বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীরের টাকা চুরির গল্প

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

salauddin-jahangir

সালাউদ্দীন জাহাঙ্গীর

আমার বয়স তখন কতো হবে? বড়জোর আট-নয়। স্কুলে পড়ি। কোন ক্লাস, মনে নেই। থ্রি বা ফোর কিছু একটা হবে।

একদিন ফুটবল কেনার জন্য কয়েকটা টাকার ভীষণ প্রয়োজন পড়ে গেলো। বেশি না, সাকুল্যে ২০ টাকা। স্কুলে শুনতাম— ক্লাসের অনেকেই নাকি ওদের আব্বাদের পকেট থেকে হেব্বি টাকা মেরে দেয়। কেউ কেউ নাকি ঘরের গোলা থেকে ধান বা চালও পাচার করে বাজারে বিক্রি করে! সিস্টেম আছে।

সঙ্গত কারণে এমন একটা সরল ও সহজ পন্থা আমারও গ্রহণ করার তাগিদ অনুভব করলাম।

এদিকে আবার অন্য চিন্তা আছে— আব্বার যে পরিমাণ রাগ, যদি একবার ধরা খাই... এক থাপ্পড়ে মুতিয়ে ফেলবে। গ্রামের অনেক ছেলে আব্বার হাতের থাপ্পড় খেয়ে লুঙ্গি ভিজিয়ে ফেলার রেকর্ড আছে। সুতরাং সাধু সাবধান!

কিন্তু আমার ভেতরে কৌতূহল বেশ তাতিয়ে উঠেছে— আব্বার মানিব্যাগ থেকে টাকা নেয়া, এ তো যেনতেন কাজ নয়। বিকেলবেলা আলগোছে তোষকের তলে রাখা আব্বার মানিব্যাগ থেকে পাট আর কৃষকের ছবিওয়ালা একটা ২০ টাকার নোট আত্মসাৎ করে ফেললাম।

হায়! এই সুখ আমার কপালে বেশিক্ষণ সইলো না। মা কীভাবে যেনো আঁচ করে ফেললেন— সামওয়ান আত্মসাৎ টুয়েন্টি টাকা ফ্রম আব্বা'স মানিব্যাগ!

বড়আপা ছোটআপা দুজনই স্কুলে। সন্দেহের তীর তো তীর, সন্দেহের ধনুক সুদ্ধ আমার দিকে এসে পড়লো। মা আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি প্রবল প্রতাপের সঙ্গে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার সাথে আমার সম্পৃক্ততার ব্যাপারে সরাসরি ইনকার করলাম।

কিন্তু মা তো আমার চোখের নাচন দেখেই বুঝে ফেলেছে— তুই আইজকা শ্যাষ! আর যাবি কোথায়? ক্যাক করে আমাকে ধরে ফেললো। গালে-পিঠে দু-চারটে পড়তে দেরি হলো না।

আমি রাগে-দুঃখে-লজ্জায় গম ক্ষেত অভিমুখে দৌড়ে পালালাম। জগৎ-সংসার ছেড়ে আত্মগোপন। বন থাকলে বনে গিয়ে বনবাস নিতাম। বন না থাকায় একমাত্র ভরসা বাড়ির পাশের গম ক্ষেত। আপাতত ক্ষেতবাস!

যদিও ক্ষেতবাসের স্থায়িত্ব এক ঘণ্টার বেশি দীর্ঘ হলো না। ঘণ্টাখানেক পর দেখি মা আর ছোটআপা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে ক্ষেতের দিকে চলে এসেছে। ছোটআপার চোখভরা জল। মায়ের চোখেও পানি।

এমন ইমোশনাল সিকোয়েন্সের পর বৈরাগ্য সাধনের কোনো মানেই হয় না। প্রিয়জনের চোখের জলের সামনে বৈরাগ্য কি, স্বর্গসাধনাও ভঙ্গ করা যায়। সবাই তো আর গৌতম বুদ্ধের মতো পাষাণ হৃদয়ের বৈরাগী না!

যাকগে, যে কথা বলতে চাচ্ছি—
আর্মির লোক থাকার কারণে আব্বার নীতি-নৈতিকতার টেম্পারেচার সবসময় ১০৫-এর আশপাশে উঠানামা করতো। মিথ্যাকথা আর বেয়াদবিমূলক কোনো আচরণ একবার যদি তার সামনে কেউ করতো, আর রক্ষে নেই! ওর অবস্থা কেরোসিন। গ্রামের মুরব্বিরা পর্যন্ত আব্বাকে আসতে দেখলে টানতে থাকা মুখের বিড়ি পাছার নিচে লুকিয়ে ফেলতো! দু-একজনের তো অত্র এলাকার লুঙ্গিও পুড়ে গিয়েছিলো।
লিঙ্ক চাইবেন না প্লিজ!

আব্বার এমন নৈতিক স্ট্রেংথের কারণে মা এবং দুই বোন আমাকে সবসময় কোনো ধরনের অনৈতিক কাজ থেকে সেভ করতো। দ্যাট ওয়াজ আ বিগ ডিল! এটা আমার পরবর্তী জীবনে একটা পরম শিক্ষা হয়ে কাজ করেছে।
আই স্যালুট মাই ফ্যামিলি!

মূলত পরিবারের চেয়ে বড় শিক্ষক আর কিছু নেই। বাচ্চার উন্নত স্কুল আর টিউশনের পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা নষ্ট না করে তাকে ভালোমানুষ হওয়ার শিক্ষা দিন। এবং এ কাজ শিশুর মা-বাবা, ভাই-বোন সবার।

একটা ভালো গল্প শোনান, নবিদের গল্প শোনান, বড়দের গল্প শোনান, সততার গল্প শোনান, মিথ্যা-চুরি-বেয়াদবি-পাপের ভয়বহতার ভয় দেখান। আজাইরা সারাদিন এবিসিডি, হাট্টিমাটিমটিম, টুইঙ্কল টুইঙ্কল না শুনিয়ে হাতেম তায়ির গল্প শোনান। আখেরে ফায়দা দেবে।

আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের মূলত ভালোমানুষ হওয়ার শিক্ষা দেয় না, ভালো চাকর হওয়ার প্রশিক্ষণ দেয় মাত্র।

যে ছাত্র সারাজীবন শিখেছে চাকর হওয়ার কায়দা-কানুন, তার কাছে নৈতিকতা আশা করা বৃথা।

সো— বি ট্রুথ, বিং ট্রু...

সালাউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ফেসবুক পেইজ  থেকে...

আআ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