শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


গড়া জিনিসকে ভাঙ্গার বদলে ভাঙ্গাকে গড়াই সময়ের দাবি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুসা আল হাফিজ
কবি, গবেষক ও কলামিস্ট

পাকিস্তানের আলেমগণ যা বলেছেন, যথার্থ বলেছেন। অনেক ভুল-ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও তাবলিগের যে কল্যাণকারিতা বিশ্বময়, তা পারস্পরিক রক্তারক্তির ফলে বিপন্ন হবে, এ উপলব্ধি সবার। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার পরিবেশে ভুল বুঝাবুঝি নিরসনে করতে হবে। যা নির্ভরশীল এক ও নেক হওয়ার মানসিকতার উপর।

দূরত্বের যে বিষয়গুলো, তাকে এক পাশে রাখার উদারতার ওপর। কিন্তু এটা কী সম্ভব? পাকিস্তানের শীর্ষ উলামার যে অবস্থান, সেখানে তাদের বাস্তবতার বোধ, উম্মাহচেতনা, তৃণমূলে দ্বীনী দাওয়াত ও মেহনত ইত্যাদির বিবেচনাকে তারা প্রাধান্য দিয়েছেন।

ভারতের দেওবন্দ-নদওয়া-সাহারানপুর সঙ্ঘাত, কাঁদা ছোড়াছুড়ি ইত্যাদিকে এড়িয়ে চলেছে। সংঘাত অনিবার্য করে, এমন পথে হাঁটেনি। নতুবা বাংলাদেশে যে রক্তাক্ত ব্যাপার ঘটেছে (এবং বলে দিচ্ছি, পরিস্থিতি না বদলালে আরো ঘটবে) সেটা ভারতে ঘটতো আরো আগে।

এখন যদি পাকিস্তানের ওলামার চিঠিকে আমলে আনতে হয়, ভারতের উলামা যদি অনুরূপ অবস্থানের নির্দেশনা দেন, তখন বাংলাদেশে, বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে আমরা যে সব মাত্রাছাড়া বক্তব্য রেখেছি, ইহুদিদের দালাল বলেছি, গুমরাহ ঘোষণা করেছি, ফাঁসি দাবি করেছি, সেগুলো আমাদের দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে না?

চিঠিতে দেখা যাচ্ছে, সাদ সাহেবের ভ্রান্তবক্তব্যের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। আমির ও শুরার সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে। তাতে স্পষ্ট, সাদ সাহেবের বক্তব্যের যেসব প্রমাণ তাদের কাছে আছে, তাতে তার গুমরাহী প্রমাণ হয় না। আর যদি প্রমাণ হয়, তাহলে ঐক্যপ্রক্রিয়ায় এগুলো কী একেবারে এড়িয়ে যাবে, সে প্রশ্ন থেকে যাবে?

এগুলো কী এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়? সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে তিনি কী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বক্তব্য প্রচার করবেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সেটা যেমনি উপেক্ষা করা যায় না, তেমনি তার অবস্থান ও বক্তব্যকে উপলক্ষ করে যুদ্ধংদেহী অবস্থা তৈরি করা যাবে না।

চিঠি বাংলাদেশে আমাদের যুদ্ধংদেহী অবস্থানের পক্ষে নয়। আমরা বার বার পরিস্থিতিকে লেজেগুবরে করি এবং ভারসাম্য হারাই। শাখাগত ভিন্নমতের প্রতি প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে গিয়ে মাত্রা ছাড়াই। ফলে এখতেলাফ স্থায়ী শক্রুতায় রূপ নেয়।

এটি বাংলাদেশে বলতে গেলে অধিকাংশ ঘরানা ও মাকতাবায়ে ফিকরের অন্যতম প্রবণতা। এতে ক্ষতি যা হয়, তা শুধু এক প্রজন্মে সীমাবদ্ধ থাকে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তা বিষ ছড়াতে থাকে। অথচ দলিলভিত্তিক যেসব শাখাগত ভিন্নমত, তাতে সংলাপ ও বিতর্কের মূল লক্ষ্য থাকে দূরত্ব কমানো এবং সত্যের অধিকতর কাছাকাছি হওয়া।

ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. এর একটি উক্তি এসেছে পাকিস্তানি উলামার বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ঐক্যবদ্ধ হতে মৌলিকভাবে দু’টি জিনিস দরকার। এক. ইসার- একে অপরকে প্রধান্য দেয়া। দুই. তাওয়াজু- বিনয়, নম্রতা। আর সততা একনিষ্ঠতা সব কাজের মূল।

