বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


ডাস্টবিনে নবজাতকের লাশ: সভ্য সমাজের চিত্র নয়!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

১৮ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাস্টবিন থেকে ৩১টি অপরিণত নবজাতক শিশুরমৃতদেহ ও ভ্রুণ উদ্ধার করা হয়েছে। যেগুলো বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। চোখ মেলে দেখার আগেই হত্যার শিকার হন নবজাতকরা! যারা বর্তমান সভ্যতায় বিশ্বাসী এবং এ সভ্যতার হাত ধরে সুন্দর এক পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেন। তাদের সে বিশ্বাস ও স্বপ্নে চির ধরেছে, প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে আসলেও কী এ সভ্যতা সুন্দর ও মুক্তির, নাকি সেকেলে বর্বরের?

সম্প্রতি এ ঘটনায় কেঁদে ওঠেছে মানবতা। কেন হচ্ছে এমন, কী কারণে হচ্ছে, মানবিক সামাজিক অবক্ষয় ও তা থেকে পরিত্রাণের বিষয়ে আওয়ার ইসলাম টোরেন্টিফোর ডটকম সম্পাদক কথা বলেছেন দুজন গুণীআলেমের সঙ্গে। একজন ঢাকার মুহাম্মদপুরের রাহমানিয়া আরাবিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা মামুনুল হক আরেকজন

উত্তরার বাইতুল আমান জামে মসজিদের খতিব শায়েখ মাওলানা আহমদ আলী।

শ্রুতি লিখনে ছিলেন মাওলানা রোকন হারুন

মাওলানা মামুনুল হকের কাছে জানত চাওয়া হয়, সম্প্রতি বরিশালের মেডিকেল কলেজের ডাস্টবিনে ২২ নবজতকের লাশ আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে কোন দিকে ইঙ্গিত করছে বলে মনে করেন?

উত্তরে তিনি বলেন, এ ঘটনা আমাদের সামনে দুটি বিষয়কে স্পষ্ট করে এবং দু‘দিকে ইঙ্গিত করে, প্রথমত, আমাদের দেশ ধর্ম পরায়ন মানুষের দেশ, রক্ষণশীল একটি দেশ, এখানে এমন ঘটনা ঘটা ভংকর একটা বিষয়।

গা শিউরে উঠার মতো সংবাদ। ইসলামি সভ্যতায় গড়া দেশে বাবা-মা পরিচয়হীন নবজাতকের লাশ পাওয়া কল্পনা করা যায় না। এ ঘটনা আমাদের যুব চরিত্র ও তরুণ-তরুণীদে খোলামেলা চলাফেরা, অবাধে মেলামেশা যে পশ্চিমা কালচার আমাদের দেশে আমদানি করা হয়েছে এবং ইতিমধ্য তা সমাজের কতটা গভীরে পৌছিয়েছে এ ঘটনা সেদিকে ইঙ্গিত করছে।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, আসলে শুধু আমাদের মতো রক্ষণশীল বা ইসলামি সমাজ ব্যবস্থার জন্যই শুধু অশুভ সংকেত না, এটা ভয়ংকর এক লোমহর্ষক ব্যাপারও, কোনও খোলামেলা দেশেও তো এমন চিত্র ভাবা যায় না।

এভাবে পড়ে থাকা ডাস্টবিনে সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক, নবজাতক সন্তানের লাশ আবর্জনায় নিক্ষিপ্ত হবে! আবার সেটা কোন মেডিকেলেরে ডাস্টবিনে, এ থেকে আরেকটি তথ্য বেরিয়ে আসে, এ প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত অর্থাৎ নবজাতকের মা বাবাই কেবল এ অপকর্মের সঙ্গে জড়িত না বরং সমাজে সভ্যতার মুখোশ পড়ে চলা এক শ্রেণির মানুষও জড়িত এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্তরাও এ অপরাধের সাথে সমানভাবে জড়িত।

সে দিকেও ইঙ্গিত করছে। এ ঘটনা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন পৈশাচিক পাপকর্ম তেমনই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও জঘন্য লজ্জাজনক অপকর্ম।

আমাদের সমাজে অদৃশ্যমান এমন হাজারো ঘটনা রাতের আঁধারে ঘটে যা মিডিয়ায় আসেনা এ বিষয়টা কেমন করে দেখছেন?

