্লায় আসলে মানুষ এটা না দেখে যায় না।

রূপবান মুড়া

কমিল্লার ময়নামতিতে আরো একটি আশ্চর্যের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনস্থল আছে। যাকে আমরা রূপবান মুড়া নামে চিনি।বাংলাদেশ প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের মতে রূপবান মুড়া অষ্টম শতাব্দীরও আগে নির্মিত। খননের পর এখানে একটি বিহার, একটি মন্দির, একটি ছোট স্তূপ ও একটি বেদির স্থাপত্য নিদর্শন উন্মোচিত হয়েছে। খননের পরই বেড়িয়ে আসে অসাধারণ স্থাপত্ব।

চারপত্র মুড়া

চারপত্র মুড়া ময়নামতির আরেকটি আলোচিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনস্থল। এটি লালমাই শৈলশিরার উত্তরাংশে সেনানিবাসের প্রায় মধ্যভাগে অবস্থিত। খননের ফলে এখানে ছোট একটি হিন্দু পীঠস্থান বা মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পরিকল্পনা, আকৃতি, স্থাপত্য নকশা ও অলঙ্করণের দিক থেকে এ মন্দির বিখ্যাত।

ময়নামতি জাদুঘর
পূর্বেই বলেছি কুমিল্লার প্রত্নস্থাপনাগুলোর অধিকাংশই ঐতিহ্যবাহী স্থান ময়নামতিতে। এই সমস্থ বিহারগুলো খননের ফলে অনেক মূল্যবান সামগ্রী খুঁজে পাওয়া যায়। এসব পুরাকীর্তি সংরক্ষণ ও র্প্রনের জন্য ১৯৬৫ সালে কোটবাড়ির শালবন বিহারের দক্ষিণ পাশে এ জাদুঘর স্থাপন করা হয়।
এ জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে স্থাপত্যসমৃদ্ধ ধ্বংসাবশেষের ভূমি-নকশা, ময়নামতিতে পাওয়া স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জ ও তামার তৈরি সামগ্রী, লোহার সামগ্রী। এ ছাড়া রয়েছে মাটির তৈরি বিভিন্ন খেলনা, কাঠের নিদর্শন, তুলট কাগজে লেখা প্রাচীন হস্তলিপির পা-ুলিপি, বিভিন্ন নমুনার মৃৎপাত্র ইত্যাদি। অবাক কারর মত অনেক অনেক আশ্চর্য বস্তু। দূর্লভ সব সংগ্রহ।

ময়নামতির ওয়ার সিমেট্রি
ইতিহাসের রাজ সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে ময়নামতি রণ সমাধিক্ষেত্র। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) নিহত ভারতীয় (তৎকালীন) ও ব্রিটিশ সেনাদের কবরস্থান। এটি ১৯৪৩-১৯৪৪ সালে নির্মিত হয়। কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে সেনানিবাসের খুব কাছে এই যুদ্ধ সমাধির অবস্থান। কমনওয়েলথ ওয়্যার গ্র্যাভস কমিশন (সিডব্লিউজিসি) সমাধিক্ষেত্রটি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করে। প্রতিবছরের নভেম্বরে সব ধর্মের ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে এখানে একটি বার্ষিক প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সেনাবাহিনী সহ সর্বস্তরের লোকসমাগম ঘটে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কুমিল্লা ছিল যুদ্ধের সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্র, বিমানmoinamoti 3 ঘাঁটি, আর ১৯৪৪ সালে ইস্ফলে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে চতুর্দশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর। এ সমাধিক্ষেত্রে ৭৩৬টি কবর আছে। যুদ্ধের সময় ও পরে বিভিন্ন স্থান থেকে মৃত সৈনিকদের এনে এখানে সমাহিত করা হয়।

সমাধিক্ষেত্রটির প্রবেশমুখে একটি তোরণ ঘর আছে। এখানে সমাধিক্ষেত্রের ইতিহাস ও বিবরণ ইংরেজি ও বাংলায় লিপিবদ্ধ করে একটি দেয়াল ফলক লাগানো আছে। ভেতরে সরাসরি প্রসস্ত পথ আছে, যার দুপাশে সারি সারি কবর ফলক। ধর্ম অনুযায়ী সেনাদের কবর ফলকে নাম, মৃত্যুর তারিখ, পদবির পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতীক লক্ষ করা যায়। প্রশস্ত পথ ধরে সামনে গেলে সিঁড়ি দেওয়া বেদি দেখা যাবে। এর দুপাশে আরও দুটি তোরণ ঘর আছে। এ পথ ধরেই সমাধিক্ষেত্রের পেছন দিকের অংশে যাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে আরও বহু কবরের ফলক। সমাধিক্ষেত্রের সামনের দিকে ব্যতিক্রমী একটি কবর দেখা যায়। সেখানে একসঙ্গে ২৩টি কবরের ফলক দিয়ে একটা স্থানকে ঘিরে রাখা হয়েছে। এই স্থানটি মূলত ২৩ জন বিমানসৈনিকের একটি গণকবর। সুন্দর ও সৌন্দর্যের কুমিল্লায় গিয়েই একবার দেখুন। অসাধারণ স্থাপনা ও প্রত্নস্থাপনাগুলোর দেখা পাবেন।

যেভাবে যেতে হয়

ঢাকা থেকে কুমিল্লার পথ মাত্র ৯৬ কিলোমিটারের। রাজধানীর নামকরা বাস ষ্টেন সায়েদাবাদ থেকে বিভিন্ন বাসে সরাসরি যেতে পারেন। সময় লাগবে মাত্র দুই ঘণ্টা। বাসভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১৫০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও ফেনীর যেকোনো বাসে চড়েও পৌঁছাতে পারেন কুমিল্লা। ইচ্ছে করলে রেলপথে ও যেতে পারেন। তবে ট্রেনে সময় বেশি লাগবে বাস থেকে। ভ্রমণ করুণ আর ঘুরে দেখে আসুন সৌন্দর্যের লিলাভূমি সবুজের ছায়াভূমি কুমিল্লা। সঙ্গে কুমিল্লার বিখ্যাত খাদী আর রসমলাই খেতে ভুলবেন না যেনো।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