শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


যিলহজ্জ মাসে করণীয় ও বর্জনীয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

শাইখুল হাদিস মুফতি মনসূরুল হক
প্রধান মুফতি, জামিয়া রাহমানিয়া আলী এন্ড নূর ঢাকা

আরবী বছরের শেষ মাস যিলহজ্জ মাস। হাদীসে আসছে “ইন্নামা ইবরতু বিল খাওয়াতীন” ।

শরী‘আতে শেষেরটাকেই ধরা হয়। শেষ অবস্থাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। যেমন কেউ সারা জীবন মু‘মিন ছিল কিন্তু মৃত্যুর সময় ঈমান হারা হয়ে মারা গেল তো তার স্থান হবে জাহান্নাম।

আবার কেউ যদি সারা জীবন কাফের থাকে কিন্তু মৃত্যুর সময় ঈমান নিয়ে মারা যায় তো তার স্থান হবে জান্নাত। যার শেষ ভালো তার সব ভালো। এই জন্য আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীন প্রতিদিনের আমল এমনভাবে সাজিয়েছেন।

আমরা যখন ঘুম থেকে উঠি তখন ইবাদত দিয়ে দিন শুরু করি। অর্থাৎ ফজর নামায পড়ি। আবার যখন ঘুমাতে যাই তখন ইশার নামায পড়ে ঘুমাতে যাই। শরী‘আতের হুকুম অনুযায়ী ইশার নামায পড়ে দুনিয়াবী আর কোন কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে। হারাম করা হয়নি কিন্তু নিষেধ বা অপছন্দনীয়।

যেন শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আর ফজরের জন্য উঠতে পারি এবং এই জন্য চার মাযহাবের ইমাম ইশার নামায একটু দেরী করে পড়া মুস্তাহাব বলেছেন। সর্ব্বোচ্চ অল্প একটু সময় তালীম করা যেতে পারে। রাতের খানা এইজন্য ইশার নামাযের আগে খেতে বলা হয়েছে।

যেন রাতের খানা খাওয়ার পর ইশার নামায পড়তে যাওয়ার সময় একটু হাঁটা চলা হয়। আল্লাহ আমাদের দুনিয়ার ফায়দার কথাও চিন্তা করেছেন। আল্লাহ ফেরেস্তাদের জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা আমার বান্দাদের কী হালে দেখছো?” ফেরেস্তারা বলেন, “হে আল্লাহ তাদের শুরু বন্দেগী এবং শেষও হয় বন্দেগীতে।”

আল্লাহ বলেন, “তাহলে আর কী, যার শুরু এবং শেষ বন্দেগী তার পুরোটাই বন্দেগী লিখে দাও।” এই জন্য আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীন শেষ মাসকে এমন ভাবে সাজিয়েছেন যেন মু‘মিনের শেষটা ভালো হয়ে যায়।

যিলহজ্জ মাসে অনেক ইবাদাত। নিম্নে কুরআন হাদীসের আলোকে ইবাদতসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো-

যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকে নেক আমলের ফযীলত ইবনে আব্বাস رضي الله عنهم থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهَا أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ. يَعْنِى أَيَّامَ الْعَشْرِ. قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَلاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ قَالَ وَلاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَىْءٍ.

‘এমন কোনো দিন নেই যার আমল যিলহজ্জ মাসের এই দশ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর سبحانه و تعالى পথে জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ صلى اللهعليه وسلم বললেন, আল্লাহর سبحانه و تعالى পথে জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর سبحانه و تعالى পথে যুদ্ধে বের হল এবং এর কোনো কিছু নিয়েই ফেরত এলো না (তার কথা ভিন্ন)।’ [বুখারী : ৯৬৯; আবূ দাউদ : ২৪৪০; তিরমিযী : ৭৫৭]

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাযিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَا مِنْ أَيَّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللَّهِ وَلا الْعَمَلُ فِيهِنَّ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ، فَأَكْثِرُوا فِيهَا مِنَ التَّهْلِيلِ، وَالتكبير والتَّحْمِيدِ، يَعْنِي: أَيَّامَ الْعَشْرِ.

‘এ দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়।’ [মুসনাদ আহমাদ : ১৩২; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান : ৩৪৭৪; মুসনাদ আবী আওয়ানা : ৩০২৪]

অন্য বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ أَيَّامٍ أَفْضَلُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ أَيَّامِ عَشَرِ ذِي الْحِجَّةِ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَلا مِثْلُهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ؟ قَالَ: إِلا مَنْ عَفَّرَ وَجْهَهُ فِي التُّرَابِ».

