শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


দেওবন্দে পড়ার আন্দোলন নিয়ে বিরুদ্ধবাদীদের কিছু অভিযোগ খণ্ডন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি শামসুদ্দোহা আশরাফী

গত ২১ মে সোমবার ‘কওমি ছাত্র শিক্ষক পরিষদে’র ব্যানারে দারুল উলুম দেওবন্দে পড়ার নিয়মতান্ত্রিক সুযোগ সৃষ্টির দাবিতে একটি মানববন্ধন হয়েছে। একই দাবিতে আগামী ২৭ তারিখ ভারতীয় দুতাবাস বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসুচি ঘোষণা করা করা হয়েছে।

কিন্তু আমরা লক্ষ করলাম কিছুভাই এ নিয়ে কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করে লেখালেখি শুরু করেছেন। অবস্থান নিয়েছেন এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে। তুলে ধরার চেষ্টা করছেন এ আন্দোলনের অসারতা ও ক্ষতিকর দিকগুলো।।

তাদের কেউ কেউ যৌক্তিক কিছু জিনিস নিয়ে এলেও অধিকাংশের লেখাগুলোই ধারণাপ্রসূত।বিশেষত একটি মাসিক পত্রিকার সাবেক দায়িত্বশীল শুরু থেকেই এ আন্দোলন নিয়ে আজগুবি কিছু বিষয় নিয়ে এসেছেন। সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষপাত, অখণ্ড ভারতের পক্ষাবলম্বন, ভারতীয় তাবেদার আলেম সৃষ্টির পায়তারা আরও কত কি! এমনকি মানববন্ধনের দিন থেকে শুরু অদ্যাবধি এমন ভাবুক আরও কিছু ভাইয়ের লিখনী আমার কাছে শিশুসুলভ ও হাস্যকর মনে হয়েছে। অনেকটা আমার ছেলেবেলার ভাবনার মত।

‘দেয়ালের গায়ের এলোমেলো দাগ আর ঢেঁকির আওয়াজ ছোট বেলায় বেশ উপভোগ্য ছিল।এতদুভয়ের মাঝে কত কি আবিস্কার করতাম! মনে হলে আজও হাসি পায়। সবচেয়ে ভাল লাগতো, দাগ আর আওয়াজকে আমি যা কল্পনা করতাম সেভাবেই সাড়া দিত দেখে।

যদি ভাবতাম ঢেঁকি কাউকে ডাকছে! আওয়াজেও তাই মনে হত! আবার যদি ভাবতাম জিকির করছে, মনে হত সত্যিই জিকির করছে! দেয়ালের দাগে কখনো হাতি, কখনো ঘোড়া আবার কখনো বিশাল দেও দানব খুঁজে বের নিজেকে বিজ্ঞানী ভাবতে ভালোই লাগতো।

এ নিয়ে খেলার সাথীদের সাথে মধুর ঝগড়ার ঘটনাও একেবারে কম নয়। প্রায়ই আমরা লেগে যেতাম। ভিন্ন কিছু আবিষ্কার করা আর সেটার পক্ষে দলিল পেশ করে পন্ডিতি জাহির করা একরকম নেশায় পরিণত হয়েছিল।’

দেয়ালের দাগ ও ঢেঁকির আওয়াজের মাঝে নিজের ভাবনাযুক্ত বস্তু আবিষ্কারের মতই মনে হচ্ছে এ পক্ষের ভাবনাগুলো। আর এ ধরনের অবান্তর ভাবনা যে কেউ ভাবতেই পারে। তাকে বাধা দিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে মনে করি না। আর বাধা দেয়া সম্ভবও না।

তবে ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি একটা স্পষ্ট বিষয়কে কিভাবে স্পষ্টতার বেড়াজালে আবদ্ধ করে এভাবে মিথ্যাচার করা যায় তা দেখে! আন্দোলনের ইস্যু অস্পষ্ট বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অচিন কেউ হলে না হয় তাদের এমন অযাচিত ভাবনাকে আমলে নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করতাম।