এটা তো বাস্তবিকই, যা ঘটে তার কিঞ্চিতই মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। তাছাড়া এ অপকর্মগুলো গোপনেই করা হয়। সে কারণে খুব সামান্যই খবরে আসে। এদিকে খেয়াল করলে তো আমাদের সমাজের আরো ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে।

বর্তমান ‘সমাজ’ এ অমানবিক অশ্লীল পাপকর্মের দিকে ধাবমান হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কারণ হল, সামাজিকভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মের ব্যাপারে উদাসিনতা এবং পরক্ষভাবে ধর্মীয় অনুশাসনে অনিহা প্রকাশ।

সাথে সাথে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও ধর্ম পালনকে সেকেলে, অনগ্রসরতার সভ্যতা বলে মানুষের সামনে তুলে ধরার যে প্রবনতা, আমি মনে করি এ কারণগুলোই হচ্ছে তার কুফল।

এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী হতে পারে বলে মনে করেন আপনি?

মানুষকে ধর্মীয় অনুশাসনেই ফিরে আসতে হবে। সমাজে বিচারহীনতার কালচার এবং সামাজিক নিরাপত্তা-ব্যবস্থা কতটা যে দুর্বল তা এ থেকে বুঝা যায়। আমাদের গোটা দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র কেবল রাজনৈতিক কারণে রাজনীতির ময়দানে তাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ।

সমাজের এ নিবির অবক্ষয় ও ধ্বংসের কারণগুলো চিহ্নত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার সময় তাদের নেই। কাজেই সামাজিক এ অবক্ষয়কে রোধ করতে হবে সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে। সকলক্ষেত্রে ধর্ম, নীতি-নৈতিকতার ব্যবস্থা নেয়া অতিব প্রয়োজন।

সেই সাথে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে এই ধর্মবোধ, নীতি-নৈতিকতার উম্মেশ না ঘটালে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে সমাজকে উত্তোলন করা সম্ভবপর না।

নীতি বিবর্জিত বর্বর এ আচরণ নবজাতককে হত্যা করা অপরাধের শামিল। নবজাতকের মা-বাবা, সম্পৃক্ত চিকিৎসা সেবা ভিবাগীয় কার্যালয় ও অসাধু ভণ্ডরা যারা এ হত্যর সাথে জড়িত-ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কেমন শাস্তি হওয়া দরকার সে বিষয়ে বলেন, নিঃসন্দেহে এটা হত্যাকাণ্ড।

ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হত্যাকাণ্ডের অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। সামাজে বিশেষ করে এমন ঘটনা রোধ করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করা বিশেষভাবে প্রয়োজন বলে মনে করি।

একই বিষয়ে কথা হয়েছিলো আলেম, লেখক ও গবেষক মাওলানা আহমদ আলীর সঙ্গে।

তিনি বলেন, আমি হিসেব মিলাতে পারছিনা। এ ঘটনা কি আদৌ বাস্তব নাকি অবস্তাব! বাস্তবতার সাথে তো মিলছে না। এরপর বলেন এ ঘটনার কারণে পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে দোষারপ করা যায় না। সব জায়গায় কলুষিতকারী নিদির্ষ্ট কিছু লোক থাকে, আল্লাহর মেহেরবানি, গণমাধ্যমগুলো আমাদের জন্য নেয়ামত শরূপ-যদি তারা সততার সঙ্গে কাজ করে।

কেননা, গণমাধ্যমের দ্বারা অনেক অসঙ্গতি ও দুষ্টমি বেয়িয়ে আসবে, যদিও আগে এসব ছিল কিন্তু তা বেরিয়ে আসতো না। এখন বেরিয়ে আসছে, এরজন্য সত্যিই সবচেয়ে বড় বিষয় হল, মানুষকে মানবিক জয়গানটা শেখাতে হবে। যদি মানুষের মধ্যে মনুষত্ব ফিরে আসে তাহলে মানুষ এমন কাজ করতে পারে না।

সমাজের মৌলিক অবক্ষয় কেনো হয়?

