শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


আবু হানিফা রহ. ও তার অবদান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

Abu Hanifaজামিল আহমদ

যে মহামনীষীগণ ইসলামের বিধান সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে তা অন্যান্য মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার জন্য আজীবন আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন তন্মধ্যে ইমাম আবু হানিফা রহ. ছিলেন অন্যতম।

কুরআন হাদিস গবেষণা তথা ইজতিহাদের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাকে সমকালীন যুগে ফকীহদের সর্দার বলে গণ্য করা হত। এছাড়া তিনি ইরাকের কুফা নগরীর ‘মুফতী’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ইলমী ময়দানে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি হানাফী মাযহাবের প্রবর্তক। আজো তিনি ইমাম আজম নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন এবং প্রসিদ্ধ চার ইমামের মাঝে তাকেই শ্রেষ্ঠ ইমাম হিসেবে অভিহিত করা হয়।

নুমান ইবনে সাবিত ইবনে যূতি ইবনে মারযুবান (৬৯৯ — ৭৬৭ সালে ৮০ — ১৪৮হিজরী) উপনাম আবু হানিফা নামেই অত্যধিক পরিচিত, ছিলেন ফিকহশাস্ত্রের একজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ এবং হিজরী প্রথম শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব। ইসলামী ফিকহের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও প্রসিদ্ব চারটি মাযহাবের একটি “হানাফী মাযহাব”-এর প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি।

জন্ম, নাম ও বংশধর

ইমাম আবু হানিফা ইরাকের কুফায় ৫ সেপ্টেম্বর ৬৯৯ ইংরেজী মোতাবেক ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর আসল নাম নুমান ইবনে সাবেত ইবনে যূতি। আবু হানিফা তার কুনিয়্যাত বা ডাকনাম। পরবর্তী যুগে তিনি ইমাম আবু হানিফা নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। বিশ্ববাসী তাকে আবু হানিফা নামেই বেশী চেনে। (মুসলিম মণীষা, আবদুল মওদুদ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা)

উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের রাজত্বকালে ইমাম আবু হানিফা ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ছয় বছর বয়সে আবদুল মালিক মৃত্যুবরণ করেন। ষোল বছর বয়সে তিনি পিতার সাথে হজ্জে গিয়েছিলেন তার পিতা সাবিত বিন যুতা কাবুল, আফগানিস্তানের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তার পিতার বয়স যখন ৪০ বছর তখন আবু হানিফা জন্মগ্রহণ করেন। বংশধরের দিক থেকে তাকে অ-আরবীয় বলে ধরা হয়ে থাকে কারণ তার দাদার নামের শেষে যুতা। প্রখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ খতীবে বাগদাদী আবু হানিফার নাতি ইসমাইল বিন হামাদের বক্তব্য থেকে আবু হানিফার বংশ ব্যাখা দেন। অন্য আরেক ইতিহাসবিদ হামাদ আবু হানিফাকে পারসিক বংশ্বদ্ভূত বলে দাবি করেন। আবু হানিফার বংশ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য মত হলো তিনি কাবুলের পারসিক বংশদ্ভূত।

 শিক্ষা জীবনের সূচনা :

প্রথমত- ইমাম আবু হানিফা রহ. ‘কূফা’ শহরেই ইলমে কালাম ও ইলমে ফিকাহ শিক্ষা করেন। অতঃপর কূফার শীর্ষস্থানীয় ফিকাহ শাস্ত্রবিদ হাম্মাদ রহ.-এর নিকট জ্ঞান আহরণ করতে থাকেন। তিনি দীর্ঘ আঠারো বছর ইমাম হাম্মাদের একান্ত সান্নিধ্যে জ্ঞানার্জনে নিমগ্ন থাকেন। অতঃপর ১২০ হিজরীতে স্বীয় ওস্তাদ ইমাম হাম্মাদের যখন ইন্তেকাল হয়। এ সময় তিনি উস্তাদের স্হলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রে কুফার ‘মাদ্রাসাতুর রায়’-এর পূর্ণদায়িত্ব গ্রহণ করেন ৷ এরপর তিনি কুফা শহর থেকে সফর করে দীর্ঘ ছয়টি বছর মক্কা-মাদীনা অবস্থান করে সেখানকার সকল শায়খদের নিকট থেকে ইলম হাসিল করেন।

