শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন; সুখ দুঃখের ঘর সংসার

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

রকিব মুহাম্মদ
আওয়ার ইসলাম

মাওলানা শফিকুল ইসলাম কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার খাদিমপুর গ্রাম থেকে এসে রাজধানীর জামিয়া এমদাদুল উলুম মাদরাসায় ২০১৩ সাল থেকে শিক্ষকতা করে আসছেন। যোগদানের সময় তার বেতন ছিল মাত্র  সাড়ে ৫ হাজার টাকা। ৫ বছর পর বর্তমানে তিনি বেতন পান মাত্র ৭ হাজার টাকা।

মাওলানা শফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে দ্রব্যমূল্যসহ সব কিছুর দাম যেভাবে বেড়েছে সেখানে মাত্র ৭ হাজার টাকা দিয়ে কিভাবে সংসার চালানো সম্ভব? স্ত্রী-সন্তানদের মুখে ভালো খাবার তুলে দিতে পারি না। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাব তারও উপায় নেই।

তিনি বলেন, এই ৭ হাজার টাকা বেতনও মাসের শেষে ঠিকঠাক মতো পাই না। দেখা যায়, তিন মাস গড়িয়ে গেলেও প্রথম মাসের বেতন পরিশোধ হয় না। এতে করে করজে হাসানা নিয়ে সংসার চালাতে হয়। অনেক সময়, করজের টাকাও পরিশোধ করার পরিস্থিতি হারিয়ে ফেলি।

শুধু মাওলানা শফিকুল ইসলামই নন, সব মিলিয়ে প্রায় ১৩ হাজার কওমি মাদরাসার শিক্ষকের বেতনের একই অবস্থা। বড় শহরের মাদরাসাগুলোতে একজন সাধারণ শিক্ষকের বেতন ১০ থেকে ১৫ হাজার হলেও মফস্বলে ভিন্নচিত্র। মফস্বলের কওমি মাদরাসাগুলোতে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা বেতনেই দিন গুজরাতে হচ্ছে অনেক আলেমকে।

তবে এই স্বল্প বেতন নিয়েও অনেকে তাদের সন্তৃষ্টির কথা জানালেন। রাজধানী ঢাকার নন্দিপাড়ার এক মাদরাসা শিক্ষক ৯ হাজার টাকা বেতনেই তার সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, আমার শিক্ষকতার বয়স মাত্র দুই বছর। আমি শুরু থেকেই নয় হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে আসছি। এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি দীনি খেদমত করার জন্যই মাদরাসায় পাঠদান করি।

তবে মফস্বলের কওমি মাদরাসাগেুলোতে এরকম কোনো সুযোগ না থাকায় তারা  কষ্টে জীবন পার করছেন বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, মফস্বলের শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে নিরবে কাঁদি। আমিও একসময় ওই পরিস্থিতি পার করে এসেছি, আমার কাছে দু:স্বপ্ন মনে হয়। তাদের ব্যাপারে আমাদেরই চিন্তা করতে হবে।

মুগদার জামিয়াতুস সালামের শিক্ষক মাওলানা তাওহিদুল ইসলামের বেতন মাত্র সাড়ে তিন হাজার। মাদরাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি একটি অফিসে খণ্ডকালীন সময় দিয়ে আসছেন। একটি ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গেও তিনি জড়িত বলে আওয়ার ইসলামকে জানান।

তিনি বলেন, শুধুমাত্র দীনের খেদমত করার জন্য আমি মাদরাসায দরস প্রদান করে থাকি। পাশাপাশি একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা রয়েছে আমার। একটি প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম চাকরি করি। সব মিলিয়ে আমার সংসার চালাতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না।

প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাসে কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের নির্দিষ্ট কোনো বেতন কাঠামো সৃষ্টি হয়নি। কওমি মাদরাসার আট মূলনীতিতে (দারুল উলুম দেওবন্দের উসূলে হাশতে গানা) প্রতিষ্ঠানের আয়ের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হলেও আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা নেই।

মাদরাসা শিক্ষকদের অভিন্ন বেতন কাঠামো তৈরি এবং সন্তোষজনক বেতন প্রদানে মাদরাসা কর্তৃপক্ষকেই উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মাদরাসা পরিষদের সভাপতি মুফতি জহির ইবনে মুসলিম

তিনি বলেন, ওলামায়ে কেরাম কওমি মাদরাসায় পাঠদানকে পেশা হিসেবে নয়, খেদমত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, একটি পরিবার সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্য নূন্যতম যে খরচ হয় সেটা যেন মাদরাসা শিক্ষকরা পান।

নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো তৈরির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার বা বেফাক কর্তৃপক্ষ যদি নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো তৈরি করে দেয়, সেক্ষেত্রে বেতন পরিশোধ করার মতো সামর্থ মাদরাসাগুলোর নেই।

তবে বেফাক থেকে মাদরাসাগুলোকে সন্তোষজনক বেতন প্রদানের ব্যাপারে আহ্বান করা যেতে পারে।  এ ব্যাপারে আইন করলেও তা কার্যকারিতা পাবে না বলে মনে করেন তিনি।

কওমি মাদরাসার বেতন সমস্যা দূরীকরণে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মহাপরিচালক মাওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী মনে করেন বেফাক থেকে নির্দিষ্ট একটা বেতন কাঠামো তৈরি করা উচিৎ।

তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বেতন কাঠামো তৈরির পক্ষে। দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ মাদরাসা অস্বচ্ছলভাবে পরিচালিত হচ্ছে আবার কিছু মাদরাসার স্বচ্ছল। আমি মনে করি, নির্দিষ্ট একটা বেতন কাঠামো তৈরি করলে, চাই সেটা অল্প হোক, তাহলে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে চিন্তা করবে এবং সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।

তিনি আরো বলেন, সময়-সুযোগ মতো বড়দের সামনে আমি এ প্রস্তাবটি তুলে ধরব। আশা করি, খুব শিগগির এ সমস্যা সমাধানের একটি পথ আমরা খুঁজে পাব।

মাদরাসার শিক্ষকরা যেহেতু এটাকে দীনি খেদমত হিসেবে দেখেন তাই বেতনের এই কমতিতে তাদের অধিকাংশেরই খেদ নেই। তবে জীবন মান যেহেতু বেড়ে গেছে মানুষের, দ্রব্যমূল্য যেহেতু দিন দিন চলে যাচ্ছে ক্রয় সীমার বাইরে তাই তাদের মত বছরে অন্তত কিছু করে হলেও বেতন বাড়া উচিত।

ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দও সাম্প্রদিক বৈঠকে শিক্ষক ও অন্যান্য স্টাফদের বেতন বাড়িয়ে বাজেট বৃদ্ধি করেছে। জীবন মানের উন্নতি ও দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বিষয়টি তাদেরও চিন্তা থেকে এড়িয়ে যায়নি।

পড়ুন: দারুল উলুম দেওবন্দে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ

তবে ঢাকায় বা বড় শহরগুলোতে যারা শিক্ষকতা করছেন তাদের পার্টটাইম অন্য কাজের সুযোগ থাকে। যাতে যুক্ত হয়ে ভালো অর্থই ইনকাম করে থাকেন।

অনেকে ইমামতি, মুয়াজ্জিনি, লেখালেখি, অনুবাদ কিংবা অন্য কোনো পার্টটাইম চাকরি বেছে নিচ্ছেন। বড় কোনো মাদরাসার শিক্ষকতার পাশাপাশি ছোট মাদরাসাগুলোতেও দু’একটি ক্লাস নিয়ে থাকেন কেউ কেউ। আবার সিনিয়র শিক্ষকদের অনেকেই ছোট মাদরাসায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। সব মিলিয়ে তাদের অবস্থান বেশ ভালোই বলতে হয়।

রাজধানীর জামিয়া রাহমানিয়া অারাবিয়ার উস্তাদ মুফতি সাঈদ আহমদ শিক্ষকতার পাশাপাশি মিরপুর ১০ এ অবস্থিত বায়তুল আতিক জামে মসজিদে জুমা পড়ান। তিনি মাদরাসার শিক্ষকতাকে খেদমত উল্লেখ করে বলেন, মাদরাসা থেকে আমি মাসিক ওজিফা যা পাই তা নিয়ে সন্তুষ্ট আছি।

মুফতি সাঈদ বলেন, তবে আমি মনে করি, খরচের ব্যাপারটা আপেক্ষিক। কেউ যখন ৬ হাজার টাকা বেতন পান তখন তার মনে হয় আরো ৫০০ টাকা হলে ভালো হতো। আয় যত বাড়তে থাকে মানুষের খরচও ততো বেশি হয়ে হয়ে থাকে।

বর্তমানে সব মিলিয়ে আমার মাসিক আয় ৪৪ হাজার টাকা, এখনও আমার মনে হয় যদি আরো বেশি উপার্জন করতে পারতাম তবে আরো ভালো হতো।

রাজধানীর মালিবাগে অবস্থিত জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ মাদরাসার মুহাদ্দিস মুফতি আবদুস সালাম। কওমি মাদরাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি নয়াটোলা আনওয়ারুল উলুম কামিল মাদরাসায় (আলিয়া মাদরাসা) শিক্ষকতা করেন এবং একটি মসজিদে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তিনি বললেন, কওমি মাদরাসায় যে হাদিয়া দেওয়া হয় তা সন্তোষজনক নয় তবে শিক্ষকরা দীনি খেদমত মনে করে নিজেকে মানিয়ে নেন। ঢাকায় আমি তিন রুমের একটি বাসা নিয়ে থাকি।প্রতিমাসে বাসাভাড়া দিতে হয় ২৭ হাজার টাকা। অথচ, আমি মাদরাসা থেকে মাত্র ১৪ হাজার টাকা হাদিয়া পাই। এ কারণে আমাকে ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতে হয়।

তবে কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের মাদরাসার পাশাপাশি ভিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি বা কাজ এতটা সহজ বলেই জানান অনেক শিক্ষক। এ ক্ষেত্রে তাদেরকে দেখা হয় আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিতে। একটা আলাদা কিংবা সন্দেহের নজর রাখা হয় সবসময়। তক্কে তক্কে থাকেন অন্য শিক্ষকরা।

এ বিষয়ে মুফতি আবদুস সালাম বলেন, এরকম পরিস্থিতিতে কখনও পড়তে হয়নি আমাকে। তবে অভিযোগের বিষয়টি আমিও শুনেছি।

আমল আখলাক ঠিক রেখে শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য কোনো কাজ করে অর্থ উপার্জন করলে কোনো ক্ষতি নেই এবং তাকে আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখাও উচিত নয় বলে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

আরও পড়ুন: সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপমুক্ত কওমি স্বীকৃতি বিরল ঘটনা: মুফতি ওয়াক্কাস

-আরআর


সম্পর্কিত খবর