বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিরোনাম :

সৌভাগ্য-সান্নিধ্য এবং ‘একুশে’ ভ্রমণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
মুহাদ্দিস, ইমাম, প্রাবন্ধিক

rashidul_hakপ্রিয় নবিজী সা. এর ভাষ্য মতে প্রতিটি সফর আগুনের একেকটি টুকরো। আপনি ভ্রমণ করছেন তো সেটি আপনার পিছু পিছু আছে। নবিজী সা. এই বাণী মূলত সফরের কষ্ট-ক্লেশ উপলব্ধির একটি চমৎকার উপমা। অন্য দিকে ভ্রমণ আপনার অভিজ্ঞতার বাহন। মহান রব্বুল আলামীন নিজ বান্দাদেরকে এই বাহনে চড়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। আর কষ্টের দিকে লক্ষ করে হ্রাস করে দিয়েছেন অনেক বিধান। ভ্রমণকে যদি একটি নিত্তির সাথে তুলনা করা হয় আর সেটির এক পাল্লায় কষ্ট এবং অন্য পাল্লায় অভিজ্ঞতা রাখা হয়, তাহলে জ্ঞনীরা অভিজ্ঞতার পাল্লাটাকেই ভারি দেখতে পাবেন। ভ্রমণলব্ধ অভিজ্ঞতা কষ্টের স্মৃতিকে ম্লান করে দেয়। আর যদি সেই সফর হয় দিনি, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। বলা ভালো, ‘নুরুন আলা নুর’।

কৈশরের তিনটি বছর কেটেছে শিল্পনগরী খুলনায়। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে খুলনার সাথে। ইচ্ছের অনেক অনেক ঘুড়ি ওড়াওড়ি করলেও বাধ্য হয়েই লাটায়ের সূতো ঢিল করা হয় না অনেকটা বাধ্য হয়েই। চারিদিকের জালগুলো ছিঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগটুকু হয়ে ওঠে না। এবারের ২১ ফ্রেরুয়ারি ছিলো আমার জন্য ‘মাগনামে বারেদা’ বা অনায়াস লব্ধ এক পরম পাওয়ার দিন। ওই দিন খুলানায় একটি সম্মেলন ছিলো। সৌদি আরব, মালোয়েশিয়া, ভারতসহ নানা দেশের মেহমান সেখানে অংশগ্রহণ করেছেন। বক্তৃত করেছেন। দক্ষিণবঙ্গের প্রখ্যাত ফকীহ মুফতি গোলাম রহমান সাহেব দা. বা. প্রতিষ্ঠিত জামেয়া ইসলামিয়া মারকাজুল উলুমের উদ্যোগে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। বেফাকের নবনির্বাচিত মহাসচিব ফরিদাবাদ মাদ্রসার মুহতামিম ও শাইখুল হাদিস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস সাহেব দা. বা.ও ছিলেন ওই সম্মেলনের অন্যতম বিশেষ অতিথি। তাঁর সফর সঙ্গী হিসেবে মুফতি মানজুর হাসান যুবায়ের এবং আমার খুলনা সফরের সৌভাগ্য হয়।

বেফাকের মহাসচিবের দায়িত্ব লাভের পর এই প্রথম হজরতের খুলনা সফর। পদ্মার ওপারের উলামায়ে কেরাম তাই তাকে বরণের জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন। পদ্মার ওপারের সাথে আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের এটি ইতিহাস আছে উস্তাদে মুহতারামের। তার প্রথম জীবনের শিক্ষকতার একটি সময় কেটেছে যশোরর বিখ্যাত মাদ্রাসায়। যশোরের রেলওয়ে স্টেশন মাদ্রসায় তিনি ১৯৭৮ সাথে শিক্ষকতা করেন। তখন দক্ষিণবঙ্গের বিখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা আবুল হাসান সাহেব রহ. ওই মাদ্রাসায় ছিলেন। রেলওয়ে স্টেশন মাদ্রসাসহ বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা আবেদন করলেও সময় সল্পতার দরুন যশোরের মাত্র দু’টি মাদরসায় মাননীয় মহাসচিব সাহেব যাত্রা বিরতীর সিদ্ধন্ত নেন। আগ্রহীদেরকে সেখানে অংশ নেওয়ার পরাপর্শ দেওয়া হয়। এভাবে মূল প্রোগ্রামের সাথে সাথে খুলনাতেও আরো দু’টি প্রোগ্রাম করার সিদ্ধান্ত হয়।

