শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


ভারতে নবীদের কবরে এক সকাল

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হাওলাদার জহিরুল ইসলাম ; দেওবন্দ থেকে

india_nabi

সারহিন্দ সফরের অন্যতম আকর্ষণ ছিলো নবীদের কবর জেয়ারত৷ সকাল সোয়া ছ'টায় বেরুলাম নবীদের কবর জেয়ারতের উদ্দেশ্যে৷ মুজাদ্দিদে আলফে সানি রহ.-এর দরবার থেকে ২২ কিলেমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে ‘বারাস’ নামক স্থানে, ন’জন নবীর কবর রয়েছে৷ আওয়ার ইসলামের অ্যাসাইনম্যান্টও ছিল, কবরগুলো নিয়ে যেন ভালো করে লিখি।

তিনশ' রুপিতে একটা সিএনজি রিজার্ভ নিলাম৷ ওখানে যাওয়ার সরাসরি গাড়ির রাস্তা নেই৷ সিএনজি মহা সড়ক ছেড়ে সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো৷ মাঝে মাঝে থামিয়ে রাস্তা ঠিক আছে কি না জেনে নিচ্ছিলো৷ বুঝলাম, সে এই পথে নতুন আসছে৷ প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা চলার পর আমরা পৌঁছলাম বারাস-এ৷ ড্রাইভারকে চা নাশতা খেতে বলে আমরা কবরগাহের দিকে পা বাড়ালাম৷ টিলার মতো উঁচু জায়গা৷ চারদিক বাউণ্ডারি ঘেরা৷ প্রধান ফটক পেরুলাম৷ মাদরাসার ছোট ছোট শিশু নজরে পড়লো৷ নিজেদের ক্লাসের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ কয়েকজন এগিয়ে এসে আমাদের সাথে মোসাফাহা করলো৷ এগোলাম আরো৷ পাথরে বাঁধাই করা লম্বা একটা সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে৷ সিঁড়ির শেষ মাথার গেটে লেখা রয়েছে, ‘কুবুরে আম্বিয়া আলাইহিস সালাম।’

কবরগুলো কমপক্ষে ছয় হাজার বছর পুরনো৷ হজরত মুজাদ্দিদে আলফে সানি রহ.কে এলহামের মাধ্যমে জানানো হয়, সিরহিন্দের বারাস নামক জায়গায় নবীদের কবর রয়েছে, তুমি এগুলো সংরক্ষণ করো৷ তিনিই প্রথম এ কবরগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন৷ তিনি স্বীয় খাস খলিফাদের বলেছিলেন, নবীদের সাথে আমার স্বপ্নযোগে সাক্ষাত হয়েছে এবং আমার সুকুনে কলব হাসিল হয়েছে৷

রুহানি পরশে…

লম্বা লম্বা মোট নয়টি কবর৷ একটি বাদে সবগুলো প্রায় ৭ গজ লম্বা৷ একসাথে পাশাপাশি চারটি, একটু দূরে দু’টি, আর দু’টি আলাদা এবং একটি এক কোণে৷ তবে সব কবরই বাউণ্ডারির ভেতরে৷ ঘুরে ঘুরে প্রত্যকটা কবর পৃথকভাবে জেয়ারত করলাম৷ সাধ্যমতো সুরা কালাম পড়ে ইসালে সওয়াব করলাম৷ অন্তরে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব হলো৷ আমার পঙ্কিল হৃদয়ে কি নবীদের রুহানি পরশ লাভ করা সম্ভব? কয়েকজন যুবক (মডার্ণ মুসলিম!) কে কবরে পাশের ফুল গাছের নিচে বসে গল্প করতে দেখা গেলো৷ একজন তালিম দেয়ার সুরে, নিজের মতো করে, নবীদের বিভিন্ন কাহিনি শোনাচ্ছিলো বাকিদের৷ হাসি-ঠাট্টাও চলছে৷ বিষয়টা আমার ভালো লাগলো না৷ বেরিয়ে এলাম মাকবারা থেকে৷

বস্তবেই কি এগুলো নবীদের কবর?

india_nabi2মাকবারার পশ্চিম দিকে রয়েছে ‘মসজিদে আম্বিয়া৷’ মসজিদে আম্বিয়ার সামনে স্থনীয় এক মুরুব্বিকে পেলাম৷ কবরগুলো যে নবীদের এ ব্যাপারে তার মন্তব্য জানতে চাইলাম৷ তিনি পাঞ্জাবি ও হিন্দি মিলিয়ে বলে চললেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের থেকেই আমরা জেনে আসছি এগুলো নবীদের কবর৷ কবরগুলো কমপক্ষে ছয় হাজার বছর পুরনো৷ হজরত মুজাদ্দিদে আলফে সানি রহ.কে এলহামের মাধ্যমে জানানো হয়, সিরহিন্দের বারাস নামক জায়গায় নবীদের কবর রয়েছে, তুমি এগুলো সংরক্ষণ করো৷ তিনিই প্রথম এ কবরগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন৷ তিনি স্বীয় খাস খলিফাদের বলেছিলেন, নবীদের সাথে আমার স্বপ্নযোগে সাক্ষাত হয়েছে এবং আমার সুকুনে কলব হাসিল হয়েছে৷ আমি তাদের কবর থেকে নূর বের হয়ে আসমানের দিকে যেতে দেখেছি৷ তার ওফাতের পরও অনেক বুযুর্গ ব্যক্তি এ কবরগুলো জেয়ারত করেছেন৷ হজরত শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রহ., হজরত ইউসুফ কান্ধলভী রহ.সহ অনেকেই এখানে জেয়ারতে এসেছিলেন৷ হজরত হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. কবরগুলো নিয়ে মোরাকাবা করে বলেছিলেন, আমার মন সাক্ষী দেয় যে এগুলো নবীরই কবর, আমার অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয়েছে৷’

