শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


গোলাপজলের সন্ধানে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর

‘গোলাপজল’ এক বহুমাত্রিক জলের নাম। নানা চরিত্রে সে চরিত্রবান। রং-রূপ-গন্ধ-স্বাদ-ব্যবহারে আমাদের জীবনের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ জোরালো। গোলাপের বহুরঙা অভিসন্ধির মতো এর ব্যবহারও নানান।

গোলাপ পাপড়ির আত্মদানে তৈরি হয় যে পানীয়, কী এমন রহস্য আছে এ স্বচ্ছ জলের ফোঁটায়। চলুন, জেনে নেয়া যাক গোলাপজলের এক ছিলিম গোলাপী পাঠ।

এক
পহেলা নম্বর গোলাপজলের অস্তিত্ব ইদানীং হুমকির মুখে। এ হলো ছিটানো গোলাপজল। আগে মিলাদ-মাহফিল বা ধর্মীয় কোনো রেওয়াজ-অনুষ্ঠান হলে ছিটানো গোলাপজলের উপস্থিতি ছিলো অবশ্যম্ভাবী।

মিলাদের ‘ইয়া নবি সালাম আলায়কা’ কোরাসের মাঝে সাহেবে দাওয়াত চিড়িক চিড়িক করে গোলাপজল ছিটিয়ে দিতেন। গোলাপজল ছিটানোও সওয়াবের একটা অংশ মনে করা হতো।

ঈদের নামাজে, শবে বরাত-শবে কদরে, কখনো জুমআর নামাজান্তে শিরনি বিলানোর মচ্ছব থাকলে সেদিনও গোলাপজল ছিটানো হতো।

ছোটবেলায় ভাবতাম, গোলাপজলের চিড়িক-ছিটা বড় পুণ্যজল। মিলাদ-মাহফিলের যেখানে গোলাপজলের ছিটা বেশি বর্ষণের সম্ভাবনা, সেদিকে গিয়ে বসতাম। যদি কখনো ছিটা কম পড়তো, ছিটা বিতরণকারীকে বলতাম, এদিকে এদিকে...।

গোলাপজলের ছিটা জামায় পড়লে কেমন একটা পবিত্র পবিত্র ভাব এসে যেত মনের মধ্যে। এখন গোলাপজল ছিটানোর প্রস্তুতি দেখলেই নিজেকে আড়াল করি, দারুণ বিচ্ছিরি লাগে গন্ধটা।

অবশ্য এখন মিলাদ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গোলাপজল ছিটানোর দৃশ্য খুব একটা চোখেও পড়ে না।

ছিটানো গোলাপজলের আবশ্যিক উপস্থিতি পাওয়া যায় জানাজায়। জানাজার নামাজে কাতারবন্দী হওয়ার পর মৃতের আত্মীয়-স্বজনরা গম্ভীর মুখে কাতারে কাতারে গোলাপজল ছিটিয়ে দেন। লাশ কবরে রাখার সময়ও গোলাপজল ছিটানোর রেওয়াজ আছে।

তবে গোলাপজলের প্লাস্টিকের বোতল ঘরে আনবার রীতি নেই। নীল বা সাদা রংয়ের প্লাস্টিকের বোতলগুলো পড়ে থাকে সদ্য আলগা মাটির কবরের পাশে। বছরের পর বছর ধরে ওখানেই পড়ে থাকে, যতদিন না নতুন আরেকটা কবর খোঁড়া হয়।

সব মসজিদে নানা উপলক্ষে গোলাপজল জমা হতো। বড় বড় মসজিদে গোলাপজল, আগরবাতি, মোমবাতির স্তূপ জমে যেতো। কিন্তু সময় বদলে গেছে। মসজিদে বিদ্যুত আছে, মোমবাতি জ্বালানোর দরকার হয় না। আগরবাতির গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে।

আতর, পারফিউম আর বডি স্প্রের যুগে গোলাপজল পাততাড়ি গুটিয়ে আশ্রয় নিয়েছে কেবল উরশ আর মাজারে। যা-ও দু-চার জন মসজিদের দিয়ে যায়, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা সেসব বিক্রি করে মসজিদের ঝাড়ু আর পাপোস কিনেন।

গোলাপি, নীল, সাদা রংয়ের প্লাস্টিক বোতলে সত্যিই গোলাপ নিঃসৃত জল থাকতো কি-না কে জানে! কিন্তু নাম তো হয়েছে গোলাপজল। গোলাপের মতোই পবিত্র।

দুই
বউ একদিন বললেন গোলাপজল আনতে। আমি বললাম, ‘গোলাপজল দিয়ে কী করবা? মিলাদ কই?’

