শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


বাংলাদেশে আইসিসির তদন্ত দল, রোহিঙ্গা মুসলমান গণহত্যার প্রমাণ সংগ্রহ করবে তারা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আওয়ার ইসলাম: রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চালানো গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করতে বাংলাদেশে এসেছে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) প্রতিনিধিদল। বুধবার বাংলাদেশে আসা এ দল আজ বৃহস্পতিবার থেকে কক্সবাজারে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করবে তারা।

আইসিসির বরাত দিয়ে বেনার ডটঅরজ এ খবর প্রকাশ করেছে। আইসিসি তদন্ত দলের এই সফরের উদ্দেশ্য- তদন্ত নয়; প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিরপেক্ষ প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করবেন।”

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব এম শহীদুল হক বেনারকে জানান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম এবং তার সঙ্গে বৈঠক করবেন নেদারল্যান্ডস থেকে আসা এই তদন্তকারীরা।

“বৈঠকগুলোর পরে তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে,” বলেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আইসিসির প্রধান আইনজীবী ফেতৌ বেনসুদার নেতৃত্বে সাত সদস্যের তদন্ত দলটি ঢাকায় পৌঁছেছে।

মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। সাত দিনের সফরের অধিকাংশ সময় রোহিঙ্গাদের সাথে কাটাবেন তদন্তকারীরা।

এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম বেনারকে বলেন, “আইসিসির তদন্ত দলটি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেখা করে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করবে।”

কক্সবাজারের স্থানীয় পুলিশ সূত্র জানায়, আগামী ৮ থেকে ১২ মার্চ বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবে প্রতিনিধি দলটি।

“বাংলাদেশে থেকে ফিরে এই দলটি যে প্রতিবেদন আদালতে জমা দেবে, তার ওপর শুনানিতে নির্ধারিত হবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের অপরাধের পূর্ণ তদন্ত হবে কিনা,” বেনারকে বলেন নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মোহাম্মদ বেলাল।

তিনি আরো বলেন, “এই প্রতিনিধিদলের সদস্যরা মূলত তদন্ত প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ।”
তারা এমন এক সময়ে এসেছে যার মাত্র দুই দিন আগে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যামূলক নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো এবং তাদের নিজ বাসভূমি থেকে পালাতে বাধ্য করার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ অনুমোদন করেছে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৬তম কাউন্সিলের শেষ দিনে (২ মার্চ) আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) বিচার চাওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে বলে সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়বে
আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি মনে করেন, ওআইসির প্রস্তাব এবং আইসিসির প্রতিনিধিদলের সফর রোহিঙ্গাদের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াবে।

“তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি আইসিসিকে এমন একটি দেশের অপরাধ বিচার করতে দেবে, যারা তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়? যদি তেমনটা না হয় তবে অন্যান্য দেশও আইসিসির সাথে থাকতে নিরুৎসাহিত বোধ করবে,” বেনারকে বলেন তিনি।

যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, “মিয়ানমার সদস্য না হওয়ার কারণে বিচার সম্পন্ন বা শাস্তি কার্যকর করা হয়ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তবে আইসিসির বিচারে কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হয়, সেটাও অনেক ইতিবাচক ঘটনা হবে।”

“রাখাইনে গণহত্যা ও জাতিগত নিপীড়নের জন্য দায়ীরা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হওয়াও মিয়ানমারের জন্য একপ্রকার শাস্তি। কারণ শুরু থেকেই এমন অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে দেশটি,” বলেন তিনি।

বিশ্লেষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আইসিসি মূলত ব্যক্তি বিশেষের অপরাধের দায় নিরূপণ করে, আর আইসিজে রাষ্ট্রের। গণহত্যার মামলায় আইসিসির বিচারিক এখতিয়ার অস্বীকার করলেও আইসিজের বিচারিক এখতিয়ার অস্বীকার করা মিয়ানমারের পক্ষে সম্ভব হবে না।

