শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


হোসেন মাহমুদের উপন্যাস : সমর্পণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সারাদিন রোদ ঢেলেছে সূর্য। এখন শেষ বিকেলে ক্লান্ত হয়ে ছুঁই ছুঁই করছে পশ্চিমের পাহাড় চূড়া। আরেকটু পরই সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে যাবে। তারপরই আঁধারের ছায়া নামবে পূবের দিগন্তরেখায়। হামাগুড়ি দিতে দিতে সে ছায়া দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকবে। একসময় গোটা চরাচর ঢাকা পড়ে যাবে আঁধারের কালো পর্দায়। তার সাথে ওয়াদিউল কুরাও। রাত মানে অন্ধকার, রাত মানে শান্তি ও গভীর ঘুম।

ইহুদি বনি আসার গোত্রের বিরাট এ পল্লিটি গড়ে উঠেছে আল-কাব পাহাড়ের পাদদেশে। একদিকে বেশ উঁচু পাহাড়, আরেকদিকে মরুভূমি। সারা জনপদে অনেক খেজুর গাছ। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসা একটি সবুজ রেখা হঠাৎ করেই সীমাহীন মরুভূমির কিনারে এসে থমকে গেছে।

সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তের এ সময়টিতে ওয়াদিউল কুরা পল্লিবাসীদের প্রায় সকলেই খুব ব্যস্ত। আসন্ন রাতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে তারা। ইতোমধ্যেই ভেড়া আর ছাগলের পাল নিয়ে ফিরতে শুরু করেছে রাখালেরা। পল্লির পথে ঘন হয়ে উড়ছে ধূলি। ঘরে মেয়েরা গুছিয়ে রাখছে মশাল, প্রদীপ আর মোমবাতি। দিনের আলোর শেষ আভাটুকুও বিলীন হওয়ার পর ঘরে ঘরে আলো জ¦লে উঠতে শুরু করবে।

দাসী ঘরে প্রদীপ জ¦ালিয়ে দিয়ে গেছে। সে আলোতে রূপসজ্জা শেষ করে হরদিয়া। এমনিতেই খুব সুন্দরী সে। এ মুহূর্তে তাকে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা মনে হচ্ছে। মায়ের হিসাব মতো এ বছর বিশের ঘরে পা দিয়েছে সে। ওয়াদিউল কুরায় তার চেয়ে সুন্দরী কোনো কুমারী নেই। আশপাশের সব পল্লিতেও তার রূপের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। বহু যুবক তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল। এ জন্য বেশ গর্ববোধ করে হরদিয়া। তাদের পল্লির মেয়েদের দু-একজন এ রূপের কারণে তাকে হিংসা করে, তাও জানে সে। তবে তা নিয়ে সে মোটেও মাথা ঘামায় না। তার মাথায় এখন অন্য চিন্তা। সে এমন এক চিন্তা যা হরদিয়াকে বেসামাল করে তুলেছে। কী করে কাজটি করা যায় তা ভেবে রেখেছে সে। চিন্তা হল যাকে দিয়ে তা করানো হবে তাকে নিয়ে। কারণ তার শর্ত। সে শর্ত দিয়েছে কাজটি সে করবে, তবে হরদিয়ার সাথে বিয়ে হওয়ার পরই করবে, তার আগে নয়।

হরদিয়া এখন যাবে বনি মোস্তালিকের কুয়ার পাড়ে। সেখানে তার দেখা হবে আইয়ুব ইবনে তালহার সাথে। ওয়াদিউল কুরার যুবকদের মধ্যে শক্তি ও সাহসে সে সবার সেরা। এমনকি আশপাশের পল্লিগুলোতেও তার সমকক্ষ বীর আর কেউ নেই। তবে এই কিছুদিন আগেও আইয়ুবের চেয়েও সেরা একজন বীর ছিল। তবে তার কথা মনে আনতে চায় না হরদিয়া। যাহোক, হরদিয়ার প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছে আইয়ুব। কিন্তু হরদিয়া তাকে একটুও পছন্দ করে না। কিন্তু বীরযোদ্ধা হলে কি হবে, আইয়ুবের চরিত্র ভালো নয়। ইতোমধ্যেই দু-দুবার বিয়ে করেছে সে। কিন্তু কোনো স্ত্রীই তার ঘর করতে পারেনি। স্ত্রীদের কাউকেই নাকি তার পছন্দ হয়নি।

Image result for bedouin family art

মারধরসহ নানা অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত দুজনেই তার ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। তারপর থেকেই আইয়ুবের চোখ পড়েছে হরদিয়ার ওপর। কিন্তু হরদিয়া অন্য ধাতুতে গড়া। তার কাছাকাছি ঘেঁষতে পারেনি আইয়ুব। অনেক চেষ্টা তদবির করে, লোকজন লাগিয়ে শেষ পর্যন্ত হরদিয়ার কাছে নিজের মনে কথা পৌঁছাতে পেরেছে সে। হরদিয়া প্রথম দিকে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে ওঠায় নিরুপায় হয়ে আইয়ুবের একতরফা প্রেমের জবাবে সাড়া দিতে শুরু করে। হরদিয়া নিজেও জানে যে প্রেম ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় এটা তা নয়। আসলে এটাকে তার অভিনয় বললেই ঠিক বলা হয়। যেহেতু সে একটি ভয়ঙ্কর কাজ করতে চায় সে জন্য আইয়ুবের মতো একজন সাহসী ও বীর যুবককে তার হাত করা দরকার। এর মধ্যে দুদিন তার সাথে সাক্ষাত করেছে সে।

আইয়ুবের একই কথা, হরদিয়ার সম্মতি পেলেই সে তার বাবা শামাউনের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। আইয়ুবকে এ রকম নাছোড়বান্দা দেখে হরদিয়া তার কাছে নিজের প্রস্তাবটি পেশ করে। হরদিয়াকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে আইয়ুব। কোনো চিন্তা-ভাবনা না করেই তার প্রস্তাবে রাজি হয়েছে সে। কিন্তু কথা হলো, বিয়েটা আগে হতে হবে। হরদিয়া দিন কয়েক সময় নিয়েছে তার কাছ থেকে। সে বুঝতে পারছে, আইয়ুবকে আর বেশিদিন ঘোরানো যাবে না, শিগগিরই তাকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। তবে আইয়ুবকে বিয়ে করবে, এটাই শুনতে চাইবে সে। অন্যকিছু বললে তার বিরাগভাজন হতে হবে। সেটা ভালো হবে না।

প্রদীপের আলোয় প্রসাধন শেষ করে উঠেপড়ে হরদিয়া। দামেস্ক থেকে আনা আয়নায় নিজেকে দেখে সে। নিজের রূপে যেন নিজেই মুগ্ধ হয়ে পড়ে। যুবকরা তার এ রূপ দেখে পাগল হবে না তো কি করবে? ওয়াদিউল কুরার যুবকদের কেউ যদি তাকে অংকশায়িনী করতে পারে, নিজেকে ধন্য মনে করবে। কিন্তু তারা তো জানে না, হরদিয়া কি চায়। জানলে তাকে বিয়ে করার জন্য অনেকের আগ্রহেই হয়ত ভাটা পড়ত।

দুই.
মক্কার সেই অদ্ভুত মানুষটির কথা ওয়াদিউল কুরাতেও পৌঁছেছে। এটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ইহুদি পল্লি। মক্কা থেকে সিরিয়াগামী পথটি এ পল্লির প্রায় গা ছুঁয়ে গেছে। অনেক প্রাচীন এই পথ। উটের কাফেলা নিয়ে যাওয়া-আসার পথে মক্কার বণিকরা এক রাত এখানে জিরিয়ে নেয়। বনি মোস্তালিকের কুয়ার কাছাকাছি তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটায়। এখান থেকে মক্কা মাত্র দুদিনের পথ। বাণিজ্যের জন্য প্রায়ই আসা-যাওয়া করতে হয়। তাই ওয়াদিউল কুরার লোকজনের সাথে মক্কার বণিকদের ভালো স¤ণ্ঠর্ক গড়ে উঠেছে। এই বণিকদের কাছেই ওয়াদিউল কুরাবাসীরা শুনেছে মক্কার সেই মানুষটির কথা। তার নাম মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ। কুরাইশ বংশের বনি হাশিম গোত্রের সন্তান। তার দাদা আবদুল মুত্তালিব ছিলেন খুব বিখ্যাত মানুষ, কাবা ঘরের সেবক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী। তার জন্মের আগেই বাবা আবদুল্লাহ মারা যান।

শিশু বয়সে তাকে রেখে তার মা-ও মারা যান। তারপর তার চাচা তাকে সন্তান হিসেবে লালন-পালন করেন। ভদ্র, বিনয়ী, সচ্চরিত্র, অত্যন্ত বিশ^াসী বলে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। মক্কার লোকেরা তার কাছে মূল্যবান জিনিস আমানত রাখত। তার সবই ভালো ছিল। কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সের পর তার মাথা বিগড়াতে শুরু করে। সে এখন নিজেকে আল্লাহর নবী বলে দাবি করছে। আর নানা রকম কথা বলছে। সে বলছে, মূর্তিপূজা হারাম। বিশ^-জগত ও মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। সেই আল্লার ইবাদত-বন্দেগি করতে হবে। আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা যাবে না। তার এসব কথায় প্রথম দিকে কেউ কান না দিলেও এখন বহু নারী-পুরুষ তার অনুসারী হয়েছে। শুধু তাই নয়, তার অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

হরদিয়ার বাবা শামাউন ওয়াদিউল কুরার ইহুদি গোত্রের প্রধান। বাবার কাছেই প্রথম সে জানতে পারে সেই মানুষটির কথা। সে যা প্রচার করছে সেটা নাকি ইসলাম ধর্ম। যে ইসলাম গ্রহণ করে তাকে ঈমান আনতে হয় এ বলে যে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রভু নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। এ পর্যন্ত যা জানা গেছে তাতে সু¯ণ্ঠষ্ট যে, এ ব্যক্তি ইহুদিদের জন্য বিপজ্জনক।