এ অবক্ষয়ের মূল কারণ দু‘টি। প্রথমত মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় কমে যাচ্ছে। আল্লাহর ভয় কমে যাওয়ার ফলে এ কাজ করতে পারছে, কেননা, কোন দ্বীনদারের দ্বারা একাজ হওয়া সম্ভব না।

দ্বিতীয়ত মানুষের মানবিক গুন মানুষ হারিয়ে ফেলছে। এটা কিছুতেই মানুষের কাজ না। মানুষের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব না। সুতরাং একাজটা অসঙ্গতি, মানবতার সঙ্গে অসঙ্গতি।

বর্তমান তরুণ-তরুণীদের মাঝে এ অবক্ষয় রোধ করার বিষয়ে বলেন, মিডিয়া যেরকমভাবে মানুষকে স্বাস্থ্যর ব্যাপারে সচেতন করছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপারে সচেত করছে ঠিক অনুরূপ মানুষকে মানবিকতার ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে।

আর এটা করতে হবে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে, যেন প্রতিটি সমাজ প্রতিটি মানুষ একজন সুন্দর মানুষ হয়।

নবজাতক শিশুদেরকে এভাবে হত্যা করে ফেলে রাখার বিষয়ে বলেন, এদেরকে হত্যার অপরাধিদের কী বিচার হবে তা ঠিক করবে আদালত। হত্যার যে শাস্তি, আদাল সে শাস্তিই প্রয়োগ করবে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হত্যার শাস্তির বিধান বিষয়ে বলেন, বিচারের জন্য প্রথমে সাক্ষী লাগবে। সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণ হলে তখন ধর্মীয়ভাবে হত্যার যে শাস্তি ধার্য করা আছে সেটাই প্রয়োগ হবে। আর শাস্তিগুলো দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত, যাতে করে তা থেকে মানুষ শিখতে পারে এবং ভবিষ্যতে যেন এমন পাপকর্ম থেকে মানুষ বিরত থাকে।

উত্তরা ঢাকার বাইতুল আমান জামে মসজিদের খতিব, শায়েখ মাওলানা আহমদ আলী এ ঘটনায় আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কথা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমি তো ভেবেছিলাম এ ঘটনা কোন মানুষের সমাজে হয়নি, হয়তো পশুদের সমাজে মানবসন্তানদের আকৃতির কিছু পাওয়া গেছে।

কিন্তু যখন জানতে পারলাম এটা মানুষের সমাজে ঘটেছে, শুনেই গা’টা শিউরে উঠেছে। ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল, মানব সমাজে এমন অমানবিক ঘটনা ঘটতে পারে!?

জঘন্য এ পাপ কর্মের সাথে যারা জড়িত (বাবা-মা,পরিবার ও সংশ্লিষ্ট) তাদের প্রতি বিশেষ নসীহা মূলক বার্তা দেয়ার সময় বলেন, মাদকতার ভয়াবহতারও ছোবল এখানে স্পষ্ট প্রতিফলিত। আগেও বলেছি কোন সুস্থ মানুষ এ কাজ করতে পারে না।

যাই হোক এ ন্যাক্কারজনক কাজরে কারণে প্রথমে অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করত হবে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরানে ঘোষণা করেছেন, বনী আদম গুনাহের পর ভুল বুঝে যদি অনুতপ্ত হয়ে ভবিষ্যতে না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে তাওবা করে তাহলে দয়াময় আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।

দ্বিতীয়ত ‍ধর্মীয় অনুশাসনের ছায়াতলে আনতে হবে। সামাজিকভাবে সুন্দর পৃথিবী গড়ায় ইসলামি সভ্যতার চর্চা করতে হবে।

-এটি


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