‘যিলহজ্জ মাসের (প্রথম) দশদিনের মতো আল্লাহর কাছে উত্তম কোনো দিন নেই। সাহাবীরা رضي الله عنهم বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ صلى اللهعليه وسلم , আল্লাহর পথে জিহাদেও কি এর চেয়ে উত্তম দিন নেই? তিনি বললেন, হ্যা, কেবল সে-ই যে (জিহাদে) তার চেহারাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।’ [সহীহুত তারগীব ওয়াত তারহীব : ২/১৫; মুসনাদ আবী আওয়ানা : ৩০২৩]

এ হাদীসগুলোর মর্ম হল, বছরে যতগুলো মর্যাদাপূর্ণ দিন আছে তার মধ্যে এ দশ দিনের প্রতিটি দিনই সর্বোত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিনসমূহে নেক আমল করার জন্য তাঁর উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁর এ উৎসাহ প্রদান এ সময়টার ফযীলত প্রমাণ করে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলীল ও তাকবীর পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন ওপরে ইবন উমর রাযিআল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ হয়েছে।

ইবন রজব রহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে বুঝা যায়, নেক আমলের মৌসুম হিসেবে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক হল সর্বোত্তম, এ দিবসগুলোয় সম্পাদিত নেক আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। হাদীসের কোনো কোনো বর্ণনায় أَحَبُّ (‘আহাব্বু’ তথা সর্বাধিক প্রিয়) শব্দ এসেছে আবার কোনো কোনো বর্ণনায় أَفْضَلُ (‘আফযালু’ তথা সর্বোত্তম) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।

অতএব এ সময়ে নেক আমল করা বছরের অন্য যে কোনো সময়ে নেক আমল করার থেকে বেশি মর্যাদা ও ফযীলতপূর্ণ। এজন্য উম্মতের অগ্রবর্তী পুণ্যবান মুসলিমগণ এ সময়গুলোতে অধিকহারে ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন। যেমন আবূ ছিমান নাহদী বলেন,
كانوا ـ أي السلف ـ يعظمون ثلاث عشرات: العشر الأخير من رمضان، والعشر الأول من ذي الحجة، والعشر الأول من محرم.

‘তাঁরা অর্থাৎ সালাফ তথা পূর্বসূরীগণ দিনটি দশককে অনেক বেশি মর্যাদাবান জ্ঞান করতেন : রমযানের শেষ দশক, যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক এবং মুহাররমের প্রথম দশক।’

যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের রাতের নেক আমল

যিলহজ্জ মাসের প্রথম নয় রাতের ইবাদত বন্দেগী লাইলাতুল কদরের রাতের ইবাদত বন্দেগীর সমুতূল্য। এই ৯টি রাত কুরআন এবং হাদীসের আলোকে যিলহজ্জ মাসের দশ রাতের ফযীলত সুপ্রমাণিত। কুরআন শরীফে সুরায়ে ফাজরে আল্লাহ তা‘আলা এই দশ রাতের শপথ করে বলেছেন, শপথ দশ রাতের, শপথ যা জোড় ও বেজোড়, শপথ রাতের যখন তা গত হতে থাকে।”

এই চারটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা পাঁচটি বস্তুর শপথ করেছেন। (১) ফজর ; (২) দশ রাতের ; (৩) জোড়ের ; (৪) বেজোড়ের ; (৫) রাতের।

অধিকাংশ মুফাসসিরীনদের মতে দশ রাত দ্বারা যিলহজ্জ মাসের এই দশ রাতকে বুঝানো হয়েছে। একটি মারফু হাদীস দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। হযরত জাবের رضي الله عنه থেকে বর্ণিত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন وَلَيَالٍ عَشۡرٖ দ্বারা উদ্দেশ্য হল যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন। তাতে কুরবানির দিনও শামিল।

উল্লেখিত দশ রাত সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা رضي الله عنه রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি ইরশাদ করেছেন, পৃথিবীর দিন ও রাত্রির মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার ইবাদতের জন্য সবচেয়ে প্রিয় হল যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন, এই গুলির তুলনায় ইবাদতের জন্য প্রিয় আর কোন দিন নেই। এই দিন গুলির এক একটি রোযা এক বৎসর রোযা রাখার সমতুল্য, আর ঐ রাতগুলির এক একটির ইবাদত শবে কদরের ইবাদতের সমতুল্য। (ফাযাইলুল আওকাত লিল বাইহাকী-৩৪৬, শুআবুল ঈমান, ৩/৩৫৫)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস رضي الله عنهم থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, এই দশ দিনের নেক আমল আল্লাহ তা‘আলার নিকট যতটা পছন্দনীয় অন্যদিনের আমল ততটা নয়। (বুখারী শরীফ)