লোকটি একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলেন, ‘মাওলানা! আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন, পুরো হিন্দুস্তানে বড় বড় বুযুর্গদের যতো কবর রয়েছে দু’একটি বাদে সবখানেই বিদয়াতি কর্মকাণ্ড চালু আছে৷ অবাক ব্যাপার হলো, যিনি আজীবন শিরক, বিদয়াত, রুসুমাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, সেই শায়খ আহমদ সিরহিন্দি রহ.-এর কবরেও বিদয়াত চালু রয়েছে! কিন্ত এখানে আগেও কোনো বিদয়াত ছিলো না, এখনও নেই৷ এতেও বোঝা যায় যে এগুলো নবীদের কবর৷’

এলাকায় মুসলিম জনবসতি কত ভাগ?

১৯৪৭ সনের ভয়াবহ দাঙ্গার আগে এখানে কেবল মুসলিম জনবসতিই ছিলো৷ শিখ বা হিন্দু ছিলো না বললেই চলে৷ '৪৭ সনে দেশ বিভাগের সময় শিখ ও হিন্দু জমিদররা এ এলাকায় ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালায়৷ মুসলমানদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, জমি-জমা দখল করে নেয়৷ এরপরও যারা বেঁচে ছিলো তাদের পাকিস্তানে হিজরত করতে বাধ্য করা হয়৷ ফলে একসময় এলাকটি মুসলিমশূন্য হয়ে পড়ে৷ পরে ১৯৯০/৯৫ এর দিকে কিছু কিছু মুসলিম বসতি স্থাপিত হতে থাকে৷’

এ এলাকায় নবীদের কোনো নিদর্শন আছে?

নবীদের বেশ কিছু নির্শন ছিলো৷ ’৪৭ এর সময় তা মিটিয়ে দেয়া হয়েছে৷ ওরা নবীদের কবরে হাত লাগাতে সাহস করেনি বলেই কবরগুলো অক্ষত আছে৷ এ গ্রামে নবীদের সময়ের চারটি মসজিদ ছিলো৷ তার তিনটি বর্তমানে শিখ ও হিন্দুদের দখলে৷ ওরা সেগুলোকে মন্দিরে পরিণত করেছে! একটি মসজিদ স্থনীয় মুসলমানরা আবাদ করতে সক্ষম হয়েছে৷’

'৪৭ সনে দেশ বিভাগের সময় শিখ ও হিন্দু জমিদররা এ এলাকায় ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালায়৷ মুসলমানদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, জমি-জমা দখল করে নেয়৷ এরপরও যারা বেঁচে ছিলো তাদের পাকিস্তানে হিজরত করতে বাধ্য করা হয়৷ ফলে একসময় এলাকটি মুসলিমশূন্য হয়ে পড়ে৷

বর্মানেও কি আপনারা অত্যাচারিত?

‘না, বর্তমানে আমরা মোটমুটি ভালো আছি৷ তবে ধর্মীয় ক্ষত্রে খুব একটা স্বাধীন নই৷’ লোকটিকে বেশ জ্ঞানী মনে হলো৷ ইতিহাসের অনেক গোপন কথাই তিনি আমাদের শোনালেন৷

হাতে সময় কম ছিলো বলে তার থেকে বিদেয় নিতে হলো৷ প্রধান ফটকের দিকে এগোবার সময় ওখানকার কারী সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো৷ তিনি ‘দারুল উলুম দেওবন্দে’র ফারেগ৷ কুশল বিনিময় হলো৷ চা-নাশতার ব্যবস্থা করতে চাইলেন৷ আমাদের গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছি ওজর পেশ করলাম৷ সংক্ষিপ্ত কথাবার্তায় তিনি জানালেন, বর্তমানে এ কবরস্থানের সংরক্ষণ ও উন্নয়েনের দায়িত্ব নিয়েছেন জম্বু’র এক দ্বীনদার ব্যবসায়ী৷ তার নাম হাজি মুহাম্মাদ নিযামুদ্দিন কোটলাবি৷ তার প্রচেষ্টায় এখানে মক্তব ও হিফজ বিভাগ চালু হয়েছে৷

কারী সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে সামেনের দিকে পা বাড়ালাম৷ আমাদের গাড়ি এগিয়ে চললো সারহিন্দ দরবারের দিকে…

লেখক: শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ

আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