khulna6

এয়ার লাইন্সের ভাষায় সকাল ৮টা ১০ মিনিটে ‘ডোর ক্লোজ’। আমি ফজরের নামাজ আদায় করে বিমানবন্দেরের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। রাতে এগিয়ে থাকায় সকাল ৭টার মধ্যেই হজরত শাহজালাল আন্তর্জতিক বিমন বন্দরের আভ্যন্তরীণ টার্মিনালে পৌঁছলাম। মোবাইল ডিভাইসে থাকা টিকেট প্রিণ্ট করিয়ে নিয়ে বড়দের অপেক্ষায়। ফোনে জানতে পারলোম মুফতি যুবায়ের ভাই মহাসচিব সাহেবকে নিয়ে ইতিমধ্যে রওনা হয়ে গিয়েছেন। ‘বিতাকাতুস সুউদ’ বা ‘বোয়াডিংপাস’ নেব সবাই আসার পর। অপেক্ষায় সোনা ফললো। হজরতওয়ালা ফরিদাবাদ আসার আগেই দারুল উলুম দেওবন্দের ৩৪ বছরের প্রবীণ উস্তাদ মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন দা. বা. এর দর্শনলাভে ধন্য হলাম। জানলাম তিনিও অভিন্ন ফ্লাইটে যাচ্ছেন। আমি যেন তার অভ্যর্থনার জন্য পূর্ব থেকেই অপেক্ষা করছি। তার সফরসঙ্গী কাজ সুরাহা করতে না পারায় ‘সুউদ’পূর্ব কাগজপত্র সামলানোর খেদমতের সুযোগ মিলল আমারই। মহাসচিব সাহেব আসার আগেই এসব শেষ। উস্তাদে মুহতারাম এলেন।

যথা সময়ে জহাজ কেবিনে পৌঁছলাম আমরা। উড্ডয়নমুহূর্তে প্রায় নির্লিপ্ত সবাই। কেউ কেউ বাহির দেখছে। আমার দৃষ্টি উস্তাদের মুহতারামের প্রতি। তর্জনী, মধ্যমা, অনামিকা ও কনিষ্ঠায় চলমান বৃদ্ধাআঙ্গুলির সাথে সাথে তাঁর পবিত্র ঠোঁটযুগল নড়ছে। ভাবলাম, চলার পথে কিম্বা যানজটে নগরবাসীর অগনিত শ্রমঘণ্টা অবলিলায় ক্ষয়ে যায়। অথচ ইচ্ছা করলেই নষ্ট সময়গুলো মূল্যবান থেকে মহামূল্যবান করে তোলা যায়। শুধু জিহবা নেড়েই ওপারের সঞ্চয়-খাতের ‘ডিপজিট’ বাড়ানো যায়।

দারুল উলুম দেওবন্দের ৩৪ বছরের প্রবীণ উস্তাদ মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন দা. বা. এর দর্শনলাভে ধন্য হলাম। জানলাম তিনিও অভিন্ন ফ্লাইটে যাচ্ছেন। আমি যেন তার অভ্যর্থনার জন্য পূর্ব থেকেই অপেক্ষা করছি

