শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


ইতিহাসে সিপাহী বিদ্রোহ, ১৩ হাজার আলেমের ফাঁসি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবদুল্লাহ তামিম: ইংরেজ বেনিয়াদের ভারত উপমহাদেশ থেকে তাড়ানোকে কেন্দ্র করে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যে তুমুল সংগ্রাম ফেনিয়ে ওঠে তার চূড়ান্ত পরিণতি আসে অন্তত ১৩ হাজার আলেমের ফাঁসির মধ্য দিয়ে।

মোঘলদের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর পরিণত হন রাজনীতির শোপিসে । শাহ ওলীউল্লাহ ও সাইয়েদ আহম শহিদ (রহ)-এর ত্যাগ-তিতিক্ষার যে ইতিহাস এর পূর্বে রচিত হয়েছে, যদিও সেটাই হলো এই ক্ষেত্রে ইংরেজ মূল ভীতির কারণ । কিন্তু ১৮৫৭ সাতান্ন সিপাহি বিদ্রোহের পর একদিকে আলেমগণ এবং অন্যদিকে ইংরেজ উভয়েই খোলাখুলি শত্রুতায় জড়িয়ে পড়েন ।

সিপাহী বিদ্রোহোর সূচনা যেভাবে

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে ইংরেজরা সিপাহী বিদ্রোহ বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। যদিও এটা কেবল সিপাহী বিদ্রোহ ছিলো না, সর্বস্তরের জনগণেরও বিদ্রোহ ছিলো । ভারতে ইংরেজের শাসনের বিরুদ্ধে ধূমায়িত আক্রোশের এটাই ছিলো প্রথম বিস্ফোরণ।

এ বিদ্রোহে মুসলমানের সাথে হিন্দু সমাজের বিরাট অংশও যোগ দেয়। কেবল বাংলার হিন্দুরাই একমাত্র ইংরেজের পক্ষালম্বন করে বিশেষ কৃপা পাবার আশায় । সিপাহীদের বিদ্রোহের সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো কার্তুজে শুয়োরের চর্বি ব্যবহার সম্পর্কিত গুজব।

কেননা, কার্তুজ তাদের ছিঁড়তে হতো দাঁত দিয়ে । ফলে মুসলমান-হিন্দু সকল সিপাহী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে স্বাভাবিকভাবে । ১৮৫৭ সালের ২ জানুয়ারী দমদম থেকে শুরু হয় এবং ফেব্রুয়ারীতে কোলকাতা থেকে ১৬ মাইল দূরে বারাকপুর সেনানিবাসে মংগল পাণ্ডে নামক এক হিন্দু সৈনিক এক ইংরেজ সার্জেন্ট মেজরের ওপর গুলী চালিয়ে এই বিদ্রোহের উদ্বোধন করে।

তারপর মিরাঠে অবস্থিত সবচে’ বড় সেনানিবাসে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিদ্রোহী সৈন্যরা দিল্লীর দিকে মার্চ করতে শুরু করে, যেখানে ছিলেন ক্ষমতাহীন শেষ মোঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর। (উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী, খ. ৪, পৃ. ২৫০)

ভারতের থানভবনে আলেমদের মোর্চা

সেনা বিদ্রোহের কারণে চতুর্দিকে আইন-শৃংখলার চরম অবনতি দেখা দিলে এবং ইংরেজ শাসকরাও ভীতি ও আতংকের মধ্যে অবস্থান করতে তখন সাহারানপুরের ইংরেজ কালেকটর মি. স্প্যাংকির একটি চক্রান্তমূলক পদক্ষেপ নেন। বিনা দোষে তিনি থানাভবনের প্রভাবশালী রইসের ছোট ভাই কাজী আবদুর রহীম ও তার দলবলকে সাজানো মামলায় ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ঘোষণা করে তড়িঘড়ি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলায়। এ ঘটনায় থানাভবন, নান্নুতা ও চারদিকের থানাগুলোর জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

তাছাড়া এসব এলাকার সকল প্রতিষ্ঠিত ও মশহুর আলেমের মুরব্বী হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কীর বাসস্থানও ছিল এখানে। শহীদ কাজী আবদুর রহীমের বড় ভাই কাজী ইনায়েত আলী খান এসময় জনগণের বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য ওলামায়ে কেরাম জরুরী বৈঠকে বসেন ।

কাসেম নানুতবী এলেন নানুতা থেকে এবং মওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব সাহারানপুর থেকে । রহমতুল্লাহ কিরানভীকে দিল্লীর সঠিক অবস্থা জানার জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিল। তিনি ফিরে এসে বৃদ্ধ বাদশাহ ও তার শাহজাদাদের অনভিজ্ঞতার রিপোর্ট পেশ করেন। প্রথম বৈঠকে সাইয়েদ আহমদ শহীদ প্রবর্তিত এ যাবত যে সংস্কারমূলক ও রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থাপনা চলে আসছিল তাকে একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার রূপ দেবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেবকে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার ‘আমীর’ নির্বাচন করা হলো।

মওলানা মুহাম্মদ কাসেম, মওলানা রশীদ আহমদ, হাফেজ যামেন, মওলানা মুহাম্মদ মুনীরের ন্যায় নেতৃবৃন্দকে সেনাবাহিনী, প্রতিরক্ষা, আইন-শৃংখলা ও বিচার বিভাগ ইত্যাদি পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়।৩ এই সংগে বাদশাহর একান্ত সহচর নওয়াব শের আলী মুরাদাবাদীকে বাদশাহর কাছে পাঠানো হলো যথাযথভাবে আইন-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত রাখার এবং তাদের সাথে সহযোগিতা করার বার্তা দিয়ে। (সাওয়ানেহে কাসেমী, খণ্ড ২, পৃ. ১০৫)