কারণ তারা গণহত্যাবিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী এবং আইসিজের এখতিয়ারও স্বীকার করে।

এটা আমরা সহ্য করব না: মিয়ানমার
মিয়ানমার সরকারের এক মুখপাত্র মিয় নুন্ট মঙ্গলবার বেনারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে জানান, ওআইসি যদি নির্বিচারে সবাইকে ‘জাতিগতভাবে রোহিঙ্গা’ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চাপ দেয়, সেটা হবে তাদের সার্বভৌমত্বে আঘাতের শামিল।

“এটা আমরা সহ্য করব না। তারা (ওআইসি) শক্তি প্রয়োগ করলে আমাদেরও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে,” বলেন ওই মুখপাত্র। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল বলেন, “মিয়ানমার এখন অনেক কিছুই বলতে পারে। তবে ‘ওআইসি’ নিজেদের কাজ করে যাবে।”

বাংলাদেশি বিশ্লেষক ড. দেলোয়ারের দাবি, “এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের বাংলাদেশকে দায়ী করার সুযোগ নেই। কারণ আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমরা আইসিসি বা আইএসজে-কে সহায়তা করছি।”

রেডিও ফ্রি এশিয়াকে মিয় নুন্ট আরও জানান, কক্সবাজারে অবস্থানকারী যেসব রোহিঙ্গার ১৯৯৩ সালের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী রাখাইনে বসবাসের প্রমাণ রয়েছে, তাদেরই শুধু স্বীকৃতি দিতে ও ফিরিয়ে নিতে রাজি মিয়ানমার।

আইসিসির প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসার ঠিক আগমুহূর্তে ঢাকা ও কক্সবাজার ঘুরে গেছেন এশিয়া বিষয়ক চীনের বিশেষ দূত সান গুয়োশিয়াং। তিনি প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেও তাকে বলা হয়েছে, জোর করে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পাঠাবে না বাংলাদেশ।

ঢাকায় বুধবার এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, “বর্তমানে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি বেসামরিক নিরাপদ অঞ্চল (সেফ জোন) প্রতিষ্ঠার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে।”

“এ ইস্যুতে চীন ও রাশিয়ার ভূমিকারও পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে এ সংকট শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া আরও সহজ হচ্ছে,” যোগ করেন মন্ত্রী।

রেডিও ফ্রি এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি জাতিসংঘের এক অনুষ্ঠানে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরির প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার।

যেভাবে সক্রিয় হয়েছে আইসিসি
আইসিসির প্রধান কৌশলী ফেতৌ বেনসুদার গত বছরের এপ্রিলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করার অধিকার আছে কিনা তা জানতে চেয়ে একটি আবেদন করেন। শুনানির পর গত ৬ সেপ্টেম্বরে আদালত জানায়, তার এই অধিকার আছে।

ওই রায়ের ঠিক ১১ দিন আগে জাতিসংঘ প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগের দায়ে মিয়ানমারের সেনা প্রধানসহ শীর্ষ ছয় জন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত এবং বিচার হওয়া দরকার।

বিচারের জন্য বিষয়টি আইসিসি-তে পাঠানোর আহ্বান জানানো হয় প্রতিবেদনে। যে কারণে রায়ের পরই প্রাথমিক তদন্ত শুরু করে আইসিসি। এর আগে আগস্টে মিয়ানমার এক বিবৃতিতে জানায়, আইসিসির উদ্যোগটি এখতিয়ার বহির্ভূত।

এরই মধ্যে ডিসেম্বরে আইসিসির ব্যুরো (শীর্ষ পরামর্শক পর্ষদের) সদস্য নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ। গত মাসের মাঝামাঝি মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন ফেতৌ। ওই বৈঠকেই তিনি মার্চের শুরুতে বাংলাদেশে আসার কথা জানান।

২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেই সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল।

গত এক বছরে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের কথায় উঠে এসেছে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের ওই লড়াই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে নয়।

কেপি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