যশোর বিমান বন্দরে যখন পৌঁছি তখন নয়টার কাঁটা ছুঁই ছুঁই করছিলো। জালানা দিয়েই যতটুকু দেখলাম তাতে বুঝলাম, অভ্যর্থনায় আগত উলামায়ে কেরামের সংখ্যা বেশ। সিঁড়ি ভেঙে নেমে যখন বহির্গমন ফটকে পৌঁছলাম তখন আমি রীতিমত অভিভূত। খুলনা ও যশোরের উল্লেখযোগ্য উলমায়ে কেরাম অভ্যর্থনায় এসেছেন। খুলনা দারুল উলুমের শাইখুল হাদিস সাহেব এবং রেলওয়য়ে স্টেশন মাদরাসার মুহতামিম সাহেব তাদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এরপর সোজা রেলওয়য়ে স্টেশন মাদরাসায়।

যশোরের বিপুল সংখ্যক আলেম-উলামা সেখানে আগ থেকেই অপেক্ষমান ছিলেন। সৌজন্য সাক্ষতের পর সমবেত উলামায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে প্রথমে কথা বলেন শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর সাহেবজাদা জামেয়া রহমানিয়া ঢাকার মুহতামিম ও বেফাকের যুগ্নসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক সাহেব দা. বা.। তিনি বেফাক সৃষ্টির পেক্ষাপট এবং বেফাকের অতীত, বর্তমান এবং ক্রমাগত অগ্রগতি নিয়ে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। এরপর আলোচনা শুরু করলেন বেফাকের মহাসচিব শাইখুল হাদিস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস সাহেব দা. বা.। তিনি কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতি ইস্যুর সর্বশেষ অবস্থা এবং দাওয়াত ও তাবলীগের ব্যাপারে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের সর্বশেষ অবস্থান ও কর্মপন্থা নিয়ে সংক্ষেপে অতন্ত সারগর্ভ ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। এরপর দোয়ার মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

খুলনার পথে যাত্রা বিরতী হয় মুফতী ওয়াক্কাস সাহেব দা. বা. প্রতিষ্ঠিত মাদানী নাগর মাদ্রাসায়। সেখানে বয়ান হয় ছাত্রদেরকে কেন্দ্র করে। মাওলনা মাহফুজুল হক সাহেব দা. বা. দেওবন্দিয়ত ও উপমহাদেশে এর দিনি প্রভাব নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন। আল্লামা আবদুল কুদ্দুস সাহেব দা. বা. তালিবুল ইলমদের ইলমী উন্নতি সাধনে করণীয় বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংক্ষিপ্ত বয়ান করেন এবং দোয়ার মাধ্যমে তা সমাপ্ত করেন। মাদানী নগর মাদ্রসাটি যশোরের মনিরামপুর অঞ্চলে অবস্থিত। অজোপাড়াগায়ে বিপুল সংখ্যক ছাত্রের উপস্থিতির পাশাপাশি বালিকা শাখায় ছাত্রী সংখ্যা বালক শাখার প্রায় দ্বিগুণ। বিষয়টি ছিলো রীতি মতো অবাক করার মতো।

khulna7এবার গন্তব্য সোজা দারুল উলুম খুলনা। আল্লাহর তৌফিকে উদ্দেশ্যে মতো জোহরের আগেই সেখানো পৌঁছা গেল। মুহতামিম সাহেব মাওলানা মুশতাক আহমাদ সাহেব দা. বা. এর উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং রুচিশীল আতিথ্য হৃদয়ে দাগ কাটার মতো। তিনি এবং তাঁর সহোদর বুখারী শরীফের উস্তাদ মাওলনা শিব্বির আহমাদ সাহেব দা. বা. নিজেই মেহমানদের খেদমতে নিয়েজিত ছিলেন প্রায় সারাক্ষণ। বাদ আসর খুলনা, সাতক্ষীরা ও আশ-পাশের উলামায়ে কেরামের আগমনে খুলনা দারুল উলুম ভারি হয়ে ওঠে। মাগরীবের আজান পর্যন্ত বেফাকের মহাসাচিব সাহেব এবং যুগ্নসচিব সাহেব তাদের সাথে মতবিনিময় করেন এবং দক্ষিণাঞ্চলের কওমী শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে তাদের নানা আলোচনা করেন। তারা নানা ধরনের সমস্যার কথা তুলে ধরলে সেগুলো সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে আলোচনার আশ্বাস দেন মহাসচিব মহোদয়। এরপর বাদ মাগরীব ছাত্রদের উদ্দেশ্যে খুব সংক্ষিপ্ত বয়ান করে দোয়ার মাধ্যমে তা শেষ হয়।

