বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


সাপ কেন অভিশাপ নয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

shapপৃথিবীর যে কয়েকটি প্রাণীর নাম শুনলে মানুষ আতকে ওঠে, তার মধ্যে সাপ অন্যতম। সাপকে ভয় পায় না, এমন মানুষের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোণা।

সাপ নাম শুনলেই বিচলিত হওয়া যেন  আমাদের একটি নীতিগত অভ্যাস। কেন না এটি একটি ভীতিকর এবং প্রাণসংহারী প্রাণী। প্রতিবছর অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হয় এর বিষাক্ত ছোবলে। তাই সাপ নাম শুনলেই আমরা অন্তত দশ হাত দূরে থাকার চেষ্টা করি। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে সাপকে আমরা যতটুকু না ভয় পায়, সাপ আমাদের তার চেয়ে শতগুণ ভয় পায়। সে জন্যই দেখবেন কোনো মানুষের উপস্থিতিতে সাপ কতটা দ্রুত পলায়ন করে। সাপকে যদি নিরীহ প্রাণী বলি তাহলে হয়ত অনেকেই অবাক হবেন, তবে তার চেয়ে অবাক হওয়ার মত কথা হলো সাপ আমাদের পরম উপকারী বন্ধু। যে সাপের ভয়ে মানুষ জড়সড়, যে বিষের কারণে মানুষের প্রাণহানি ঘটে, সেই সাপ আর সাপের বিষই কিন্তু মানব দেহের রোগ নিরাময়ের অন্যতম
প্রতিষেধক।

সম্প্রতি সাপ নিয়ে উন্নত বিশ্বের গবেষণাগারে এটা প্রমাণিত হয়েছে, ক্যান্সার নিরাময়ে সাপের বিষ এক অনন্য নিয়ামক। ব্যাঙ্গোর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ড. উলফগ্যাং উস্টার জানান, 'বিষধর সাপের বিষ মানুষের নানা জটিল রোগের প্রতিষেধক।' ফ্রাঙ্কফুর্টের জীবরসায়নবিদ ইয়োহানেস এব্লে বলেন, 'সাপের বিষ হৃদ রোগের ঝুকি কমায়।'

আরেক গবেষক, ড. ক্যাজ ওয়েল মনে করেন, 'সাপের বিষ ঔষুধ শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।' আর এ জন্যই রসায়ন গবেষণাগারে সাপের বিষ একটি মূল্যবান উপাদান।

জেনে নিশ্চয় অবাক হবেন এই ভেবে যে, উন্নত বিশ্বের ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, অস্ট্রিয়াসহ যেসব দেশ রাসায়নিক মৌল বা যৌগ উপাদান তৈরি করে, সেসব দেশে এক আউন্স সাপের বিষের দাম হচ্ছে এক কোটি টাকা। এছাড়াও সাপ আমাদের অারো অনেক উপকার করে থাকে। এই যেমন ফসলী জমির ইঁদুর ও পোকা মাকড় খেয়ে কৃষকের ফসলকে অনিষ্টতার হাত থেকে রক্ষা করা, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিকরা ইত্যাদি। তাছাড়া সাপের চমৎকার কারুকার্যময় চামড়া দিয়ে তৈরি করা হয় নানান রকম সৌখিন জিনিসপত্র।

সাপ হচ্ছে সরীসৃপ প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত লম্বা বেলনাকার পা-হীন মেরুদণ্ডী প্রাণী। এদের দেহ অাঁশ দ্বারা আবৃত। সাপ মানুষের আবাস্থল বাড়ি,গভীর জঙ্গলের মাটিতে, মাটির নিচে গর্তে বা সুড়ঙ্গে, গাছে ও পানিতে থাকে। প্রায় সব সাপই সাঁতার কাটতে পারে।

সাপ বছরে কয়েকবার খোলস বদলায়। এদের কোনো বহিঃকর্ণ নেই, যেজন্য বায়ুবাহিত শব্দ নিখুঁতভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তবে মাটি বা অন্য যে মাধ্যমে এরা থাকে তা থেকে শব্দ তরঙ্গ নিচের চোয়াল ও কোয়াড্রেট অস্থির মাধ্যমে অন্তঃকর্ণ গ্রহণ করতে পারে। সাপের কান ও চোখের পাতা নেই। চোয়ালের দুই অংশের হাড় নমনীয় অস্থিবন্ধনী দিয়ে যুক্ত থাকায় শিকার গেলার সময় চোয়ালের প্রতি অর্ধাংশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।