প্রাথমিক জীবন বা ব্যবসায়িক জীবন :

ইমাম আবু হানিফার রহ. প্রাথমিক জীবন কেমন ছিল এ বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ বেশীকিছু উদ্ধৃত করেননি। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী। ইমাম আবু হানিফার পৈত্রিক পেশা ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ইরান থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া ও হেজায পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলব্যপী বিপুল পরিমণ মুল্যবান রেশমী কাপড়ের আমদানী ও রফতানী হতো। পৈত্রিক এই ব্যবসার সুবাদেই তিনি প্রচুর বিত্তের মালিক ছিলেন। তৎকালীন বিশিষ্ট ওলামাগণের মধ্যে সম্ভবত তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি রাস্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা বা বিত্তবানদের হাদীয়া-তোহফা প্রাপ্তির পরোয়া না করে নিজ উপার্জনের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ, এলেমের সেবা এবং তাঁর নিকট সমবেত গরীব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার নির্বাহ করার ব্যবস্হা করতেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। পিতা ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী । তাঁর মৃত্যুর পর এই ব্যাবসার দায়িত্ব নিতে হয় যুবক ইমাম আবু হানিফাকে। (আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)।

তাঁর অসামান্য দক্ষতা ও নিষ্ঠায় ব্যাবসা প্রসারিত করার পাশাপাশি কাপড় তৈরির এক কারখানা স্থাপন করেন। যা কিছু দিনের মধ্যেই অনন্য হয়ে ওঠে। ব্যবসায় তার সততার পরিচয় পেয়ে দিগ্বিদিক থেকে লোকেরা তার দোকানে ভিড় জমাতেন। এভাবে তিনি জন মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত লাভ করলেন। ইমাম শাবী রহ. তাকে ইলমের ব্যাপারে উৎসাহিত করার আগ পর্যন্ত তিনি এ ব্যবসাকেই নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন। (উসুলুদ্দিন ইনদা আবি হানিফা, পৃষ্ঠা- ৬৬)

 ব্যবসা জীবন থেকে শিক্ষা জীবনে পদার্পণ :

কিশোর বয়স থেকেই ইমাম সাহেব পিতার ব্যবসার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ব্যবসায়ীক কাজেই তাঁকে বিভিন্ন বাজার ও বাণিজ্য কেন্দ্রে যাতায়াত করতে হতো। ঘটনাচক্রে একদিন ইমাম শাবীর রহ. সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়ে যায়। প্রথম দর্শনেই ইমাম শাবী আবু হনীফার নিষ্পাপ চেহারার মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ লক্ষ করেছিলেন।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে বৎস! তুমি কি কর? এ পথে তোমাকে সব সময় যাতায়াত করতে দেখি? ইমাম সাহেব জবাব দিলেন, আমি ব্যবসা করি। ব্যবসার দায়িত্ব পালনার্থেই ব্যবাসায়ীদের দোকানে দোকানে আমাকে যাওয়া-আসা করতে হয়। ইমাম শাবী রহ. পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এটা তো তোমার লেখাপড়ার বয়স। কোন আলেমের শিক্ষায়তনেও কি তোমার যাতায়াত আছে? আবু হানিফা সরলভাবেই জবাব দিলেন, সেরূপ সুযোগ আমার খুব কমই হয়। কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই ইমাম শাবী আবু হানিফাকে জ্ঞানার্জনে মনোযোগী হওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুললেন। ইমাম আবু হানিফা বলেন, ইমাম শাবীর রহ সেই আন্তরিকতাপূর্ণ উপদেশবাণী গুলো আমার অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করল এবং এরপর থেকেই আমি বিপনীকেন্দ্রগুলোতে আসা-যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা কেন্দ্রেও যাতায়াত শুরু করলাম। এ সময় আবু হানিফার রহ. বয়স ছিল উনিশ বা বিশ বছর।(আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম,ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)