‘আরে পাগল, ওই গোলাপজল না। ত্বকে ব্যবহার করার জন্য আলাদা গোলাপজল।’
‘এমন গোলাপজল আছে নাকি?’

‘আছে, কসমেটিকসের দোকানে গিয়ে বললেই হবে।’

মনে মনে ভাবলাম, কথা তো ঠিক। গোলাপ সৌন্দর্যের প্রতীক, সেটার নিঃসৃত জল তো নারীর রূপচর্চাতেই অধিক ব্যবহার হওয়ার কথা। অথচ গোলাপজলের এই ব্যবহার সম্পর্কে এতোদিন আমি বিরাট বেখবর ছিলাম।

বইয়ে শুধু পড়েছি, সুন্দরী রানি-রাজকন্যারা গোলাপের পানিতে গোসল করতেন। আহা! কী বিলাস, কী সৌখিন! কিন্তু সেই গোলাপজল যে বোতলবন্দী হয়ে এ জমানার নারীদের রূপচর্চায় মহান ভূমিকা রাখছে, কে জানতো এ খবর!

উইকিপিডিয়ায় ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, রূপচর্চায় গোলাপের ব্যবহার সুপ্রাচীন কাল থেকে। রোমান, পারস্য থেকে শুরু করে হিন্দুস্তানের ডাকসাইটে সুন্দরীতমাগণ গোলাপজলের ব্যবহার শিখিয়ে গেছেন।

মিসরের রানি ক্লিউপেত্রা থেকে সেলিমের আনারকলি, শেবার রানি বিলকিস থেকে উসমানি হেরেমের হুররম সুন্দরী, সবাই ভক্তি করতেন গোলাপজলের। ঘরোয়াভাবে তৈরি হতো গোলাপজল। নিজস্ব গোলাপ বাগান থাকতো যাদের, তারাই তৈরি করতো এই সৌখিন ভেষজ প্রসাধনী।

এখানে একটা মজার তথ্য আছে। পারস্যকে (ইরান) মনে করা হয় রূপচর্চায় গোলাপজল ব্যবহারের পীঠস্থান হিসেবে। তারাই ইউরোপ, আরব এবং দক্ষিণ এশিয়ায় গোলাপজল ব্যবহারের তরিকা শিখিয়েছে।

তবে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে গোলাপজল প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন পারস্যের বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। তার আবিষ্কৃত থিউরি অনুসরণ করে উৎপাদিত পারস্যের মোহময় গোলাপজল বহুমাত্রায় বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গোলাপজল নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। আরও উন্নতমানের গোলাপজল তৈরির বাসনায় গোলাপের বিভিন্ন প্রজাতি ক্লোন শুরু হয়। এমনই এক ক্লোন প্রজাতির গোলাপের নাম ‘রোজা দামাস্কানা’।

রোজা গ্যালিসিয়া ও রোজা মোশাতা নামের দুই প্রজাতির গোলাপকে ক্লোন করে উৎপাদন করা হয় রোজা দামাস্কানা। ধারণা করা হয় এর উদ্ভব ঘটে দামেস্কে। তবে বুলগেরিয়া ও তুরস্কে এর উৎপাদন সবচে বেশি হয়।

গায়ের রং উজ্জ্বল গোলাপী, অন্যান্য গোলাপের চেয়ে এর আকার ও পাপড়ির পরিমাণ বেশি থাকে।

মজাদার খাবার ‘নোগাটের’ উপর সরাসরি রোজা দামাস্কানার পাপড়ি বিছিয়ে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে বুলগেরিয়ায়।

মাদকাসক্ত সন্তানের টেনশনমুক্ত হোন

তিন
রান্নার জন্য আলাদা এক গোলাপজল ব্যবহার হয়। এই তবকার গোলাপজলে নির্দিষ্ট পরিমাণ চিনি বা সির্কা মিশিয়ে সেটাকে প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ার উপযোগী করা হয়। খাওয়ার গোলাপজলের প্রচলনও পারস্য থেকেই আমদানি করা।

পারস্যের মুঘলরা যখন ভারতবর্ষে আগমন করেন, তখন অন্য অনেক জিনিসের সঙ্গে গোলাপজলের বাহারি রান্নাও সঙ্গে নিয়ে আসেন।