এসব হাদীস দ্বারা আমরা যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন ও রাতের ফযীলত সম্পর্কে অবগত হতে পারলাম। হযরত হাফসা رضي الله عنها থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, চারটি বিষয় এমন যেগুলিকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও ছাড়তেন না। আশুরার রোযা, যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের রোযা, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোযা এবং ফজরের পূর্বের দুই রাকাআত সুন্নাত। (নাসাঈ শরীফ, মিশকাত-১৮০)

আলোচ্য হাদীসে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক বলতে এখানে নয় দিনকে বুঝানো হয়েছে। কেননা অন্য এক হাদীসে দশ তারিখে ঈদের দিনে রোযা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে।

আরাফা দিবসের ফযীলত

যিলহজ্জ মাসের নয় তারিখকে ইয়াওমে আরাফা বা আরাফার দিন বলা হয়ে থাকে। এই দিন হজ্জের মূল অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে। এই দিনটি যেমন ফযীলতপূর্ণ তদ্রুপ এর পূর্ববর্তী রাতটিও ফযীলতপূর্ণ। এই দিন সম্বন্ধে হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে, হযরত আবু কাতাদাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি আল্লাহ তা‘আলার নিকট আশাবাদী যে, আরাফা দিবসের রোযা তার পূর্ববর্তী এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গুনাহ মুছে দিবে। আর আল্লাহর নিকট এও আশাবাদী যে, আশুরার রোযা তার পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মুছে দিবে। (মুসলিম শরীফ, মিশকাত-১৭৯)

তাকবীরে তাশরীক

যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখ ফজর হতে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয নামাযের পর সকল সাবালক পুরুষ,মহিলার জিম্মায় উক্ত তাকবীর একবার বলা ওয়াজিব। তিনবার বলা ওয়াজিব নয়। পুরুষগণ উচ্চস্বরে আর মহিলাগণ নিম্নস্বরে পড়বে। তাকবীরে তাশরীক এই :
الله أكبر الله أكبر،لآإله إلاالله والله أكبرالله أكبرولله الحمد. (আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ) (আদ্দুররুল মুখতার:২/১৭৭-১৮০)

কুরবানীর করা

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, (তরজমা) “আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন।” (সূরা কাউছার-২)

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।” (ইবনে মাজাহ হাঃ নং ৩১২৩)

কুরবানীর ফযীলত বর্ণনা প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কুরবানীকৃত পশুকে তার শিং, পশম, খুর, ইত্যাদিসহ কিয়ামতের ময়দানে হাজির করা হবে এবং নেকীর পাল্লায় তা ওজন করা হবে। আর কুরবানীর পশু যবেহ করার সাথে সাথে তার রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহ পাকের দরবারে তা কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্ট চিত্তে কুরবানী কর।” (তিরমিযী শরীফ হাঃ নং ১৪৯৭)

কুরবানীর হুকুম

যিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ সূর্যোদয় হতে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত যদি কোন সুস্থ মস্তিষ্ক,প্রাপ্ত বয়স্ক মুকীম ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, অর্থাৎ ঋণমুক্ত থাকা অবস্থায় সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫০) তোলা রূপা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য সমপরিমাণ নগদ টাকা বা ব্যবসায়ের মাল কিংবা সমমূল্যের নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত যে কোন সম্পদ থাকে তাহলে তার উপর নিজের পক্ষ থেকে কুরবানী করা ওয়াজিব।

কিন্তু পুত্র, কন্যা ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে তার কুরবানী করা ওয়াজিব নয়। বরং তারা নিসাবের মালিক হলে নিজেরাই নিজের কুরবানী আদায় করবে। অথবা তাদের অনুমতিক্রমে গৃহকর্তা তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী দিবে। (শামী-৬/৩১২, আল ফিকহুল ইসলামী-৪/২৭১১, ২৭০৮)

কারো পক্ষ হতে তার অনুমতি ব্যতীত ওয়াজিব কুরবানী করা হলে সে ওয়াজিব আদায় হবে না। অবশ্য একই পরিবারভুক্ত কোন সদস্য অন্য সদস্যের পক্ষ হতে তার জ্ঞাতসারে নিয়মিত কুরবানী করে আসলে সে ক্ষেত্রে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে, তবে এক্ষেত্রে উত্তম হল প্রকাশ্যে তার থেকেও অনুমতি নিয়ে নেয়া। (আদ্‌দুররুল মুখতার-৬/৩১৫)

