শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


কোন ফাঁদে আটকে গেল কওমি স্বীকৃতি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

Rokonরোকন রাইয়ান

নির্বাহী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম

কওমি সনদের স্বীকৃতি। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করেই তুমুল আলোচনায় এসেছিল। তারপর বছরের শেষে এসে থমকে গেছে। থেমে গেছে সব রকম দেন দরবার। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির পুরোটা জুড়ে এ নিয়ে কোনো আলোচনা বা বক্তৃতা বিবৃতি কিছুই হয়নি। ফলে বহুসংখ্যক ছাত্রকে আশান্বিত করা বিষয়টি আবারও আশাভঙ্গে পরিণত করেছে। অথচ ওই সময় সবগুলো পত্রিকায় নিউজ হযেছিল স্বীকৃতি হচ্ছে চলতি বছরেই।

যদিও আশাহত হওয়ার বিষয়টি নতুন নয়। গত এক যুগ ধরেই এমনটা হয়ে আসছে। স্বীকৃতির আলোচনা উঠলেই নানারকম কথা চারপাশ থেকে উঠতে থাকে। আবার দপ করে নিভেও যায়। একপক্ষ আলোচনা তুললে আরেকপক্ষ শুরু করে বিরোধিতা। আবার আলোচনা শুরুকারীরা থেমে গেলে বিরোধী পক্ষও থেমে যায়। ফলে সাপলুডুর মতো এই আলোচনা ওঠানামাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

কওমি স্বীকৃতির চলতি আলোচনা শুরু হয়েছিল গত বছরের আগস্টে। মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সংগৃহিত লক্ষ আলেমের ফতোয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তরের এক অনুষ্ঠান থেকে। সে অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন আপনারা এক হয়ে আসুন, কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি হবে।

মূলত প্রধানমন্ত্রীর সে আহ্বানের পর পরই বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। বিষয়টি একসময় সবার দাবি হয়ে ওঠায় বেফাকুল মাদারিস ও দেশের শীর্ষ পর্যায়ের আলেমদের সম্পৃক্ততা জরুরি হয়ে পড়ে। এর মধ্যে হয়ে গেছে নানান আলোচনা, চিন্তা ফিকির।

দেশের অধিকাংশ কওমি মাদরাসা ও আলেমের দাবি ছিল স্বীকৃতির এ নেতৃত্ব থাকুক বেফাকের চেয়ারম্যান সর্বজন শ্রদ্ধেয় আল্লামা শাহ আহমদ শফীর হাতে। বিষয়টি নিয়ে মাঝখানে অনেক জলঘোলা হলেও শেষ পর্যন্ত ১০ ডিসেম্বর একটি সর্বদলীয় বৈঠক হয় দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায়। আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে সে বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসেন সবাই। বৈঠকে দুটি কমিটিও হয়েছিল স্বীকৃতির আন্দোলনকে নিষ্কণ্টকভাবে এগিয়ে নিতে। স্বীকৃতির জন্য ঐক্যবদ্ধ এগিয়ে যাওয়াকে স্বাগত জানায় কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীরা।

বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো হলো- ১. কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি দারুল উলুম দেওবন্দের আদলে শুধুমাত্র দাওরায়ে হাদিসকে এমএ’র মান নেয়া। ২. সম্মিলিত কাজ ও স্বীকৃতির জন্য ‘কওমি মাদরাসার সনদের মান বাস্তবায়ন কমিটি’ নামে ২২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন। ৩. সরকারের সঙ্গে লিয়াজোঁ করার জন্য ৫ সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়।

সরকারের সঙ্গে লিয়াজোঁর অংশ হিসেবে ২৩ নভেম্বর বুধবার সন্ধ্যায় গণভবনে বেফাকের একটি প্রতিনিধি দল আল্লামা আহমদ শফীর চিঠি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।

 বৈঠকে বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আশরাফ আলীর নেতৃত্বে ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, সহ-সভাপতি মাওলানা সাজিদুর রহমান, মাওলানা নূরুল ইসলাম, যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, মুফতি নুরুল আমিন, মাওলানা আনাস মাদানী, মাওলানা মুনির আহমদ ও মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম।

বৈঠকে মাওলানা আনাস মাদানী প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিটি পড়ে শোনালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, স্বীকৃতি আল্লামা আহমদ শফীর মাধ্যমেই হবে। আমরা সবাই তার নেতৃত্বে এক হয়ে আসুন।

