শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ইসলাম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

মানুষের জানমালের নিরাপত্তা ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রাষ্ট্রকর্তৃক সংরক্ষিত এবং নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের রক্ষাকবচ। অন্য মানুষকে নিরাপদ রাখা ও বাঁচতে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম। কোনো ব্যক্তি, সংঘ, সংগঠন, বহিঃশত্রু বা স্বয়ং রাষ্ট্র কোনো মুসলিম বা অমুসলিম নাগরিককে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে উদ্যত হতে পারে না; বরং রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা যে কোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে।

বিশ্বশান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামে শাসকদের এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু অমুসলিম নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা লাভের অধিকার বিঘ্নিত না হয়। রাসূলুল্লাহ সা. প্রদত্ত জনকল্যাণকর নীতিমালার আলোকে যাতে অমুসলিমরাও ইহকালীন জীবনে নিরাপত্তা লাভে ধন্য হতে পারে। কেননা সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায়ের জানমাল মুসলমানদের নিজের জানমালের মতো পবিত্র আমানত ও নিরাপত্তাযোগ্য। সমাজে যাতে কোনোভাবেই মুসলমানদের কাছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তাহীনতা বোধ না হয়।

বিশ্বমানবতার মহান মুক্তিদূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. সুস্পষ্ট ভাষায় অমুসলিমদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতো এবং তাদের ধনসম্পদ আমাদের ধনসম্পদের মতো।’ যে কোনো জীবনই মূল্যবান, মূল্যবান মানুষের প্রাণ। তাই বিদায় হজ্জ্বের অভিভাষণে মহানবী সা. জনতার প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের জানমাল ও ইজ্জত-আব্রু তোমাদের পরস্পরের কাছে পুত-পবিত্র।’ (বুখারি)

বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্র্রদায়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা না করলে এবং জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্র্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি না হলে জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধিত হওয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন ধর্মমতে বিশ্বাসী এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জনসমষ্টির মধ্যে সমঝোতা ও পরমতসহিষ্ণুতার মাধ্যমে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জানমালের নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে তা সম্ভব হয়। তাই মদিনা সনদে যে উম্মাহর কথা বলা হয়েছে তা শুধু মুসলমান সমন্বয়ে সংগঠিত নয়, বরং তা সর্বধর্মের সমন্বয়ে গঠিত।

সনদের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বনু আউফের ইহুদিরা মুমিনদের সঙ্গে একই উম্মাহ। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম আর মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম, তাদের মাওয়ালী বা আশ্রিত এবং তারা নিজেরাও। অবশ্য যে অন্যায় বা অপরাধ করবে সে নিজের এবং তার পরিবার-পরিজনের ক্ষতিই করবে।’ যেমনভাবে মহানবী সা.-কে উদ্দেশ্য করে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলো! তোমাদের ধর্ম তোমাদের এবং আমার ধর্ম আমার।’ (সূরা কাফিরুন : ৭)

মুসলমানদের ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের প্রতি উদার, পরস্পরের প্রতি সহনশীল, জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমকে সাহায্য-সহযোগিতা, মুসলমানদের অনুসরণকারী বিধর্মীদের সহায়তা, অন্যের প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণতা পরিত্যাগ, অন্যের রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে। মদিনা সনদের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রে বসবাসকারীদের হঠকারিতা পরিত্যাগ করতে, পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদান করতে, মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে দায়িত্বশীল হয়ে রাষ্ট্রের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মহানবী সা. ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সাথে যে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষর করেন এর মূল বিষয়বস্তু ছিল যথাক্রমে : ১. অমুসলিমরা শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে মুসলমানেরা তাদেরকে রক্ষা করবে। ২. তাদেরকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হবে না। ৩. তাদেরকে সকল প্রকার নিরাপত্তা দেওয়া হবে। ৪. তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পত্তি ও অধিকারের নিরাপত্তা প্রদান করা হবে। ৫. তাদের ধর্ম, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও গির্জা বা উপাসনালয়ের কোনো ক্ষতি করা হবে না। ৬. তাদের কোনো অধিকার ক্ষুন্ন করা হবে না। ৭. তাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী প্রেরণ করা হবে না। ৮. ধর্মীয় ও বিচার ব্যবস্থায় তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে।