কুরবানীর পশু

চান্দ্র মাস হিসাবে পূর্ণ এক বৎসর বয়সের ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ও পূর্ণ দুই বৎসর বয়সের গরু, মহিষ এবং পূর্ণ পাঁচ বৎসর বয়সের উট-এ ছয় প্রকারের জন্তু দ্বারা কুরবানী করা যায়। প্রথম তিনটি মাত্র এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে এবং পরের তিনটি সর্বোচ্চ সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা যায়। তবে শর্ত হল,সকলের নিয়ত খাঁটি ভাবে সওয়াবের জন্য হতে হবে। সাত শরীকের কোন একজনের নিয়তও যদি শুধু গোশত খাওয়ার জন্য হয় তাহলে কারো কুরবানীই আদায় হবে না। (শামী-৬/৩১৫)

তেমনিভাবে কোন শরীকের মাল হারাম হলে বা অনুমতি না নিয়ে কাউকে শরীক করলে সেক্ষেত্রে সকলের কুরবানী বাতিল হয়ে যায়। (শামী-৬/৩২৬)

উল্লেখ্য যে, ভেড়া ও দুম্বা যদি এমন হৃষ্ট-পুষ্ট হয় যে, ছয় মাসের বয়সেরটিও দেখতে এক বৎসর বয়স্ক মনে হয় তবে এর দ্বারাও কুরবানী জায়িয আছে। কিন্তু বকরী বা ছাগলের জন্য এ হুকুম প্রযোজ্য নয়। (আদদুররুল মুখতার-৬/৩২১)

অন্ধ, কানা ও ল্যাংড়া জন্তু বা এমন রুগ্ন ও দুর্বল জন্তু কুরবানীর স্থান পর্যন্ত যার হেঁটে যাওয়ার শক্তি নেই, অনুরূপভাবে এক তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশী লেজ ও কান কাটা কিংবা লেজ ও কান বিহীন পশুর কুরবানী সহীহ হবে না। এবং অধিকাংশ দাঁত পড়ে যাওয়া পশু দ্বারাও কুরবানী সহীহ হবে না। (শামী:৬/৩২৩, আল বাহরুর রায়িক:৮/৩২৪)

ব্যবসার হিসাব নিয়ে জটিলতা আর নয় (কল- 01771 403 470) ক্লিক করুন

যবাইয়ের মাসাইল

১. নিজের কুরবানীর পশু নিজ হাতে যবাই করা মুস্তাহাব, নিজে সক্ষম না হলে অন্য লোক দ্বারা করানো যায়।কিন্তু সেক্ষেত্রেও নিজে উপস্থিত থাকা উত্তম। মহিলাগণও সম্পূর্ণ পর্দার আড়ালে থেকে অবলোকন করতে পারলে করবেন। (ফাতাওয়ায়ে শামী:৬/৩২৮, আল বাহরুর রায়িক:৮/২৩৮)

২. কুরবানী নিয়ত শুধু মালিক কর্তৃক মনে মনে করাই যথেষ্ট, মুখে কিছু বলার আবশ্যকতা নেই। অনুরূপভাবে মালিক নিয়ত করার পর যবাইকারী কর্তৃক নামের লিস্ট পড়ারও জরুরত নেই। তবে “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” অবশ্যই বলতে হবে। (শামী:৬/২৯৭-৩০১, আল ফিকহুল ইসলামী ৪/২৭৩১)

৩. কুরবানীর দু‘আ সশব্দে পড়া জরুরী নয়, মনে মনে পড়াই যথেষ্ট। দু‘আ না পড়লেও কুরবানীর কোন অসুবিধা হবে না। (শামী:৬/২৯৭)

৪. হলক এবং কন্ঠের মধ্যখানে যবেহ করতে হবে। নতুবা জানোয়ারটি হালাল হবে না। (বাদায়িয়ুস সানায়ে:৫/৪১)

৫. গলার ৪টি রগ তথা: খাদ্যনালী, শ্বাসনালী, দুটি রক্তনালী হতে কমপক্ষে ৩টি রগ না কাটলে পশু হালাল হবে না। (বাদায়িয়ুস সানায়ে:৫/৪১)

৬. কুরবানীর পশুকে মাথা দক্ষিণ দিকে দিয়ে কিবলামুখী করে শুইয়ে প্রথমে এ দু‘আটি পড়তে পারলে পড়বে:

اللهم إني وجهت وجهي للذى فطرالسموات والأرض حنيفا وما أنامن المشركين،إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العلمين،لاشريك له وبذلك أمرت وأنا أول المسلمين .

