শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


মহিমান্বিত শবে বরাত: করণীয় এবং বর্জনীয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাহদী হাসানাত খান।

চলছে মাহে রমজানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের মাস শা‘বান। প্রতিজন মুমিন সাধ্যমতো শরিয়তসিদ্ধ আমল করে করে বিশেষ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে সদা সচেষ্ট। এই শা‘বান মাসের অবিচ্ছেদ্য একটি মহিমান্বিত রাত হচ্ছে চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত। উপমহাদেশে এই রাতটি ‘শবে বরাত’ নামে প্রসিদ্ধ। এটি ফারসি বাক্য। ‘বরাত’ অর্থ ‘মুক্তি’ এবং ‘শব’ অর্থ ‘রাত’।

অতএব ‘শবে বরাত’-এর অর্থ ‘মুক্তির রাত’। এই রাতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে রয়েছে বেশ কিছু সহিহ হাদিস। তা ছাড়া এ রাতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে রয়েছে বিশিষ্ট ইমামগণের নির্ভরযোগ্য বহু বক্তব্য। হজরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “শা‘বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন। সে রাতে তিনি মুশরিক এবং অন্য ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষক ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।” মুসনাদে বাজজার- ৮০

অন্যত্র মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “শা‘বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান। সে রাতে তিনি মুশরিক এবং উম্মতে বিভেদ সৃষ্টিকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।” [সহিহ ইবনে হিব্বান- ৫৬৬৫; শুআবুল ইমান, বায়হাকি- ৩৮৩৩]

অন্যত্র ইবনে উমর (রা.) বলেন, “পাঁচটি রাত এমন রয়েছে, যে রাতের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।— ১. জুমু‘আর রাত। ২. রজব মাসের প্রথম রাত। ৩. শা‘বান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত (শবে বরাত)। ৪. ইদুল ফিতরের রাত। ৫. ইদুল আজহার রাত।” [মুসান্নাফে আবদুর রাজজাক- ৭৯২৭]

★শবে বরাতের নামাজ—
এই ‘শবে বরাত’ উপলক্ষে বিশেষ নামাজ বা নামাজের বিভিন্ন রাকাতসংখ্যা, বিশেষ সুরা তেলাওয়াত এবং বিশেষ রোজা রাখা সম্পর্কিত কোনো সহিহ হাদিস নেই। আল্লামা জাহিদ কাউসারি এবং আল্লামা ইউসুফ বানুরি (রহ.) বলেছেন, “এ রাতের বিশেষ কোনো নামাজ সম্পর্কে একটি বর্ণনাও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়। তাই যেগুলো আছে, সেগুলো জাল এবং বানোয়াট।”

★শবে বরাতের রোজা—
‘শবে বরাত’ উপলক্ষে বিশেষ কোনো রোজা নেই। এই উপলক্ষে রোজা রাখা সম্পর্কিত হাদিস সহিহ নয়; দুর্বল। তবে এমনিতে কেউ চাইলে পরের দিন অর্থাৎ চান্দ্র মাসের ১৫ তারিখ ‘আইয়্যামে বিজ’-এর রোজা রাখতে পারি। (‘আইয়্যামে বিজ’ অর্থ ‘উজ্জ্বল রাতের দিনগুলো’। চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখকে ‘আইয়্যামে বিজ’ বলা হয়। হজরত আবু জর ও কাতাদা ইবনে মিলহান (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আইয়্যামে বিজ তথা শুক্লপক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে প্রতি মাসে এই তিন দিন রোজা রাখতে বলেছিলেন।”) [জামে তিরমিজি- ৭৬১; সুনানে নাসায়ি- ৪/২২৩-২২৪; সুনানে ইবনে মাজাহ- ১৭০৭-১৭০৮, সুনানে আবু দাউদ- ২৪৪৯]

শবে বরাতে একাকী ইবাদতসমূহ—
চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত তথা শবে বরাতে একাকী ইবাদত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তাই রাতে আমরা যত ইচ্ছা তত, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নামাজ পড়তে পারি, কুরআন কারিম তেলাওয়াতসহ বিভিন্ন সহিহ জিকির-আজকার, ইস্তেগফার, তাসবিহ-তাহলিলে মশগুল থাকতে পারি এবং পরের দিন তথা ১৫ তারিখ দিনে ‘আইয়্যামে বিজ’-এর রোজা রাখতে পারি।

শবে বরাত উপলক্ষে কবর জিয়ারত—
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, “এক রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি হারিয়ে ফেললাম। আমি তাঁর খোঁজে বের হলাম। জান্নাতুল বাকিতে (সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ কবরস্থান) তাঁকে পেলাম। তিনি বললেন, ‘তুমি কি ভয় করছো যে, মহান আল্লাহ তাঁর রাসুলের ওপর অত্যাচার করেছেন?’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি ধারণা করেছি যে, আপনি অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে এসেছেন।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শা‘বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং বনু কালব গোত্রের বকরি-লোমের সংখ্যার চেয়ে বেশি মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দেন।” [তিরমিজি- ৭৩৯; ইবনে মাজাহ- ১৩৮৯]

