শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


সরকারী বেতন নিয়ে পড়ানো হলে কওমি মাদরাসার মৌলিকত্ব নষ্ট হবে : মাওলানা কাজী ফজলুল করিম

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

kazi-copyমাওলানা কাজী ফজলুল করিম। বাংলাদেশের অন্যতম একজন আলেমে দীন। বগুড়ার জামেয়া আরাবিয়া শামসুল উলুম (কারবালা) মাদরাসার শাইখুল হাদিস। লেখক এবং গবেষক হিসেবেও তার খ্যাতি রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কওমী মাদরাসার সরকারী স্বীকৃতি বিষয়ক চলমান বিতর্ক বিষয়ে এবং কওমী মাদরাসার সরকারী স্বীকৃতি বিষয়ক খুটিনাটি বিষয় নিয়ে আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন সালাহুদ্দীন মাসউদইশতিয়াক আহমাদ

আওয়ার ইসলাম : বর্তমান সরকার কওমী মাদরাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়ন করতে চান এবং এ ব্যাপারে তারা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই এ সংক্রান্ত নীতিমালা ও আইনের খসড়া মন্ত্রীসভায় পেশ করা হবে। স্বীকৃতি বিষয়ে উলামায়েকেরামের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা, আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এক বোর্ড-কয়েক বোর্ড নানারকম আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। এ ব্যাপারে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : সনদের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো, এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। একটি হলো আদর্শিক আরেকটি হলো বাস্তবতা বা বর্তমান প্রেক্ষাপট।
আদর্শিক সনদের বিষয়ে আমার কথা হলো, এই সনদ আল্লাহ তায়ালা এবং সাধারণ মানুষ আমাদেরকে দিয়েই রেখেছেন। প্রায় দুইশত বছর যাবৎ আমাদের কওমী ধারার মাদরাসাগুলো জনগণের সাহায্য সহযোগিতা, দুআ ও অর্থায়নে পরিচালিত হয়ে আসছে। তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং স্বীকৃতি আমাদের সঙ্গে আছে। জনগণ আমাদের সহযোগিতায় অর্থ দিয়ে থাকে, আমাদের মাদরাসার জন্য জায়গা দান করে, তাদের সন্তানকে আমাদের কাছে মানুষ বানানোর জন্য পাঠায়। এটিই আমাদের আমাদের মৌলিক বিষয় এবং মৌলিক সনদ। গোটা বিশ্বের মুসলমানরা তাদের ভালবাসা ও অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাদের উজ্জীবিত রেখেছেন, তারা হচ্ছে দারুল উলুম দেওবন্দের উত্তরসুরী মানে কওমী মাদরাসা। এক্ষেত্রে অর্থাৎ আমাদের আদর্শিক ব্যাপারকে পাশ কাটিয়ে সরকার তারা যে দলেরই হোক না কেন, আমাদের স্বীকৃতি দিতে চায়, তাহলে আমরা তা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখান করবো। কোনো সরকারের কাছে আমরা আদর্শিক স্বীকৃতির ব্যাপারে মুখাপেক্ষী নই।