তবে খাওয়ার এ গোলাপজল হাই লেভেলের রান্না-বান্নার মধ্যে দেয়া হয়। মুঘল সালতানাতের বাতচিতই আলাদা। তারা খানা-খাদ্যতে বড় উমদাহ ছিলেন। বিরিয়ানি, পোলাও, কাবাব, রেজালা, টিক্কা, কোর্মা তারাই রেঁধেছেদে আমাদের খাওয়া শিখিয়েছেন। এমন সুস্বাদু রসনাবিলাসের জন্য তাদের ধন্যবাদ না দিলেই নয়।

খানিকটা দুঃখের বিষয়ও রয়েছে, ভোজনরসিকরা পোলাও বা বিরিয়ানিতে গোলাপজল ব্যবহার বরাবর নাপছন্দ করে থাকেন। তাদের ধারণা, ওজনদার খাবারে গোলাপজল দিলে খাওয়ার রুচিতে বিঘ্ন ঘটে। বিঘ্নতার কারণে পোলাও-বিরিয়ানি পরিমাণে কম খাওয়া যায়।

কিন্তু এ কথা পুরোপুরি সত্য নয়। পোলাও বা বিরিয়ানিতে গোলাপজল দেয়া হয় মূলত ফ্লেভারের জন্য, সামান্য স্বাদের জন্য। তবে গোলাপজল ব্যবহারের যে মাত্রা তার থেকে সামান্য উনিশ-বিশ হলে স্বাদের হেরফের হতে পারে।

যেহেতু গোলাপজল হাই লেভেলের রসনা, সচরাচর এর ব্যবহার দুষ্প্রাপ্য। এ কারণে এর ব্যবহারবিধি সম্পর্কে আকছার বাবুর্চিই অজ্ঞ। বাবুর্চির অজ্ঞতার কারণে আপনার ভুরিভোজে ব্যঘাত ঘটলে গোলাপজলের কী কসুর! সুতরাং গোলাপজলের ওপর থেকে অহেতুক মামলা তুলে নিতে ভোজনরসিকদের প্রতি জোর নিবেদন থাকবে।

রান্নার গোলাপজল থাকে কাচের বোতলে। যেনতেন দোকানে এ গোলাপজল মওজুদ থাকে না, বাজারের পুরোনো বনেদী দোকানগুলোতে কেবল এর দিদার পাওয়া যায়। অবশ্য শহরের সুপার স্টোরগুলোতে এখন দেদার পাওয়া যাচ্ছে।

কনজিউমার কোম্পানিগুলোর কথা আর কী বলবো, খাওয়ার এমন কোনো জিনিস নেই যেটা তারা উৎপাদন করছে না। খিচুরি তো অলরেডি প্যাকেটজাত হয়ে মুদি দোকানে বিক্রি হচ্ছে, কয়েকদিন পর ভাত তরকারিও প্যাকেট কিনেই খেতে হবে।

কচুর লতি আর ডালই বা বাকি থাকবে কেন, বেগুন ভর্তা আর সবজির লাবড়ার ব্যাপারেও আশাবাদী হোন। আর তো দিন কয়েকের ব্যাপার মাত্র!

আধুনিককালে খাওয়ার গোলাপজলের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। জুস, মিল্কশেক, আইসক্রিম, ডেজার্ট, পুডিংসহ নানা কনফেকশনারি খাবারে গোলাপজল ব্যবহার করা হয়।

অ্যালকোহলমুক্ত অনেক ল্যামোনেড পানীয় এবং বেভারেজেও ব্যবহৃত হচ্ছে গোলাপজল। এশিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপেও গোলাপজলের পদাতিক যাত্রা শুরু হয়েছে।

ইংল্যান্ডের ফুটবল কাপ ‘উয়েফা প্রিমিয়ার লিগ’-এর রীতি হলো, টুর্নামেন্টে যে দল জিতবে তারা শ্যাম্পেনের বোতলের ছিপি খুলে উৎসব উদযাপন করবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো, বিভিন্ন দলে মুসলিম খেলোয়াড় থাকে যারা অ্যালকোহল পান করেন না।

তাই লিগ কর্তৃপক্ষ একবার ঘোষণা দিয়েছিল, লিগে যে দল জিতবে, সে দলে যদি মুসলিম খেলোয়াড় থাকে তবে শ্যাম্পেন নয়, শ্যাম্পেনের বদলে গোলাপজল ব্যবহৃত কোনো পানীয়ের বোতল খুলে সেলিব্রেট করতে পারবে।

এই রীতি এখন আর আছে কি-না, জানি না।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক


সম্পর্কিত খবর