বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


আলেম ও সমাজবান্ধব একজন ব্যক্তির বিদায় ও তার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাওলানা রোকন রাইয়ান
নির্বাহী সম্পাদক

পৃথিবীতে একদিন কেউ থাকবে না। সবাইকে চলে যেতেই হবে। সাড়া দিতে হবে আল্লাহর ডাকে। তবে কারো কারো দ্রুত চলে যাওয়া সমাজের জন্য বয়ে আনে সাময়িক অন্ধকার। যদিও তা আল্লাহ পাকের অপার কুদরতে একসময় পূরণও হয়ে যায়। কিন্তু সাময়িকভাবে পড়তে হয় বিপাকে।

সম্প্রতি আমার শ্বশুর আবুল কালাম আজাদ ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতুল ফেরদাউন নসিব করুন। আমার দেখা এ সময়ে তিনি ছিলেন একজন অন্যরকম মানুষ। বিশেষ করে সাধারণ একজন মানুষ এবং ডিফেন্সে চাকরি করেও তিনি যেভাবে সমাজকে ইসলামি চিন্তায় সাজাতে চাইতেন এবং আলেম উলামাকে ভালোবাসতেন তা ছিল সত্যিই বিরল।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন জনাব আবুল কালাম আজাদ রহ.। সমাজে তার কাজ ও প্রভাব নিয়ে ফেসবুকে ছোট্ট করে লিখেছিলাম। তবে তার একটি অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করার তাগিদে আজ বিষয়টি এখানে তুলে ধরছি। আশা করি আল্লাহ পাক তার কোনো দয়াবান বান্দার মাধ্যমে অসমাপ্ত কাজটি পূর্ণ করবেন।

এ বছরের শুরুতে আবুল কালাম আজাদ রহ. আমাকে কল দিয়ে বললেন, আমাদের এলাকায় (শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী থানার ফাকরাবাদ গ্রাম) তো কোনো মহিলা মাদরাসা নেই। এখানকার যারা মাদরাসায় পড়তে আগ্রহী তাদের বেশ কষ্ট করতে হয়। অনেকেরই পড়ার আগ্রহ থাকলেও মাদরাসায় পড়া হয় না। তাই এলাকার মুরব্বি ও আলেমদের প্রস্তাবে আমি একটি মাদরাসার কাজে হাত দিচ্ছি। দোয়া করো।

তখন ভেবেছিলাম হয়তো এটা মাত্র স্বপ্ন- ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু কয়েক দিন পর খবর নিয়ে দেখি কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। মাদরাসার জন্য বাবা ৭ কাঠা (৩৫ শতাংশ) জায়গা দিয়েছেন। সেখানে মাটিও ভরাট হয়েছে। বানানো হয়েছে খুঁটি। গত শুক্রবার ২২ ফেব্রুয়ারি এলাকার সবাইকে নিয়ে মুনাজাতের মাধ্যমে কাজ উদ্বোধন করেছেন।

আমার শ্বশুর মরহুম আবুল কালাম আজাদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সাধারণ শিক্ষার মানুষ হলেও চলতেন আলেম উলামাদের সাথে। এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা, ঈদগাহ তার হাতেই উন্নত হয়েছে। দৈহিক ও মানসিকভাবে তিনি ছিলেন প্রচণ্ড শক্তিশালী। যে কারণে ঢাকা, টেকনাফ, ময়মনসিংহ যেখানেই চাকরি করেছেন তার ভয়ে অপরাধীরা ছিল তটস্ত।

এলাকায় তিনি থাকলেই অন্যরকম প্রশান্তি ও নিরাপত্তাবোধ করত মানুষ। একটা অন্যরকম ভরসা পেত।তিনি খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই চলে গেলেন। বয়স হয়েছিল ৫৫। এখনো তিন বছর চাকরি ছিল। কোন অসুখও ছিল না। যে কারণে প্রথমে মৃত্যুর খবর কেউ বিশ্বাসই করেন নি।

২১, ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি অফিস ছুটি ছিল। বাড়িতে এসেছিলেন। যাওয়ার কথা ছিল ২৪ তারিখ সকালে। কিন্তু এক কলিগের মেয়ের বিয়ে থাকায় ২৩ তারিখেই চলে যান। সব কলিগ মিলে বিয়েতে অংশ নেন। শৈশবের মতই আনন্দ করেন বিয়েতে।