সহস্র অালোক বৎসর দূরের গ্রহ নক্ষত্র আর নিকটের বৃক্ষ তরুলতা, কিম্বা গহীন সমুদ্রের মাংসাশী মৎস আর মৃত্তিকা গর্ভের ক্ষুদ্র পিপিলিকাসহ সমস্ত মাখলুকই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। যারা দিনরাত মানুষের সেবা করে যাচ্ছে মহান রাব্বুল আলামীনের হুকুমের দাস হয়ে।

পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় তিন হাজার প্রজাতির সাপ রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় পাঁচশ’ প্রজাতির সাপ বিষধর। বাকিগুলো নির্বিষ। আমাদের বাংলাদেশেই রয়েছে প্রায় একশ’ প্রজাতির সাপ। এর চার ভাগের তিনভাগই নির্বিষ। এদের মধ্যে সহজদৃষ্ট যেসব সাপ সেসব হচ্ছে ঢোঁড়া, ঘরগিন্নী, কুকরি, মেটেসাপ,  দুধরাজ সাপ, ফণিমনসা, পাইন্যা বা পানিসাপ , দাঁড়াশ, অজগর, গোখরা ও কিছু  সামুদ্রিক সাপ।

সাপ নিয়ে যুগে যুগে নানান ভুল ধারণা ও কুসংস্কারের কমতি নেই। সাপের মাথায় 'সাত রাজার ধন' বা মনির কাল্পনিকতাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে রুপকথার নানা গল্প, উপন্যাস। নির্মিত হয়েছে অসংখ্য নাটক সিনেমাও। তাই সাপুরেরা আজও সেই ধারণার অপব্যবহার করে মুক্তা বা অন্য কোনো পাথরকে সাপের মনি বলে সাধারণ মানুষদের ধোকা দিয়ে থাকে। আবার কোনো কোনো সম্প্রদায় সেকেলে ধ্যানধারণায় সাপের পূজাঅর্চনাও করে থাকে, যা চরম মূর্খতা বৈ অার কিছুই নয়।
আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, সহস্র অালোক বৎসর দূরের গ্রহ নক্ষত্র আর নিকটের বৃক্ষ তরুলতা, কিম্বা গহীন সমুদ্রের মাংসাশী মৎস আর মৃত্তিকা গর্ভের ক্ষুদ্র পিপিলিকাসহ সমস্ত মাখলুকই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। যারা দিনরাত মানুষের সেবা করে যাচ্ছে মহান রাব্বুল আলামীনের হুকুমের দাস হয়ে। সুতরাং সাপকে স্রষ্টা মানা নির্বোধেরই পরিচায়ক।

আমাদের একটা নিন্দনীয় স্বভাব হল সাপ দেখলেই তা মেরে ফেলা। হ্যা একথা সত্য সাপ একটি প্রাণসংহারী প্রাণী। পৃথিবীতে এমনও সাপ আছে যাদের এক ফোটা বিষ এক মিনিটের মধ্যে একাধিক মানুষের প্রাণনাশে সক্ষম। কিন্তু সব সাপইতো বিষধর নয়। তাছাড়া অধিকাংশ সাপই বিরক্ত বোধ না করলে বা কেউ উত্ত্যক্ত না করলে সহসা কামড় বসায় না।

তার পরেও সাপের দ্বারা ক্ষতীর সম্ভাবনা থাকলে মারতে বাধা নেই। তবে সাপ মারার আগে আমাদের যা করণীয় তা হচ্ছে, এ সাপ আমাদের ক্ষতী করবে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। আর এ ব্যাপারে হাদিসেও খুব সুন্দর নিয়মাদি বলা হয়েছে।

হাদিসে বর্ণিত অাছে, কোনো সাপকে মারার অাগে ''তিনবার তাকে (সাপকে) সাবধান করবে। এরপর ও যদি সে বের হয়, তখন তাকে মেরে ফেলবে। কেননা, সে শয়তান।''  সূনানে আবু দাউদ : ৫১৬৮, ইফা.