সেই সব ভাইকে বুঝা উচিত চলমান আন্দোলনের সাথে যুক্ত একজনও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কম অবগত এবং কম সোচ্চার নন। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে এদের সবক না দিলেও চলবে।

অবশ্য কিছু ভাই যৌক্তুক কিছু বিষয় নিয়ে এসেছেন। যেমন-

ক) বাংলাদেশি মাদরাসাগুলোতে ছাত্র কমে যাবে।

খ) দাওরায়ে হাদিসে ছাত্র পাবে না।

জবাব- এটা একটা হালকা চিন্তা। যারা দারুল উলুমের নিয়মতান্ত্রিকতা সম্পর্কে অবগত তারা অবশ্যই অবগত আছেন দারুল উলুম ঢালাওভাবে ছাত্র ভর্তি নেয় না। বরং বিভিন্ন প্রদেশের জন্য নির্ধারিত কোটাপূরণ সাপেক্ষে ভর্তি নেয়।

সুতরাং নিয়মতান্ত্রিক অনুমতি মিললেই যে সব ছাত্র দারুল উলুমে ভর্তি হয়ে যাবে এটা মনে হয় ঠিক না। বরং আমি মনে করি এতে মাদরাসায় ছাত্র বৃদ্ধি পাবে এবং পড়াশোনার মান বাড়বে।

ছাত্ররা প্রতিযোগিতার মানসিকতা নিয়ে পড়বে। আর সন্তান বিদেশে পড়বে এমন আগ্রহ থেকে অভিভাবকরা সন্তানদের মাদরাসায় দিতে আগ্রহবোধ করবে।

গ) ছাত্ররা সনদপ্রাপ্তি থেকে মাহরুম হবে।

জবাব- আমাদের অধিকাংশ ছাত্রই দারুল উলুমে যাওয়ার আগে বাংলাদেশে পরীক্ষা শেষ করেই যেয়ে থাকে। আর নিয়মতান্ত্রিকভাবে গেলে তখন দারুল উলুমের সনদই তার জন্য যথেষ্ট।

এখানে একটা বিষয় আমাদের ক্লিয়ার হওয়া দরকার। বিরোধী পক্ষ তাদের অবস্থান ক্লিয়ার করুক। তারা ছাত্রদের দারুল উলুমে যাবার পক্ষে না বিপক্ষে?

বিপক্ষে হলে তো কোনো কথাই নাই! পক্ষে হলে প্রশ্ন হল তারা কিভাবে ছাত্রদের যেতে দিতে চায়? বৈধভাবে না অবৈধভাবে? অবৈধভাবে হলে যাবার কোনো সুযোগই নাই। এতে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। আর বৈধভাবে হলে সেটার প্রক্রিয়া কি হবে, তা স্পষ্ট করলে ভালো হয়।

আমাদের মনে হয়েছে বৈধ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে দারুল উলুম দেওবন্দে পড়ার ব্যবস্থা গ্রহণের অনেক গ্রহণযোগ্য কারণ রয়েছে। আমি কিছু কারণ তুলে ধরছি।

১) নিরাপত্তা।

ক) ছাত্রদের নিজের নিরাপত্তা; অধিকাংশ ছাত্রই নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকায় যেভাবে দারুল উলুমে যায় এতে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ফলে যেতে বা আসতে গ্রেফতারির শিকার হতে হয়। আশা করি এটা কারোই অজানা নয়। ভয়ের কথা হল, দাঁড়ি টুপি থাকায় প্রতিবারেই গ্রেফতারকৃতরা জংগিবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত হন।

খ) পরিবারের নিরাপত্তা; নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ অভিভাবক সন্তানের আবেগের দিকে খেয়াল করে দারুল উলুমে যাবার অনুমতি দিলেও সব সময় অজানা এক আতংক নিয়ে দিনাতিপাত করেন। ভয়ে থাকেন কখন কি হয়ে যায়?

