বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


এরদোগান কি জয়ের মুখ দেখতে পারবেন?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মোস্তফা ফয়সল পারভেজ
তুর্কি প্রবাসী

আগামী ২৪ জুন তুরস্কে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট পদে ৫ জন প্রার্থী (বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগান, সিএইচপির মোহাররেম ইনজে, ইয়ি বা গুড পার্টির মেরাল আকসেনার, কুর্দিশদের এইচডিপির সালাদিন দেমিরতাশ এবং সাদাত পার্টির তেমেল কারামুল্লাউলু) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।

অপরদিকে সংসদ নির্বাচনে দুটি শক্তিশালী রাজনৈতিক জোট এবং আরও কিছু রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করছে। এরদোগানের একেপির নেতৃত্বে "জুমহুর ইত্তিফাক" নামক জোটে একে পার্টি, জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপি এবং ইসলামিক জাতীয়তাবাদী দল বুয়ুক বির্লিক পার্টি।

অপরদিকে আতার্তুকের অনুসারীদের সিএইচপির নেতৃত্বে "মিল্লেত ইত্তিফাক" নামক জোটে সিএইচপি, জাতীয়তাবাদী দল থেকে ভেঙে নবগঠিত ইয়ি পার্টি বা গুড পার্টি, তুরস্কের ইসলামপন্থী দল সাদাত পার্টি এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি।

কুর্দিশ রাজনৈতিক দল এইচডিপি কোনো জোটে না গেলেও গত ১১ তারিখে কুর্দিশ শহর দিয়ারবাকারে সিএইচপির সমাবেশে দলীয় পতাকাসহ এইচডিপির অনুসারীদের অংশগ্রহণ এবং তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দেমিরতাসের সঙ্গে সিএইচপি প্রার্থী মোহাররেম ইনজের সাক্ষাতের মাধ্যমে সিএইচপি জোটের সঙ্গে তাদের গোপন কোয়ালিশনের বিষয়টা প্রকাশ্যেই এখন মিডিয়াতে প্রচারিত হচ্ছে।

২০০২ সাল থেকে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে টানা ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা একে পার্টি প্রথমবারের মতো শক্তিশালী চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।

যে কারণে এই নির্বাচন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং

তুরস্কের রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত ব্যক্তি হিসেবে এরদোগান এবং দল হিসেবে একেপি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ের জন্য এরদোগানকে ৫০ শতাংশ এর বেশি ভোট পেতে হবে।

প্রথম রাউন্ডে যদি বিজয়ী হয় তাহলে সহজেই এই যাত্রায় বেঁচে যাবে কিন্তু নির্বাচন দ্বিতীয় রাউন্ডে গড়াইলে এরদোগানকে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

কারণ সেক্ষেত্রে সিএইচপির নেতৃত্বে সাদাত, ইয়ি পার্টি এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির জোট ছাড়াও কুর্দিশ জাতীয়তাবাদী দল এইচডিপিও এই জোটে যোগ দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে সাধারণ তার্কিশদের মতে প্রেসিডেন্ট পদে এরদোগান প্রথম রাউন্ডেই জিতে যাবে।

বেশির ভাগ জরিপে প্রেসিডেন্ট পদে এরদোগান ৫০-৫৪ শতাংশ, সিএইচপির মোহররেম ইনজে ২০-২২ শতাংশ, ইয়ি পার্টির মেরাল আকসেনার ৮-১২ শতাংশ, সাদাত পার্টির তেমেল কারামুল্লাউলু ১-৩ শতাংশ এবং কুর্দিশ এইচডিপি ৯-১১ শতাংশ ভোট পেতে পারে।

কিন্তু একই সঙ্গে এরদোগানের দল একে পার্টিকেও ৩০০+ আসনে বিজয়ী হতে হবে। বিভিন্ন জরিপে দল হিসেবে একেপি ৪২-৪৬ শতাংশ, জাতীয়তাবাদী এমএইচপি ৭-৯ শতাংশ, ইসলামিক জাতীয়তাবাদী বুয়ুক বির্লিক ১-২ শতাংশ। অপরদিকে বিরোধী জোটের সিএইচপি ২৪-২৬ শতাংশ, ইয়ি পার্টি ৫-৭ শতাংশ, কুর্দিশ জাতীয়তাবাদী এইচডিপি ৮-১০ শতাংশ, সাদাত পার্টি ১-৩ শতাংশ ভোট পেতে পারে।

সাদাত পার্টির সমর্থকদের মতে ৫-৭ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে ১-৩ শতাংশের বেশি সম্ভাবনা নেই। কারণ নাজমুদ্দিন আরবাকানের মিল্লিগুরুশের ৯০ শতাংশ ভোট এখন পর্যন্ত একে পার্টি পায়, যদিও এরবাকান হোজা বিভিন্ন নির্বাচনে ৮-২১.৬ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পেয়েছিলেন।

তবে কোনো কারণে কুর্দিশ এইচডিপির ভোট যদি ১০ শতাংশ এর সামান্য নিচে চলে আসে তাহলে সমগ্র কুর্দিশ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে এরদোগানের একেপি ৯০ শতাংশ আসন পেয়ে যাবে।

শান্তিপ্রিয় এবং ধার্মিক কুর্দিশদের ভোট বরাবরই এরদোগান এবং তার দল পেয়ে আসছে। এইচডিপি কুর্দিশ সন্ত্রাসীগোষ্ঠী পিকেকের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে অঘোষিতভাবে পরিচিত থাকা এবং বাম আদর্শে বিশ্বাসী হওয়ায় ধার্মিক এবং শান্তিপ্রিয় কুর্দিশরা বরাবরই তাদের এড়িয়ে চলেছে।

