শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


মুবাল্লিগ ও দায়ীর অপরিহার্য গুণাবলি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আবদুস সাত্তার আইনী

muhammadপবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের প্রতি আহ্বান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ [সুরা নাহল : আয়াত ১২৫] নবী ও রাসুলগণের প্রধান কার্যাবলি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘(নবী ও রাসুল) তাঁর আয়াতসমূহ তাদের কাছে তেলাওয়াত করে, তাদেরকে পরিশোধন করে এবং কিতাব ও হিকমত শিা দেয়।’ [সুরা আলে ইমরান : আয়াত ১৬৪]
পবিত্র কুরআন যেমন আহকাম ও শরিয়তের কিতাব তেমনি তা দাওয়াত ও হেদায়েতেরও কিতাব। দাওয়াত ও হেদায়েতের কথাই কুরআনে বেশি বলা হয়েছে। কারণ, ঈমাদের ভিত্তি হেদায়েতের ওপর প্রতিষ্ঠিত; আর ঈমান অর্জন বা গ্রহণ দাওয়াতের ওপর নির্ভরশীল। যাঁরা দওয়াত দেন তাদের জন্য কুরআন বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে। দায়ী’ ও মুবাল্লিগের জন্য কুরআন বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি নির্দেশ করেছে।

১। ইলম ও হেকমত : নবীগণের (আলাইহিমুস সালাম) কাজ ছিলো কিতাবের জ্ঞান ও হিকমত শিা দেয়া। হিকমত শব্দের অর্থ হলো যাবতীয় বিষয়বস্তুকে যথার্থ জ্ঞান দ্বারা জানা। নবীগণ ওহির মাধ্যমে জ্ঞানপ্রাপ্ত হতেন। স্বয়ং আল্লাহ তআলাই তাঁদের শিক। তাই নবী সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়ে ছিলেন চূড়ান্ত পর্যায়ের জ্ঞানী। তাঁদের জ্ঞান ছিলো যথার্থ ও পরিপূর্ণ। আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহির মাধ্যমে প্রতিটি বিষয়ে সত্যজ্ঞান লাভ করেছেন এবং সাহাবাগণকে শিাদান করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাহাবাগণ জ্ঞান ও হিকমত অর্জন করেছেন এবং পরবর্তী যুগের মানুষদেরকে শিাদান করেছেন। এভাবে এই ধারা অব্যাহত থেকেছে। সুতরাং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান একজন মুবাল্লিগ ও দায়ী’র প্রধান ও অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মূলত প্রজ্ঞাবান আলেম ও ইসলামি জ্ঞানে যথার্থ জ্ঞানীদের মাধ্যমেই দাওয়াত ও তাবলিগের কর্মধারা চলমান রয়েছে। উপমহাদেশে যাঁরা দাওয়াত ও তাবলিগের বর্তমান পদ্ধতির সূচনা করেছেন তাঁরাও ছিলেন মহান আলেমে দীন ও কুরআন-হাদিসের ক্ষেত্রে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী। তাঁরা সাধারণ জনম-লীর মধ্যে সত্য ও শুদ্ধ জ্ঞানের আলো বিকশিত করার চেষ্টা করেছেন; জনগণের প থেকে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে সেগুলোর জবাব দিয়েছেন কুরআন ও হাদিসের আলোকে এবং প্রজ্ঞা ও পরিমিতিবোধের সঙ্গে। সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহর বিষয়ে জ্ঞানের স্বল্পতা বা অপূর্ণাঙ্গ জ্ঞান দাওয়াত ও তাবলিগের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও সঙ্কটের সৃষ্টি করতে পারে। প্রত্যেক দায়ী’ ও মুবাল্লিগই একজন শিক। শিককে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানী হতে হয়।

২। উত্তম চরিত্র : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ [মুয়াত্তা, ইমাম মালেক : হাদিস ২৬৫৫] তিনি আরো বলেছেন, ‘ঈমানের দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ মুমিন সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম।’ [জামিউল আহাদিস, জালালুদ্দিন সুয়ুতি : হাদিস ৪৩৭৯] সবার জানা বিষয় যে, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বোচ্চ সৎ ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আপনি মহান চরিত্রের ধারক।’ [সুরা ক্বলাম : আয়াত ৪] তাঁর চরিত্রমাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে অসংখ্য অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী যুগে মুসলমানগণ তাঁদের চারিত্রিক গুণাবলির মাধ্যমে অমুসলিমদের আকর্ষণ করেছেন এবং তাঁদের হৃদয়ে ঈমানের শিখা প্রজ্জ্বলিত করেছেন। যাঁরা দায়ী’ ও মুবাল্লিগ, যাঁরা সাধারণ জনমণ্ডলী ও অমুসলিমদের মধ্যে ঈমান ও ইসলামের আলো জ্বালিয়ে দিতে চান তাঁদেরকে অবশ্যই উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। তাঁদের আচার-ব্যবহার হবে মাধুর্যপূর্ণ, লেনদেন হবে পরিষ্কার ও ইনসাফপূর্ণ, কথাবার্তা হবে শালীন ও চিত্তাকর্ষক। তাঁরা এমন কোনো কাজ করবেন না বা এমন কোনো কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত হবে না, যা অন্যদের বিরক্তি ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং তাঁদের সম্পর্কে সমালোচনা করতে অন্যদের সুযোগ করে দেয়। পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ববোধ ও আত্মমর্যাদাশীলতাও উত্তম চরিত্রের অংশ।

