শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


সিয়াম ও বিজ্ঞান ২

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আলী আবদুল মুনতাকিম
অতিথি লেখক

গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম রোজায় শরীরের উপকারিতা ও রোগমুক্তি সম্পর্কে।আমার প্রানপ্রিয় পাঠকমন্ডলী আমাকে তথ্যসমৃদ্ধ এ রকম লেখা আরও দিতে বলেন।

আমার সংগ্রহে থাকা আরও কিছু লেখা এ পর্বে দিলাম। ইনকিলাবসহ কিছু ব্লগ এর প্রতি ধন্যবাদ যে সিয়ামের উপকারিতা বিষয়ক তথ্যবহুল লেখাগুলো তারা ছাপেন। এ দিক থেকে বর্তমানে আওয়ার ইসলাম সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রদত্ত তার প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা. প্রদর্শিত বিশ্বে সার্বজনীন ও সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম মানুষের জন্য কল্যাণকর ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ফলে এতে স্বাস্থ্যনীতিও রয়েছে। স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখার জন্য রোজা অপরিহার্যতা আলোচিত হয়েছে।

সিয়াম ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি। একজন সক্ষম ঈমানদারের উপর আল্লাহ রমজানের রোজা ফরজ করেছেন। আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় বান্দাহদের নিছক কষ্ট দেয়ার জন্যে রোজা ফরজ করেননি।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহর বাণী, ‘ওয়া আনতা সুউমু খাইরুল লাকুম ইনকুনতুম তা’লামুন’। অর্থ:- ‘তোমরা যদি রোজা রাখো তবে তাতে রয়েছে তোমাদের জন্য কল্যাণ, তোমরা যদি সেটা উপলব্ধি করতে পারো।’ সুরা বাকারাহ-১৮৪

এখানে আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রোজা পালনের বহুবিধ কল্যাণের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন।

গবেষক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ গবেষণা করে উপরোক্ত আয়াতের যথার্থতা প্রমাণ করেছেন। সিয়ামের গোটা কর্মসূচি স্বাস্থ্য রক্ষার দিকে লক্ষ্য রেখেই করা হয়েছে।

যেমন ২/১ টি বিষয়:- ১) শিশু ও বৃদ্ধের জন্যে রোজা ফরজ নয়।

২) সফরে ও অসুস্থ অবস্থায় রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে।
৩) ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় বেশি কষ্ট না পাওয়ার জন্যে সাহরির ব্যবস্থা।

৪) রোজাদার ভুলে খেতে থাকলে বাধা না দেয়া বা মনে করিয়ে না দেয়া।
৫) রক্ত দিলেও রোজা না ভাংগা। ইত্যাদি।

সিয়াম পালনের ফলে মানুষের দেহের কোনো ক্ষতি হয় না বরং অনেক উপকার হয়, গবেষণা বই Scince for Fasting গ্রন্থের বিবরণ মোতাবেক-

১) পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ বলেছেন, The power and endurance of the boby under fasting Conditions are remarkable; After a fast properly taken the boby is literally bom afresh. অর্থাৎ ‘রোজা রাখা অবস্থায় শরীরের ক্ষমতা ও সহ্যশক্তি উল্লেখযোগ্য: সঠিকভাবে রোজা পালনের পর শরীর প্রকৃতপক্ষে নতুন সজীবতা লাভ করে।’

২) রোজা রাখার ফলে দেহে রোগ জীবাণুবর্ধক জীর্ণ অস্ত্রগুলো ধ্বংস হয় এবং ইউরিক এসিড তার ধ্বংসাত্মক কর্মে বাধাপ্রাপ্ত হয়। দেহে ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন প্রকার নার্ভ সংক্রান্ত রোগ বেড়ে যায়।

৩) রোজাদারের শরীরের পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে চর্মরোগ বৃদ্ধি পায় না।

৪) গবেষক ড. লুটজানারের মতে, ‘খাবারের উপাদান থেকে সারাবছর ধরে মানুষের শরীরে জমে থাকা নানা রকম বিষাক্ত পদার্থ (টক্সিন), চর্বি ও আবর্জনা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র সহজ ও স্বাভাবিক উপায় হচ্ছে সিয়াম।

আমরা জানি, ইবনে সিনা প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন, কিন্তু আমরা জানি না, তিনি তার রোগীদের মাঝে মাঝে টানা ৩ সপ্তাহ উপবাস থাকার পরামর্শ দিতেন। এ বিজ্ঞানীর গবেষণা যেন সিয়াম সাধনার সাথে একাকার হয়ে গেছে। মাওলানা মিরাজের সম্পাদনা থেকে

দেখা যাক, অন্যান্য গবেষকগণ কি বলেন- ১) ১৯৬০ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় ১৭ জন রোজদারের পেটের রস পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যাদের পাকস্থলীতে এসিড খুব বেশি বা খুম কম রোজার ফলে তাদের এ উভয় দোষই নিরাময় হয়েছে।

এ গবেষণায় আরো প্রমাণিত হয়, যারা মনে করে রোজা দ্বারা রক্তের পটাসিয়াম কমে যায় এবং তাতে শরীরের ক্ষতি সাধন হয়, তাদের এ ধারণাও অমূলক। কারণ পটাসিয়াম কমার প্রতিক্রিয়া প্রথমে দেখা যায় হৃদপিণ্ডের উপর অথচ ১১ জন রোজদারের হৃদপিণ্ড অত্যাধুনিক ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম যন্ত্রের সাহায্যে (রোজার পূর্বে ও রোজা রাখার ২৫ দিন পর) পরীক্ষা করে দেখা গেছে রোজা দ্বারা তাদের হৃদপিণ্ডের ক্রিয়ার কোনোই ব্যতিক্রম ঘটে নাই।

