শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৭ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১১ শাওয়াল ১৪৪৫


‘সৌদি আরবের উদারনীতি ও যুবরাজের ভিশন সময়োপযোগী পদক্ষেপ’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৌদি আরবের যুবরাজ ও আগামীর বাদশা মুহাম্মদ বিন সালমান দেশ পরিচালনায় উদারনীতি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি, স্টেডিয়ামে খেলা দেখাসহ অাধুনিক অনেক বিষয় বাস্তাবায়নে কাজ চলছে।

এ লক্ষে যুবরাজ মুহাম্মদ ভিশন ৩০ নামের প্রকল্পও হাতে নিয়েছেন। গণমাধ্যমে এসব প্রকাশের পর আলোচনা চলছে সর্বত্র। কেউ সহনীয় মনোভাব কেউ বা তীর্যক ভাষায় সমালোচনা করছেন এসব পদক্ষেপের।

বাংলাদেশের আলেমগণ কিভাবে দেখছেন তার ভিশন ২০৩০ কে। এসব- এ বিষয়ে আওয়ার ইসলাম মুখোমুখি হয়েছিল বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার, শিক্ষাবিদ আলেম ও সাংবাদিক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভীর। যেখানে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সবগুলো বিষয়ের।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব

আওয়ার ইসলাম: সৌদি আরব ভৌগলিকভাবে একটি রাষ্ট্র হলেও ২০০’শ কোটি মুসলমানের কাছে এটা শুধু একটি রাষ্ট্র নয় বরং ভালবাসা ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি যুবরাজ রাষ্ট্র পরিচলানায় যে উদারনীতি গ্রহণ করেছেন তা আপনি কিভাবে দেখছেন?

উবায়দুর রহমান খান নদভী: এটা সাধারণ একটা জিজ্ঞাসা, প্রতিটি মুসলমানের মনেই; আমরাও অনুভব করেছি বিষয়টা।

আসলে সৌদি আরব যে অবস্থানে আছে, আবেগের দৃষ্টি থেকে এটার একটা পরিচয় আছে, মুসলিম উম্মাহ তাদের যা মনে করেন বা তারা যেই অবস্থানে সে হিসেবে কি তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করে আসছিলেন? এটা একটা বড় প্রশ্ন।

সৌদি আরবের শাসনের যে ধর্মীয় দিক, বিচার, শরিয়া পরিপালন ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের মনে কোন প্রশ্ন নাই। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তারা শরিয়ার সীমালঙ্ঘন করতেন, এর আগে বহু আগেও এরকম দেখা গেছে।

বিশেষ করে ২০০ কোটি উম্মাহ যেটা আপনি বললেন, তাদের সবাইকে একসাথে রেখে, সবার ভালমন্দ বিবেচনা করে একসূত্রে গাঁথা, সমানভাবে দেখা, এক্ষেত্রে সৌদির কিছু কঠোরতা, কিছু ত্রুটি ছিল।

এজন্য আমরা উপমহাদেশের আলেমগণ সৌদি আরবের ধর্মতত্ত্বের সাথে একমত পোষণ করতাম না। যেমন, মাযহাবকে তার সঠিক মর্যাদায় রাখা, আহলে হাদীস সম্প্রদায়কে নিয়ে বেশী অগ্রসর না হওয়া, বিশ্বের নানা দেশের কোটি কোটি মুসলমানকে তাদের আকিদা খারাপ, তারা শিরকে লিপ্ত, নির্দ্বিধায় এসব বলা থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি।

এমনকি বাড়াবাড়ি এমন পর্যায়েও ছিল যে, একজন সৌদি স্কলার গবেষণাপত্র তৈরি করেছেন যে, মানুষ খুব গুরুত্বসহকারে যিয়ারতে আসে এজন্য নবী করিম সা. এর রওজা মোবারক সরিয়ে ফেলা।

জান্নাতুল বাকী কবরস্তানে চিহ্নিত না করে হযরত সা. এর কবর তৈরী করা। দাড়ির শরয়ী বিধান নিয়ে এমনকি হারামাইনের কিছু ইমামেরও উদাসীনতা। নারীদের সাথে চলাফেরা হাত মেলানো বিষয়ে এক আলেমের নতুন ফতোয়া।

