শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


রাহাফ আল কানুন: সৌদির গায়ে কালিমা; মুসলিম মিল্লাতের?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আলী আবদুল মুনতাকিম
প্রকৌশলী ও কুরআন গবেষক

মুশকিল হল সৌদ আরবের সাথে ইসলাম বা মুসলমান আমরা গুলিয়ে ফেলি, অবশ্য যুক্তিসংগত কারণও আছে। ইসলামের নবী, মানবতার নবী, বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা. এর জন্মভূমি যে মক্কায়, আল্লাহর ঘরও যে মক্কায়, মানবতার গাইডবুক কোরান তথা ইসলামি শাসন বা সমাজ ও পারবারিক ব্যবস্থার জীবন্ত আদর্শ মুহাম্মদ সা. শুয়ে আছেন মদিনায়, মসজিদে নববীও মদিনায়, কোরান নাযিল হয়েছে মক্কা ও মদিনায়। দুই পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনা তো সৌদি আরবে। ঐতিহাসিক তায়েফ, বদর, ওহুদ, খন্দক এগুলো সবই তো সৌদি আরবে।

তাই ইসলাম, মুসলমান, সৌদি আরব আলাদা করা অনেকের জন্যই কঠিন। মুহাম্মদ সা., মক্কা, মদিনা, কোরান, ইসলাম বিশ্বজনীন। কোন দেশ বা জাতির সম্পদ নয় তা আলাদা করে ভাবলে সমস্যা থাকে না, কিন্তু আলাদা ভাবাটা সহজ নয়। আলাদা ভাবতে হত না যদি সৌদি আরব কোরান সুন্নাহ এর শতভাগ ধারক বাহক হত।

আমার কাছে মনে হয় সৌদি আরব একটা বিশাল সাদা পাঞ্জাবি। একটু কালো দাগ পড়লেই বড় করে দেখা যায়। যে সমাজ কালো সেখানে কেউ কালো দাগ দেখে না। বিষয়টা কেন সৌদি আরব বুঝে না আমার জানা নেই।

তাদের দেহ তেলতেলে, তাই তেলের উপর বিপদ আপদগুলো পড়ে আর একে একে পিছলে যাচ্ছে। এভাবে তেলের প্রভাব দিয়ে কতদিন চলতে পারবেন জানা নেই। আপনাদের বড় পাওয়ার ছিল মুহাম্মদ সা. এর আদর্শ। রাসুলের পোমাক, হজের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া নবী সা. এর কিছু আপনারা মানেন কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঈসরায়েলের ইহুদিরা মারছে ফিলিস্তিনিদের, আপনারা মারছেন ইয়েমেনের নারী শিশুদের, সাধারণ মানুষদের। কাতারকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন, মিশরের বর্তমান স্বৈরশাসক সিসিকে অন্ধ সমর্থন আর সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। আপনাদের বাদশাহী শাসনের সমালোচনাকারী জামাল খাশোগজিকে কিলার পাঠিয়ে হত্যা করেছেন।

বর্তমানে বলা হয় সৌদি আরব দেশটি নাকি একটি কারাগার। শত শত আলেম কারাবন্দি।মিডিয়ায় প্রচার পাওয়া এসব খবরের জবাব দেয়ার যোগ্যতাও তাদের নাই। আল জাজিরার মত একটি চ্যানেল তারা খুলতে পারেনি। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বাড়িগুলো কিনতে পেরেছে। এগুলো কি মুহাম্মদ সা. এর শিক্ষা?

ইরাক, সিরিয়া, আফগান, মায়ানমারের মুসলিম হত্যায় কোথায় আপনাদের ভূমিকা? আলজেরিয়া, লিবিয়া, সুদানে বা সোমালিয়ায় আপনাদের কি কিছুই করার নেই।

রাজপুত্রের যে বাড়ি আর বাহন দেখতে পাই ইউটিউবে, তা দিয়ে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর (ইয়েমেন-ইরাক- সিরিয়ার কথা বাদ দিলাম) অসহায় নারী ও শিশুদের কয়েকবছরের চিকিৎসা সম্ভব।

যাক ধান ভানতে শীবের গীত অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে। কথাগুলো মনের কষ্টে বললাম।

এই সেদিন ইউটিউবে দেখলাম- দুনিয়ার তাবৎ দামি গাড়ি, জাহাজ, প্লেন, বাড়ির মালিক যুবরাজ। এগুলো দেখে ইয়েমেনের শিশুদের করুন চিৎকার আর মৃত্যুর বিভীষিকা দেখলাম।হায় সৌদি আরব!!