দ্বিতীয় বিষয় হলো, জনগণ আমাদের সহযোগিতা করে দীনের স্বার্থে। সমাজের যে দীনি চাহিদাগুলো রয়েছে, সেগুলো পূরণ করার জন্য। সরকারী চাকুরি করার জন্য নয়। বহু পরিবার রয়েছে যাদের তিনটি বা চারটি সন্তান, তারা কাউকে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন আবার কাউকে দিয়ে যাচ্ছেন আমাদের কওমী মাদরাসায়। সাধারণ শিক্ষায় যাকে দিচ্ছেন, তার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের চিন্তা করছেন আর যাকে মাদরাসায় দিচ্ছেন, তাকে দীনের খাতিরে দিচ্ছেন। ছেলে সরকারী চাকুরি পাবে, বড় চাকুরে হবে; এজন্য নয়। কারণ প্রত্যেক অভিভাবক জানেন, কওমী মাদরাসায় পড়ে সরকারী চাকরি পাওয়া যায় না। কাজেই যখন সরকার আমাদের চাকুরির ব্যবস্থা করে দিয়ে আমাদের বেতন ভাতার ব্যবস্থা করবে, আমাদের সাথে জনগণের যে অকুণ্ঠ সমর্থন আছে, স্বাভাবিকভাবেই তা বিলুপ্ত হবে। জনগণের সাথে আমাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যাবে, যা আমরা কখনো হতে দিবো না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে যে দীনি সম্পর্ক আছে তা নষ্ট হোক, আমরা চাই না । সাধারণ মানুষের ধর্মীয় চাহিদা পূরণে আমরা শতভাগ সফল। ব্যর্থতা নেই এবং ব্যর্থতার দায় ঢাকার জন্য আমরা সনদ নিচ্ছি, ব্যাপারটি তা নয়। বরং স্কুল কলেজের শিক্ষার যে সরকারী মর্যাদা আছে, সরকার এটাকে শিক্ষা মনে করে এবং যারা স্কুল কলেজে পড়ালেখা করে না, তাদেরকে শিক্ষিত বলে মনে করে না। যেমন কওমী মাদরাসার ছাত্রদেরকে সরকার শিক্ষিত বলে মনে করে না। আমরা এতটুকু চাই যে, সরকার আমাদের শিক্ষার স্বীকৃতি দিবে এবং কাগজে কলমে আমাদেরকে শিক্ষিত বলে স্বীকৃতি দিবে। এর বাইরে সরকারী চাকরি বা সরকারের বেতনের পর্যায়ে স্বীকৃতি আমরা চাই না। এতে আমাদের স্বকীয়তাও রক্ষা হবে, আমাদের ছেলেরা সমাজে শিক্ষিত বলে বিবেচিত হবে।

তৃতীয় কথা হলো, সাধারণ জনগণ আমাদেরকে যে সমর্থন দিচ্ছে, এই ধরনের সমর্থন আগে মানুষ আলিয়া মাদরাসাকে দিতো। আপনি জেনে থাকবেন, আমাদের বগুড়ার সরকারী মোস্তফাবিয়া আলিয়া মাদরাসার নামে অনেক ওয়াকফকৃত জমি আছে। যা জনগণ তাদের দিয়েছে এবং তা মাদরাসা হিসেবেই দিয়েছে। কিন্তু যখন আলিয়া মাদরাসাগুলো পুরোপুরিভাবে সরকারী স্বীকৃতি পেলো এবং সরকারের মতো করে পেলো এবং মাদরাসার আদর্শ জলাঞ্জলি দিলো, দীনের মারকাজ হিসেবে জনগণ তখন তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আমাদের আশঙ্কা, আমরা যদি সরকারের মতো করে আমাদের আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে স্বীকৃতি নিই, তাহলে জনগণ যেমন আলিয়া মাদরাসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তেমনি আমাদের থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিবে। এ জন্য আমাদের দেশের যারা দীনদার মানুষ, তাদের সন্তানকে দীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চান, তারা তাদের সন্তানকে আলিয়া মাদরাসায় দিচ্ছে না। এমনকি আলিয়া মাদরাসায় যারা ভালো ওলামায়েকেরাম, তারাও তাদের সন্তানকে কওমী মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দিচ্ছেন।

চতুর্থ বিষয় হলো, সনদের স্বীকৃতির প্রয়োজন আছে, নাকি নেই এবং স্বীকৃতির ধরনটা কেমন হবে, কোন দৃষ্টি থেকে আমাদের স্বীকৃতির প্রয়োজন। আমি আগেই বলেছি, মৌলিক স্বীকৃতিটা আল্লাহর দরবারে হয়। সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এছাড়া আমাদের দেওবন্দী নেসাবের সনদ আমাদের থেকে নিয়ে রাসূল সা. পর্যন্ত যে ধারাবাহিকতা রয়েছে, এটি দীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশ্বব্যাপী হাদীসের যে সনদ তা আমার জানামতে দেওবন্দী উলামায়েকেরাম ছাড়া আর কেহই তেমনটি করে না। কারণ সিহাহ সিত্তার কিতাবগুলোতে মুসান্নিফ থেকে নিয়ে রাসূল সা. পর্যন্ত সনদ লেখা আছে। এর নিচের দিকে আমি, আমার ওস্তাদ থেকে মুসান্নিফ পর্যন্ত হাদিসের সনদ আমরা সংরক্ষণ করি।

হ্যাঁ, আমরা সরকারের কাছে এতটুকুই দাবি করতে পারি যে, কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা নয় বরং এই কওমী মাদরাসাগুলোতে যে পড়ালেখা শেখানো হয়, এই পড়ালেখাও যে একটি শিক্ষা, সে ব্যাপারে সরকারের ঘোষণা চাই। শিক্ষার এই স্বীকৃতিটুকুই আমরা চাই, সরকারের বেতন বা নিয়ন্ত্রন নয়।