নামাযের সময় কাজকর্ম বন্ধ রাখা এমনকি ধর্মীয় পুলিশ সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা। এসব ধর্ম তাত্ত্বিক বাড়াবাড়ি ও হালকাপনা থেকে মধ্যপন্থায় ফিরে আসা প্রসংশসনীয়। এক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন ও সংস্কারের প্রয়োজন।

আর রাষ্ট্র সৌদি আরব তাদের রাষ্ট্রকে সংরক্ষিত রাখা, শাসকদের নিরাপত্তা, তাদের রাজনৈতিক কৌশল, মধ্যপ্রাচ্য নীতি ইত্যাদির আলোকে যদি নতুন সংস্কারে হাত দেয় এ নিয়ে আমাদের বলার তেমন কিছু নেই।

যে উদ্দ্যেশে তারা এসব কিছু করে যাচ্ছে। আমরা শুধু বলব কোনো সংস্কারই যেন শরীয়ত বিরোধী না হয়।

কেননা, সৌদি আরব তার ঐতিহাসিক অবস্থানের কারণে মুসলিম উম্মাহর আশা ভরসার জায়গা। শরীয়তের কিছু অংশ এখন বলতে গেলে সে দেশের শাসন ও বিচার বিভাগেই আছে।

বর্তমানে যুবরাজ যেটা করছেন সেটাকে আমি এই শর্তে স্বাগত জানাই যে, তার কাজে তিনি যেন সীমালঙ্ঘন না করেন। ঐতিহ্য ও শরীয়ত যেন লঙ্ঘিত না হয়। প্রয়োজনে সংস্কার করতেই হবে।

কারণ সৌদির ১ কোটি নাগরিকদের মধ্যে ৭০ ভাগ যুবক, যাদের বয়স ৩০ বছর। এই বিশাল যুবশক্তি তাদের মধ্যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা নেই বললেই চলে। ইসলামী উম্মাহর নেতৃত্বে তাদের আরও দক্ষ হতেই হবে।

তাদের মধ্যে মুসলিম বিশ্বের সমাজ নিয়ে, দারিদ্র নিয়ে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, নারী অধিকার নিয়ে গবেষণাটা কোথায়? আমি তো লক্ষ করেছি, সৌদি আরবের কিছু সংখ্যক মানুষ সামাজিক কারণেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে, নিজের বাবা-চাচাকেও হত্যা করতে দ্বিধা করেনি।

আইএস, আল-কায়েদার সাথে জড়িয়ে পড়েছে যেগুলো ইসলামের মুলধারা নয়। তরুণ সমাজের বিশাল একটা অংশ অপসংস্কৃতির চেয়েও মারাত্মক নৈতিক এবং চারিত্রিক অপকর্মে যুক্ত। দেশে যেমনই হোক সৌদি বিত্তবানরা বিদেশে অনেক বদনাম কুড়িয়ে থাকে। যা আমি আমাদের বাংলাদেশের ধর্মীয় শিক্ষিতদের মধ্যে দেখি না।

এই যে দীনতা তাদের মাঝে কাজ করছে। এজন্য সৌদির নতুন জাগরণ প্রয়োজন ছিল- যুবরাজ সেটা করছেন।

আওয়ার ইসলাম: তার মানে আপনি সৌদি যুবরাজের ভিশন থার্টি প্রকল্পকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন?

উবায়দুর রহমান খান নদভী: শুধু ইতিবাচক না বরং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলেও মনে করি। কারণ, সৌদি আরব শুধুমাত্র তেল নির্ভর দেশ। তেল না থাকলে দু’বেলা খাবারও জুটবে না তাদের।

তেল ফুরালে মরুভূমিতে যাও, খেজুর খাও আর বকরি চড়াও। অর্থনীতি মজবুত না হলে তাদের ভবিষ্যত বেশ অন্ধকার। পবিত্র দুই হারামের খেদমতের জন্যও অর্থের প্রয়োজন।

এইভাবে তো কোন দেশ চলে না, বর্তমান যুগের চাহিদাও এটা না। তাদের যে ভিশন থার্টি এটার মূল কথাই হলো তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে বাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা। বিকল্প অর্থনীতির দাঁড় করানো। এতে তো কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। যারা বাস্তববাদী তারা এ বিষয়ে দ্বিমত করবে না।