নবী করিম সা.-এর সাথে অমুসলিম পৌত্তলিক, ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা গোপনে বা প্রকাশ্যে শত্রুতা ও বিরোধিতা করতে শুরু করলেও তিনি অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেননি। ইসলাম প্রচার করতে যেয়ে তায়েফবাসীর প্রস্তরের আঘাতে নিজের গায়ের রক্ত ঝরালেন, উহুদের ময়দানে নিজের দাঁত মোবারক শহীদ হলো; কিন্তু তিনি ক্ষোভ প্রকাশ বা অভিশাপ না দিয়ে স্বজাতিকে মাফ করে দিলেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

যে বিধর্মী মক্কাবাসী একদা তাঁকে বিভিন্ন দিক দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য করেছিলো, মক্কা বিজয়ের পর তিনি সবার প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর সমগ্র জীবন জুড়ে এমন অতুলনীয় ক্ষমা ও মহানুভবতার উদাহরণ ভরপুর। তিনি কখনো অমুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে অসদাচরণ করেননি, বরং তাঁর সদ্ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে বহু অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছিলো।

তাই আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন সময়ে অমুসলিমদের সঙ্গে অসদাচরণ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা-নির্যাতন, ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, জানমালের নিরাপত্তা বিনষ্টকরণ এবং সামাজিক দুর্বৃত্তায়ন, মানবিক বিপর্যয় ও অনিষ্ট সাধনকে সমাজে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করা দরকার। এজন্য দেশের জনগণকে হতে হবে মানবাধিকার সচেতন। যেনো মানুষ কখনো মনুষ্যত্ব, নীতি-নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ না হারায়; বরং সবাই মনুষ্যত্ব অর্জনে হয়ে ওঠে তৎপর ও সচেষ্ট এবং হৃদয়ে গর্জে তোলে মানবতার হাতিয়ার।

আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন সবাই সমবেত কণ্ঠে ঘোষণা করুক, ‘ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের কোনো ক্ষতি সাধন করবে না; বরং পারলে অন্যের উপকার করবে!’ কেননা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রে অহেতুক অমুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর জোর-জবরদস্তি বা জুলুম-নির্যাতন করা ইসলামের দৃষ্টিতে মহাপাপ। এজন্য রাসূলুল্লাহ সা. মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি অন্যায় করে, তবে আমি কিয়ামতের দিন সেই মুসলমানের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবো।’ (আবু দাউদ)

সুতরাং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের সংঘাত, উগ্রতা বা সহিংসতা নয় সমঝোতা, সাম্প্রদায়িকতা নয় সহমর্মিতা, যুদ্ধ নয় শান্তি, শত্রুতা নয় বন্ধুত্ব, পরশ্রীকাতরতা নয় ভ্রাতৃত্ব, জবরদস্তি নয় ন্যায়পরায়ণতা, অমঙ্গল কামনা নয় সমবেদনা, অনিষ্ট বা ক্ষতিসাধন নয় পারস্পরিক কল্যাণকামিতা এবং হিংস্রতা ও বর্বরতা নয় সদাচরণ ও মানবতা; অন্যান্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ দলমত নির্বিশেষে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ইসলামের এহেন উদারতার প্রকৃত মর্মবাণী প্রতিফলিত হোক!

পৃথিবীতে বহু ধর্মমতের পার্থক্যের কারণে তথাকথিত মানুষ মানুষকে হত্যা করছে, ধনসম্পদ লুট করছে, এমনকি মা-বোনদের সম্ভ্রমহানিও পর্যন্ত করছে! একশ্রেণীর মানুষরূপী পশুর উন্মত্ত নাশকতার আশংকায় নিরীহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বা জনগোষ্ঠীর জানমালের নিরাপত্তা যেনো কখনোই বিপন্ন না হয়! কেননা মানুষ যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দলমতের অনুসারী হোক না কেন তাকে সর্বাবস্থায় সাহায্য-সহযোগিতা করা, বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধার করা শান্তিকামী মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য।

যেহেতু মানব সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, সৌহার্দ-সম্প্রীতি ও জাতি-গোষ্ঠীর মিলেমিশে একতাবদ্ধ থাকা নির্ভর করে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের মানুষের সম্পর্কের উপর সেহেতু নির্বাচনকালীন সময়ে তাদের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান ও পারস্পারিক সুসম্পর্ক যতটা সহনশীল ও সম্প্রীতিময় হবে, সমাজ জীবনে ততোটাই শান্তি-শৃঙ্খলা ও জানমালের নিরাপত্তা বিরাজ করবে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইনস্টিটিউট অব ল্যাংগুয়েজ স্টাডিজ। প্রফেসর ও এডভাইজার, ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা। উপদেষ্টা সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয় পরিক্রমা।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