একজন ডাক্তার যেমন সমাজের মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেন, একজন উকিল যেমন সমাজকে আইনের সেবা দেন, আমরাও মানুষকে ধর্মীয় সেবা প্রদান করে থাকি। মানুষকে নামায শিক্ষা দিই, মানুষকে ইসলাম শিক্ষা প্রদান করে তাদেরকে ইসলামের পথে জীবন পরিচালনা করতে উৎসাহিত করি। আমরা দেশের মানুষকে উত্তম চরিত্র শিক্ষাপ্রদানের মাধ্যমে সমাজে শৃংখলা বজায় রাখতে চেষ্টা করি। আমরা চাই, সরকার আমাদের এই সকল সেবাকে স্বীকৃতি প্রদান করুক।

আওয়ার ইসলাম : সরকার যদি আমাদের দাওরার সনদের মাধ্যমে সরকারী চাকুরির সুযোগ দেয়, এ সেক্ষেত্রে আপনার বক্তব্য কী? মাওলানা কাজী

ফজলুল করিম : কওমী মাদরাসা থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখানকার ডিগ্রীধারীরা একই পেশায় সম্পৃক্ত থাকবে, আমি এটা মনে করি না। কওমী মাদরাসায় পড়ে, হাফেজ হয়ে, মুফতী হয়ে, মুহাদ্দিস হয়ে কেউ যদি সরকারী কোন চাকরি করতে চায় তাহলে করতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের ধর্মীয় বিষয়গুলো যেন প্রাধান্য পায়। ধর্মীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সরকারের চাকরি করতে হলে, এ ধরনের স্বীকৃতি আমরা চাই না।
মনে রাখতে হবে, ইতিপূর্বের আলোচনায় আমি দুটি মৌলিক বিষয় উল্লেখ করেছি। ১. শিক্ষার স্বীকৃতি ২. সনদের স্বীকৃতি। আমি প্রথমেই বলেছি, আমাদের সনদের স্বীকৃতি আল্লাহপাক দিয়েই রেখেছেন। নতুন করে এখানে স্বীকৃতি দেয়ার কিছু নেই। কিন্তু আমি মনে করি, আমরা যে শিক্ষা লাভ করি, সরকারী নথিপত্রে আমাদের এই শিক্ষাও শিক্ষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হোক। কারণ আমরা দেখি, বিভিন্ন সরকারী কাগজপত্রে যেমন ধরুন ভোটার আইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্রের ফরমে লিখা আছে, শিক্ষকতা যোগ্যতা কী? সেই ঘর পূরণ করতে গিয়ে আমরা লেখি এসএসসি/এইচএসসি/অনার্স/মাস্টার্ট ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের কওমী ছাত্ররা সেখানে কী লিখবে? যে ছাত্র স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে এসে দাওরায়ে হাদিস পাশ করলো, সে ঐ ফরমে দাওরায়ে হাদিস লিখবে, এই বিষয়টি সরকার কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে।

শিক্ষার স্বীকৃতি আর সনদের স্বীকৃতির মধ্যে পার্থক্য আছে। শিক্ষার স্বীকৃতি হলো, সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স এর মান দিবে। এবং সরকারী যে সকল নথিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করতে হয়, সেখানে দাওরায়ে হাদীসও উল্লেখ করবে।এখন আসুন, সনদ বা সার্টিফিকিটের স্বীকৃতি। এই সনদের স্বীকৃতি হলো যে, এই সনদ কোথায় কোথায় কাজে লাগবে। এই সনদধারী ব্যক্তি রাষ্ট্র থেকে কী কী অধিকার ভোগ করবে। এবং দেশ ও জাতির ক্ষেত্রৈ সে কি অবদান রাখবে। কোন ধরণের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করবে।

যেমন, একজন চিকিৎসক সরকারের কাছ থেকে বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু সুবিধা ভোগ করে। আবার দেশ ও জাতির জন্য সেবাও দেয়। আমরা কী অধিকার নিবো এবং কী সেবা দিবো? এখানে আমার স্পষ্ট বক্তব্য হলো, জনগণ আমাদের যেভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছে, সেটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আমরা সরকার বা রাষ্ট্রের কোন অনুকম্পা সাহায্য সহযোগিতা চাই না। আমরা শুধুমাত্র শিক্ষার স্বীকৃতি চাই। পক্ষান্তরে আমরাও মানুষকে ধর্মীয়ভাবে যে সেবা দিয়ে আসছি এবং ভবিষ্যতেও সেবা দিয়ে যাবো। আমরা সেবা দিই, রাষ্ট্র এ কথার স্বীকৃতি দিক।

আওয়ার ইসলাম : সরকার যেভাবে দিতে চায় আমরা কি সেভাবেই নেবো নাকি আমাদের নির্দিষ্ট কোন অবস্থান রয়েছে?

