বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


আজ শপথের দিন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

২৬ মার্চ, আজ আমাদের ৪৮তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বাঙালির শৃংঙ্খল মুক্তির দিন।বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন । রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহঙ্কারের দিন।

আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনটিতেই আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটেছিল বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের। ডাক এসেছিল হানাদারদের কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার। ওই ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি শোষকের হাত থেকে প্রিয় দেশকে মুক্ত করতে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা। যেদিন শুরু হয়েছিল এক সর্বাত্মক জনযুদ্ধ।

২৬৬ দিনের সেই রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের সফল পরিণতিতে বিশ্বের বুকে জন্ম নিয়েছিল একটি নতুন রাষ্ট্র, আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, প্রিয় বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভয়াল ‘কালরাত্রি’র পোড়া কাঠ, লাশ আর জননীর কান্না নিয়ে রক্তে রাঙা নতুন সূর্য উঠেছিল। ভয়াল কালরাতের ধ্বংসস্তূপ আর লাশের ভেতর দিয়ে রক্ত রাঙা সেই নতুন সূর্য। ভীতবিহ্বল মানুষ দেখেছিল লাশপোড়া ভোর। সারি সারি স্বজনের মৃতদেহ। আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছিল ধোঁয়া। পুড়ছিল স্বাধীন বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল-সবুজ পতাকা।

জ্বলছিল শাড়ি, খুকুর ফ্রক। চোখে জল। বুকে আগুন। জ্বলে উঠেছিল মুক্তিকামী মানুষের চোখ, গড়ল প্রতিরোধ। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ‘জয় বাংলা’ তীব্র স্লোগান তুলে ট্যাঙ্কের সামনে এগিয়ে দিয়েছিল সাহসী বুক।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরুর পর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করতে দেশবাসীকে নির্দেশ দেন।

সেই রাতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বীর বাঙালি মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেস থেকে সে বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় দেশের সর্বত্র।

চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ। প্রথমে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপঅধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। তাই এই ঘোষণা দেশের জনগণের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একাত্মতার বার্তা হিসেবে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করে।

এরপর ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার নিভৃত এক আমবাগানে শপথ নেয় নবগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত এই সরকারের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করে। তাদের নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করে।

প্রশিক্ষণহীন নিরস্ত্র বাঙালিরা যেভাবে একটি সুশৃঙ্খল অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে তেমন সংগ্রামের দৃষ্টান্ত বিরল। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বিজয়। বাঙালি লাভ করে চিরকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।

বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাসের এক অনিবার্য ফল। আমাদের অতীত ইতিহাস নানা বিপর্যয়ের, প্রতারণা, নির্যাতনের ও বঞ্চনার। দীর্ঘদিন আমরা বন্দি ছিলাম দাসত্বে। আমাদের চিন্তার আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। বঞ্চনার পাহাড় গড়ে উঠেছিল চারদিকে।

নবাবী শোষণ, বেনিয়া শাসন এবং পরবর্তীকালে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ আমাদের জাতীয় সত্তা আর অধিকারে অক্টোপাসের মতো চেপে বসেছিল। তা থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্খা থেকে যে সংগ্রামী চেতনা জেগে উঠেছিল, তারই ফলে স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং পরিশেষে বিজয়গর্বে স্বাধীনতা লাভ।

যাদের রক্ত ও সম্ভ্রমের মূল্যে আমরা পেয়েছি মহামূল্যবান এই স্বাধীনতা, তাদের কাছে মহামূল্য ঋণ গভীর কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার দিন আজ। মহান স্বাধীনতা দিবসে আজ উৎসবের পাশাপাশি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বেদনায় স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদকে।

স্মরণ করছি স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী তার সহকর্মী জাতীয় নেতাদের। শ্রদ্ধা জানাই বীরাঙ্গনা আর শহীদ মাতাদের।

স্বাধীনতা অর্জিত হলেও গত ৪৭ বছর জাতির চলার পথ মসৃণ ছিল না কখনো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়া, দারিদ্র্য ও দুর্নীতি থেকে মুক্তির সংগ্রামের পাশাপাশি একইভাবে চলেছে সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, যুদ্ধাপরাধের বিচার, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ আন্দোলন।

এসব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই মোকাবিলা করতে হয়েছে প্রবল বন্যা, ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের। এই বন্ধুর পথপরিক্রমায় অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু শত বাধা-প্রতিবন্ধকতায়ও হতোদ্যম হয়নি দেশের মানুষ। তবে এখনো আমাদের অনেক কাজ বাকি। বিশেষ করে সমবেত চেষ্টায় দেশের হতদরিদ্রদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।

তা হলেই জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য যথার্থভাবে প্রতিফলিত হবে।বিশেষ করে, স্বাধীন বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এগিয়ে নিতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম

soyedfaizul@gmail.com
২৬ মার্চ, ২০১৮


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