তবে বিরোধী জোটের কিছু কাজ যেগুলোর কারণে আলটিমেটলি এরদোগান এবং একেপি লাভবান হচ্ছে।

সিএইচপির অভ্যন্তরে কোন্দল

আতার্তুকের অনুসারীদের সিএইচপির অভ্যন্তরে অনেকটা প্রকাশ্য কোন্দল পরিলক্ষিত হচ্ছে। দলের সভাপতি কেমাল কিলিসদার সঙ্গে দলের সহসভাপতি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মোহররেম ইঞ্জের দ্বন্দ্ব। কেমাল কিলিসদা ইতিমধ্যে সংসদ নির্বাচনে ইনজের পক্ষাবলম্বনকারী প্রায় ৬০ জন এমপিকে নমিনেশন দেয়নি যা নিয়ে এই দুই নেতা প্রকাশ্যেই তাদের জনসভাগুলোতে একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

বিভিন্ন স্থানে কেমাল কিলিসদার সমর্থিত নেতারা ইয়ি পার্টির প্রধান মেরাল আকসেনারের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ উঠছে। ফলে ধারণা করা হচ্ছে সংসদ নির্বাচনে সিএইচপি ২৪-২৬ শতাংশ ভোট লাভের সম্ভাবনা থাকলেও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মোহররেম ইনজে ২০-২২ শতাংশ এর বেশি ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার স্ট্রাকচারের পরিবর্তনের ঘোষণা

তুরস্কের সব ইসলামি এবং ডানপন্থী দলগুলো ক্ষমতায় এসে ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা তথা ৪+৪+৪ পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য কাজ করেছেন।

এই পদ্ধতির মাধ্যমে একজন ছাত্র কোনো প্রকার শিক্ষা গ্যাপ ছাড়াই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে মাদ্রাসা (ইমাম হাতিপ) এবং হেফজ সম্পূর্ণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। ৪+৪+৪ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে নাজমুদ্দিন এরবাকান ক্ষমতায় এসেই এই শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কাজ করেছেন।

২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ সালে ক্ষমতা থেকে সরানোর সময় ১৮ টি ধারায় তার জোরপূর্বক স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিল যার একটি ছিল ৪+৪+৪ শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে কাজ না করা। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সিএইচপির প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে তিনি ক্ষমতায় এলে এরদোগানের প্রবর্তিত ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা উন্মুক্ত রাখার এই স্ট্রাকচার ভেঙে সেক্যুলারদের পুরনো স্ট্রাকচার আবার প্রবর্তন করবে।

টিকা বন্ধ ও সিরিয়ানদের বিষয়ে হুমকি

এছাড়া বিদেশি সাহায্য সহযোগিতা সংস্থা টিকা (TIKA) কে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে সিএইচপি এবং ইয়ি পার্টির প্রধান। সেই সঙ্গে সাড়ে তিন মিলিয়ন সিরিয়ানদের তুরস্কে থাকার বিষয়েও তারা উভয়েই হুমকি দিয়েছে।

বিদেশি শক্তির এরদোগান বিরোধী অবস্থান

ইতিমধ্যে ইউরোপের দুই একটি দেশ ছাড়া সব স্থানে এরদোগান তথা একে পার্টির প্রচারণা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, একই সঙ্গে বিরোধীদল সেখানে পুলিশ প্রহরায় কাজ করছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অধিভুক্ত এক দেশের মন্ত্রী সিএইচপি প্রার্থীর কাছে জানতে চেয়েছে সে বিজয়ী হলে এরদোগানকে গ্রেফতার করবে কিনা।

এভাবে বিদেশি শক্তিগুলোর এরদোগানের বিপরীতে অবস্থান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ তার্কিশদের হৃদয়ে এরদোগানের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধিতে কাজ করছে। সেই সঙ্গে বিদেশি শক্তিগুলো যে ইউরোপের পাশে শক্তিশালী তুরস্ককে চাই না সেটাও সাধারণ তুর্কিশরা অনুধাবন করে।

তুরস্কের রাজনীতির আদর্শিক বিভাজন ওসমানীদের উত্তরসূরি এবং আতার্তুকের অনুসারীদের মধ্য বিভক্ত। এই নির্বাচনের দুটি জোট মূলত তুরস্কের আদর্শিক বিভাজনেরই একটি বহিঃপ্রকাশ। যদিও মূল ইসলামপন্থী দল সাদাত পার্টি বাম আদর্শে বিশ্বাসী সিএইচপির জোটভুক্ত এবং মেরাল আকসেনাদের অধিকাংশ সমর্থক ডানপন্থি জাতীয়তাবাদী দল থেকে আসা।

এরদোগান তার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের মাধ্যমে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে এবং শক্তিশালী তুরস্ক গঠনে আবারও ক্ষমতায় আসতে জনগণের দ্বারপ্রান্তে ছুটে যাচ্ছে।

অপরদিকে বিরোধী জোট শুধুমাত্র এরদোগানের পরিবর্তনকে সামনে নিয়েই কাজ করছে। আগামী ২৪ জুন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে তুরস্কের ভাগ্য, এই তুরস্ক এরদোগানের নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে নাকি আতার্তুকের উত্তরসূরি কেমাল কিলিসদা এবং মোহররেম ইনজেদের নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন : মধ্যপ্রাচ্য সফরে ট্রাম্প জামাতা; আলোচনায় ফিলিস্তিন ইস্যু

 

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