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : প্রথম কথা, আমাদের দাওরায়ে হাদিসের সনদকে ইসলামিক স্টাডিজের এমএর মান দেয়া আছে। ২০০৬ সালের প্রকাশিত গেজেটে এমনটিই ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে দেখছি সেখানে বলা হচ্ছে, দাওরার সনদধারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ থাকবে। আমার প্রশ্ন হলো, গেজেটের মাধ্যমে দাওরা হাদিসের সনদধারীদের এমএর মান দেয়ায় আছে, তারা তো এমএ ডিগ্রিধারী হয়েই আছে। এখানে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এমএ করার কোনো প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে না। এটি একটি ধোঁয়াশাপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে দাওরায়ে হাদীসকে এমএর মান দিতে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আওয়ার ইসলাম : কওমী মাদরাসাগুলো পরিচালনাকারী কমিশনটি কেমন কমিশন হিসেবে দেখতে চান?

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : আমরা কওমী শিক্ষা কমিশন নামে একটি স্বাধীন কমিশন চাই। যে কমিশন কোনো কওমী মাদরাসার উপর দাপ্তরিক কোনো বিধান আরোপ করতে পারবে না। অর্থাৎ কওমী মাদরাসা শিক্ষা কমিশনের কাজ হবে, যারা বা যে মাদরাসাগুলো স্বীকৃতি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায় বা সরকারী চাকরি করতে আগ্রহী, তারাই কেবল এই কমিশনের অধীনে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। কমিশন এমন হবে না যে, তারা বাংলাদেশের সকল কওমী মাদরাসাগুলোকে নিয়ন্ত্রন করবে।

আওয়ার ইসলাম : কমিশন কর্তৃক নিয়ন্ত্রন হলে সমস্যা কোথায়?

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : সে কমিশনের মাথায় যদি ভূত চেপে বসে, চাই সেটা সরকারী ভুত হোক বা দুনিয়ামুখী আলেমদের ভুত হোক, তাহলে মাদরাসাগুলো সমূহ বিপদের সম্মুখীন হবে। তাই আমি মনে করি, কমিশন এমন হবে যে, কেউ চাইলে তাদের কাছ থেকে সনদ নিতে পারবে, কেউ না চাইলে তাকে জোর করা যাবে না।

আওয়ার ইসলাম : কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া আমাদের শাইখুল ইসলাম শাহ আহমাদ শফী দা.বা. যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই হওয়া উচিত। সরকারের পক্ষ থেকে সাচিবিক পর্যায়ের কেউ এই কমিশনে থাকতে পারবে না। কমিশন শুধুমাত্র ওলামায়েকেরামের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত থাকবে, বাইরের কেউ এখানে থাকবে না।

আওয়ার ইসলাম : সরকারের পক্ষ থেকে একজন সচিব থাকলে সমস্যা কোথায়?

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : দেখুন, আমাদের এই মাদরাসাগুলো শিক্ষার সাথে সাথে দীক্ষা দেয়ার সাথেও সম্পৃক্ত। এখন সরকার যদি ক্ষমতাবলে একজন সচিব নিয়োগ দেয়, তাহলে সমস্যা সৃষ্টি হবে। একটু ব্যাখা দিলেই বুঝতে পারবেন। দেখুন, কোনো সচিব যদি হিন্দু ধর্মের অনুসারী হোন, তাহলে সরকারের আইন অনুযায়ী সেও কমিশনের সচিব হতে পারেন। একজন বেনামাজীও এই কমিশনের সচিব হতে পারেন, যা আমাদের কাম্য নয়। সরকারের তো এমন কোনো নীতিমালা নেই যে, ইসলামী বিধি বিধান মানে এমন একজন এখানে নিয়োগ পাবেন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সচিব দেয়া হবে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য, অন্যকিছু নয়। আইন কানুন সম্পর্কে একজন সচিব এজন্যই দেয়া হবে। তাঁর এই কথাটি মতলবী কথা। কেন, আমাদের মাঝে তো যোগ্যতাসম্পন্ন আলেমের অভাব নেই। সচিব হওয়ার মতো যোগ্যতা রাখেন, এমন একজন আলেমকে সচিবের পদমর্যাদা দিয়ে এই কমিশনে নিয়োগ দিতে সমস্যা কোথায়? আমরা তো বাইরের লোক না। আমরা এদেশের নাগরিক। আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য আমাদের মধ্যে থেকে একজন নির্বাচন করার ব্যাপারে আপত্তি কোথায়?