হাদিসশাস্ত্রের শিক্ষা গ্রহণ :

ফিকাহ অধ্যায়নের এরপর তিনি হাদিস শিক্ষার জন্য তদানিন্তন হাদিস বেত্তাদের খিদমতে হাজির হন এবং শিক্ষা লাভ করেন। তখনও কোন প্রনিধান যোগ্য হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়নি। কোন একজন মুহাদ্দিস সকল হাদিসের হাফিজ ছিলেন না। প্রথমে তিনি কুফায় অবস্থানরত মুহাদ্দিসদের থেকে হাদিস শেখেন। এরপর তিন বসরা যান। সেখানে হজরত কাতাদাহ রহ.-এর খিদমতে হাজির হন এবং হাদিসের দরস হাসিল করেন। তারপর ইমাম আবু হানিফা রহ. হজরত শুবা রহ.-এর দরসে যোগ দেন। তাঁকে হাদিস শাস্ত্রে ‘আমিরুল মুমিনিন’ বলা হয়। কুফা ও বসরার পর ইমাম আবু হানিফা হারামাইন শরিফাইন এর দিকে দৃষ্টিপাত করেন । প্রথমে তিনি মক্কা গেলেন এবং সেখানে তিনি হাদিসবিদ হজরত আতা ইবনে আবু রিবাহ রহ. -এর দরবারে যান এবং দরসে শামিল হয়ে শিক্ষা অর্জন করেন। ১১৫ হিজরিতে আতা রহ. ইন্তেকাল করলে তিনি মক্কায় চলে আসেন এবং হজরত ইকরামা রহ. -এর কাছ থেকেও হাদিসের সনদ লাভ করেন। (আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)

ফিকাহশাস্ত্রে ইমাম আবু হানিফার রহ. অবদান :

যুক্তিবিদ্যাসহ অন্যান্য বিষয়ে অসাধারণ জ্ঞানে গুণান্বিত হওয়ার পাশাপাশি ইমাম আবু হানিফা রহ. ইসলামী শরীয়তের বিধিবিধানের উপর গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ইমাম শাবী রহ. -এর অনুপ্রেরণায় আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক তাওফিক প্রাপ্ত হওয়ার পর তিনি ফিক্বহের জগতে পদার্পন করেন। ইলমে দ্বীন শিক্ষার্জনের  মানসে বিভিন্ন মুহাদ্দিস ও ফকীহদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাদের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। ফিকহের উপর তার এত আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল যে, তিনি হাম্মাদ ইবনে আবি সুলায়মান রহ. এর সান্নিধ্যে সুদীর্ঘ্য ১৮ টি বছর ইলমে দ্বীন শিক্ষার্জনে কাটিয়ে দিয়েছিলেন। কুরআন হাদিস গবেষণা তথা ইজতিহাদের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তাকে সমকালীন যুগে ফকীহদের সর্দার বলে গণ্য করা হত। এছাড়া তিনি ইরাকের কুফা নগরীর ‘মুফতী’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ইলমী ময়দানে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি হানাফী মাযহাবের প্রবর্তক। আজো তিনি ইমাম আজম নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন এবং প্রসিদ্ধ চার ইমামের মাঝে তাঁকেই শ্রেষ্ঠ ইমাম হিসেবে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে ইরাক, চীন, ভারত, পাকিস্তান,বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ নিজেদের জীবনচলার পথে উদ্ভুত সমস্যার সমাধানে ইসলামের দিকনির্দেশনা হিসেবে তার মাজহাবকে মেনে চলেন।এমনকি উসমানী সাম্রাজ্যের অন্তর্গত এলাকাসমুহে আবু হানিফা রহ.-এর মাজহাবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে রাষ্ট্রে প্রয়োগ করা হত। (উসুলুদ্দিন ইনদা আবি হানিফা-৯৯)