সুতরাং বুঝা গেল, রোজার দ্বারা রক্তের যে পটাসিয়াম কমে তা অতিসামান্য এবং স্বাভাবিক সীমারেখার মধ্যে। তবে রোজা দ্বারা কোনো কোনো মানুৃষ কিছুটা খিটখিটে মেজাজি হয়। এর কারণ সামান্য রক্ত শর্করা কমে যায় যা স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ক্ষতিকর নয়। অন্যকোন সময় ক্ষিদে পেলেও এরূপ হয়ে থাকে।

২. ডা. জুয়েলস এম. ডি বলেছেন, ‘যখনই একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে, তখনই দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে।’

৩. ডক্টর ডিউই বলেছেন, ‘রোগজীর্ণ এবং রোগকিষ্ট মানুষটির পাকস্থলী হতে খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে ফেলো, দেখবে রুগ্ন মানুষটি উপবাস থাকছে না, সত্যিকাররূপে উপবাস থাকছে রোগটি।’

৪. জার্মানির এক স্বাস্থ্য ক্লিনিকের গেইটে লেখা আছে, ‘রোজা রাখো স্বাস্থ্যবান হবে।’ এর নিচে লেখা আছে ‘মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ।’

খৃস্টান জার্মানিসহ অন্যান্য খৃস্টান চিকিৎসকেরা রোজার উপকারিতার বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা করেছেন। বিশ্বের অনেক দেশে রোজার মাধ্যমে ‘চিকিৎসা ক্লিনিক’ খোলা হয়েছে। এর মধ্যে বেশি প্রসিদ্ধ হলো জার্মানির ড. হেজিগ রাহমান কিনিক, ড. ব্রাশরাযজ ও ড. ওয়ালারের ক্লিনিক।

৫. ডা. আলেক্স হেইগ বলেছেন, ‘রোজা হতে মানুষের মানসিক শক্তি ও এবং বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি পরিবর্ধিত হয়।’

প্রীতি, ভালোবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। ঘ্রানশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি প্রভৃতি বেড়ে যায়। খাদ্যে অরুচি ও অনিচ্ছা দূর করে। রোজা শরীরের রক্তের প্রধান পরিশোধক। রক্তের পরিশোধন এবং বিশুদ্ধি সাধন দ্বারা দেহ প্রকৃতপক্ষে জীবনীশক্তি লাভ করে। যারা রুগ্ন তাদেরও আমি রোজা পালন করতে বলি।’

৬. বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড নারায়ড বলেন, ‘রোজা মনস্তাত্ত্বিক ও মস্তিষ্ক রোগ নির্মূল করে দেয়। মানবদেহের আবর্তন-বিবর্তন আছে। কিন্তু রোজাদার ব্যক্তির শরীর বারংবার বাহ্যিক চাপ গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। রোজাদার ব্যক্তি দৈহিক খিচুনি এবং মানসিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয় না।’

৭. প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী Macfadden সাহেব মনের প্রগাঢ়তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে রোজার ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেন, ‘রোজার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে কি পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করা হলো তার উপর বুদ্ধিবৃত্তির কর্মক্ষমতা নির্ভর করে না। বরং কতিপয় বাধ্যবাধকতার উপরই তা নির্ভরশীল। একজন ব্যক্তি যত রোজা রাখে তার বুদ্ধি তত প্রখর হয়।’

৮. ডা. এ এম গ্রিমী বলেন, ‘রোজার সামগ্রিক প্রভাব মানব স্বাস্থ্যের উপর অটুটভাবে প্রতিফলিত হয়ে থাকে এবং রোজার মাধ্যমে শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠে।

৯. ডা. আর ক্যাম ফোর্ডের মতে, ‘রোজা হচ্ছে পরিপাক শক্তির শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।’

১০. ডা. বেন কিম তাঁর Fasting for health প্রবন্ধে বেশ কিছু রোগের ক্ষেত্রে উপবাসকে চিকিৎসা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ (হাঁপানী), শরীরের র‌্যাশ, দীর্ঘদিনের মাথাব্যথা, অন্ত্রনালীর প্রদাহ, ক্ষতিকর নয় এমন টিউমার ইত্যাদি।

এসব ক্ষেত্রে তিনি বলেন, উপবাসকালে শরীরের যেসব অংশে প্রদাহজনিত ঘা হয়েছে তা পূরণ (Repair) এবং সুগঠিত হতে পর্যন্ত সময় পেয়ে থাকে। বিশেষতঃ খাদ্যনালী পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাওয়াতে তার দেহে ক্ষয়ে যাওয়া টিস্যু পুনরায় তৈরি হতে পারে।

সাধারণতঃ দেখা যায় টিস্যু তৈরি হতে না পারার কারণে অর্থপাচ্য আমিষ খাদ্যনালী শোষণ করে দুরারোগ্য (Auto, une disease) সব ব্যাধির সৃষ্টি করে। ডা. বেন কিম আরো বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন উপবাসে কিভাবে দেহের সবতন্ত্রে (system) স্বাভাবিকতা রক্ষা করে।

১১. প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. জন ফরম্যান Fasting and eating for helth প্রবন্ধে সুস্বাস্থ্য রক্ষায় উপবাস এবং খাবার গ্রহণের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে উপবাসের স্বপক্ষে মত দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় রমজানের রোজা রাখার সুফল পাওয়া যায় না মূলত খাদ্যাভ্যাস ও রুচির জন্য।

সিয়াম যে এক বিজ্ঞান, গবেষনালব্দ আর ও বেশ কিছু তথ্য আগামী পর্বে দেব বলে আশা রাখি ইন্শাল্লাহু তায়লা।

আগের পর্ব: সিয়াম ও বিজ্ঞান-১

-আরআর


সম্পর্কিত খবর