আওয়ার ইসলাম : যদি সব শর্ত মেনে নিয়ে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়, তাহলে কওমী মাদরাসার ভবিষ্যত নিয়ে আপনার কী মন্তব্য?

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : যা আমি একটু আগেই বললাম। যদি সরকার আলাদা কমিশন গঠন করে, যে কমিশন কোনো মাদরাসাকে নিয়ন্ত্রন করবে না, তাহলে আমি তেমন অসুবিধা দেখি না। আর যদি এমন না হয়, তাহলে কওমী মাদরাসার ভবিষ্যত নিয়ে আমি শঙ্কিত।

আওয়ার ইসলাম : সাধারণ ওলামাকেরামের করণীয় কী?

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : আমার মনে হয় আমাদেরকে নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। ফেসবুক টুইটার বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নবীণ আলেম বা ছাত্রদের পোস্ট কমেন্টগুলোতে বড়দের অসম্মান করে কথা বলা হচ্ছে, যা কাম্য নয়। সর্বোপরী সনদ আমাদের জন্য তেমন জরুরী বিষয় নয়। আমাদের সনদ তো আছেই। বর্তমানে যে সনদের কথা উঠেছে, এটি একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়। এটাকে কেন্দ্র করে কোন বিতর্ক কাম্য নয়। এতে করে শুধু দূরত্ব বাড়বে, সমস্যার সমাধান হবে না। কী হবে, কিভাবে হবে তা বড়রাই ঠিক করবেন। আমাদের যদি দাবি দাওয়া থাকে, আমরা সেটা খুব মার্জিতভাবে তুলে ধরতে পারি। আমাদের স্বীকৃতি হলে সকলেই মিলেই হওয়া উচিত, না হলে সেটাও সকলকে নিয়েই হওয়া উচিত। আমাদের শত বছরের সম্পৃতি এই সনদের কারণে বিনষ্ট না হোক, এটাই কামনা করি।

আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশের মাদরাসাগুলো বিভিন্নভাবে কাজ করছে। তারা বিভিন্ন বোর্ডের তত্বাবধানে পরিচালিত। এক্ষেত্রে এসে সনদ নেয়ার ব্যাপারে ওলামায়েকেরামের মাঝে বিভেদ দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে আমার মন্তব্য জানতে চাই।

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : এখানে বিভক্তি শব্দটাই আমার আপত্তি আছে। আদর্শিক দিক দিয়ে আমাদের মাঝে কোনো বিভক্তি নেই। আমরা কাজের সুবিধার জন্য নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এটা আমাদের কাজের সুবিধার জন্য। এটাকে বিভক্তি বলা যাবে না।

আওয়ার ইসলাম : জি, ঠিক বলেছেন, আপনার কাছে আরো একটি বিষয় জানতে চাই, তাহলো সরকার স্বীকৃতি দেয়ার পর যদি বেতন ভাতাও দিতে চায়, আমাদের করণীয় কী হবে? ইতিহাসে তো আমরা দেখতে পাই, সরকার মাদরাসাগুলোর বেতন নির্বাহ করেছে। উপমহাদেশেও মোঘলদের শাসনামলে সরকারের বেতনেই ওলামায়েকেরাম চলতেন। আমাদের এখানে সমস্যা কী?