জামাল খাশুগজি হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই বিশ্বের নজর কেড়েছে, বলা যায় আবার রোস্ট হচ্ছে সৌদি আরব। এবার ইস্যু ‘রাহাফ মুহাম্মদ আল কানুন’। চলুন আজকের বিষয়ে যাই।

১৮ বছর বয়স রাহাফ আল কানুনের। ১১ মার্চ ২০০০ সালে উত্তর সৌদি আরবের এক বিত্তশালী পরিবারে তার জন্ম হয়। দেওবন্দে অধ্যয়নরত ছাত্র আশরাফ আলম নদভি তার নিজ ভাষায় রাহাফের একটি আত্মকথা লিখেছেন এভাবে-

‘আমার পিতা সৌদি সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আমরা মোট নয় ভাই বোন। বিত্তশালী পরিবারে জন্ম নিয়েছি তাই আমার প্রতিপালন রাজকীয় ব‍্যবস্থায় হয়। একাধিক গৃহকর্মী আমাদের সেবায় হরদম নিয়োজিত ছিলো। প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান এর মডারেট ইসলামে আমি খুবই প্রভাবিত হই। এবং পাশ্চাত্যের আবিষ্কৃত ঘুণেধরা নারী স্বাধীনতা ও নারী সমতার স্লোগান গ্রহণ করে নিজ পরিবারে বিদ্রোহী হয়ে উঠি।

ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আজ কাফেরদের কোলে উঠে ইসলাম ও মুসলমানদের অপদস্ত করার সবচে বড় কারণ হয়ে দাঁড়াই । ধর্মত‍্যাগী মুরতাদ হয়ে যাওয়াতে কোনো প্রকার আক্ষেপ নেই আমার । আমি স্বাধীনতা চাচ্ছিলাম। এমন স্বাধীনতা যেখানে কোনো বাধাবিঘ্নতা ছাড়াই মেয়েদের মুক্তভাবে ঘুরতে দেওয়া হবে। অবাধে মিলামিশা করা যাবে। প্রেম ভালোবাসার নামে অশ্লীলতায় গা ভাসিয়ে দেওয়া যাবে। এমন স্বাধীনতাই আমি চাচ্ছিলাম।

কিন্তু ইসলামের গন্ডির ভিতরে, সৌদি আরবে বসবাস করে এই স্বাধীনতা সম্ভব ছিলো না । তাই আমি একটি যন্ত্র হিসেবে ব‍্যবহৃত হলাম। কৌতুক ছলে সারা পৃথিবীর ধ‍্যান আকর্ষণ করতে সক্ষম হলাম। এবং ‘সেইফ রাহাফ’ রাহাফকে রক্ষা করো আন্দোলন চালানো হলো। এভাবে আমি ক‍্যানাডার বাহাদুর কন‍্যা বলে স্বীকৃতি পেয়ে যাই ।

জি হ‍্যাঁ ! আমি সেই রাহাফ আল কানুন বলছি! যে ক‍্যানাডার নাগরিকক হওয়া ও সেখানকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী খৃষ্টাহ ফেরি ল‍্যান্ড এর সাক্ষাৎ লাভে সীমাহীন আনন্দ প্রকাশ করেছে। এবং নিজেকে দ্বিতীয় বারের মতো জন্ম গ্রহণ করছি বলে ব‍্যক্ত করেছে। আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার মুখ থেকে একথা বের হয়ে আসে ‘স্বীয় অনুভূতিতে এমন মনে হচ্ছে যেন পূনর্জন্ম ঘটেছে আমার ! এটি অনেক ভালো দেশ। এখানে অনেক ভালোবাসা ও সম্মান আছে।