আমাদের অনেকেই শবে বরাতে দলবেঁধে কবর জিয়ারত করেন। কিন্তু কোথাও এর ফজিলত সংক্রান্ত বর্ণনা নেই। এমনিতে যেকোনো সময় এবং শবে বরাতে শরিয়তসিদ্ধ পন্থায় কবর জিয়ারত করতে পারি আমরা। কিন্তু শবে বরাতের বিশেষ আমল হিসেবে জিয়ারত করা সম্পূর্ণ অবৈধ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে না বলে, একাকী, সংগোপনে জান্নাতুল বাকিতে গিয়েছিলেন। কাউকে যাওয়ার কথা বলেননি এবং তিনি নিজেও কাউকে নিয়ে যাননি। পুরো বিষয়টি হাদিস থেকে সহজেই অনুমেয় হয়। আমাদের জন্য কর্তব্য হলো, শরিয়তসিদ্ধ পন্থায় জীবনযাপন করা।

রুটি-হালুয়ার আয়োজন অনর্থক—
অনেকে এমন আছেন, যাঁরা রুটি-হালুয়া ইত্যাদি তৈরি এবং তা বিতরণ করা শবে বরাতের বিশেষ আমল মনে করেন। এসব কষ্ট করে হলেও, খুব ঘটা করে তাঁরা আয়োজন করে থাকেন। তাঁদের ধারণা, “শবে বরাতে হালুয়া-রুটি ইত্যাদি তৈরি করলে, আরশের নিচে ছায়া পাওয়া যাবে।” আর এটিকে রাসুলের হাদিস হিসেবেই বলা হয়েছে! কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসের সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই। এটি এমন একটি ভিত্তিহীন কথা—যার জাল-ভ্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি জাল হাদিসের ওপর লেখা কিতাবাদিতেও এর কোনো হদিস পাওয়া যায় না। এ পবিত্র রাতে রুটি-হালুয়া ইত্যাদি তৈরি এবং বিতরণ ইবাদতে চরম বিঘ্ন ঘটায়। এসব অশুদ্ধ আমলের পেছনে পড়ে অনেকেই বঞ্চিত হোন মহান আল্লাহপ্রদত্ত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত থেকে। কাজেই অন্তত এ রাত উপলক্ষে এসব বর্জনীয়। [ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া; আ. কা. শাওয়াল- ১৪৩৫ হি.]

শবে বরাতের গোসল সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা—
অনেকে আবার শবে বরাতে বিশেষ গোসল করে থাকেন। তাঁদের ধারণা, “যে ব্যক্তি শবে বরাতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে গোসল করবে, গোসলের প্রতি ফোঁটা পানির পরিবর্তে তাঁর আমলনামায় ৭০০ রাকাত নফল নামাজের সওয়াব লেখা হবে।”— এই বর্ণনাটি নিঃসন্দেহে জাল। এর কোনো ভিত্তিই নেই।

শরিয়ত গর্হিত কর্মকাণ্ড—
বিভিন্ন জায়গায় আতশবাজি ফুটানো, আগরবাতি জ্বালানো, আলোকসজ্জা করার প্রথাগুলোও সম্পূর্ণ কুসংস্কার এবং বিদ‘আত। এসব ভ্রান্ত কর্মকাণ্ড অপব্যয়ের নামান্তর। মহান আল্লাহ ‘সুরা বনি ইসরাইল’-এর ২৭ নং আয়াতে বলেছেন, “নিশ্চয় অপব্যয়ীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।” অন্যত্র সুরা আ‘রাফ-এর ৩১ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়ীকে আল্লাহ ভালোবাসেন না।”

এমন মহার্ঘ-পবিত্র শবে বরাত উপলক্ষে ইসলামি শরিয়ত গর্হিত কর্মকাণ্ড থেকে আমাদের বেঁচে থাকা অত্যাবশ্যকীয়। মহান আল্লাহ কুরআন কারিমে ‘সুরা জারিয়াত’-এর ৫৬ নং আয়াতে বলেছেন, “আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি মানুষ এবং জিন।” তাই মানুষের প্রতিটা কাজ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা তাঁর ইবাদতের উদ্দেশ্যে হওয়া আবশ্যক। কিন্তু ইবাদতের ক্ষেত্রে সঠিক-বেঠিক, বৈধ-অবৈধের মিশেল হওয়ার দরুন আমরা সাধারণ মুসলিমরা আমল করার ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দে পড়ি। অনেক আমল করা সত্ত্বেও ফলাফল শূন্যই থেকে যাচ্ছে। অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিখাদ করো তোমাদের ইমান। অল্প আমলই হবে নাজাতের জন্য যথেষ্ট।” [বায়হাকি, শুআবুল ইমান- ৬৪৪৩]

খেয়াল রাখতে হবে, আমলগুলো যেন হয় ইসলামি শরিয়তসমর্থিত; এতটুকু যেন অতিরঞ্জিত বা নব উদ্ভাবিত না হয়। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী হলো মহান আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ হলো মুহাম্মাদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো (দীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আত হলো ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম হলো জাহান্নাম। [সহিহ মুসলিম- ১৫৩৫; সুনান আন-নাসায়ি- ১৫৬০, হাদিসের শব্দ নাসায়ি থেকে চয়িত।]

আমাদের জ্ঞান সসীম আর মহান আল্লাহর জ্ঞান অসীম। আমরা অজ্ঞ আর মহান আল্লাহ বিজ্ঞ। তাই অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। ভুল ও বিস্মৃতির সমষ্টিই মানুষ। মহান আল্লাহই সবকিছু খুব ভালো জানেন। হক্কানি আলেমগণের পরামর্শ নিয়ে আমাদের জীবনযাপন করা উচিত। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্ট মোতাবেক পরিশুদ্ধ আমল করার পূর্ণ তাওফিক দান করুন। আমিন, ইয়া রাব্বাল আলামিন। ●

লেখক: মাহদী হাসানাত খান। (শিক্ষক, জামিয়াতুল আশরাফ ঢাকা)

-এ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