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : সরকার যদি বেতন দিতে চায়, সেটা আমাদের নেয়া উচিত হবে না। আর ইতিহাসের যে কথা বলছেন, সেটা তো ছিল খেলাফত ব্যবস্থার অধীনে। বর্তমান সরকার খেলাফত ব্যবস্থার সরকার না। আরেকটি ব্যাপার হলো, কওমী মাদরাসাগুলো দেওবন্দী মাদরাসা। এর আটটি মূলনীতির একটি হলো, জনগণের সাহায্য সহযোগিতায় পরিচালিত হবে। যদি সরকারী বেতন নিয়ে পড়ানো হয় তাহলে এর যে মৌলিকত্ব, তা নষ্ট হবে। সরকারী অর্থ নিয়ে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান তাদের আদর্শ ধরে রাখতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। এ শঙ্কার কারণে আমরা আর্থিক সহযোগিতা নিতে চাই না। আমাদের মৌলিকত্ব বিসর্জন দিতে চাই না। হ্যাঁ, নৈতিক সমর্থন দিলে দিতে পারে, আর্থিক নয়।

আওয়ার ইসলাম : সরকার যদি সরকারী চাকরির সুযোগ দিতে চায়?

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : টাকা পয়সা উপার্জনের জন্য ইলম শিক্ষা করা হারাম। একজন হাফেজ বা আলেমের ইলম শেখার উদ্দেশ্যই হবে দীন। কোনো আলেম যদি ইসলামের স্বার্থ সামনে রেখে চাকরি করতে চায়, তাহলে করতে পারে। চাকরি মূল লক্ষ্য হতে পারে না। মূল লক্ষ্য হবে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন।

আওয়ার ইসলাম : বর্তমান তরুণ ও নবীনদের অভিযোগ হলো, বড়রা তো জীবনে সেট হয়ে গেছেন। এ জন্য তারা আমাদের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে চায় না বলে তারা সরকারী স্বীকৃতির বিরোধীতা করছেন। এ বিষয়ে আপনার কাছে জানতে চাই?

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : এখনকার যারা নবীন, তারা বড়দের বর্তমান সময়টাকে দেখছে। এ পর্যায়ে আসার জন্য বড়রা যৌবনে যে পরিমান কষ্ট করেছেন, তা বিবেচনায় রেখে কথা বলতে হবে। তারা নবীন থাকতে যে কষ্ট করেছেন, তা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। আরেকটি কথা বলতে চাই, তা হলো- আমরা আমাদের ওস্তাদদের রুহানী সন্তান। তারা আমাদের পিতা। কোনো পিতা তার সন্তানের খারাপ চান না। কাজেই কেউ যদি এমন ধারণা রাখে, তাহলে তার পর্যবেক্ষণ ভুল।

আওয়ার ইসলাম : কিছু কিছু কওমী মাদরাসাগুলোর কালেকশন পদ্ধতি লজ্জাজনক। নিন্দনীয়। এমনকি অনেক অভিভাবক এ কারণে মাদরাসায় দেন না যে, তার সন্তানের মাধ্যমে কালেকশন করে নেয়া হবে। সরকারী অর্থ নিলে এই কালেকশনের প্রয়োজন পড়বে না। সমাজে থাকা খারাপ ধারণাগুলো দূর হয়ে যাবে।

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : আমাদের কিছু মাদরাসাগুলোতে যে পদ্ধতিতে কালেকশন করা হয়, তা অবশ্যই ঠিক না। শরীয়তের পক্ষ থেকেও এর অনুমোদন দেয়া হয় না। এই জন্য আমাদের দায় আছে। দায় আছে মাদরাসা পরিচালনা কমিটিরও। তারা আমাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাধ্য করে থাকেন। কমিটি বলে দেয় যে, আপনারা কালেকশন করে বেতন নেন। এক্ষেত্রে ইংরেজি শিক্ষিত কমিটিরাও দায়ী। দেওবন্দের নীতি এমন নয়। আমি নিজে দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র। সেখানে ফসলের সময় সাধারণ মানুষ নিজ উদ্যোগে তাদের ফসলের একটি অংশ পৌঁছে দেন। এমনটাই হওয়া উচিত। তাই বলে সরকারী সাহায্য নেয়া যাবে না। তাতে আমাদের স্বকীয়তা বিসর্জন দিতে হবে। আমরা আমাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবো। আমাদের উচিত হবে, সাধারণ মানুষকে বোঝানো যে, কালেকশনের পদ্ধতি এমন। মাদরাসা পরিচালনা কমিটি চাঁদা আদায় করবে। ওস্তাদরা পড়ানো নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।

আওয়ার ইসলাম : আওয়ার ইসলামকে সময় দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

মাওলানা কাজী ফজলুল করিম : আপনাদের মাধ্যমে কথাগুলো হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পেরে আপনাদেরকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