এখানকার একজন মন্ত্রী এয়ার পোর্টে এসে আমাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ, আমার জন‍্য এখানে সকল প্রকার অধিকার নিশ্চিত করা হবে’। যা সৌদি আরব ও ইসলামের কাছে নেই ।

জি হ‍্যাঁ আমি সেই রাহাফ আল কানুন বলছি, যে খুব আগ্রহ করেই শুকরের মাংস ভক্ষণ করে নিজেকে শুকর বলে পরিচয় দিয়েছে। জি হ্যাঁ আমি মদ পান করতেও শুরু করেছি। শুধুমাত্র ইসলামকে কুৎসিত করার জন্য। কেননা ইসলামে মদ পান করা হারাম। আমি তো ধর্মত‍্যাগী মুরতাদ হয়ে গেছি তাই ইসলামি আইন কেন মানবো!

আজ আমি সৌদি আরব থেকে পলায়ন করেছি। পৃথিবী দেখবে অতি শিগগির সৌদি আরবে কিভাবে ইরতেদাদ তথা ধর্মত‍্যাগের তরঙ্গ উঠতে শুরু করে। আমার মতো মেয়েদের অনেক বড় একটি অংশ স্বীয় পরিবারদ্রোহী ও ধর্মদ্রোহী হয়ে উঠবে। কেননা আমাদেরকে ইসলামের সঠিক শিক্ষা দেওয়া হয়নি এবং ইসলামের মৌলিক অধিকার আকিদা বিশ্বাস সম্পর্কেও অবগত করা হয়নি।

সৌদি আরব খুব ভালো একটি রাষ্ট্র ছিলো। যেখানে পরিপূর্ণ ভাবে ইসলামি অনুশাসন প্রয়োগ হতো। কিন্তু আজ সেখানে নাইট ক্লাব চালু হতে লাগলো। মহিলাদের ড্রাইভিং ও অবাধে বিচরণের অনুমোদন দেয়া শুরু হলো। যখন ইসলামি বিশ্বের অনুসৃত কোনো দেশে পশ্চিমা অপসংস্কৃতি গ্রহণ করা হবে। তখন সেখানে পশ্চিমা কালচারই ছড়াবে। আর আমার মতো মেয়েরা জন্ম নিবে। মদের আড্ডায় ড‍্যান্সকারীদের মেয়েরা রাবেয়া বসরিয়া নয় বরং আমার মত ধর্মত‍্যাগী মুরতাদ হবে।

ইসলাম কি জিনিস তা আমি জানি না । অথচ আমি বংশগতভাবে মুসলমান ছিলাম। শুধু নামে মাত্র মুসলমান। ইসলামে নারী ও পুরুষকে কি কি অধিকার দেওয়া হয়েছে তা আমার জানা ছিলো না। আমি একজন ছাত্রী ছিলাম। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করতাম। আমার শিক্ষাও ইসলামি পদ্ধতিতে হয়নি।

আমার চাল চলনও ইসলামি অনুশাসনে ছিলো না। আমি পশ্চাত‍্যের স্বাধীনতা কেই মূল স্বাধীনতা মনে করেছি। পশ্চাত‍্যের মহিলাদেরকে পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে দেখে আমি ভাবলাম ইসলাম নারীদের প্রতি বড় অবিচার করেছে। নারীকে চার দেয়ালের ভিতর বন্দি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু এই অবিচারের পেছনে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত স্বাধীনতাকে আমি আঁচ করতে পারিনি।

আমি আজ ক‍্যানাডায় এসে গেছি। এখানে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা খুবই স্বাভাবিক। এখানে আমি যে কোনো কিছু করতে পারবো। এর পেছনে বাধা দিতে মা-বাবা অথবা ধর্ম কেউ আসবে না। তাই আজ থেকে আমিও এই পরিবেশের সাথে মিশে গেছি। আর এই পরিবেশে যারা আসতে চায় তাদের জন্য পরিচিত মুখ আমি। কিন্তু এই পরিবেশে কেউ আসার পূর্বে সে যেন ইসলামি শিক্ষাকে খুব ভালো করে গভীরভাবে পড়ে নেয়।