মাম আবু হানিফা রহ. একজন তাবেয়ী ছিলেন :

মূলত সাহাবী আনাস ইবনে মালিক রা. -এর সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার কারনে ইমাম আবু হানিফাকে রহ. তাবেয়ী বলা হয়ে থাকে। তখন পৃথিবীতে অনেক সাহাবী জীবিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আল হারিছ রা. [মৃত্যু: ৮৫ হিজরি] হজরত ওয়াছিলা ইবনে আল আস কাআ রা. [মৃত্যু: ৯১ হিজরি] হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবি আওফা রা. [মৃত্যু: ৮৫ হিজরি]; হজরত সাআল ইবনে সায়াদ রা. [মৃত্যু: ৯১ হিজরি] হজরত আনাস ইবনে মালিক রা. [মৃত্যু: ৯৩ হিজরি] হজরত মাহমুদ ইবনে লবিদ আল আশহালি রা. [মৃত্যু: ৯৬ হিজরি] হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ইউছর আল মাজানী রা. [মৃত্যু: ৯৬ হিজরি] হজরত মাহমুদ ইবনে আরবাবি আল আনসারী রা.[মৃত্যু: ৯৯ হিজরি] হজরত আল হারমাম ইবনে জিয়াদ আল বাহিলী রা. [মৃত্যু: ১০২ হিজরি] এবং হজরত আবু আল তোফায়েল আমীর ইবনে ওয়াছিলা আল কিনানী রা. [মৃত্যু: ১০২ হিজরি] ওয়াসেনা ইবনুল আসকা রা. (ওফাত ৮৫ হিজরী)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ইমাম আবু হানিফা রহ. এদের সকলের না হলেও সাত জনের সাক্ষাত লাভ করেছিলেন এবং তিন জনের কাছে থেকে ইলমে দাহিসের দরস হাসিল করেছিলেন সুতরাং তিনি তাবেয়ী। (আল ফিকহুল আকবার, ভূমিকা, ইমাম আবু হানিফার জীবন ও কর্ম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন)

ফাতাওয়ার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার র অনুসৃত নীতি:

যে কোন সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফার রহ অনুসৃত নীতি ছিল, প্রথমে কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া। কুরআনের পর হাদিস শরীফের আশ্রয় গ্রহণ করা। হাদিসের পর সাহাবায়ে কেরাম গৃহীত নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া। উপরোক্ত তিনটি উৎসের মধ্যে সরাসরি সামাধান পাওয়া না গেলে তিনটি উৎসের আলোকে বিচার-বুদ্ধির (কেয়াসের) প্রয়োগ করা। তাঁর সুস্পস্ট বক্তব্য ছিল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কোন ধরনের হাদিস বা সাহাবীগণের অভিমতের সাথে যদি আমার কোন বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক মনে হয়, তবে আমার বক্তব্য অবশ্য পরিত্যাজ্য হবে। হাদিস এবং আছারে সাহাবা দ্বারা যা প্রমাণিত সেটাই আমার মাযহাব। (তাফসীরে মাযহারী, খায়রাতুল-হেসান)