মুহাম্মদ বিন সালমান সৌদি যুবকদের বিজ্ঞানমনস্ক হতে এবং পৃথিবী নিয়ে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির দিকে এগিয়ে আসার যে চিন্তাটুকু করেছেন এ সময়ে এটা খুব জরুরি। কিন্তু মিডিয়া এগুলোকে এড়িয়ে শুধুমাত্র ভিশনটুকুকে উদারনীতি বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

আওয়ার ইসলাম: উদার নীতি বলতে সৌদি সরকার নারীদের ঘর থেকে বের করে পশ্চিমা সংস্কৃতি আমদানি করার পথ খুলে দিচ্ছে না?

উবায়দুর রহমান খান নদভী: আমার যতদূর জানা, আমি মুসলিম অন্যান্য দেশগুলোর মত সৌদিকেও খুব কাছে থেকে জানি।

আমার মনে হয় সৌদির এই জাগরণ, পাশ্চাত্য নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার যে পরিকল্পনা, অর্থনীতিকে মজবুত করার যে প্রতিজ্ঞা যুবরাজ করেছেন, পশ্চিমাদের এসব ভালো লাগছে না।

কারণ, তারা একটি পাশ্চাত্য নির্ভর পঙ্গু সৌদি আরব দেখতে চায়। নিজের পায়ে দাঁড়ানো শক্তিশালী হিসেবে দেশটিকে তারা দেখতে চায় না। শরীয়তের শর্ত মেনে এদেশের শক্তিশালী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা খুবই দরকার।

এজন্য তারা ওই বিষয়গুলোকে টেনে আনছে যেগুলো অনুসঙ্গ মাত্র, মূল বিষয় না। সম্প্রতি সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানোর যে অনুমতি দেওয়া হয়েছে এখানেও তো খারাপ কিছু দেখছি না।

কারণ, পর্দা করে নারীরা নিজ গণ্ডিতে গাড়ি চালানো আর একাকী নারী একজন পুরুষ ড্রাইভারসহ চলাফেরা করা, এ দু’য়ের মধ্যে কোনটি ভালো তা সৌদি নীতি নির্ধারকরা বেছে নিয়েছেন।

ইসলামে তো প্রয়োজনে পর্দা মেনে নিজস্ব পরিবেশে নারীদের গাড়ি চালানো, ঘোড়া চালানো কোনদিনই নিষেধ করে না। সৌদিতে বিভিন্ন কারণে নারীদের গাড়ি চালানো নিষেধ ছিল, এখন মাত্র অনুমতি দিয়েছে, এতে আহামরি কিছু হয়নি।

এনিয়ে পশ্চিমাদের এতো মাথা ব্যথা কেন? সৌদিতে যে ধর্মীয় তদারকি তাতে নারীদের কিছু সুবিধা অসুবিধা দেখা বা সংস্কার হলেও আমার বিশ্বাস তা শরীয়ত লঙ্ঘন করে হবে না। স্টেডিয়ামে যাওয়ার যেসব শর্ত রাখা হয়েছে এসব মেনে মুসলিম নারীরা সব দেশেই যেতে পারবেন।

আর পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশে নারীদের গাড়ি চালানো বৈধ হলে, সৌদি নারীরা পারবে না কেন? আর বিনোদন তো পৃথিবীর সব দেশে আছে। তবে দ্বীনদার মানুষের বিনোদন আর বদদ্বীনদের বিনোদনে দিন-রাত পার্থক্য। এগুলো মেন্টেইন করা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব। রাষ্ট্র এসব কারও ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না।

অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, সামাজিক অবক্ষয়, সৌদি নাগরিকদের নৈতিক অধ:পতন, মুসলিম বিশ্বের প্রতি অবহেলা, শ্রমিকদের প্রতি উদাসীনতা, নারী শ্রমিকদের সাথে ঘৃণ্য আচরণ ইত্যাদি অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি, অনেকাংশে তাদের ক্ষত আরো গভীর।

এসব কিছু চিন্তা করে আমি এই জাগরণ এবং নতুন পদক্ষেপকে সময়োপযোগী বলে মনে করি। এর ফলে যেন মুসলমান শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্থ না হন, ভিসা সহজ করা হয়, নাগরিকত্ব দেওয়ার পদ্বতি সহজ করা হয়।

সর্বোপরি ইসলামী ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। এটাই আমি চাই। অর্থাৎ, শরীয়তকে সমুন্নত রাখার শর্তে সংস্কারকে স্বাগত জানাই।

আওয়ার ইসলাম: তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে পশ্চিমা সংস্কৃতি আমদানির যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা ভুয়া বরং তাদের মধ্যে ইসলামি সংস্কৃতি যা কঠোরভাবে পরিচালিত হয়ে আসছিল, সেখান থেকে তারা মূল ইসলামে ফিরে আসছে?

উবায়দুর রহমান খান নদভী: তাদের মধ্যে মনগড়া কিছু ধর্মীয় তত্ত্ব ছিল, ইসলামে অবকাশ আছে এমন বিষয়কেও তারা অস্বীকার করছিলো, সেখান থেকে বেরিয়ে যদি তারা ইসলামের সহজ ও সাবলীল ধারায় ফিরে আসে, যেটাকে মধ্যপন্থা বলা হয়। ইসলাম এটারই প্রবক্তা।

আওয়ার ইসলাম: তাহলে, যেখানে কুরআন নাজিল হয়েছে, আল্লাহর রাসুল জন্ম গ্রহণ করেছেন সেখানে কঠোরতা এল কিভাবে?

উবায়দুর রহমান খান নদভী: আমি এটাকে একটা প্রতিক্রিয়া বলব, কারণ একসময় ইসলামের নামে কুসংস্কার বাড়তে লাগল, মুর্তিপূজা, শিরক, বিদআত শুরু হয়ে গেল তখন তারাও কঠোর পন্থা অবলম্বন করা শুরু করল।

বিশেষ করে সৌদি আরবের বিশাল ভূমি ইসলামের কোন অংশ নয়। ইসলামের পবিত্রভূমি হলো মক্কা-মদিনা, আল্লাহর রাসুলের সাথে সম্পর্কিত জায়গা। সেগুলোর মর্যাদা, হারামাইনের সম্মান, হজের আধ্যাত্মিকতা এটা তারা বজায় রাখুক।

বাকি তাদের সারাদেশে তারা যদি শরীয়ত মেনে পরিবর্তন আনে, উন্নতি করে তাহলে সমস্যা কি? তা না হলে অচিরেই তারা তেল বিক্রি করে করে অঢেল অর্থ-বিত্ত পেয়ে অলসতায় ডুবে যাবে, নাগরিকরা আয়েশী জীবন যাপন করবে, তারা নিজেরা সক্ষম মানুষের মতো চলাচলও করতে পারবে না।

আধুনিক বিশ্বে সৌদিরা অপাংক্তেয় হয়ে থাকবে। নতুন যুবরাজের কাছে এসব ঠিক মনে হচ্ছে না।

আমি মুহাম্মদ বিন সালমানের কথা শুনেছি, তার লেখা পড়েছি। আমি এসব চিন্তাই পেয়েছি তার কথাবার্তা ও লেখায়। সুতরাং, প্রাথমিক দৃষ্টিতে পশ্চিমাদের উত্থাপিত বিষয়ে হাহাকার করার মতো কিছু নেই, যে পরিবর্তন হচ্ছে তা ইসলামের মধ্য থেকেই হয়ে থাকলে ভয়ের কিছু নেই।

বিশ্ব মুসলিমের উচিত পরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবে নেওয়া এবং আশাবাদী থাকা।

আওয়ার ইসলাম: তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন সৌদি আরব অনেকটা প্রতিক্রিয়াশীল জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে মূল ইসলামের দিকে ফিরছে?

উবায়দুর রহমান খান নদভী: হ্যাঁ, এটাতে অস্থিরতার কিছু নেই। ইসলামকে নিয়ে সারা পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান যে যাত্রা, সভ্যতার যে যাত্রা, তারুণ্যের যে যাত্রা এটা থেকে ইসলাম পিছিয়ে নয়।

এটা বোঝার জন্য এই পরিবর্তন খুবই জরুরি ছিল। যোগ্য ব্যক্তিরা সংশোধনী ও পরামর্শ দিলে বড় কোনো ভুল হবে না। সৌদি আরব অতীতের ভুল সংশোধন করে আরও অগ্রসর হবে।

এই রুদ্ধদ্বার খোলায় আমি নতুন যুবরাজকে স্বাগত জানাই। তবে, আমি বলবো দেখে শুনে, চিন্তা করে এগোতে হবে। নিজের আবেগ ও সাহস, প্রবীণদের অভিজ্ঞতা ও আদর্শের সাথে মিলিয়ে এগোতে হবে। কোনো ভাবেই যেন মহান ইসলাম ক্ষতিগ্রস্থ না হয় যা সৌদি আরবের অস্তিত্বের পূর্ব শর্ত।

আওয়ার ইসলাম: আপনি হয়তো জেনেছেন, সৌদি আরবে সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু প্রতিনিধিত্বশীল আলেমকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এটা সৌদিসহ মুসলিম বিশ্বের জন্য কতটা সুখকর?

উবায়দুর রহমান খান নদভী: সৌদি আরবের যে প্রায় ৯০ বছরের ইতিহাস, এখানে অধিকাংশ সময় বিরোধী মতের লোকদের দমন করার বিষয়টা লক্ষ করা যায়, এটা রাজতন্ত্রের দোষ।

এক্ষেত্রে তাদের নীতির বিরোধী, রাজনৈতিক কৈাশলের বিরোধী, কোন ভুল চুক্তি বিরোধী এসব বিষয় নিয়ে যারা কথা বলেছে তাদের আটকে রাখা, গুম করে ফেলা এটা তাদের মধ্যে দেখা যায়।

অনেক ক্ষেত্রে শরিয়া অনুযায়ী এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, আমরা এখানে নিশ্চুপ। তবে, অনেকক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজির ছিল। যেসব ইমাম-আলেমদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এটা অনেকাংশেই তাদের রাজনৈতিক বিষয়, যার ব্যখ্যা বা জবাবদিহিতা তারাই করবেন।

এভাবে চললে তারা অর্থনৈতিকভাবে এগোনোর যে পরিকল্পনা করেছে সেটা সফল হবে না। জনগণকে উদারভাবে, স্বাধীনভাবে কথা বলতে দিতে হবে। যেটা ইসলমের রীতি।

নাগরিকরা ইসলামের মহান খলিফার সামনে যদি প্রশ্ন করার অধিকার পায়, তাহলে বাদশাহর সামনে কেন কথা বলতে পারবে না। যদি তিনি এটুকু বাকস্বাধীনতা না দেন তাহলে তিনি ইসলামি শাসক নন, একজন স্বৈরশাসক।

আওয়ার ইসলাম: সামান্য বিষয় নিয়ে আলেমদের যে নির্যাতন করা হচ্ছে, অনেক সামাজিক সমস্যা সেখানে রয়েছে এসব বিষয়ে কি আপনি কিছু বলবেন না?

উবায়দুর রহমান খান নদভী: এটাই তো আমি বলতে চাই, যে সংস্কার শুরু হয়েছে ইসলামের বাকস্বাধীনতা ফিরে আসুক।

অর্থনীতির সংস্কার হোক, তারুণ্যের উজ্জীবন হোক, রাজতন্ত্রের দমন-পীড়ন না থাকুক, ইসলাম প্রদত্ত নারীদের অধিকার তারা ফিরে পাক, বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজেও যে অধিকার কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে, আমরা যা নারীদের দিতে পারিনি।

সৌদি আরবে আপনি দেখবেন, নারীদের বিয়ে-শাদীর ব্যাপারে বংশ, সৌদি নাগরিক, মোটা অংকের দেনমোহরের বিবেচনা করা হয়। যে কারণে, লক্ষ লক্ষ মেয়ে স্বামীর সংসার না করেই জীবন পার করে দিচ্ছে। এটা তো ইসলাম নয়।

বাংলাদেশী অনেক শ্রমিককে কঠোর পরিশ্রমের পরেও দুই চারশ রিয়াল বেতন দেওয়া হয়। অথচ হাজার হাজার রিয়াল এসব মালিক অপচয় করেন। গৃহকর্মীদের উপর ঘৃণ্য অত্যাচার সৌদিতে অনেক বেশি। ইত্যাকার সমস্যা যেন এই পরিবর্তনের ফলে দূর হয় আমরা সেটাই চাই।

এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ইসলামি স্কলারদের নিয়ে বসা উচিৎ, শরিয়া কি বলে তা অনুসরণ করা উচিৎ।

আমরা বলতে চাই, সৌদি আরবের এই বিশাল ভূমিতে মাত্র এক কোটি মানুষ কেন? তাদের সঙ্গে আরো এক কোটি মানুষ আছেন প্রবাসী। সৌদি আরবে তো নির্দ্বিধায় দশ কোটি মানুষের জায়গা হয়।

তাহলে তারা মুসলিম বিশ্বের ব্রিলিয়ান্টদের এই সুযোগ করে দেয় না কেন, বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানীরা সেখানে যাক, ল্যাবরেটরি করে গবেষণা করুক। উদ্যেক্তারা যাক, সে দেশকে গড়ে তুলুক।

গত ২৫ বছরে অসংখ্যবার আমি সৌদি আরব গিয়েছি। হজ্ব-ওমরা ছাড়াও অনেক ইলমি সফরে যাওয়া হয়েছে। সেখানকার মানুষের ভালো গুণ বৈশিষ্ট্য যেমন আছে মানুষ হিসেবে তাদের ভুল-ত্রুটিও কম নয়।

দীর্ঘদিন থেকেই একটি আমূল পরিবর্তন দরকার মনে হচ্ছিল। মরহুম বাদশাহ আবদুল্লাহর সময়ে আমি রাষ্ট্রীয় সফরে সৌদি গিয়েছিলাম। সেখানে তিনি একটা বড় ইউনিভার্সিটি উদ্বোধন করেছিলেন, সেখানে মুসলিম বিশ্বের সরকার প্রধানরাও উপস্থিত ছিলেন।

সেখানে তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেটা ছিল একটা অসাধারণ চিন্তার উদ্দীপক।

তিনি বলেছিলেন, আমি চাই না মানুষকে ধবংস করার অস্ত্র পারমাণবিক বোমা তৈরি করা হোক, আমি চাই খাদ্য, চিকিৎসা, প্রযুক্তির উৎকর্ষ এই তিনটা জিনিস আমাদের দেশে এমন হোক যে দুনিয়ার মানুষ তাক লেগে যায়।

কৃষি বিপ্লব তিনি শুরু করেছেন। বিজ্ঞান গবেষণা শুরু করেছেন। আমার যদ্দুর মনে পড়ে, দক্ষিণ কোরিয়া অথবা জাপান থেকে নামকরা এক বিজ্ঞানীকে এ কাজে নিযুক্ত করছেন তিনি। জেদ্দার কিছু শহরে বিদেশীদের আসা যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

সৌদি আরবের যে কঠোর নীতি এর থেকে কিছু অঞ্চলকে মুক্ত করা হয়েছে।একটা মুসলিম রাষ্ট্রেও তো সমস্ত ধর্মের লোক তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে থাকার অধিকার রাখে।

আমাদের জন্য অনেক কিছু নিষেধ হতে পারে তাই বলে তাদের জন্য তো আর নিষেধ না। এ জন্য, ইসলামের যে বৈধ নীতিমালা তা সবাইকে দিতে হবে। নতুন যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের এই দর্শন ভালই। তবে, ইসরাইলের সাথে তার সম্পর্ক, তার বিশদ নীতিমালা এসব আমাদের কাছে স্পষ্ট না।

কিন্তু বিশ্বের পরাশক্তির সাথে তার কুটনৈতিক সম্পর্ক আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্সে যাওয়া এবং তার বুদ্ধিবৃত্তিক বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার আমি দেখেছি। সবকিছু বুঝতে সময় লাগবে।

উনি বলেছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যে কোম্পানিগুলো- আমাজন, আলিবাবা, এ্যাপল, মাইক্রোসফট, এই ৪ কোম্পানিকে কেনার মত বা এমন কোম্পানি তৈরির সাহস এবং পরিকল্পনা নিয়ে আমি এগুচ্ছি। আগামী ৩০ সালের পরে তেল যদি নাও থাকে সৌদি আরব কোমর সোজা করে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

বিনোদন তো মানুষের অন্য পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মতই একটি অধিকার। মানবতা, সামাজিক কিছু শেখা এগুলো তো নিষেধ নয়।

তবে মুসলমানের জন্য সৌদি মেধাবী দায়ীদের নেতৃত্বে সিনেমা হলে, নাটক চলচ্চিত্র নির্মাণ হলে বিশ্বের মানুষের জন্য আশা করার মত কিছু থাকতে পারে। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও গান-বাজনা ছাড়া ইসলামী ঐতিহ্য, ইতিহাস ও স্বর্ণযুগের গৌরবগাথা নিয়ে নতুন কিছু করলে তা সমর্থন করা যেতে পারে।

প্রচলিত সিনেমা, নাটক ও অপসংস্কৃতি সমর্থন যোগ্য নয়। যদিও এসব ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। সিনেমা হলের সংস্কৃতি যখন দুনিয়া থেকে উঠে যাচ্ছে তখন সৌদি আরবে নতুন করে তা চালু করার বিষয়টি বোঝে আসে না।

আওয়ার ইসলাম: আমরা আপনার বক্তব্য থেকে যা বুঝতে পেরেছি, যুবরাজের নতুন ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন এবং তারুণ্যের অগ্রযাত্রার মাইলফলক ভাবছেন। আপনার কি মনে হয় না এতে নৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয় ঘটবে?

উবায়দুর রহমান খান নদভী: এতে যদি সঠিকভাবে নেতৃত্ব দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে যদি মোটিভেশনাল স্পিরিট থাকে তবে আমার ধারণা, এতে করে নৈতিকতার বিপর্যয় ঘটবে না।

বরং মানুষ যদি অলস হয়, কর্মমুখী না হয়, গবেষণা না থাকে, শ্রম বা অভাববোধ না থাকে তবে মানুষ অধিক সম্পদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়, পথ হারায়। যা কিনা ধর্মীয় উপদেশ দিয়েও রক্ষা করা যায় না। তাকে আদর্শভিত্তিক ও আনন্দময় শ্রম, ব্যস্ততা বা পরিচ্ছন্ন বিনোদন দিতে হয়।

আওয়ার ইসলাম: উপমহাদেশের আলেমদের সাথে সৌদি আলেমদের সম্পর্ক খুব কম। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক করাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? সম্পর্ক না থাকলে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রক্রিয়া কী হতে পারে বলে মনে করেন?

উবায়দুর রহমান খান নদভী: সম্পর্ক রাখার জন্য আমাদের আলেমরা গত প্রায় ৯০ বছরই যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন। কিন্তু তারা হাত বাড়াননি। তাদের যতটুকু সম্পর্ক আছে তা বিভিন্ন বিতর্কিত দল সংগঠনের সাথে। যার মাধ্যমে লাভের তুলনায় ক্ষতিই হয়েছে বেশি।

আমি আশা করছি, আবেদন জানাচ্ছি, নতুন এই সংস্কারের ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানের সাথে তারা সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে। আমাদের যদি কোন ভুলত্রুটি থাকে তারা আমাদের সাথে বসুক, আলোচনা হোক এতে করে সমস্যার সমাধান হবে। তাদের ভুলত্রুটি বা বাড়াবাড়ি গুলিও উদার মনে সংশোধন করে নিতে হবে।

এটা তাদের দায়িত্ব, পথ তাদেরই খুলতে হবে। তারা যদি বলে থাকেন, আমরা যা বলবো তাই হবে, তাহলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। আর পৃথিবীর আলেম সমাজ মেনেও নেবে না।

কারণ, ইসলাম মক্কা মদিনায় জন্মগ্রহণ করেছে ঠিকই, কিন্তু ইসলামী চিন্তা ও জ্ঞানের বিকাশের জন্য মক্কা মদিনার মাটি শর্ত না।

তাহলে জ্ঞান কুফা, দামেষ্ক, বাগদাদ, কায়রো, বুখারা-সমরকন্দ, দেওবন্দ, নদওয়া ইত্যাদি কেন্দ্রে বিকশিত হতো না। বিশ্বব্যাপী ইসলাম বিরোধী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সৌদি আলেমদের সাথে সারা বিশ্বের সমন্বয় সাধনে আমরা সবসময় আন্তরিক।

আওয়ার ইসলাম পরিবারকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আপনাদেরও ধন্যবাদ।


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