এরপর যদি কেউ এই পরিবেশে ঝাঁপ দিতে চায় তাহলে ভালো। আজ আমার অনুসূচনা হচ্ছে না। কিন্তু আমি জানি, যেদিন আমার যৌবন অস্তগামী হবে। যেদিন আমার বিবেক বুদ্ধি পূর্ণ হবে। মেধা মস্তিষ্ক আমার শানিত হবে এবং ইসলামকে অন‍্যান‍্য বাতিল মতবাদের সাথে তুলনা করতে শিখবো। তখন আমার বুঝে আসবে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক বিলম্ব হয়ে যাবে। শুধু আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

আপনারা দোয়া করুন, আল্লাহ যেন আমাকে সুস্থ বিবেক বুদ্ধি দান করেন। সত্তাগত ধর্ম ইসলামে পূণরায় ফিরিয়ে আনেন। আমি যেন নিজের অন্তিম সাজাতে পারি।’ (আশরাফের লেখাটি হুবহু তুলে ধরলাম- বানানও হুবহু দিলাম)।

কথাগুলো রাহাফের না হলেও কল্পনায় সাজিয়েছেন বাস্তবতায় মিল রেখে৷ রাহাফ তার চুল কেটেছিল বলে ছয়মাস ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। তখনই সে বিদ্রোহী হয়ে উঠে। পরিবার থেকে পালাবার পথ খুঁজতে থাকে।

পরিবারের সাথে কুয়েত বেড়াতে যায়, সেখান থেকে পালিয়ে থাইলেন্ড যায়। থাইলেন্ড এয়ারপোর্টে সৌদি কনসুলার তার পাসপোর্ট সিজ করে। সে নিজেক হোটেলে বন্দী করে বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়।

পিতা ভাই থাইলেন্ড গিয়ে তাকে ফেরত আনতে চাইলে সে দেখাই করেনি। সে জানিয়ে দেয় ফেরত গেলে তাকে মেরে ফেলা হবে। এরকম ঘটনা আরও ঘটেছে। এসব ভয়ানক খবর বিশ্বব্যাপী চাউর হতে থাকে।

অবশেষে কানাডা তাকে বরণ করে। বিবিসি-সিএনএন এর মত কোন চ্যানেল না থাকায় সৌদির বক্তব্য কেউ জানতে পারছে না।

সৌদি আরবের চেয়ে অনেক খারাপ সমাজ ও পরিবার বিশ্বের বহু দেশেই আছে। রাহাফ তো রাজকীয় হালে বড় হয়েছে। পরিবারে স্বাধীনতা না থাকলে সে মোবাইল, নেট, সোস্যাল জগতে ঢুকল কিভাবে? আন্তর্জাতিক নজর তার দিকে নিতে পারল কিভাবে?

এর শত ভাগের এক ভাগ সুযোগও যে সমাজে নেই, যে সমাজের মেয়েরা মানুষের মর্যাদা পায় না, কিশোরী কাজের মেয়েকে শত আগুনের ছ্যাকা দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় তারা কি কানাডা ইউরোপ এর নজরে পড়ে? সেইসব দেশ সমাজ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই, তাদের নিয়ে কোনো কথা নেই। কারণ এই সমাজ ও দেশগুলো ইসলামের প্রাণকেন্দ্র নয়।

সৌদি আরবের সমাজ, পরিবার, মানবাধিকার, আইন-কানুন ইত্যাদি লাখ ক্যামেরা দিয়ে বিশ্বের সব মিডিয়াগুলো পর্যবেক্ষণ করে থাকে। তিল পরিমাণ কিছু পেলেই তাল হিসেবে বিশ্ববাসী দেখে। এর কাউন্টে সৌদি আরবকে যথেষ্ট সচেতন হওয়ার সময় চলে যাচ্ছে।

আরআর


সম্পর্কিত খবর