বাংলাদেশে ভিন্নমত মানেই ইসার ও তাওয়াজু উধাও হয়ে যায়। বরং একরকম রণদামামার আওয়াজ শুনা যায় । যা পরস্পরকে পরস্পরের শত্রুর জায়গায় না নিয়ে আর থামে না।

এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার স্পষ্ট বার্তা আছে পাকিস্তানি উলামার পত্রে। বিভক্তি যেখানে আমাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, সেখানে আল্লামা রাফি উসমানি, তাকি উসমানি দা. গণ বলছেন, যদি আমাদের জীবন দিয়ে হলেও ঐক্য সম্ভব হয়, তাহলে আমরা সেটাই করবো। এটাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রে থাকা উচিত।

যদি ঐক্য সম্ভব না হয়, দূরত্বকে আর না বাড়ানোর কথা বহু দিন ধরে বলে আসছি। এ দেশে ক্ষীণকণ্ঠে, বহু দিন ধরে, স্রোতের উজানে কিছু কথা বলে আসছিলাম বিবেচনার জন্য, ভাবার জন্য, কিন্তু স্রোত একে ভাসিয়ে নিয়েছে।

দুই ভাইয়ের ঘর ভাঙলে তখন আলাদা ঘরে খাওয়া-দাওয়া মেনে নেযা হয়। চেষ্টা থাকে ভাই ভাইয়ের সম্পর্কটা যেন নষ্ট না হয়। এটি আমরা পারিবারিক জীবনে প্র্যাকটিস করি। কিন্তু তাবলিগ ইস্যুতে উভয় ধারা চলেছি উল্টো পথে। ফলে বাংলাদেশে পাকিস্তান কিংবা ভারতের বাস্তবতা আর নেই।

পাকিস্তানি আলেমগণ নিজেদের জায়গায় নিজেদের মতো করে দ্বীনের কাজ করার যে বক্তব্য দিলেন সম্প্রতি, সে বক্তব্য আরো আগে এলে এদেশের কওমী আলেমগণ সময়মতো ইতিবাচকভাবে ভাবতে পারতেন।

উলামার কাছে তাদের একটি বিশেষ আবেদন আরো আগেই আসা উচিত ছিলো। সেটা হচ্ছে ‘আপনারা এমন বয়ান থেকে বিরত থাকুন, যাতে দু’দলের কোনো দলের পক্ষে যায়। আপনারা নির্দলীয় অবস্থায় থাকলে আশা করা যায় খুব দ্রুত এ সমস্যা থেকে আমাদের উত্তরণ সম্ভব হবে।’

তারা বলেছেন একদল যেন অন্য দলের সম্পর্কে দোয়া ছাড়া আর কোনো মন্তব্য না করে। বিশেষ করে ঝগড়া সৃষ্টি করে এমন কোনো কথা বা আলোচনা যেনো তারা না করে। কিন্তু বাংলাদেশ এই সব মারহালা অতিক্রম করেছে অনেক আগেই।

তবে তারা বলেছেন, কোনো জায়গায় যদি কোনো দলের আধিক্য থকে সেখানে অন্যরা আসবে না। এটা নিশ্চিত হবে তখন, যখন পারস্পরিক সম্পর্ক হবে ভালো, আস্থাপূর্ণ এবং শ্রদ্ধার।

নেতৃবৃন্দের সমঝোতায় যদি এটা হয়, হতে পারে। নতুবা এটা রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে তা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি না, সন্দেহ।

বাংলাদেশে আরো টেকসই ও্র কার্যকর কিছু একটা ভাবতে হবে। নতুবা তাবলিগ ইস্যু আরো রক্ত ঝরাবে। কারণ খুব কম সময়ে আমরা দূরত্বকে খুব দূরে নিয়ে গেছি।

পাকিস্তানের শীর্ষ উলামার এই চিঠি সব সত্ত্বেও একটি আশার আলো। গড়া জিনিসকে ভাঙ্গার বদলে ভাঙ্গা জিনিশকে গড়াই হচ্ছে সময়ের দাবি। এই দাবির ডাকে সবাইকে সর্বোত্তম পন্থায় সাড়া দেয়া উচিত। নতুবা ক্ষতির শেষ থাকবে না।

আরআর


সম্পর্কিত খবর