৩। ধৈর্য ও স্থিরচিত্ততা : পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘সুতরাং তারা যা বলে তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ করো এবং তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো।’ [সুরা ক্বাফ : আয়াত ৩৯] ধৈর্য ও স্থিরচিত্ততা ছাড়া যেমন কোনো কাজেই সফলতা অর্জন করা যায় না, তেমনি ধৈর্য না থাকলে অনেক পাপকাজ থেকেও বিরত থাকা যায় না। ধৈর্য ও স্থিরচিত্ততা এমন একটি গুণ যা ছাড়া দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ কোনোভাবেই সুচারুরূপে আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয়। রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর গোটা জীবনভর ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। তবে ধৈর্যের অর্থ এই নয় যে, সব অন্যায় সহ্য করে নেয়া হবে এবং যে যা-ই বলুক মুখ বুজে মেনে নেয়া হবে। যদি তর্কের প্রয়োজন হয় তবে উত্তম পন্থায় (মৌখিক বা লিখিত) তর্ক করতে হবে, অন্যথায় কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে যে-ব্যবস্থা প্রয়োজন ও সময়োপযোগী তা গ্রহণ করতে হবে।

৪। নিজে না করে অন্যকে বলা : পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা কি মানুষকে সৎকাজের নির্দেশ দাও, আর নিজেদেরকে ভুলে যাও! অথচ তোমরা কিতাব অধ্যয়ন করো। তবে কি তোমরা বুঝো না?’ [সুরা বাকারা : আয়াত ৪৪] কোন কাজ নিজে না করে অন্যকে তার নির্দেশ দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনে কখনোই এমনটি করেন নি। এমনকি সাহাবায়ে কেরামের জীবনেও এমন কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, তাঁরা নিজেরা করেন নি অথচ অন্যদের তা করতে নির্দেশ দিয়েছেন অথবা নিজেরা করেছেন অথচ অন্যদেরকে তা করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। এ ক্ষেত্রে দায়ী’ ও মুবাল্লিগণকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামকে অনুসরণ করাই হবে যথার্থ। বর্তমান যুগে বিভিন্ন কারণে অনৈতিক সামাজিক কর্মকা-, সুদি কার্যক্রম ও সুদভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, ইসলামের নীতিবিরুদ্ধ সংগঠন ও কার্যকলাপ ইত্যাদরি সঙ্গে জড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এই স্বাভাবিকতা থেকে অবশ্যই আমাদের নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। আমরা নিজেরা অনৈতিক ও অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে অন্যদেরকে যত উপদেশই দিই না কেনো তা কোনো কাজে আসবে না।

৫। আত্মতুষ্টি ও আত্মম্ভরিতা : মানুষের আর যত গুণই থাকুক না কেনো, আত্মতুষ্টি ও আত্মম্ভরিতাই একজন মানুষকে ইহকালে ও পরকালে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। এই ব্যাধির কারণেই মানুষ অন্যকে ছোট করে দেখে, তাদের বদনাম করে, পরচর্চায় লিপ্ত হয়। মাওলানা তারিক জামিল বলেছেন, ‘পরচর্চা-পরনিন্দার মতো আমল ধ্বংসকারী আর কিছু নেই। যবানের অসংযত ব্যবহারই এর জন্য দায়ী। সৎলোকেরাও এই পাপ থেকে বাঁচতে পারেন না। হামলা করার জন্য শয়তানের কাছে বিভিন্ন অস্ত্র রয়েছে। একটি নয়, অনেকগুলো অস্ত্রে সে সজ্জিত। সৎলোকদের ঘায়েল করার হাতিয়ার হলো পরচর্চা ও পরনিন্দা। শয়তান তাঁদের কাছে পরচর্চাকে সুন্দররূপে পরিবেশন করে। তাঁরা নিজেদের সততা ও কামিয়াবি বড় চোখে দেখতে পান। অন্যদের তুচ্ছ ভাবতে প্রয়াস পান। তখন তাঁরা পরচর্চায় লিপ্ত হন এবং নিজেদের আমল বরবাদ করেন।’ [দেখুন : খাওয়াতিন কে লিয়ে ইসলাহি ও তারবিয়তি বায়ানাত, ২০১০, ফরিদ বুক ডিপো, নিউ দিল্লি]

আমাদের সকল কাজ মানুষের কল্যাণের জন্য হোক এবং তা আমাদের ইহকালীন ও পরকালীন সৌভাগ্যের দলিল হোক—আল্লাহ তাআলার কাছে এই প্রার্থনা করি।

এফএফ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