প্রধানমন্ত্রীর এমন আশ্বাসের পরও কাজের গতি কেন থমকে গেল এ বিষয়ে জল্পনা কল্পনা চলছে জনমনে। এমনকি সম্মিলিত বৈঠকে তিন সিদ্ধান্তের মাত্র একটি বাস্তবায়ন হলেও বাকিগুলো নিয়ে আগায়নি কমিটির সদস্যরা।

মাঝখান থেকে শুধু শোনা গিয়েছিল বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া গহরডাঙ্গা বোর্ডের চেয়ারম্যান মুফতি রুহুল আমিন আশকোনার হাজিক্যাম্পে স্বীকৃতির কাজ বাস্তবায়নের জন্য সরকারি অফিস বরাদ্ধ পেয়েছেন এবং মিলাদ পড়িয়ে সেটি উদ্বোধনই করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এরপর অফিসটি আর সেভাবে ব্যবহার হয়নি।

এ বিষয়ে তার সঙ্গে ৭ মার্চ রাতে মোবাইলে কথা বলতে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে লাইন কেটে দেন। হঠাৎ করে স্বীকৃতির এ স্থবির অবস্থা নিয়ে কথা হয় বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, বেফাকের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক ও দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসার উস্তাদ ও হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী’র সঙ্গে। তারা কেউ বিষয়টির বিস্তারিত জানেন না এবং তেমন কিছু জানাতেও চাননি। বলেছেন এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়নি বা এসব বিষয় বড়রা জানেন ইত্যাদি বলে এড়িয়ে গেছেন।

কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি বিষয়ে গত দুই দশক ধরে আনুষ্ঠানিক আন্দোলন চলছে। যদিও আলোচনা শুরু হয়েছিল ৯০ সালের পরপর। এর মাঝে দিয়ে পাড় হয়েছে অনেক চড়াই উৎরাই। শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. কওমি সনদের স্বীকৃতি দাবিতে পল্টনের মুক্তাঙ্গনে ৫দিন ব্যাপী অবস্থান ধর্মঘটও করেছিলেন। যেখানে কওমি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ করা গিয়েছিল।

প্রায় ৩ দশক পেড়িয়ে গেলেও এ দাবির রূপরেখা এখনপর্যন্ত সুষ্পষ্ট নয়। যার ফলে একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য বিবৃতি শোনা যায়। গতবছর স্বীকৃতির নেয়ার পদক্ষেপ শোনা গেল শুধু দাওরায়ে হাদিসের মান নিয়ে। অথচ আগে বিষয়টি এমন ছিল না। পুরো ধাপের স্বীকৃতি হবে এবং সেভাবেই এগিয়েছে আন্দোলন।

আন্দোলনগুলোর ওপর নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে স্বীকৃতি মূখ্য নয় বরং কেউ স্বীকৃতির আন্দোলন শুরু করলে সেখানে কিভাবে সময়ক্ষেপন করা যায় সেটার প্রচেষ্টাই হয়েছে বিগত সময়গুলোতে। নইলে বিশলক্ষ শিক্ষার্থীর প্রাণের দাবি উপলদ্ধি করে হয়তো এতদিন বেফাকের পক্ষ থেকে শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি হতো এবং স্বীকৃতির সুস্পষ্ট একটি রূপরেখা দাঁড় করানো হতো। কিন্তু তিন দশকের মতো লম্বা সময়েও আমরা এখনো দাবিগুলোকে স্পষ্ট করতে পারিনি যা আফসোসেরই কারণ।

চলতি সময়ের স্বীকৃতি আন্দোলন কোন দিকে মোড় নিয়েছে তা বলা মুশকিল। জমিয়তুল উলামা’র চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বারবার আল্লামা আহমদ শফীর সাক্ষাৎ ও ঐক্য চাইলেও তিনি নিজে একটি বোর্ডের অভাববোধ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত একটি বোর্ড গঠন করে ফেলেছেন। যার নাম দিয়েছেন আবার জাতীয় বেফাক। বেফাক নামে একটি প্রতিষ্ঠিত ও প্রধান বোর্ড থাকতেও কেন এই নামেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আরেকটি বোর্ডের জন্ম হলো তা অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়।

এখন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বে গোপন বৈঠকও হচ্ছে স্বীকৃতি বিষয়ে। তাই কওমি স্বীকৃতি নিয়ে বলা যায়, সচেতনরা সঠিক নিয়মে না এগুলে অন্য কেউ ভিন্ন উপায়ে ফসল ঘরে তুলতে পারে।

আরও পড়ুন : কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি একটি ট্রামকার্ড: স্বীকৃতি বাস্তবায়ন পরিষদ

এআরকে

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