অত:পর “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর ” বলে যবাই করবে। যবাই করার পর এ দু‘আটি পড়া ভাল: اللهم تقبل مني كما تقبلت من حبيبك محمد و خليلك إبراهيم عليهما الصلاة والسلام
(বাদায়িয়ুস সানায়ে:৫/৬০, জাওয়াহিরুল ফিকহ:১/৪৫০)

কুরবানীর গোশত

১. কুরবানী শরীকানা হলে গোশত ওজন করে সমানভাগে বণ্টন করা জরুরী। অনুমান করে বণ্টন করা নাজায়িয। (আল বাহরুর রায়িক:৮/৩২৭)

২. মুস্তাহাব বা উত্তম হচ্ছে, কুরবানীর গোশত তিন ভাগে ভাগ করে এক ভাগ নিজেরা রাখবে, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দিবে এবং এক ভাগ গরীব মিসকীনদের দান করবে। তবে এটা ওয়াজিব নয়, বরং মুস্তাহাব। তাই যদি কেউ কুরবানীর সমস্ত গোশত প্রয়োজনে নিজেরা খায় তাতেও গুনাহগার হবে না।

কুরবানীর চামড়া

১. কুরবানীর চামড়া বিক্রি না করে পরিশোধন করে নিজে ব্যবহার করা যায়। কুরবানীর চামড়া কুরবানী দাতার জন্য বিক্রি না করা উত্তম। এতদসত্ত্বেও কেউ বিক্রি করলে বিক্রয় মূল্য সদকা করে দেয়া ওয়াজিব। যাদেরকে যাকাত দেয়া জায়িয তারাই এর উপযুক্ত পাত্র। যাদেরকে যাকাত দেয়া জায়িয নেই তাদেরকে কুরবানীর চামড়ার মূল্য দেওয়াও জায়িয নেই। (হিদায়া:৪/৪৫০)

২. কুরবানীর চামড়ার ব্যাপারে উত্তম পন্থা হল: তা গরীব আত্মীয়-স্বজন বা দীনী শিক্ষায় অধ্যয়নরত গরীব ও এতীম ছাত্রদেরকে সরাসরি দান করে দেয়া। তালিবে ইলমদের দান করলে একদিকে যেমন দান করার সওয়াব পাওয়া যায়, অপরদিকে ইলমে দীন চর্চার মহান কাজে সহযোগিতাও করা হয় এবং এতে সদকায়ে জারিয়ারও সওয়াব পাওয়া যায়।

কুরবানীর চামড়া কোন দীনী প্রতিষ্ঠানের গরীব ছাত্রদের দান করে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রি করানো উত্তম। কেননা এতে অধিক মূল্য অর্জিত হয়ে গরীবের বেশী উপকার হয় এবং দাতার সওয়াবও বেশী হয়। (জাওয়াহিরুল ফিকহ:১/৪৫৬)

৩. কুরবানীর গোশত বা অন্য অংশের বিনিময়ে, অনুরূপভাবে চামড়া বা চামড়া বিক্রিত টাকা দ্বারা যবাই করানো বা গোশত কাটানোর পারিশ্রমিক দেয়া জায়িয নেই। দিলে তার উপযুক্ত মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। (শামী:৬/৩২০, ফাতহুল কাদীর ৮/৪৩৭)

যদি কোন কারণে কুরবানীর দিনগুলোতে কুরবানী করা সম্ভব না হয় তাহলে কুরবানীর পশুর মূল্য গরীবদের মাঝে সদকা করে দেওয়া জরুরী। (শামী-৬/৩২০)

৪. কুরবানীর গোশত, চামড়া বা চামড়ার মূল্য ইমাম, মুআযযিন, মাদরাসার শিক্ষক বা অন্য কাউকে পারিশ্রমিক হিসাবে দেয়া যাবে না। তেমনিভাবে মসজিদ মাদরাসার নির্মাণ কাজেও লাগানো যাবে না। (শামী: ৬/৩২৮, ফাতহুল কাদীর:৮/৪৩৭)

ভিজিট করুন: www.darsemansoor.com & www.islamijindegi.com ইন্সটল করুন: ISLAMI JINDEGI অ্যাপ।

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