মোহাম্মাদ নগর মাদ্রসায় প্রতি মাসে মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। আল্লামা আবদুল কুদ্দুস সাহেব দা. বা. এর আগমন উপলক্ষে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ওই মাসিক ইজমার তারিখ নির্ধারণ করেন। হজরত সেখানেও বেশ কিছু সময় বয়ান করেন এবং অবশেষে গিয়ে পৌঁছেন জামেয়া ইসলামিয়া মারকাজুল উলুমে। সেখানে অবস্থান করছিলেন আওলাদে রাসুল সা. হজর হুসইন রা. এর বিয়াল্লিশতম উত্তরসূরী নাসির বিল্লাহ মক্কী দা. বা. এর। মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম মুফতি গোলাম রহমান সাহেব দা. বা. ও নায়েবে মুহতামিম মুফতি আবদুল্লাহ ইয়াহইয়া দা. বা. মেহমানবৃন্দকে অভ্যর্থনা জানান। আওলাদে রাসুল সা. এর সাথে মহাসচিব সাহেব সংক্ষিপ্ত সাক্ষাত কারেন। স্বল্প সময়ের আলাপচারিতায় ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় আসার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। তাঁর সাথেই ইশার সাথে সাথে ‘আশা’র ব্যবস্থা হয়। একেবারে আরব্য দস্তরখান বলেই মনে হচ্ছিলো।

জামেয়া ইসলামিয়া মারকাজুল উলুমের ফারেগীন ছাত্রদের দস্তারে ফজিলত প্রদানের উদ্দেশ্যে আয়োজিত মাহফিলে তখন চলছে দেশ-বিদেশের মেহমানবৃন্দের আলোচনা ও তরজমা। মাননীয় মহাসচিব সাহেব মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার পর শুরু হয় দস্তারে ফজিলত প্রদানের পালা। এরপর তিনি সংক্ষিপ্ত বয়ান করেন। মানুষের প্রতি মহান আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ এবং তার নাফারমানী থেকে বান্দার বিরত থাকা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। জবান ও লজ্জাস্থান হেফাজত বিষয়ক একটি হাদিসকে কেন্দ্র করে তিনি নিজের বয়ান উপস্থাপন করেন।

খুলনা দারুল উলুমে রাত্রি যাপন করে বাদ ফজর হালকা নাস্তা সেরে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় কাফেলা। সকাল সাড়ে ন’টার ফ্লাইটে যশোরের মাটি ত্যাগ করে কাফেলা। ফিরতি ফ্লাইটে বসার সৌভাগ্য হয় দারুল দেওবন্দের প্রবীণ উস্তাদ মাওলনা হেমায়েদ উদ্দিন সাহেবের পাশে। সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি অত্যন্ত স্নেহসুলভ আচরণে আমার পরিচয় জেনে নেন। এক পর্যায়ে তিনি জানান দারুল উলুমের আগে তিনি দীর্ঘ দিন হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহ. এর কামরায় ছিলেন। সেখানকার কিছু স্মৃতির কথাও তুলে ধরেন তিনি। এভাবেই মুহূর্তে শেষ হয়ে যায় আধাঘণ্টার আকাশ ভ্রমণ। সকাল দশটায় আমরা ঢাকার মাটি স্পর্শ করি। সফরের অনেক কিছুই হয়তো চলে এসেছে লেখায়। কিন্তু একান্তু কিছু বিষয় রয়ে গেছে একেবারে নিজের করে । সেগুলো একান্তই নিজের সম্পদ। থাক না একান্ত হয়েই।

আরআর

লেখক প্রকাশক ও সম্পাদকদের মিলনমেলা

ইমাম ইবনে তাইমিয়া কে ছিলেন?


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