Image result for arabian women art

খ্রিস্টানদের সাথে ইহুদিদের রয়েছে জাত শত্রুতা। খ্রিস্টানরা যেমন ইহুদিদের সহ্য করতে পারে না, তেমনি ইহুদিরাও তাদের দুচোখে দেখতে পারে না। এমনিতেই ইহুদি ধর্ম গতি হারিয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে। নতুন কেউ এ ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে না। এর মধ্যে আবার ইসলাম নামের এ নতুন ধর্মের প্রচারক যে ইহুদি ধর্মের জন্য এক বড় ধরনের বিপদ বয়ে আনছে, তাতে কারোরই কোনো সন্দেহ নেই।

পল্লির গণ্যমান্য লোকদের নিয়ে ইতোমধ্যেই শামাউনের বাড়িতে কয়েকবার সভা হয়ে গেছে। সর্বশেষ সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, এই মুহাম্মাদ স¤ণ্ঠর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নেয়া হবে। যদি তার ধর্ম সত্যই ইহুদি ধর্মের বিরোধী হয়ে থাকে, যেমনটি শোনা যাচ্ছে, তাহলে যেকোনো মূল্যে তাকে হত্যা করতে হবে। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে তিনজনের একটি পর্যবেক্ষক দলকে মক্কায় পাঠানো হয়েছে ভালো করে খোঁজ নেয়ার জন্য। তারা ফিরে এসে কি বলে তা শোনার পর তদনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিন.
দশ দিন কেটে গেছে। মক্কায় যে দলটিকে পাঠানো হয়েছিল, ফিরে এসেছে তারা। দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও সন্ধ্যায় গোত্রপ্রধানের বাড়িতে এসে হাজির হয় তারা। তাদের আসার খবর পেয়ে পল্লির গণমান্য লোক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও এসে ভিড় জমিয়েছে সেখানে। ওদিকে অন্দর মহলে এসে জুটেছে বহু নারীও। মক্কা ফেরত পর্যবেক্ষক দলটির নেতার কাছে যা জানা গেল তাতে সবার মনেই আশঙ্কার মেঘ ভারি হয়ে ওঠে। এটা পরিষ্কার মুহাম্মাদ সা. নামের ওই লোকটিকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। খোদ কুরাইশরা তাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়েছে। মক্কার কয়েকজন শক্তিশালী ও বীর যোদ্ধা এখন তার নিত্যসাথী। সে পরিষ্কার বলেছে, ইসলামই আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন। যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিশ^াস স্থাপন করবে, সৎকাজ করবে, তারা বেহেশতে যাবে। আর যারা তা করবে না অর্থাৎ কাফেররা তাদের স্থান হবে দোযখে।

সে লোকটির কথা শেষ হওয়ার পর সবাইকে যার যার বাড়ি চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয় শামাউন। তারপর প্রভাবশালী কয়েকজনকে নিয়ে শলা-পরামর্শে বসে সে। মুহাম্মাদ সা.-কে নিয়ে কি করা যায়, সেটাই তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু। নতুন ধর্ম প্রচারকারী এ লোকটি মক্কার কুরাইশদের যেমন শত্রু তেমনি ওয়াদিউল কুরার ইহুদিদেরও শত্রু। কুরাইশদের ধর্মের মতো তার হাতে তাদের ইহুদি ধর্মও যে বিপন্ন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে এর অন্তত একটি প্রমাণ পাওয়া গেছে। তা হলো, ওয়াদিউল কুরার অন্যতম প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তি সুহায়েল বিন আমরের পুত্র আমেরের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।

আমের ছিল এ গোত্রের শ্রেষ্ঠ বীর। এই মুহাম্মাদ সা.-এর কারণেই সে আজ নিজ গৌরবময় ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করেছে। ওয়াদিউল কুরার ইহুদিদের জন্য এ যে কত বড় ক্ষতি ও অপমান, তা বলে শেষ করার নয়। গোটা গোত্রের মান-সম্মান একেবারে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছে আমের। এখন সে নাকি মুহাম্মাদের সা. বিশ^স্ত সঙ্গী। বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ধর্ম ছেড়ে এক সামান্য লোকের কথায় মুগ্ধ হয়ে সে নিজেও এখন ইসলাম প্রচার করে বেড়াচ্ছে। শামাউন সিদ্ধান্ত দিয়েছে, আমেরকে যে যেখানে হাতের নাগালে পাবে সেখানেই তাকে হত্যা করবে। আর মুহাম্মাদ সা. নিজে যদি কোনো সময় তাদের এদিকে আসে তাহলে তাকেও সমূলে ধ্বংস করা হবে।

Image result for bedouin art

শামাউনের কথা শেষ হওয়ার পর সভাস্থলে নীরবতা নেমে আসে। ইতোমধ্যে আরেক প্রস্থ শরাব ঢেলে দিয়ে যায় ভৃত্য। শরাবের পেয়ালায় নতুন করে চুমুক দিয়ে নিজেকে তাজা করে নেয় গোত্রের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা উযায়র ইবনে হারিস :

: আমার কথা হচ্ছে, পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে আমাদের আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। গোত্রের সেরা যোদ্ধাদের নিয়ে একটি গুপ্ত ঘাতক দল গঠন করা হোক। তারা মক্কায় গিয়ে সুযোগমত মুহাম্মাদ সা. মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সকল শঙ্কার ইতি ঘটাবে। ফিরে আসবে বীরের বেশে। মুহাম্মাদ সা.-কে হত্যা করাই এখন গোত্রের সবচেয়ে বড় কাজ। যারা এ কাজ করতে পারবে তাদের তারা যা চাইবে সে পুরস্কারই দেয়া হবে।

শামাউনসহ উপস্থিত গোত্রনেতাদের সবারই বেশ পছন্দ হয় কথাটা। তখনি কথা ওঠে, কাদের পাঠানো হবে এ কাজে। এ দুঃসাহসিক কাজে কি কেউ যেতে চাইবে? তাছাড়া খোদ মক্কাতে গিয়ে মুহাম্মাদ সা.-কে হত্যা করা যা তা কথা নয়। কুরাইশরা তার যত শত্রুই হোক, বাইরের কোনো গোত্রের লোক তাকে হত্যা করলে সেক্ষেত্রে হত্যাকারীদের যে তারা কিছু বলবে না, এ নিশ্চয়তা কে দেবে? সুতরাং এ কাজে মারাত্মক ঝুঁকি আছে। সত্যি বলতে কি, প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা সম্ভব নাও হতে পারে। তাছাড়া, মুহাম্মাদকে হত্যা করা হলে তার সঙ্গী-সাথীরাই কি চুপ করে বসে থাকবে? ঘাতকদলের ওপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে তাদের প্রাণ নিয়ে ফেরা অসম্ভব হতে পারে।

সবাই একমত হয় যে, কাজটা অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ রকম কাজে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য দরকার একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, কৌশলী, সাহসী ও বিচক্ষণ যুবক। আর তখনি সবার মুখে উঠে আসে আমেরের কথা! হ্যাঁ, গোত্রের মধ্যে এ রকম বীরপুরুষ একজনই ছিল বটে। তার তলোয়ারের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কারোর ছিল না। অনেকেরই ধারণা ছিল যে বয়সে যুবক হলেও শামাউনের পর সেই হবে গোত্রের প্রধান। কিন্তু কি করে যে কি হয়ে গেল! গোত্রের সেরা বীরই আজ মুসলমান হয়ে গেছে। বনি আসার গোত্রে এর চেয়ে বড় সর্বনাশের ঘটনা আর ঘটেনি। শেষ পর্যন্ত আইয়ুবের কথা উঠে আসে। স্থির হয় যে, আইয়ুবের সাহস ও বুদ্ধি আছে। সে একজন বীর যোদ্ধা। তারই নেতৃত্বে চারজনের একটি ঘাতক দল পাঠানো হবে মক্কায়। সব প্রস্তুতি সেরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রওনা হয়ে যাবে তারা।

চার.
পল্লির অন্য মেয়েরা চলে গেলেও পর্দার আড়ালে ঠিকই বসেছিল হরদিয়া। গোপন শলাপরামর্শে কি সিদ্ধান্ত হয় তা জানার জন্য ভীষণ উদগ্রীব ছিল সে। সভায় গুপ্তঘাতক দল পাঠানোর সিদ্ধান্তে খুশিতে নেচে ওঠে হরদিয়া। মুহাম্মাদ সা. ও আমের, দুজনেরই মৃত্যু চায় সে। বিশেষ করে আমেরের প্রতি তার ক্রোধ বেশি। আমের শুধু তার ভালোবাসার অমর্যাদাই করেনি, ইসলাম গ্রহণ করে স্ব-ধর্ম ও স্ব-গোত্রেরও অবমাননা করেছে। হরদিয়ার জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসার উপহারকে প্রত্যাখ্যান করে চিরকালের জন্য পর হয়ে গেছে। এ জীবনে আমেরকে পাওয়ার আর আশা করে না সে।