গ) বাংলাদেশের নিরাপত্তা; নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকায় যে কেউ বাংলাদেশি পরিচয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করে অঘটন ঘটিয়ে বাংলাদেশের বদনাম করাকেও একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না।

ঘ) দারুল উলুমের নিরাপত্তা; ছাত্ররা আবেগ নিয়ে পড়তে যায়। দারুল উলুমও তাদের এ আবেগকে মূল্যায়ন করে আইনি শিথিলতার মাধ্যমে ভর্তি নিয়ে নেয়। বহু জিনিস সহজভাবেই নিয়েই নেয়। গভীর তথ্য তালাশের পেছনে পড়ে না।

কিন্তু যখনি কোনো অপ্রিতিকর ঘটনা ঘটে দায়ভার দারুল উলুমকেই নিতে হয়। বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এতে প্রতিষ্ঠানটি বারবার নিরাপত্তাহীনতায় নিপতিত হচ্ছে।

আমরা আশাবাদী নিয়মতান্ত্রিকভাবে যাওয়ার পদ্ধতি চালু হয়ে গেলে কেউই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে না, ইনশাআল্লাহ।

ourislam tv'র সব ভিডিও দেখতে ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন

২) অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় থেকে মুক্তি; নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ ছাত্রই ভিন্ন উপায়ে যাওয়ার পথ অবলম্বন করতে হচ্ছে। ফলে অনেকেই ছাত্রদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

৩) মিথ্যা থেকে বাঁচা।

ক) ভিসা সংগ্রহে মিথ্যার আশ্রয় ও জটিলতার শিকার; নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের শিক্ষার্থীরা ভিসা সংগ্রহে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। যেখানে স্টুডেন্ট ভিসা খুব সহজেই পাওয়া সম্ভব, সেখানে সফরের ভিসা নিয়ে যেতে হচ্ছে। তাও কত ঝামেলা সহ্য করে পেতে হয় ভুক্তভোগী ছাড়া কল্পনাও করতে পারবে না।

খ) ভর্তি ফরমে আসল পরিচয় গোপন ও নকল পরিচয় উপাস্থাপন; যেহেতু দারুল উলুম অবৈধ কোন ছাত্র ভর্তি নিবে না এবং ভিনদেশীদের স্টুডেন্ট ভিসা ছাড়া নিবে না। তাই আমাদের ছাত্ররা নিজেদের আসল পরিচয় গোপন করে নকল পরিচয়ে ফরম নিয়ে ভর্তি হতে হচ্ছে। আর এটা কত কষ্টসাধ্য তা সম্মুখীন না হলে বুঝানো যাবে না।

গ) সনদে ভুল পরিচয়; দারুলে উলুমে পড়ার অন্যতম একটা কারণ বিশ্ববিখ্যাত এ বিদ্যাপীঠের সনদ/সার্টিফিকেট অর্জন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বাংলাদেশি ছাত্ররা ভর্তি হওয়ার সময়েই ভারতীয় ভুয়া পরিচয়ে ভর্তি হওয়ায় সনদে তাদের আসল ঠিকানা আসে না। ফলে এ সনদ কোন কাজেই আসে না।

আমাদের কথা পরিষ্কার। বৈধভাবে যাব, বৈধভাবে আসব। নিরাপদে যাব, নিরাপদে আসব। বুক ফুলিয়ে যাব, বুক ফুলিয়ে আসব। বৈধভাবে যেয়ে অবৈধভাবে আসা বা বুক ফুলিয়ে যেয়ে চোরের মত আসার কোন অর্থ নেই।

পরিশেষে দুয়া চাই আল্লাহ যেন খাইর থাকলে এ আন্দোলন কে আগে বাড়িয়ে দেন; আর কোন অকল্যাণ থাকলে যেকোনভাবেই হোক বন্ধ করে দেন।

লেখক: খতিব, সাইন্সল্যাব জামে মসজিদ, ঢাকা।

দেওবন্দ পড়ার জন্য রাজপথে আন্দোলন : কিছু প্রশ্নের উত্তর

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