সেই রাতে হঠাত ৩টার দিকে বুকে ব্যথা। এক বন্ধুকে নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেলে গেলেন। ব্যথা বেশি হলেও কাউকেই জানান নি। প্রকাশও করেন নি। হাসপাতালের চার তলা সিঁড়ি ভেঙে একাই উঠেছেন উপরে। বেডে গিয়ে শোয়ার কিছুক্ষণ পরই কালিমা পড়তে পড়তে সাড়া দেন আল্লাহর ডাকে।

আবুল কালাম আজাদ রহ. এর মৃত্যু এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল এলাকায়, আত্মীয়দের কাছে যা প্রকাশের অপেক্ষা রাখে না। এলাকার মানুষ এত কেঁদেছেন, আপসোসে ভেঙে পড়েছেন যা অকল্পনীয়।

এত কাঁদছেন কেন মানুষ? অসংখ্য কারণ রয়েছে। প্রথমত এই স্বার্থপর সময়ে উনার মত মানুষ বিরল। দাফনের পরদিন বাদ ফজর মসজিদে আলোচনা করা এলাকার মানুষদের থেকেই কিছু শোনাই।

এক যুবক বললেন- আমার বাবা যখন ঘর তুলে টাকার অভাবে টিন কিনতে পারছিলেন না। বাঁশের পুরনো বেড়া দিয়ে কোন মত ঢেকে রাখা হয়েছে ঘর। একদিন কালাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন ঘরের বেড়া দিচ্ছেন না কেন? বললেন, চালের টিন কেনার পর টাকা শেষ হয়ে গেছে।

জানতে চাইলেন, কত টাকা লাগে? বললেন ৭ হাজার।বিকালেই এক লোকের মাধ্যমে পৌঁছে দিলেন সাত হাজার টাকা।

একদিন এলাকার মাদরাসার এক হুজুর বাবাকে বললেন, মাদরাসায় নলকূপ নেই আমারা পানি খাই খুব কষ্টে।তিনি শুধু জানতে চাইলেন কত টাকা লাগবে? অংক জেনে সাথে সাথেই বললেন, আজই কাজ ধরেন টাকা পৌঁছে যাবে।

ফাকরাবাদ মাদরাসার মাওলানা মনির হুজুর জানালেন- মাঝে মাঝেই মাদরাসায় এসে ছাত্রদের বলতেন- এই তোমরা কী খাবে? কেউ কেউ বলতো বিরানি খাবো। শুনে বাবুর্চিকে বলতেন, সব ছাত্রকে বিরানি খাওয়ানোর আয়োজন করেন। চাল, গোশত কত কেজি লাগবে হিসাব করে আমাকে জানান।

এভাবে তিনি এলাকার প্রতিটি ঘরের, প্রতিটি মানুষের ছোট বড় উপকারে এসেছেন। মসজিদের সোলার, ঈদগাহের বাউন্ডারি সবকিছুতেই ছিল তার বড় অনুদান। এমন কখনো হয় নি তার কাছে কেউ টাকা ধার চেয়েছেন আর পায়নি।

এলাকার মানুষের সাথেও মিশেছেন দিলখোলাভাবে। দুলাল কাকা বললেন, বিকালে আমাকে রাস্তায় দেখলেই বলতেন চলো বাজারে যাই। আমি যদি না করতাম তিনি বলতেন হুম জানি বাজারে না গেলে তোমার পেটের ভাত হজম হবে না, ভঙ্গি না দেখিয়ে চলো। বাজারে গেলেই দেখতাম হোটেলে ১০/২০/৩০ জন পর‍্যন্ত মানুষ চা, পেয়াজু খেত। কিন্তু কেউ তার আগে বিল দেয়ার সাহসই পেত না।অধিকাংশ সময় তিনি বাজারে যেতেন কেমন মানুষকে চা নাস্তা খাওয়াতে। তাদের সাথে একটু খোশ গল্প করতে।

শুক্রবার বাড়িতে এলেই এলাকার আলেমদের একেকজনের সাথে দেখা করতেন আর দাওয়াত দিয়ে রাখতেন- দুপুরের খাবারটা আমার ঘরে একসাথে খাবো। মিস করবেন না কিন্তু।