ইমাম ইবনে হাযম রহ. বলেন, আবু হানীফার রঃ সকল ছাত্রই এ ব্যাপারে একমত যে, নিতান্ত দূর্বল সনদযুক্ত একখানা হাদিসও তাঁর নিকট কেয়াসের তুলনায় অনেক বেশী মুল্যবান দলিলরূপে বিবেচিত হবে। (খায়রাতুল-হেসান) সম্ভবতঃ এ কারণেই পরবর্তী যুগে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যে সব কালজয়ী প্রতিভার জন্ম হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশ ইমাম আবু হানীফার রহ. মাযহাব অনুসরণ করেছেন। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী রঃ বক্তব্য হচ্ছে- এই ফকীরের উপর প্রকাশিত হয়েছে যে, এলমে-কালামের বিতর্কিত বিষয়গুলি মধ্যে হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং ফেকাহর বিতর্কিত মাসআলাগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক হানাফী মাযহাবের দিকে এবং খুব কম সংখ্যক মাসআলাই সন্দেহযুক্ত। (মাবদা ও মাআদ)
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী রহ. হারামাইন শরীফে কাশফ যুগে যে সব তথ্য অবগত হয়েছেন, সে সবের আলোকে লিখেছেন- হযরত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আমাকে অবগত করেছেনযে, হানাফী মাযহাব একটি সর্বোত্তম তরিকা। ইমাম বুখারীর সময়ে যেসব হাদিস সংকলিত হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় আবু হানীফার রহ. সিদ্ধান্তগুলি সুন্নতে-নববীর সাথে অনেক বেশী সামন্জস্যপূর্ণ। (ফুযুলুল-হারামাইন)

সুতরাং যারা এ কথা বলতে চায় যে, হানাফী মাযহাব সহীহ হাদীসের সাথে সামন্জস্যপূর্ণ নয় বা ইমাম আবু হানীফা রঃ বহু ক্ষেত্রে হাদিসের প্রতিকূলে অবস্হান গ্রহণ করেছেন, তাদের বক্তব্য যে নিতান্তই উদ্ভট তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বরং হানাফী মাযহাব হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর এমন এক যুক্তিগ্রাহ্য ও সুবিন্যস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যা সর্বযুগের মানুষের নিকটই সমভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।

শিক্ষাদান পদ্ধতি:

সে জামানার দরসের হালকা বা শিক্ষাঙ্গনের চিত্র ছিল, উস্তাদ কোন একটি উচ্চ আসনে বসে তকরীর করতেন। ছাত্রগণ চারদিকে হাঁটু গেড়ে বসে নিতান্ত নিবিষ্টতার সাথে তকরীর শ্রবণ করতেন। অনেকেই তকরীর শুনে তা আয়ত্ব করার পাশাপাশি লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এসব তকরীর উস্তাদ কর্তৃক অনুমোদিত হলে যিনি তকরীর করতেন তাঁর নামেই সেগুলো গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হতো। হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দির সংকলিত হয়েছে। ইমাম আবু হানীফার রঃ শিক্ষাদান কার্যক্রমেও সে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হতো। কোন কোন মাসআলায় তর্ক শুরু হয়ে যেত। সে তর্ক কয়েকদিন পর্যন্তও চলতো। শেষ পর্যন্ত কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে যা সাব্যস্ত হতো সেটাই লিপিবদ্ধ হতো। কোন কোন মাসআলায় উস্তাদ ও সাগরেতের মধ্যকার মতভেদ অমীমাংসিতই থেকে যেত। সেই মত পার্থক্যগুলিও স্ব স্ব যুক্তি সহকারেই কিতাব লিপিবদ্ধ করা হতো। এভাবেই হানাফী মাযহাবের মৌলিক গ্রন্হগুলি সংকলিত হয়েছে।