মওলানা মানাযির আহসান গীলানী লিখেছেন, ‘বাদশাহকে শামেলীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য শের আলী সাহেবকে বাদশাহর কাছে পাঠানো হয়েছিল।’ কারণ ইতিপূর্বে বাদশাহর ইনকিলাবী ফৌজকে নেতৃত্ব দান করে শাহী জুলুস সহকারে ১২ মে দিল্লী শহর পরিভ্রমণ করেছিলেন। বড় বড় বাজার খোলার ব্যবস্থা করেছিল এবং জনগনকে শান্তি ও নিরাপত্তা দানের ওয়াদা করেছিলেন।

কাজেই শামেলীতে ওলামা গ্রুপ যেভাবে মোর্চা গঠন করে হাজী ইমদাদুল্লাহর নেতৃত্বে স্বাধীনতার ঝাণ্ডা উঁচু করেছিলেন তার ফলে দিল্লী থেকে বাদশাহর নেতৃত্বে ইনকিলাবী ফৌজ এদিকে আক্রমণ পরিচালনা করলে দিল্লী থেকে নিয়ে এই পুরো এলাকাটাই ইংরেজ দখল ও শাসনমুক্ত হয়ে যেতে পারে। (মওলানা মুহাম্দ কাসেমের জীবন কথা, খ. ২, পৃ. ১৩৭)

আলেমেদের দিল্লি যাত্রা

নানা আলোচনা ও পর্যালোচনার পরে হাজী সাহেবের হাতে সকল আলেম জিহাদের বাইআত গ্রহণ করেন। অর্থাৎ প্রথমে হাজী সাহেবকে আমির করা হয়েছিল এলাকার শাসন পরিচালনা করার জন্য। এবার তার হাতে বাইআত করলেন জানমাল কুরবানী করার জন্য। প্রশ্ন ওঠে তাদের গঠিত বাহিনী যাবে কোনদিকে? দিল্লীর দিকে মার্চ করাই ছিল স্বাভাবিক। কাজেই দীন ও স্বদেশভূমির এই প্রাণ উৎসর্গকারী দল জীবন বাজি রেখে একটি সুসংগঠিত শক্তির সাথে মোকাবিলা করার জন্য নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েন। প্রথমে তারা শামেলী হয়ে দিল্লী যাবার জন্য এগিয়ে যান। ধ্বনি ওঠে, দিল্লী চলো। (সাওয়ানেহে কাসেমী, খ. ২, পৃ. ১২৯)

তেরো হাজার আলেম ফাঁসি হলো যেভাবে

ইংরেজের ভাষায় থানাভবন এই আলেম নেতৃবর্গ ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ক্ষেত্রে এমন কোনো অপরাধ নেই যা করেনি। তারা থানাভবনে শের আলীর বাগানে হামলা করে ইংরেজ সেনাদলকে পরাজিত করছে, তাদের কমান্ডারকে হত্যা করছে, তোপ ছিনিয়ে নিয়েছে, তারপর শামেলিতে আক্রমণ করে সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেছে, সরকারি ইমারত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, নিজেদের স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছে ইত্যাদি। সুতরাং ইংরেজরা চাইছিলো আলেমদের হাতির পদতলে পিষে মারতে বা সাগর পাড়ে দেশান্তর করতে ।

যদিও এই সমস্ত বিদ্রোহাত্মক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও কতিপয় আলেমের প্রাণে বেঁচে যাওয়াটা ছিলো অনেকটা অলৌকিক ব্যাপার । অবশ্য পরে তাদের কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। সময় তাদের অনুকূল ছিল না। ইংরেজরাও তাদের শত্রুকে চিনতে ভুল করেনি। ফলে সারা দেশে প্রায় তেরো হাজার আলেমকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়।

এডওয়ার্ড টমাস দিল্লী শহরের হৃদয়বিদারক ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে লিখেছেন, একমাত্র দিল্লী শহরে পাঁচশো শ্রেষ্ঠ আলেমকে শুলবিদ্ধ করা হয়েছিল। জল্লাদদের বাধ্য করা হতো যাতে তারা বেশি সময় পর্যন্ত লাশ শূলের ওপর টাঙিয়ে রাখে। ময়দানে প্রতিষ্ঠিত শূলদণ্ডগুলো থেকে বারবার লাশ নামানো হচ্ছিল। আর তা দেখে সাম্রাজ্যবাদী শাসক ইংরেজদের কলিজা ঠাণ্ডা হচ্ছিলো। [সাওয়ানেহে উমরী, মওলানা মুহাম্মদ কাসেম, লেখক মওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব]

সন্দেহ নেই সিপাহী বিদ্রোহ ছিলো একটি উপলক্ষ মাত্র। আসলে শাহ ওলীউল্লাহর নতুন ও বিপ্লবী ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সমগ্র উপমহাদেশে ইসলামী পুনরুজ্জীবনের যে কার্যক্রম শুরু হয় এবং যাতে নেতৃত্ব দেন তার সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলবী।

তারই সূত্র ধরে সারা ভারতে আলেম সমাজের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান চর্চা বৃদ্ধি পায়। ইসলামকে তারা উনিশ শতকের ভারতবর্ষের জাতি-বর্ণ নির্বিশেষ সকল মানুষের জন্য রাজতন্ত্রের পরিবর্তে একটি পরামর্শভিত্তিক যথার্থ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইনসাফপূর্ণ নিয়ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। আর ধীরে ধীরে তারা সফলকাম হচ্ছিলেন। আজ গোটা ভারতবর্ষ  জুড়ে তাদেরই দাওয়াতের দীপ্ত দেখা যায়।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