দীনি খেদমতে যা করতেন নামের উদ্দেশ্য কখনোই রাখতেন না। মাহফিলে দান করতেন নাম না ঘোষণার শর্তে। এক লোক মাদরাসার আলাপের সময় বলছিল, কালাম সাহেবের মাদরাসা। তিনি সেটা প্রুফ করে বললেন, এই কথা আর কখনো বলবেন না। বলবেন আমাদের মাদরাসা। মাদরাসাটা সবার এমনটা যাতে বলতে পারে সে জন্য তিনি প্রথম দিন নিজের টাকার সাথে সবাইকে কিছু কিছু দিতে বললেন আর বললেন মাদরাসা দেখাশোনা আপনারাই করবেন।

মাদরাসার জন্য ১০ লাখ টাকা বাজেট করেছেন তিনি। ইন্তেকালের ২ দিন আগে ইট আনেন। এঙ্গেল কেনা হয়। মিস্ত্রীদের কিছু টাকাও দিয়েছেন কাজ শুরুর জন্য। মিস্ত্রীদের কাজ শুরুর কথা ২৫ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু তিনি চলে গেলেন তার একদিন আগে। ২৪ ফেব্রুয়ারি। মাদরাসার কাজটি এখন প্রায় আটকে গেছে। আটকে গেছে তার স্বপ্নের সুন্দর একটি এলাকা গড়ার, দীনি পরিবেশ কায়েমের পরিকল্পনা।

এলাকার সুন্দর পরিবেশের জন্য সবসময় তিনি ফিকির করতেন। ঢাকায় তার এক আলেম বন্ধু থাকেন। মাওলানা আমিরুল ইসলাম। তাকে প্রায়ই বলতেন তুমি বাড়িতে চলে আসো। আমরা এলাকাটাকে ইসলামের পরিবেশে সাজাবো। এলাকার জন্য একসাথে কিছু কাজ করবো।

জানি না এমন একজন মানুষকে আল্লাহ পাক কেন দ্রুত নিয়ে গেলেন। তার স্বপ্ন, পরিকল্পনা এখন কিভাবে বাস্তবায়ন হবে। আল্লাহ পাক কোনো ভালো কাজ আটকে রাখেন না। কোনো না কোনোভাবে সেটাকে এগিয়ে নেন। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেছি আরো জোর গতিতে এগিয়ে নেন। আল্লাহ পাক হয়তো এখানেও সেরকম কোনো কুদরত রেখেছেন। আমাদের এখন সে অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই।

বাবার পরিকল্পনা ছিল আমি এবং আমার স্ত্রী মানে তার মেয়ে দুজনই যেহেতু আলেম, তাই একটা সময় আমাদের মাধ্যমে মাদরাসাটি পরিচালনা করবেন। এছাড়াও এলাকার কয়েকজন ভালো আলেম আছেন যারা সবসময় তার সঙ্গে থাকতেন তাদের দিয়েই মাদরাসটি চালু করার স্বপ্ন দেখতেন। আর সেটি ছিল এ রমজান থেকেই শুরু করা।

রমজান প্রায় এসে পড়েছে। মরহুম আবুল কালাম আজাদ থাকলে এতদিনে ঘরটাও উঠে যেতো। কায়েম হতো মাদরাসার সার্বিক পরিবেশ। কিন্তু সেই কাজটি আজ একটি আশঙ্কার মধ্যে পড়ে গেছে। তবে আমি আমরা সবাই এখনো বিশ্বাস করি মরহুম আবুল কালাম আজাদ রহ. এর স্বপ্ন আর পরিকল্পনা খুব শিগগির বাস্তবায়ন হবে ইনশাল্লাহ। এ বিষয়ে সবার আন্তরিক নেক দৃষ্টি কামনা করছি।

মাদরাসাটির বিষয়ে যে কোনো কথা, পরামর্শ ও সহায়তার জন্য কেউ যোগাযোগ করতে চাইলে নিচের নাম্বাটিতে কল করুন। আমরা সবার কাছে দোয়ার মুহতাজ যেন সুন্দর এ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে পারি দ্রুত। অনেক অনেক শুকরিয়া। ফোন: ০১৭১৭-৮৩১৯৩৭

এআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