ইমাম সাহেবের দরসগাহ সপ্তাহে দুইদিন ছুটি থাকতো। শুক্রবার ও শনিবার। শনিবার দিনটি তিনি ব্যবসায়িক কাজকর্ম এবং পারিবারিক ব্যস্ততার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখতেন। শুক্রবার দিন জুমার প্রস্তুতি এবং জুমাবাদ তার বাসস্হানে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনেরা সমবেত হতেন। এ দিন বিশেষ যত্নের সাথে অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের খানা প্রস্তুত হতো। ইমাম সাহেব সমবেত সবাইকে নিয়ে খানা খেতেন। কর্মদিবস গুলিতে তিনি এশরাক থেকে চাশতের সময় পর্যন্ত ব্যবসায়িক কাজকর্ম করতেন। জোহরের পর থেকে সন্ধা পর্যন্ত শিক্ষাদান কার্যে নিয়োজিত থাকতেন। ফতোয়া দানের জন্যও এ সময়টাই নির্ধারিত ছিল। তবে অবস্হা ভেদে এ সময়সূচীর মধ্যে পরিবর্তনও হতো। দরসের মজলিসে শিক্ষার্থীগণের সাথে অনেক সাধারণ লোকও শরীক হতেন। তর্কচ্ছলে অনেকে আপত্তিকর মন্তব্যও করত। কিন্তু কারো প্রতি বিরক্তি প্রকাশ না করে পরম ধৈর্যের সাথে জবাব দিতেন। চরম ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনের মোকাবেলাতেও তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটত না। প্রায সময়ই তিনি একটা কবিতাংশ আবৃত্তি করতেন। যা অর্থ ছিলো- ইয়া আল্লাহ ! যাদের অন্তর আমাদের দিক থেকে সংকুচিত হয়ে আছে, আমাদের অন্তর তাদের প্রতি প্রশস্ত করে দাও। (আবু যোহরা)

মুসলিম-বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানতৃষ্ঞা মিটানোর লক্ষ্যে সমবেত শিক্ষার্থীগণের বিচারেও ইমাম আবু হানীফা রঃ ছিলেন তাবেয়ীগণের মধ্যে কুরআন-হাদীস এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং তাকওয়া পরহেজগারীতে অনন্য ব্যক্তিত্ব। ইমাম সাহেবের অনুপম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বদৌলতে সে যুগে এমন কিছু সংখ্যক উজ্জল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁরা মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আকাশে এক একজন জ্যোতিষ্ক হয়ে রয়েছেন। ইমাম সাহেবের সরাসরি সাগরেদগণের মধ্যে ২৮ ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে কাজী (বিচারক) এবং শতাধীক ব্যক্তি মুফতীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসালামের ইতিহাসে এক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এত বিপুল সংখ্যক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির আবির্ভাব আর কোথাও দেখা যায় না।

 কাজীর পদ প্রত্যাখান

৭৬৩ আব্বাসীয় বংশের আল-মনসুর আবু হানিফাকে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেন কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তার পরীবর্তে তার ছাত্র আবু ইউসুফকে প্রধান বিচারপতির দ্বায়িত দেওয়া হয়। প্রস্তাব প্রত্যাখানের ব্যাপারে আবু ইউসুফ আল মনসুরকে ব্যাখা দেন তিনি নিজেকে এই পদের জন্য উপযুক্ত মনে করছেন না। আল-মনসুরের এই পদ প্রস্তাব দেওয়ার পেছেনে তার নিজস্ব কারণ ছিল, আবু হানিফা প্রস্তাব প্রত্যাখান করার পর মনসুর তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। এই অভিযোগের ব্যাখ্যায় আবু হানিফা বলেন, “আমি যদি মিথ্যাবাদী হই তাহলে প্রস্তাব প্রত্যাখান করার ব্যাপারে আমার মতামত সঠিক, কারণ কিভাবে আপনি প্রধান বিচারপতির পদে একজন মিথ্যাবাদিকে বসাবেন।” এই ব্যাখার উত্তরে আল-মনসুর আবু হানিফাকে গ্রেফতার করেন ও তাকে নির্যাতন করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। এমনকি বিচারকরা সিদ্ধান্ত নিতেন কে তার সাথে দেখা করতে পারবে।