হযরত সালিম রহ. তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সা. বলেছেন, "তোমরা সাপ মারবে এবং সেই সাপ, যার পিঠে দু'টি সাদা রেখা আছে এবং যার লেজ নেই। কেননা, এরা বিষধর হওয়ার কারণে- দর্শন শক্তি বিনষ্ট করে দেয় এবং গর্ভস্থিত সন্তান ধ্বংস করে দেয়। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর থেকে আবদুল্লাহ রা. যে কোনো সাপ দেখতে পেলে তা মেরে ফেলতেন। একদা আবু
লুবাবা রা. অথবা যায়দ ইবনে খাওাব রা. তাঁকে একটা সাপ মারতে উদ্যত দেখে বললেন, নবী সা. ঘরে বসবাসকারী সাপ মারতে নিষেধ করেছেন। সূনানে আবু দাউদ, ৫১৬২, ইফা.

তিনি বলেন, মদীনার একদল জিন ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাই তোমরা যখন তাদের (সাপ) কাউকে দেখবে, তখন তাকে তিনবার ভীতি-প্রদর্শন করবে যে, 'আর বের হবে না, অন্যথায় মারা পড়বে।'

হযরত ইয়াযীদ ইবনে মাওহাব রহ. আবূ সাই'ব রা. থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একদা আমি আবূ সাঈদ খুদরী রা.-এর কাছে এসে বসি। এ সময় আমি তার চৌকির নিচে কিছুর আওয়াজ শুনতে পাই। আমি তাকিয়ে দেখি যে, একটা সাপ। তখন আমি দাঁড়ালে- আবূ সাঈদ রা. জিজ্ঞাসা করেন, তোমার কি হয়েছে? তখন আমি বলি,এখানে একটা সাপ। তিনি বলেন, তুমি কি করতে চাও? তখন আমি বলি, আমি তাকে মেরে ফেলবো। তখন তিনি তাঁর বাড়ির একটা ঘরের দিকে ইশারা করে বলেন, এখানে আমার চাচাতো ভাই থাকতো। খন্দকের যুদ্ধের সময় সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুমতি চায়, কেননা, সে তখন নতুন বিয়ে করেছিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি দেন এবং বলেন, তুমি তোমার হাতিয়ার নিয়ে যাও। সে সে ঘরে ফিরে তার স্ত্রীকে ঘরের দরজার উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, তার প্রতি কলম দিয়ে ইশারা করে। তখন তার স্ত্রী বলল, তাড়াহুড়া করো না, এসে দেখ, কিসে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। তখন সে ঘরে ঢুকে একটা কুৎসিত সাপ দেখতে পায়। সে তাকে বল্লম দিয়ে হত্যা করে এবং বল্লমে তার দেহ ফুঁড়ে বাইরে নিয়ে আসে।

বর্ণনাকারী বলেন, আমি জানি না, এরপর কে আগে মারা গিয়েছিল- ব্যক্তিটি- না সাপটি। তখন তাঁর কাওমের লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বলে, আপনি দু'আ করুন, যাতে আমাদের সাথী বেঁচে যায়। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা তার মাগফিরাতের জন্য দু'আ কর। এরপর তিনি বলেন, মদীনার একদল জিন ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাই তোমরা যখন তাদের (সাপ) কাউকে দেখবে, তখন তাকে তিনবার ভীতি-প্রদর্শন করবে যে, 'আর বের হবে না, অন্যথায় মারা পড়বে।' এরপর যদি সে বের হয়, তখন তাকে মেরে ফেলবে।’ সূনানে আবু দাউদ, ইফা.৫১৬৭

তাই সাপকে না মেরে এড়িয়ে চলাই উত্তম। সাপকে সাপের মতোই বেড়ে উঠতে দিতে হবে। কারণ এরা আমাদের জীব বৈচিত্র্যের অন্যতম অংশিদার। পরিবেশ রক্ষায় এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

লেখক : ইমাম ও খতিব, আদ্রা জামে মসজিদ, কসবা ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া।

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