আমের যদি মুসলমান না হয়ে তাকে বিয়ে না করে গোত্রেই থেকে যেত, তাও একটা কথা ছিল। যে হরদিয়াকে পাওয়ার জন্য গোত্রের যুবকরা পাগলপ্রায়, যার মত সুন্দরী আশপাশের দু-দশ পল্লিতেও খুঁজে পাওয়া যায় না, সেই হরদিয়ার প্রাণ-মন উজাড় করা ভালোবাসাকে আমের কোনো পাত্তাই দিল না! এ যে কত বড় অপমান, আর সে অপমানের কি যে জ¦ালাÑ তা শুধু হরদিয়াই বোঝে। আমেরের অবজ্ঞা ও প্রত্যাখ্যান তাকে এই কঠিন সংকল্পের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ অপমানের চরম প্রতিশোধ একমাত্র রক্ত দিয়েই হতে পারে। আমেরের প্রাণ সে নেবে। আর এই বিশ্বসঘাতক ও ঘৃণ্য আমেরকে যে গোত্রছাড়া করেছে, তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে, সেই মুহাম্মাদ সা.-কেও ছাড়বে না সে। তাকেও হত্যা করবে।

এ কারণেই আইয়ুবকে প্রয়োজন হরদিয়ার। দীর্ঘ চিন্তার পর হরদিয়া ঠিক করেছিল আইয়ুবকে সাথে নিয়ে সে নিজেই যাবে। আমেরকে খুঁজে বের করে হত্যা করে তার প্রেমের অপমানের প্রতিশোধ নেবে। এতে মুহাম্মাদ সা. যদি বাধা সৃষ্টি করেন তবে তাকেও সে ছাড়বে না। সেক্ষেত্রে লাভ হবে দুটি, এক নিজের ভালোবাসা ও গোত্রকে অপমানের প্রতিশোধ নেয়া হবে, দুই, ইহুদি ধর্মের প্রতি মুহাম্মাদের সা. কারণে যে মারাত্মক হুমকি দেখা দিয়েছে তারও অবসান ঘটবে। হরদিয়া এমনো ভেবে রেখেছে, ছুরি বা তলোয়ার দিয়ে যদি হত্যার কাজ না সারা যায় তাহলে প্রয়োজনে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে দিয়ে হলেও সে তাকে হত্যার চেষ্টা করবে। এতে যদি নিজের জীবনও যায় তাতেও তার আফসোস নেই।

গোত্রের সভায় আজ আইয়ুবের নেতৃত্বে ঘাতকদল পাঠানোর সিদ্ধান্তে সে খুশি হয়ে উঠল। কারণ, এতে তার দীর্ঘদিনের সংকল্পকে বাস্তব রূপ দেয়ার কাজটি এখন আরও সহজ হয়ে গেল। আইয়ুবকে বিয়ে করার ইচ্ছা তার কখনোই ছিল না। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত হয়ত তাতে রাজি হয়ে যেত সে। গত সপ্তাহে আইয়ুবের সাথে দেখা হওয়ার সময় বিয়ের ব্যাপারে সম্মত হওয়ার জন্য ভীষণভাবে চেপে ধরেছিল সে।

Image result for bedouin art

নানা মিষ্টি কথায় পটিয়ে আইয়ুবকে আরও কয়েকটি সপ্তাহ অপেক্ষা করার জন্য রাজি করাতে পেরেছিল হরদিয়া। এবারই বোধ হয় শেষবার। আর তাকে ঠেকানোর কোনো উপায় থাকবে না, এমনটিই মনে হয়েছিল তার। কিন্তু হঠাৎ করেই ভাগ্য সহায় হয়েছে। এখন গোত্রের সিদ্ধান্ত না মেনে আইয়ুবের উপায় নেই। আইযুব যদি সফল হয়ে ফিরে আসে তখন তাকে বিয়ে করার কথা ভাববে হরদিয়া। আর আমেরকে যখন কোনোদিনই পাওয়া যাবে না তখন সেই বা কি করবে! মেয়ে মানুষ, বিয়ে তো তার করতেই হবে। সেটা না হয় আইয়ুবের সাথেই হবে।

হঠাৎ হরদিয়ার মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে যায়। সে তো আইয়ুবের সাথে গোপনে আমেরকে হত্যা করার জন্য যেতে চেয়েছিল। এখন প্রকাশ্যেই ঘাতকদল যাচ্ছে। সে নিজেও তো তাদের সাথে যেতে পারে। আর তা হলে আমের বা মুহাম্মাদ সা.-কে হত্যার চেষ্টা করাসহ হত্যাকা-ের দৃশ্যটাও নিজের চোখেই দেখতে পারবে। এমনকি আমেরের অন্তিম মুহূর্তে হরদিয়ার প্রেম প্রত্যাখ্যানের পরিণতি যে কি ভয়াবহ সে কথাটাও বুঝিয়ে দেয়ার একটি সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু তখনি তার মনে হয়, তার বাবা-মা গোত্রের কেউই এ রকম একটি ভয়ঙ্কর কাজে তাকে যেতে দিতে রাজি হবে না। তবে কোনোভাবেই সে যদি তার বাবাকে রাজি করাতে পারে তাহলে হয়ত যাওয়ার অনুমতি মিলতে পারে। কীভাবে এ অনুমতি আদায় করা যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকে হরদিয়া।

পাঁচ
ওয়াদিউল কুরার ইহুদি গোত্রপতি শামাউনকে গোত্রের লোকেরা যত না শ্রদ্ধা না করে, ভয় করে তার চেয়ে বেশি। সিরিয়ায় বাণিজ্য করে সে প্রচুর ধনস¤ণ্ঠদের অধিকারী হয়েছে। আরবের ইহুদি গোত্রগুলোর প্রায় সবাই তার নাম জানে। মদিনার ইহুদি গোত্রগুলোর সাথেও তার যোগাযোগ আছে। কিন্তু তার ব্যবহার অত্যন্ত কর্কশ। অর্থ ছাড়া আর সবকিছুই তার কাছে মূল্যহীন। গোত্রের কেউ বিপদে পড়ে তার কাছ থেকে কখনো কোনো আর্থিক সাহায্য পেয়েছে, এমন কথা কারো জানা নেই।

সংসারে মেয়ে ও স্ত্রী ছাড়া তার কেউ নেই। মেয়ে হরদিয়া অত্যন্ত সুন্দরী। বুদ্ধিও আছে বেশ। বাবাকে টাকা-পয়সার হিসাব রাখার কাজে সাহায্য করে সে। এ জন্য মেয়েটির উপর শামাউনের বেশ দুর্বলতাও আছে। তবে মেয়েটি খুব রাগী ও অহঙ্কারী বলে মাঝে মাঝে বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। অনেকটা তারই মতো মেয়েটি। ধন-স¤ণ্ঠদের অভাব তার নেই। কিন্তু মেয়েটাকে সুখী দেখতে হলে তার জন্য একটি ভালো পাত্র দরকার। সেদিক দিয়ে আমেরকে মনে মনে পছন্দ করে রেখেছিল শামাউন। তাকে সবদিক দিয়েই হরদিয়ার যোগ্য মনে হয়েছিল। প্রয়োজন বোধে তার রাগী-অহঙ্কারী মেয়েকে ধমকে ঠা-া রাখার মতো পৌরুষ আমেরের ছিল। তাছাড়া তারপর আমেরেরই গোত্রপ্রধান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

নিজের জামাই গোত্রপ্রধান হলে সে খুবই খুশি হতো। এ বছরই তাদের বিয়ের কাজটা সেরে ফেলার কথা চিন্তা করছিল সে। কিন্তু কয়েক মাস আগে সেই যে হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল আমের, তার হদিস মিলল এই সেদিন মাত্র। মক্কায় গিয়ে সে মুহাম্মাদ সা.-এর কাছে মুসলমান হয়েছে। এ খবর পেয়ে মাথায় যেন বাজ পড়েছে তার। মেয়েটিকে এক যোগ্য পাত্রের হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার যে আশা করেছিল, এখন তা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। শামাউনের চোখে ক্রোধের আগুন জ¦লেÑ বেঈমান ! শয়তান! হাতের কাছে পেলে তোকে খুন করব আমিÑ বিড় বিড় করে বলতে থাকে শামাউন। হঠাৎ মেয়ের ডাক কানে আসতেই ফিরে তাকায় সে। হরদিয়া ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে।

মেয়েকে দেখে শামাউনের দৃষ্টি নরম হয়ে আসে। বলে,
: কি রে! কিছু বলবি?
: হ্যাঁ বাবা, তোমার মনটা ভালো আছে তো?

আমেরের উপর ক্রোধের রেশ তখনো শামাউনের মন থেকে মিলায়নি। তিক্ত কণ্ঠে সে বলেÑ
: না রে, আমের শয়তানটার কথা ভাবছিলাম। গোত্রের সাথে, বাপ-দাদার ধর্মের সাথে বেঈমানি করে মুসলমান হয়ে গেল সে। ওকে হাতের কাছে পেলে খুন করে এ বেঈমানির বদলা নিতাম। তবে তার চেয়েও আমাদের বড় শত্রু হচ্ছে ঐ মুহাম্মাদ সা.। বেঈমান আমের তার কাছেই আছে। আমাদের ইহুদি ধর্মের সর্বনাশ করে ছাড়বে লোকটা।

: সত্যি তাই বাবা! আমের আমাদের গোত্রের কলঙ্ক। সবার মুখে চুনকালি মাখিয়ে উঁচু মাথা হেঁট করে দিয়েছে সে। তাকে হত্যা না করলে এ গোত্রের ইজ্জত থাকবে না বাবা।

: হ্যাঁ, আমার মনের কথা বলেছিস তুই। সে জন্যই ঘাতকদল যাচ্ছে মক্কায়। গোত্র সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আইয়ুবসহ চারজনকে প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলে দেয়া হয়েছে। সকালেই রওনা হবে তারা।

: আমার একটা কথা আছে বাবা। আমি ওদের সাথে যেতে চাই।
: এ্যাঁ কি বলছিস তুই?

মেয়ের কথা শুনে চমকে ওঠে শামাউন। তার কাছ থেকে এ ধরনের কথা আশা করেনি সে। তারপর বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে বলেÑ

: তা কি করে সম্ভব? তোর মত যুবতী মেয়েকে এক দল পুরুষের সাথে যেতে দেব, আমি কি পাগল?

: কেন বাবা! আমি যদি তোমার ছেলে হতাম, তাহলে কি তুমি যেতে দিতে না? নিশ্চয়ই দিতে। কারণ তুমি এমন মানুষ নও যে, অন্যের ছেলেদের এ দুঃসাহসিক কাজে পাঠিয়ে নিজের ছেলেকে নিরাপদে ঘরে রেখে দেবে। সুতরাং তোমার ছেলে যদি যেতে পারত তাহলে নামি কেন পারব না?

: তুই মেয়ে। ছেলেরা যা পারে মেয়েরা তা পারে না।
বাবাকে কীভাবে নরম করতে হবে তা আগেই ভেবে রেখেছিল হরদিয়া। বলেÑ

: ওই ঘাতক দল যদি মক্কায় প্রবেশ করে তাহলে যে কেউই ওদের চালচলন দেখে সন্দেহ করে বসতে পারে। তারপর মুহাম্মাদ সা. স¤ণ্ঠর্কে দু-একদিন খোঁজখবর করলেই মুসলমানরা তাদের উদ্দেশ্য স¤ণ্ঠর্কে টের পেয়ে যাবে। আর সেখানে যদি এখন আমের থেকে থাকে তাহলে তো কোনো কথাই নেই। এমনকি কুরাইশরাও তাদের সন্দেহ করতে পারে। কিন্তু আমি যদি সাথে থাকি তাহলে কেউ কোনো সন্দেহই করবে না। আমরা ভাব দেখাব যে আমাদের দলটি ইসলাম গ্রহণ করতে আগ্রহী, তাই এ ব্যাপারে জানতে চাই। একথার পর মুসলমানরা আমাদের আর তেমন সন্দেহ করবে না।

এরই মাঝে কাজ সেরে আমরা দ্রুত মক্কা ছেড়ে বেরিয়ে পড়বো। তাছাড়া আমি যেতে চাইছি এ কারণে যে, আমেরের সাথে আমারও একটা বোঝাপড়া আছে। শয়তানটা আমাকে অপমান করেছে।

: কি! এত বড় সাহস, আমার মেয়েকে অপমান ! গর্জে ওঠে শামাউনÑ কই, তুই তো বলিসনি কখনো আমাকে!

: হ্যাঁ বাবা, তোমাকে সে সব কথা বলা যায় না। আমার ভিতরে অপমানের আগুন জ¦লছে। আমি নিজে ওর হাতে ছুরির আঘাত হানতে চাই। তুমি শুধু অনুমতি দাও।

: কিন্তু এতগুলো পুরুষের সাথে তুই একা মেয়ে হয়ে কি করে যাবি? তাছাড়া আইয়ুব বীর হতে পারে, কিন্তু তার চরিত্র ভালো নয়। না, তার যাওয়া ঠিক হবে না।

: না, না বাবা! তুমি আমাকে নিরাশ করো না। ওদের সাথে আমাকে যাবার অনুমতি দাও। আমি আমার দাসী কুলসুমকে সাথে নিয়ে যাব। আরবের যুবকরা সর্বদাই মেয়েদের সম্মান করে চলে। আর আমি তো তোমার ভীরু মেয়ে নই। নিজের সম্মান আমি রক্ষা করতে জানি।
মেয়ের দৃঢ়তার কাছে অবশেষে হার মানে শামাউন। ঘাতকদলের সাথে যাবার অনুমতি দেয় হরদিয়াকে। এ সময় এক দাসী ঘরে ঢোকে। শামাউনকে বলে, জরুরি এক খবর নিয়ে গোত্রের এক লোক বাইরে অপেক্ষা করছে। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় শামাউন।

ছয়.
দুদিন হলো মক্কায় পৌঁছেছে হরদিয়াদের দল। আইয়ুবসহ চারজন পুরুষ আর হরদিয়া ও তার দাসী কুলসুমকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এ দল। দলের মধ্যে একমাত্র আইয়ুবই এর আগে দু-একবার মক্কায় এসেছে। তাই নগরীর পথ-ঘাট একটু আধটু চেনে। মক্কা এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর। প্রতি বছর হজের সময় সারা আরবের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন আসে এখানে। মানুষে মানুষে সয়লাব হয়ে যায় পুরো এলাকা। শহরে জায়গা হয় না, তাই বাইরে থেকে আসা লোকজন শহরের বাইরে প্রান্তরে তাঁবু খাটিয়ে থাকে।

অনেকে হজ মওসুম শুরুর আগেই আসে, আবার হজ শেষ হলেও অনেকে ইচ্ছা করেই কিছুদিন থেকে যায়। এখন হলো শান্তির সময়। মারামারি-হানাহানি, কাটাকাটি, প্রতিশোধ গ্রহণ থেকে এ সময় সবাই বিরত থাকে। নেহাত বড় ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটলে আরবের লোকেরা হজের সময় হিংসায় জড়ায় না।

হজের মওসুম হলো মক্কাবাসীদের সুখের সময়। সবাই নানা রকম ব্যবসা, মনোরঞ্জনকর কাজ-কর্মে লিপ্ত হয়। পুণ্য অর্জনের আশায় আগত হাজার হাজার মানুষ তাদের মেহমান। এ সময় যে আয় হয় তাই দিয়েই বছরের বাকি দিনগুলো অতিবাহিত করে বেশিরভাগ মানুষ। কিছুসংখ্যক ধনী মানুষ যায় সিরিয়ায় বাণিজ্য করতে।

বছরে দুবারও যায় অনেকে। কুরাইশ বংশের বনি হাশিম গোত্র দীর্ঘদিন কাবা শরীফের খিদমতগারের দায়িত্ব পালন করে মক্কায় তো বটেই, সারা আরবেও সম্মানিত। মুহাম্মাদ এ গোত্রেরই লোক। তার স¤ণ্ঠর্কে বিভিন্ন লোকের কাছে নানা কথাই শুনল তারা। দেখল, মুহাম্মাদ সা.-এর ব্যাপারে সবাই মুখ খুলতে চায় না।

বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে তেমন কেউই কথা বলল না। কয়েকজন আবার ভীষণ বিরক্তি প্রকাশ করল। বলল, এতকাল ধরে বংশানুক্রমে আমরা কাবা ঘরে যেসব দেবতার মূর্তি রাখা তাদের পূজা করে আসছি। এখন এই মুহাম্মাদ বলছে এ মূর্তি পূজা মহাপাপ। সে বলছে তোমরা বলো আল্লাহ এক, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। তাহলে লাত, মানাত, উজ্জাসহ এত দেব-দেবী, এরা কি সব ভুয়া! যত্তসব পাগলের কারবার। আগে সে ছিল একা। এখন আবার তার সাথে জুটেছে সঙ্গী-সাথী। এমনকি মক্কার বাইরের লোকজনও তার কাছে এসে জুটেছে। শুধু কি তাই! হজ করতে এসে মদিনার লোকজনও নাকি তার সাথে কথা বলে গেছে। সর্বনাশের আর কিছু বাকি রাখবে না সে মনে হচ্ছে।

Image result for bedouin art

আরেকজন বলল,
: আরে এ নতুন ধর্ম নিয়ে সে আর বেশিদূর এগোতে পারবে না। কুরাইশরা তার উপর ভীষণ খেপেছে। মেরে ফেলে কিনা দেখ।

রাতে নিজের তাঁবুতে পরামর্শে বসে আইয়ুব ও হরদিয়াসহ সবাই। তাদের পুরুষ চারজনের জন্য বড় এক তাঁবু। হরদিয়া ও তার দাসীর জন্য আরেক তাঁবু। ইতোমধ্যে তারা যতটা বুঝেছে, মুহাম্মাদ সা.-এর বিরুদ্ধেই লোক বেশি। অনেকে আছে কি করবে বুঝতে পারছে না। কিছু মানুষ আছে যারা মুহাম্মাদ সা.-কে পছন্দ করে, ভালোবাসে।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে, তার ঘোর বিরোধীরাও তার ধর্ম প্রচারের জন্য তার ওপর ক্ষিপ্ত, কিন্তু তার স্বণ্ঠর্কে একটি খারাপ কথাও বলেনি কেউ। বরং মুহাম্মাদ সা.-এর মতো বিশ্বাসী, নির্ভরযোগ্য, ভালো লোক যে গোটা আরবে আর দ্বিতীয়টি নেই, তাই সবাই বলেছে।

সে যা হোক, তারা খোঁজ নিয়ে দেখেছে, তিনি সারাদিন সাথীদের নিয়ে ধর্ম বিষয়ে কথা বলেন, দিনে কয়েকবার তারা এক সাথে নামাজও পড়েন। রাতের বেলা তিনি নিজের বাড়িতেই থাকেন। এখন তাদের সামনে দুটি পথ। হয় তাকে পথের মধ্যে কোথাও আক্রমণ করে নয়ত তার বাড়িতে গিয়ে হামলা করে হত্যা করতে হবে। দুটি কাজই রাতে করাই ভালো। তাহলে অন্যরা দেখে ফেলার বা বাধা পাওয়ার ভয় থাকে না। এখন রাতে তার সাথে কজন লোক থাকে সে তথ্য জোগাড় করতে হবে। সবাই মিলে কাল সে চেষ্টাই করবে বলে স্থির হয়।

ভোরবেলায়ই আইয়ুবরা চারজন বেরিয়ে যায়। আরও কিছুক্ষণ পর বের হবে হরদিয়া ও কুলসুম। কিন্তু তা আর হয় না। তারা বেরোনর আগেই ছুটতে ছুটতে ফিরে আসে আইয়ুব। হরদিয়ার তাঁবুতে গিয়ে তাকে ডাকতেই বাইরে বেরিয়ে আসে সে,

: সর্বনাশ হয়ে গেছে হরদিয়া।
চমকে ওঠে সেÑ

: কি হয়েছে?

: মুহাম্মাদ মক্কায় নেই, ভোর রাতে পালিয়েছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। এ নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে মহাহট্টগোল শুরু হয়েছে। সবাই ভীষণ উত্তেজিত। আমরা বাইরের লোক। তাই ওদের মাঝে থাকা ঠিক নয় বলে চলে এলাম। এ সময় বাকি তিনজনও ফিরে আসে। আইয়ুবকে উদ্দেশ্য করে বলে,

: খবর শুনেছ তো! তুমি তো গেলে একদিকে, আমরা গেলাম কাবা ঘরের দিকে। কুরাইশ নেতারা জড়ো হয়েছে সেখানে। পলাতক মুহাম্মাদ সা.-এর সাথে আছে তার বন্ধু আবু বকর। তাদের ধরার জন্য বড় রকম পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। কুরাইশ যুবকরা ইতোমধ্যে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে পড়েছে তাদের সন্ধানে। তারা বোধ হয় তাকে ধরে ফেলবে। এখন আমরা কি করব? আমরা তো আর তার নাগাল পাব না।

এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি হরদিয়া। আশা ভঙ্গ হয়েছে তার, তবে হতাশায় ভেঙ্গে পড়ার মতো মেয়ে সে নয়। বলে,

: আমাদের জন্য এটা খারাপ খবর। তবে হতাশ হলে চলবে না। আমরা এত কষ্ট করে এসেছি, দুদিন অপেক্ষা করেই যাই। দেখি মুহাম্মাদ সা. ধরা পড়ে কিনা। তোমরা ঘুরে দেখ তার ব্যাপারে নতুন কি খবর মেলে। আর সম্ভব হলে বেঈমান আমেরের খোঁজ নাও। কিছু মুসলমান নাকি বাইরের দেশে চলে গেছে। সেও আবার গেল কিনা দেখ। আমরাও বের হচ্ছি। দেখি, আমাদের কানে কিছু আসে কিনা।

কাবা ঘরের কাছে মানুষের ভিড় লেগেই থাক। সেখানেই এক সময় তার পরিচয় হয় আবু আক্কাস নামের এক কুরাইশ যুবকের সাথে। কথায় কথায় পর¯ণ্ঠরের বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে তারা। এক সময় মুহাম্মাদ সা.-এর কথা এসে যায়। আবু আক্কাস ক্রুব্ধ গলায় বলে,

: আমার দুভাই তাকে খুঁজতে বেরিয়েছে। আজ তিন দিন হয়ে গেল। ফেরেনি তারা। আমি মুহাম্মাদ সা.-কে পছন্দ করি না। তা বলে পুরস্কারের লোভে তাকে খুঁজতেও যাইনি। মানুষ হিসেবে সে বড় ভালো ছিল। কেন যে নতুন এক ধর্ম নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে গেল! তা যাক না বাবা, সে যদি মক্কা ছেড়ে চলে যায় তাহলে তো ভালোই। ইসলাম ধর্মের কথা আর কেউ বলবে না। আমরা এ যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাব, কি বল তুমি?

তার কথায় সায় দেয় আইয়ুব,

: হ্যাঁ তাই তো। কিন্তু মানুষটা গেল কোথায়?

: কোথায় আর যাবে? আশপাশের কোনো পাহাড়ের গুহায় লুকিয়েছে হয়ত। হেরা পর্বতের এক গুহায় বহু বছর ধরে সাধনা করেছে সে। এবারও হয়ত এ রকম কোনো গুহায় ঢুকেছে। যেভাবে খোঁজ চলছে তার, পালাতে পারবে না। ঠিক ধরা পড়ে যাবে। এবার আর প্রাণে রক্ষা পাবে না সে। কুরাইশরা সবাই মিলে তো তাকে ভোর রাতে হত্যা করতেই গিয়েছিল। কিন্তু গিয়ে দেখে সে নেই। আবু বকরকে সাথে নিয়ে বাড়ি ছেড়েছে। কিন্তু কতদূর আর যাবে ঢিমেতালে চলা উটের পিঠে চড়ে? অশ্বারোহীরা তাকে ঠিক ধরে আনবে।

এ সময় কাবা ঘরের কাছে বেশ জোর কথাবার্তা শোনা যায়। মক্কার গণ্যমান্য লোকেরা সেখানে বসে। ব্যাপার কি জানার জন্য দুজন এগোয় সেদিকে। সবাইকে খুব উত্তেজিত মনে হয়। অল্পক্ষণেই ঘটনা জানা হয়ে যায় তাদের। সুরাকা নামের এক যোদ্ধা খবর নিয়ে এসেছে। মক্কা ছেড়ে মদিনায় পৌঁছেছেন মুহাম্মাদ সা.। মদিনাবাসীরা তাকে স্বাগত জানিয়েছে। সে খবর শুনে ক্রুব্ধ কুরাইশ নেতারা একে অপরকে দোষারোপ করছে মুহাম্মাদ তাদের হাতের বাইরে চলে গেছেন বলে।

আইয়ুব মক্কার নেতাদের কাউকে চেনে না। আবু আক্কাস চিনিয়ে দেয়Ñ ওই যে আবু সুফিয়ান, ঐ যে আবু জেহেল...। আইয়ুবের মনে হয়, এ মুহূর্তে এদের এখন তর্জন-গর্জনই সার, পাখি ঠিকই উড়ে গেছে। এখন তাদের আর কিছুই করার নেই। মদিনায় গিয়ে যুদ্ধ করে মুহাম্মাদকে ধরে আনা কুরাইশদের পক্ষে সম্ভব নয়। এদিকে যে উদ্দেশ্য নিয়ে আইয়ুবরা এসেছিল তাও হাসিল হলো না। এ অবস্থায়, আর মক্কায় থাকা নিরর্থক। তাদের উদ্দেশ্যই যখন পূরণ যখন হলো না তখন ফিরে গিয়ে শামাউনকে সব জানানোই ভলো। সে সবকিছু বিবেচনা করে যে সিদ্ধান্ত দেয় তদনুযায়ী কাজ করবে তারা। মনে হচ্ছে, মদিনায়ই যেতে হবে তাদের।

আবু আক্কাসকে স্বল্প পরিচয়েই বেশ ভালো লেগেছে আইয়ুবের। খোলা মনের মানুষ। আবার কখনো মক্কায় এলে তার সাথে নিশ্চয়ই দেখা করবে বলে তাকে জানায়। এখন জরুরি কাজ আছে, তাই তাঁবুতে তার লোকজনের কাছে ফিরতে হবে বলে আবু আক্কাসের কাছ থেকে বিদায় নেয় সে।

তাঁবুতে ফিরে দেখল অন্য যুবকরা বা হরদিয়া ও কুলসুম কেউই ফেরেনি। তারা কোথায় ঘুরছে তা কে জানে! আর বাইরে না গিয়ে তাঁবুতেই অপেক্ষা করতে থাকে সে। সবাই ফিরে এলে আজই ওয়াদিউল কুরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাবে তারা। মুহাম্মাদ সা.-কে হত্যা করতে হলে এখন মদিনায়ই যেতে হবে। এখানে বসে সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই।

সাত.
মক্কা থেকে ব্যর্থ হয়ে ওয়াদিউল কুরাতে ফিরেছিল তারা। শামাউন তাদের কথা শুনে হতাশ হয়েছে। তারপর ব্যাপারটা যাচাই করার জন্য মদিনাতে লোক পাঠিয়েছিল। সে ফিরে এসে জানিয়েছেÑ হ্যাঁ, মুহাম্মাদ সা. এখন মদিনায়। সেখানে তার অবস্থা মক্কার চেয়ে অনেক ভালো। তাছাড়া মদিনায় মুসলমানদের সংখ্যাও বেশি।

মুহাম্মাদ সা. সেখানে বেশ জোরেশোরেই তার নতুন ধর্ম প্রচারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শামাউন বুঝতে পারে যে, মুহাম্মাদ সা.-কে হত্যার কাজ এখন আরও কঠিন হয়ে পড়ল। এমনকি ঘাতক দলের সদস্যদের জীবনও সত্যিই এবার বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। সে জন্য মদিনায় তাদের পাঠানো নিয়ে বেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল সে। কিন্তু হরদিয়ার চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যায়। তারপর নতুন করে গোছগাছ করে ঘাতক দল মদিনায় এসেছে। একটি ফাঁকা জায়া দেখে তাঁবু খাটিয়েছে তারা। এর মধ্যে কেটে গেছে প্রায় দুই মাস।

মদিনার পরিবেশটা অন্যরকম। মক্কার মতো রুক্ষ নয়, অনেক খেজুর বাগান। সবুজ শ্যামল পরিবেশ। মদিনায় কোনো তীর্থস্থান নেই, তাই মক্কার কাবাঘরভিত্তিক মানুষের ভিড় এখানে আগে ছিল না। গত কয়েকদিনে নানা স্থান ঘুরে ও লোকজনের সাথে কথা বলে মুহাম্মাদ সা. স¤ণ্ঠর্কে নানা খবরাখবর জানার চেষ্টা করছে আইয়ুব ও হরদিয়া। তবে তারা তা করছে খুব সাবধানে যাতে কারো মনে কোনো সন্দেহের সৃষ্টি না হয়। কারণ, কোনোক্রমে মুসলমানরা যদি ব্যাপারটা আঁচ করতে পারে তাহলে সব ভেস্তে তো যাবেই, তাদের ভাগ্যে কি হয় তারও ঠিক নেই।

তাদের একটা বড় সুবিধা যে, মদিনার কেউ তাদের চেনে না। আগে মদিনায় বাইরের লোক তেমন না এলেও এখন পরিস্থিতি স¤ণ্ঠূর্ণ আলাদা। মক্কায় বাইরে থেকে লোক আসত হজ মওসুমে। আর মদিনায় ওসব নেই, কিন্তু প্রতিদিনই লোক আসছে মুহাম্মাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে। কেউ ইসলাম গ্রহণ করছে, কেউ ইসলাম স¤ণ্ঠর্কে ধারণা নিতে আসছে। এ ধরনের মানুষের সংখ্য দিনদিন বেড়েই চলেছে। ফলে আগন্তুক হিসেবে তাদের ওপর আলাদাভাবে নজর পড়ার সম্ভাবনা নেই।

কয়েকদিনের মধ্যে বেশকিছু খবর জানা হয়ে যায় হরদিয়ার। পরিষ্কার বোঝা যায় যে, মদিনায় মুহাম্মাদের প্রভাব মক্কার চেয়েও বেশি। এখানকার বেশকিছু লোক ইতোমধ্যে মুসলমান হয়ে গেছে। এখন শুধু মদিনা ও আশপাশের সকল গোত্রই শুধু নয়, আরবের অন্যান্য বিভিন্ন গোত্রের কাছেও ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত পাঠানো হচ্ছে লোক মারফত। এ রকমই কোনো একটি দলের সাথে আমের গেছে বলে তারা জানতে পেরেছে। কবে ফিরবে তা কেউ বলতে পারে না।

সুবিধাই হয়েছে আমের না থাকায়, ভাবে হরদিয়া। কেউ তাদের চিনতে পারবে না। পর মুহূর্তেই ক্ষেপে ওঠে সে। আমেরকে হত্যা করতে পারলে তার মনের জ¦ালা মিটত, অপমানের প্রতিশোধ নেয়া হতো। কিন্তু আমের এখন নাগালের বাইরে। তার সব রাগ গিয়ে পড়ে মুহাম্মাদ সা.-এর ওপর। আমেরকে না পেলেও মুহাম্মাদ সা.-কে ছাড়ব না আমিÑ রাগে বিড় বিড় করে বলতে থাকে হরদিয়া। এই লোকটাই সব ঝামেলার মূলে।

প্রাচীন ইহুদি ধর্ম আজ তার জন্যই বিপন্ন। তার জন্যই সে তার ভালোবাসার জন আমেরকে হারিয়েছে। তার জন্যই আজ আরবজুড়ে অশান্তির আগুন জ¦লছে। জীবন দিয়ে তাকে এর মূল্য দিতে হবে। তার চলাফেরার বিশদ খোঁজখবর নেয়ার জন্য আইয়ুবসহ সবাইকে তাড়া লাগায় সে।
পরের কয়েকদিনে প্রয়োজনীয় সব তথ্যই হরদিয়ার গোচরে আসে। রাতে হরদিয়ার তাঁবুতে বৈঠকে বসে সবাই। কীভাবে কাজ করা যায়Ñ তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আইয়ুব বলে, মুহাম্মাদ সা. প্রায় সারাদিনই নতুন তৈরি করা মসজিদে থাকেন।

সঙ্গীদের সাথে কথা-বার্তা, সালিস-দরবার, বাইরে লোকজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ সবই সেখানে হয়। মসজিদের লাগোয়া তার ঘর। কোনো কোনো দিন তিনি মসজিদ থেকেই ঘরে চলে যান। তবে মাঝেমধ্যে কোনো ভক্ত-অনুরাগীর অনুরোধে তার বাড়িতে যান এক-দুজন সঙ্গী নিয়ে। সেখানে ধর্ম নিয়ে কথাবার্তা বলেন। তারপর আহার পর্ব সেরে ফিরে আসেন। সে সময় তিনি না চাইলেও তাকে এগিয়ে দিতে দু-একজন সাথে আসে। মানে দল ভারি হয় তার। আইয়ুব বলে, তাই যাবার সময়ই তার ওপর হামলা করা ভালো। হামলা করে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্রুতগামী উটে চড়ে মদিনা ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। তাহলে রাতের আঁধারে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পারবে।

আইয়ুবের কথা ভেবে দেখে হরদিয়া। আর দেরি করে লাভ নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ কঠিন কাজটা সেরে ফেলতে হবে। পারলে কালই, তা না হলে পরশু। হঠাৎ তার আমেরের কথা মনে হয়। তবে কি আমেরের ওপর প্রতিশোধ নেয়া হবে না? বলে,

: তাহলে শয়তান আমেরের কি হবে? তার কিছু করা হবে না?
আইয়ুব হরদিয়ার এ কথাকে গুরুত্ব দেয় না,

: আমের যার কথায় মুসলমান হয়েছে সেই-ই যদি না থাকে তাহলে আমের মুসলমানদের বিরোধীদের হাতে এমনিতেই মারা পড়বে। এমনো হতে পারে যে, তখন সে সব ছেড়েছুড়ে আবার ওয়াদিউল কুরাতেই ফিরে যাবে। তখন তোমার যা করার করো।

আইয়ুবের কথা তেমন পছন্দ না হলেও আপাতত মেনে নেয় হরদিয়া। ঠিক হয়, কাল থেকেই চেষ্টা চালাবে তারা। তবে তিনি কবে কোন অনুরাগীর বাড়ি যাবেন তা বলা যায় না, তাই তিন-চারদিন একটানা নজরদারি করতে হতে পারে। আশা করা যায়, এ সময়ের মধ্যে কারো না কারো বাড়ি তিনি যাবেন। যেহেতু মুহাম্মাদ সা.-এর সাথে এক-দুজনের বেশি লোক থাকে না এবং সবাই থাকে নিরস্ত্র, সুতরাং তাদের বেশি কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজন হবে না।

সন্ধ্যার পর থেকেই তাদের একজন মসজিদের উপর কড়া নজর রাখবে। আর তারা চারজন প্রস্তুত অবস্থায় কাছাকাছি থেকে তার দিকে খেয়াল রাখবে। তিনি যদি সন্ধ্যার পর সঙ্গীদের নিয়ে মসজিদ থেকে বের হন তাহলে নজরদার সাথে সাথে এসে তাদের সে খবর জানাবে। এদিক থেকে আইয়ুব, তার সঙ্গীরা ও হরদিয়া সবাই মুহাম্মাদ সা. ও তার সঙ্গীরা যেদিকেই যান না কেন, তাদের অনুসরণ করবে। তারপর সুযোগ বুঝে পুরুষ চারজন একসাথে তার ও তার সঙ্গীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। প্রয়োজনে হরদিয়াও সাহায্য করবে তাদের

। সবাইকে যদি হত্যা করতে হয় তাই করবে। কাজ শেষে তাঁবুতে ফিরবে তারা। এদিকে কুলসুম থাকবে তাঁবুতেই। সবকিছু গুছিয়ে রাখবে সে। এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে গোটা দল রওনা হবে ওয়াদিউল কুরার দিকে।

আট.
সন্ধ্যা রাত পেরিয়ে গেছে বেশ আগেই। চতুর্থ রাতের মতো হরদিয়া, আইয়ুব ও সঙ্গীরা অপেক্ষা করছিল। আগের তিন রাতে তাদের অপেক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। আজও হয় কিনা কে জানে। মসজিদের উল্টো দিকে একটু দূরে একটি ছোট খেজুর বাগান।

কাছাকাছি দুটি খেজুর গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। অন্য দুজন আরও একটু দূরে। সে কি খবর নিয়ে ছুটে আসে তার অপেক্ষায় আছে তারা। এমন সময় আঁধারের মধ্যে এক ছায়ামূর্তিকে ছুটে আসতে দেখা যায়। নজরদার নাকি! গাছের আড়াল ছেড়ে সেদিকে এগিয়ে যায় আইয়ুব ও হরদিয়া। হ্যাঁ, সেই। কাছে আসতেই তাকে থামায় আইয়ুব। নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করে.

: কি খবর?

: মুহাম্মাদ সা. মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার সাথে মোটে একজন রয়েছে। কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে তারা।

: ঠিক আছে, তুমি তাদের পিছু নাও, আমরা আসছি। তাদের রেখে ছোটে নজরদার।
বাকি দুজনও ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। আইয়ুব তলোয়ার বের করে, হরদিয়ার হাতে খঞ্জর। সবার আগে আইয়ুব, তার সাথে হরদিয়া। পেছনে তলোয়ার হাতে বাকি দুজন। চারজন এক সাথে দ্রুত পায়ে এগোয়। কিছুটা এগোতেই আঁধারের গায়ে মৃদু গতিতে চলমান দুটি আবছা মূর্তি তাদের চোখে পড়ে। মুহাম্মাদ সা. ও তার সঙ্গী। খানিকটা পেছনে আরেকজন। তাদের লোক। আরও জোরে ছোটে তারা। তবে পায়ের শব্দ যাতে বেশি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে।

অচেনা পথ ও রাতের বেলা বলে অসুবিধা হচ্ছে ছুটতে। অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের কাছাকাছি এসে পড়ে ঘাতক দল। আর সামান্য ব্যবধান। ওদিকে মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সাথী আগের মতই স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলেছেন। পেছনের দিকে কোনো খেয়ালই নেই তাদের।

উত্তেজনায় ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে হরদিয়ার। এবার কোথায় যাবে মুহাম্মাদ সা.? তার জন্য আজ গৌরবময় ইহুদি ধর্ম বিপন্ন। বেঈমান ধর্মত্যাগী আমেরকে সে জায়গা দিয়েছে। এসব করার দিন তার আজই শেষ। খঞ্জর মুঠির মধ্যে শক্ত করে ধরে আইয়ুবকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় সে। হরদিয়া মুহাম্মাদ সা.-কে কখনো দেখেনি। কিন্তু সে শুনেছে, পথ চলার সময় অন্যদের থেকে যিনি একটু এগিয়ে থাকবেন তিনিই মুহাম্মাদ সা.। হরদিয়া দুজনের দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকায়।

Image result for bedouin art

ঐ তো! তার সামনে বাম দিকের ব্যক্তিটি একটু এগিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। আর দেরি নয়। ঝাঁপিয়ে পড়তে যায় সে উদ্যত খঞ্জর হাতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার! ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি পাথরের টুকরোর সাথে ভীষণভাবে হোঁচট খায় সে। তীব্র আর্তনাদ করে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় হরদিয়া। খঞ্জরটি তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে।

এদিকে যা ঘটল তা আরও অবিশ্বাস্য। হরদিয়ার হোঁচট খাওয়া ও আর্তনাদ করে পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে চার যুবকের মধ্যে। তাদের হাতে তলোয়ার, মনের ভেতরে মুহাম্মাদ সা.-এর বিরুদ্ধে লালন করা তীব্র ক্রোধ ও ঘৃণা।

হরদিয়ার সাথে সাথে তাদেরও সবার এতক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা মুহাম্মাদ সা. ও তার সঙ্গীর ওপর। কিন্তু তা আর হয় না। মুহূর্তে কি এক ভয়ঙ্কর আতঙ্ক গ্রাস করে ওয়াদিউল কারার ইহুদি বীর যোদ্ধা আইয়ুবকে। তার সাথে তার সঙ্গীদেরও। হরদিয়ার আর্তনাদ তার হৃদয়ের মর্মমূল কাঁপিয়ে দেয়। অজানা এক ভীতি তাকে গ্রাস করে। ঘুরে দাঁড়িয়েই সে দৌড় দেয়। ছুটতে থাকে প্রাণপণে। তাকে অনুসরণ করে তিন সঙ্গী। হরদিয়া একা মাটিতে পড়ে ব্যথায় কাতরাতে থাকে। তার কথা যেন একদম ভুলে যায় আইয়ুব ও তার সঙ্গীরা।

এদিকে নারী কণ্ঠের আর্তনাদ কানে যেতে মুহূর্তেই থেমে যান চলমান দুজন। অন্ধকারের আবরণ চারপাশে। কিছু পরিষ্কার দেখা যায় না। তবে কয়েক হাত দূরে কেউ মাটিতে পড়ে আছে মনে হচ্ছে। ব্যাপারটি কি বোঝার জন্য একজন পা বাড়াতেই অন্যজন বলে ওঠেন,

: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন, আমি দেখছি কি হয়েছে।

: চল, আমিও তোমার সাথে যাই।

উভয়ে পা বাড়ান আর্তনাদকারিণীর দিকে। দুজন তার কাছে এসে দাঁড়ান। অন্ধকারের মধ্যে তাদের চোখে পড়ে যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকা এক নারী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। সে বেশ আহত হয়েছে মনে হয়। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। এখন অপরিচিত এ নারীকে ধরে তুলতে হবে মনে হয়। তার কি অবস্থা তা বোঝার জন্য আলো দরকার। কিন্তু তারা পুরুষ মানুষ। এ মুহূর্তে একজন নারী হলে খুব ভালো হতো। এদিক ওদিক তাকান। না, কেউ নেই। অথচ কাউকে পেলে খুব ভালো হতো। সে সময় একটু দূরের এক দুটি বাড়ির দরজা খুলে যায়। সেগুলো থেকে মশাল হাতে লোক বেরিয়ে আসে। আবু বকর তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,

: আপনারা এদিকে আসুন।

তার কণ্ঠ শুনে লোকগুলো তাদের কাছে এসে হাজির হয়। মুহাম্মাদ সা. ও আবু বকরকে চিনতে পারেন তারা। এদিকে মাটিতে পড়ে আছে এক অল্পবয়সি নারী। তারা সসম্ভ্রমে জিজ্ঞেস করেÑ

: হে আল্লাহর রাসূল! কী হয়েছে? আমরা নারী কণ্ঠের আর্তনাদ শুনে বেরিয়ে এসেছি।
মুহাম্মাদ সা.-এর কণ্ঠ শোনা যায়,

: এ নারীটি বোধ হয় রাতের আঁধারে চলতে গিয়ে পড়ে পায়ে আঘাত পেয়েছে। উঠতে পারছে না। তোমাদের কেউ বাড়ি গিয়ে এক বা দুজন মহিলাকে নিয়ে এসো। সে তাকে তুলবে।
তার একথার পর মশালধারীদের একজন রওনা হয় বাড়ির দিকে। এদিকে সেই শব্দগুচ্ছ কানে যেতে হরদিয়ার সারা শরীরে যেন শীতল পরশ লাগে। এমন শান্ত, মধুর কণ্ঠ জীবনে আর কখনো শোনেনি সে।

হরদিয়া যে কাজে এসেছিল তাতে বিপদ হতে পারেÑ এ রকম আশঙ্কা তার ছিল, কিন্তু বিপদ যে এভাবে ঘটতে পারে তা ছিল তার ধারণার বাইরে। পাথরের সাথে হোঁচট খেয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ার পরমুহূর্তেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল সে পারেনি। তার ডান পায়ের গোড়ালি মনে হয় ভেঙেই গেছে, নিদেনপক্ষে মচকে গেছে তো অবশ্যই। তাছাড়া কপাল, হাত কেটে গেছে, কোমরেও আঘাত লেগেছে ভালোই। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে পায়ের যন্ত্রণা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছিল তার। উঠে বসবে এমন শক্তিও পাচ্ছিল না।

শক্ত মাটির ওপর আছড়ে পড়ার অভিজ্ঞতা যে এত যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে, তা জানা ছিল না তার। একদিকে যন্ত্রণা অন্যদিকে ভয়ঙ্কর ভীতিতে সে শিউড়ে ওঠে। ধরা পড়ে যাবে না তো সে?। তার পরিণতি কি, তা অজানা নয় তার। এসব ঘটনায় একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। তবে সে মৃত্যুর আগে এ মুহূর্তে পায়ের যন্ত্রণাই তার কাছে বড় হয়ে ওঠে। প্রাণপণ চেষ্টায় সে কোনো রকমে উঠে বসে। এ সময় ডান পায়ের গোড়ালি থেকে সুতীক্ষè যন্ত্রণার একটি অসহ্য ধারা উঠে আসতে থাকে তার হাঁটুর দিকে। তার মুখ থেকে আবার চিৎকার বেরিয়ে আসে। চোখ বন্ধ করে ফেলে সে ব্যথার তীব্রতায়।

একটু পরে শরীরে কারো হাতের স্পর্শে চোখ খুলে তাকায় হরদিয়া। দু-তিনটি মশালের আলোতে খানিকটা জায়গা আলোকিত হয়ে উঠেছে। একজন মাঝবয়সি নারী তার একটি হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে। সে তার হাত আঁকড়ে ধরে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু না পেরে বসে পড়ে। এ সময় সেই মানুষটির উপর চোখ পড়ে হরদিয়ার।

মশালের আলোতে তার প্রশান্ত চেহারা আরও দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে। আয়ত চোখের দৃষ্টি থেকে ঝরে পড়ছে গভীর মমতা ও সহানুভূতি। মানুষটিকে চিনতে দেরি হয় না হরদিয়ার। তার চেহারার অনেক বর্ণনা শুনেছে সে। ইনিই মুহাম্মাদ সা.। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে সে।

এ সময় আরেকজন তরুণী এসে পৌঁছে সেখানে। তারা উভয়ে মিলে টেনে তোলে তাকে। কিন্তু হরদিয়া ডান পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারল না। তাই নারী দুজনের কাঁধে ভর দেয়। তারপর বহু কষ্টে এগিয়ে যায় তাদের বাড়ির দিকে। এদিকে সঙ্গী আবু বকরকে নিয়ে নিজের গন্তব্যে রওনা হন মুহাম্মাদ সা.।

নয়
চারদিন কেটে গেছে। হরদিয়ার পায়ের অবস্থা এখন কিছুটা ভালো। গোড়ালির ব্যথা অনেকটা কমেছে, কিন্তু নিজের পায়ে ভর দিয়ে হাঁটার মতো অবস্থা হয়নি এখনো। একটু আগেই চেষ্টা করে দেখেছে। মাটিতে পা রেখে ভর দিলেই তীক্ষè ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। কি আর করা! নিরুপায় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।

হরদিয়ার বিছানার পাশে একটি জানালা। পর্দা ঝুলছে তাতে। একটু পরে জানালার কাছে গিয়ে পর্দাটি সরিয়ে দেয় সে। বাইরে তখন বিকাল নেমেছে। বাড়ির সামনের রাস্তায় খেলা করছে ছোট ছেলেমেয়েরা। আশপাশে অনেক খেজুরগাছ চোখে পড়ে তার। পাতায় মৃদু পরশ বুলিয়ে চলেছে বাতাস। ভয়ে দুরু দুরু করে কাঁপা তার মনে হঠাৎ করে একটা ভালো লাগার অনুভূতি জেগে ওঠে। তাদের পল্লির চেয়েও মদিনার গাছপালাগুলোকে আরও সবুজ মনে হয়। অবশ্য মদিনার মাটি খুবই উর্বর।

এখানে পানিরও প্রাচুর্য আছে। তাই মদিনার বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবী। আরবের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের মতো মদিনার মানুষজনের মেজাজ-মর্জি, আচার-ব্যবহার অত রুক্ষ নয়। এ বাড়ির লোকজনের আচরণেও হরদিয়া তার প্রমাণ পেয়েছে। যে রাতে এ বাড়িতে তাকে আনা হয়েছে তারপর থেকে মধ্য বয়সি গৃহকর্ত্রী বাররা ও তার তরুণী কন্যা শীমার আন্তরিকতা ও ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে গেছে হরদিয়া। একজন অপরিচিত, অনাত্মীয় জনকেও যে উদার হৃদয়ের মানুষ আপন করে নিতে পারে, এখানে এ অবস্থায় না পড়লে হরদিয়ার তা হয়ত কোনোদিনই জানা হতো না।

নিজের কথা মনে করে বিষাদ ও গ্লানিতে মন ছেয়ে যায় হরদিয়ার। তার ধর্মের শত্রু, গোত্রের শত্রু মুহাম্মাদ সা.। আর আমের তার কুমারী হৃদয়ের পরম ভালোবাসা, তার প্রথম প্রেমকে উপেক্ষা করে মুসলমান হয়ে তাকে চরম অপমান করেছে। তারা দুজনই তার ও তার গোত্রের মহাশত্রু। তাই প্রতিশোধ নেয়ার কঠিন সংকল্প গ্রহণ করে সে। বড় বড় বীর পুরুষদের পক্ষেও যে কাজ অসম্ভব, সে কাজটি করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মক্কায় গিয়েছিল সে। সেখানেও কাজ না হওয়ায় আবার মদিনায় আসে। সব ঠিকই ছিল। কিন্তু কি থেকে যে কি হয়ে গেল! শেষ মুহূর্তে এসে সে ব্যর্থ হলো।

মুহাম্মাদকে হত্যা করতে পারল না। মদিনার রাস্তায় পাথর কোথা থেকে এল, কি করে সে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল, হাত থেকে খঞ্জর ছিটকে গেল, কিছুই বলতে পারবে না সে। এ সময় আইয়ুবের কথা মনে হতে ঘৃণায় মুখ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে তার। ছি! ছি! ছি! সে না হয় দুর্ভাগ্যক্রমে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। কিন্তু ওয়াদিউল কুরা পল্লির সেরা বীর আইয়ুব কি করল? সে ও তার তিন সঙ্গী তো সেই মুহূর্তেই নিরস্ত্র মুহাম্মাদ ও তার সঙ্গীকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করতে পারত। কিন্তু তা সে করেনি। হরদিয়ার মনে পড়ে, সে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর আইয়ুব তাকে ওঠাতে এগিয়ে আসেনি। এমনকি সে সেখানে ছিলই না। তার মানে এই যে, তার দুর্ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সে ও তার সঙ্গীরা পালিয়েছে। তার জন্য দেরি করেনি, তার কথা ভাবেওনি।

এই কদিনে নিশ্চয় বাড়ি পৌঁছেছে তারা। তার সম্পর্কে বাবাকে কি বলেছে তা হরদিয়া জানে না, তবে সত্যি কথা বলেছে কিনা সন্দেহ। কারণ, মেয়ে মুসলমানদের হাতে ধরা পড়েছে তা জেনে তার বাবা তার কোনো খোঁজ নেবে না, তা হতে পারে না। এমনও হতে পারে, আইয়ুব ও তার সঙ্গীরা পল্লিতে এখনো ফেরেনি। হয়ত হরদিয়াকে উদ্ধারের কোন পথ সন্ধান করছে। কিন্তু তাই যদি হত তাহলে সে নিজে না এলেও অন্য লোকের মাধ্যমে হলেও তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করত। কিন্তু তেমন কিছু এ কদিনে ঘটেনি। তবে হরদিয়া অনুমান করছে যে, তারা যে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে মুহাম্মাদ সা.-এর ওপর হামলা করতে যাচ্ছিল তা কেউই জানে না।

যারা এ ব্যাপারে বলতে পারতেন অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা. ও তার সঙ্গী আবু বকর, তারা এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই কিছু বলেননি। হয় তারা তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারেননি অথবা যেহেতু তাদের জন্য ক্ষতিকর কিছু হয়নি এবং সে একজন অল্প বয়সি তরুণী, সে কারণে হয়ত বিষয়টির প্রতি কোনো গুরুত্ব দেননি।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে হরদিয়ার মাথার মধ্যে হঠাৎ একটি বিষয় ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মুহাম্মাদ সা. নিজেকে আল্লাহর নবী বলে দাবি করেন। তিনি কি সত্যিই তাই? তার সম্পর্কে সে এ পর্যন্ত বহু খারাপ কথা শুনেছে। তিনি মূর্তিপূজার বিরোধী; তিনি বলেন, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই; তিনি যে ধর্ম প্রচার করছেন সেটাই হচ্ছে সত্য ধর্ম ; তিনি মদ-জুয়া-অন্যায় রক্তপাতের ঘোরবিরোধী ইত্যাদি।

সেদিনের ঘটনা থেকে হরদিয়ার মনে হচ্ছে তিনি যে আল্লাহর কথা বলেন সে আল্লাহই মুহাম্মাদ সা.-কে তাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। নইলে একটি নিশ্চিতপ্রায় মৃত্যুর হাত থেকে তিনি এভাবে রেহাই পেতেন না। এ সময় মুহাম্মাদ সা.-এর কথা মনে হয় তার। কি মধুর, কি বমুগ্ধ তার কণ্ঠ! তার মাত্র কটি কথা সে শুনতে পেয়েছিল। তা তার মনে দাগ কেটে গেছে। কি সুন্দর মনের মানুষ! একবারও তিনি জিজ্ঞেস করলেন না সে কে, কি তার পরিচয়, রাতের আঁধারে সে একা কোথায় যাচ্ছিল। তিনি নাকি বলেন যে, আল্লাহ তাকে ইসলাম প্রচারের জন্য পাঠিয়েছেন।

শোনা যায়, আল্লাহ তার কাছে প্রায়ই দূত প্রেরণ করে তার আদেশ-নির্দেশ পাঠিয়ে থাকেন। তাহলে? তাহলে তার সব কিছুই কি তিনি জানেন? আর সব জেনে-শুনে কি তিনি তার শাস্তিবিধান না করে তার সেবা-শুশ্রƒষার ব্যবস্থা করলেন? তিনি কোন পর্যায়ের মানুষ! মানুষ না কি আর কিছু? আর ভাবতে পারে না হরদিয়া।

হঠাৎ বাইরে ছেলে-মেয়েদের কোলাহল শুনতে পায় হরদিয়াÑ আল্লাহর নবী আসছেন, আল্লাহর রাসূল আসছেন। ভীষণভাবে চমকে ওঠে সে। আল্লাহর রাসূল মানে মুহাম্মাদ সা.। তিনি কি এ বাড়িতেই আসছেন নাকি রাস্তা দিয়ে অন্য কারো বাড়ি যাচ্ছেন? কে জানে। হরদিয়ার বুক দুরু দুরু কাঁপতে থাকে। যদি তাকে দেখার জন্য এ বাড়িতেই এসে থাকেন তাহলে তার ব্যাপারে কিছু বলবেন নাকি? ভয়ে-উদ্বেগে অস্থির হয়ে ওঠে সে।

এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে শীমা। বলেদ

: বোন! আল্লাহর রাসূল আপনাকে দেখতে এসেছেন।

গত কদিনে এ বাড়িতে তাঁর কথা, তাঁর প্রচার করা ধর্মের কথা হরদিয়া অনেক শুনেছে। যত শুনেছে, তার বিস্ময়ের মাত্রা তত বেড়েছে। সকলের কথা থেকে যা উঠে এসেছে তা হচ্ছে তিনি মানুষ, কিন্তু কোনো সাধারণ মানুষ নন। তিনি নন আর কারোরই মতো। হরদিয়া যে বাড়িতে আছে, তারা কিছুদিন আগে মুসলমান হয়েছে। পুরুষদের সাথে হরদিয়ার কোনো কথা হয়নি, কিন্তু গৃহকর্ত্রী বাররা ও তার মেয়ে শীমা, সে সাথে আশপাশের বাড়ি থেকে আসা মুসলমান নারীদের কথা শুনে, তাদের নামাজ পড়ার প্রতি নিষ্ঠা দেখে তাজ্জব বনে গেছে হরদিয়া।

এক আল্লাহকে ভুলে থাকা মানুষগুলোর হৃদয়ে তিনি সযতেœ রোপণ করতে পেরেছেন এক আল্লাহর বীজমন্ত্র। বিশ্বাসের চেতনা নিয়ে তা দৃঢ়ভাবে শিকড় ছড়িয়েছে হৃদয়ের মাটিতে। আজ তিনি হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষের পথনির্দেশকারী। তাঁর স্থান এত উঁচুতে যার পরিমাপ করা তার মতো সামান্য নারীর পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি কেন আসবেন তাকে দেখার জন্য ? সে তো তার পরিচিতও নয়।

হরদিয়া কম্পিত হাতে নিজের পোশাক ঠিকঠাক করে। দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে ডাকে শীমা,

: ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ভিতরে আসুন।

রাসূল সা. ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন। তার সাথে আবু বকর রা.। হরদিয়া অবাক বিস্ময়ে তার প্রবেশ লক্ষ্য করে। এক চমৎকার সুগন্ধে ইতোমধ্যেই ঘর ভরে উঠেছে। কি আলোকিত তাঁর চেহারা! পৃথিবীর সমস্ত প্রশান্তি যেন ঘিরে রয়েছে তাঁকে। ¯িœগ্ধ দৃষ্টিতে হরদিয়াকে ¯œাত করে তিনি মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

: এখন কেমন আছ মা তুমি!

সে শব্দগুচ্ছের অপূর্ব মাধুর্যে হরদিয়ার ভেতরের সমস্ত জগতজুড়ে প্রচ- তোলপাড় শুরু হয়। হায়, কি শুনছে সে! এর চেয়ে সুধাময় সম্বোধন, এমন ¯েœহমাখা স¦র নিজের জন্মদাতা পিতা-মাতার কাছ থেকেও কি কখনো শুনেছে? আর এ মানুষটিকেই কিনা হত্যা করতে গিয়েছিল সে?
অদম্য কান্নায় হরদিয়া তাঁর পদতলে লুটিয়ে পড়ে।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