 ইন্তেকাল

১৫ রজব ১৫০ হিজরি ৭৬৭ খ্রিস্তাব্দে তিনি কারাগারে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদের কাজী হাসান ইবনে আম্মারাহ তাঁর গোসল দেন ও কাফন পরান। জোহরের পর তাঁর প্রথম নামাজে জানাজাহ অনুষ্ঠিত হয়। অগণিত লোক এতে শরিক হয়। পড়ে আসর পর্যন্ত আরও ছয় বার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় এবং আসরের নামাজের পর তাঁর অয়াসিয়ত অনুযায়ী খায়জরান কবরস্থানে দাফন করা হয়। দাফনের পর ২০ দিন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত মানুষ কবরে তাঁর জানাজার নামাজ আদায় করেন। তার মৃত্যুর কারণ পরিষ্কার নয়। কেউ কেউ বলেন আবু হানিফা আল মনসুরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের চেষ্ঠা করেন এ জন্য তাকে জেলখানর ভেতর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। পরবর্তীতে, অনেক বছর পর বাগদাদের পাশে আধামিয়াতে আবু হানিফ মসজিদ নামে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয় আবু হানিফার নামে।

রচনাবলী ২০টি প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো- ১. আল-ফিকাহুল আকবর। ২. আল-ফিকাহুল আবসাত। ৩. কিতাব আল আলিম অয়াল মুতাআল্লিম। ৪. আল-অসিয়া। ৫. আর-রিসালা। ৬. মুসনাদ আবু হানিফা। ৭. অসিয়া ইলা ইবনিহি হাম্মাদ। ৮. অসিয়া ইলা তিল মিজিহি ইউসুফ ইবনে খালিদ। ৯. অসিয়া ইলা তিল মিজিহি আল কাজী আবি ইউসুফ। ১০. রিসালা ইলা উসমান আল বাত্তি। ১১. আল কাসিদা আল কাফিয়া (আননুমানিয়া)। ১২. মুজাদালা লি আহাদিদ দাহ রিন। ১৩. মারিফাতুল মাজাহিব। ১৪. আল জাওয়াবিত আস সালাসা। ১৫. রিসালা ফিল ফারাইয। ১৬. দুআউ আবি হানিফা। ১৭. মুখাতাবাতু আবি হানিফা মাআ জাফর ইবনে মুহাম্মদ। ১৮. বাআজ ফতোয়া আবি হানিফা। ১৯. কিতাবের মাক সুদ ফিস সারফ। ২০. কিতাবু মাখারিজ ফিল হিয়াল।

ইমাম আবু হানিফা-রহ. এর মর্যাদা সম্পর্কে মনীষীদের অভিমত:

ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর প্রশংসা নিয়ে জগৎবিখ্যাত ওলামায়ে কেরামদের বেশকিছু বক্তব্য পাওয়া যায়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের বক্তব্য উল্লেখ করা হলো- ১. ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেছেন, ফিক্বহের ব্যাপারে মানবজাতি ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর পরিবারভুক্ত। ২. ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন রহ. বলেন, তিনি হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ ব্যক্তি ছিলেন; আমি কাউকে শুনিনি তাকে দুর্বল বলতে। ৩. আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন, তিনি ইলম, তাকওয়া, যুহদ ও আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেয়ায় ছিলেন অতুলনীয়। ৪. তার ইন্তিকালের সংবাদ শুনে শুবা ইবনে হাজ্জাজ আল আতকী রহ. বলেন, ইমাম আবু হানিফা রহ. -এর সাথে কুফার ফিক্বহ চলে গেল। আল্লাহ তায়ালা তার এবং আমাদের উপর রহমত করুন। ৫. ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, যদিও কিছু বিষয়ে লোকেরা ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর বিরোধিতা করে থাকে এবং তার সিদ্ধান্ত দেয়া বিষয়গুলোকে প্রত্যাখ্যান করে তবে, কেউ কখনো তার জ্ঞান-গরিমা, বুঝ শক্তি নিয়ে সন্দেহ করেনি।

 -এআরকে


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