বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


‘আনা সাগর’-এর তীরে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ana-sagarড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

দেশভ্রমণ মানুষের, অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে, স্মৃতিকে নাড়া দেয়, অনুভূতিকে সতেজ করে এবং চেতনাকে শাণিত করে। ভারতের বড় বড় শহরে রয়েছে মুসলমানদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের নিদর্শন। এসব নিদর্শন দেখলে একটি কথা বারবার মনে পড়ে এ পৃথিবী একেবারে ক্ষণস্থায়ী। এককালে যারা দোর্দণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করেছেন, আয়েশী জীবন উপভোগ করেছেন ষোলআনায়, চাকর নফর সেবিকা পরিবেষ্টিত থাকতেন সারাক্ষণ, ধন দওলত হীরা জহরত যাদের পায়ের গোড়ায় গড়াগড়ি খেত তাঁরা আজ কবরের মাটির সাথে মিশে গেছেন। তাঁদের খাসমহল, রঙমহল, নহবতখানা, উদ্যানরাজি ও স্নানাগারগুলো নির্জনতার বেদনায় খাঁ খাঁ করছে। কেবল দেয়ালগুলো ছাড়া সবকিছু লুঠ হয়ে গেছে। লালইটের সুরম্য প্রাসাদরাজি আমাদের চোখে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলছে স্বল্পসময়ের ব্যবধানে আমাদের সবাইকে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। দুনিয়ার সব কাজের জন্য তাঁর কাছে হিসাব দিতে হবে।

৭ জুন’ ২০১৬ ভোরে আজমিরের ‘আনা সাগর’ দেখতে যাই। নৈসর্গিক পরিবেশ, মৃদুমন্দ হাওয়া ও স্থির নীলজলরাশি মন ভরে দেয়। চারদিকে পানিতে নানা প্রজাতির মাছের জলকেলি ও মুক্ত হাঁসের অবাধ বিচরণ হৃদয়ে দোলা দেয়, চোখ জুড়ায়। কিছু মানুষকে দেখলাম মাছকে আগ্রহভরে খাবার দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ নগর জীবনের কোলাহল ছেড়ে সকালে বিকেলে ব্যস্ততার ফাঁকে প্রাকৃতিক ছোঁয়ায় উৎফুল্ল হওয়ার বাসনায় ‘আনা সাগর’-এর তীরে এসে ভিড় জমায়। জোৎস্না আলোকিত রাতে হৃদের হৃস্বতর তরঙ্গে আলোকজ্জ্বল শহরের প্রতিদীপ্তি যেভাবে মনে পুলক শিহরণ জাগায় হয় তা অনুভব করা যায় কিন্তু ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। পর্যটকদের বিশ্রাম ও অবকাশ সুবিধা নিশ্চিত করে মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গির আনাসাগরের তীরে ‘দওলতবাগ’ নামে একটি সবুজ উদ্যান এবং ১৬৩৭ সালে সম্রাট শাহজাহান মর্মর পাথরের ৫টি পাকা প্যাভিলিয়ন তৈরি করেন। সাগরের তীর ঘেঁষে পাহাড়চুড়ায় ব্রিটিশ অফিসারদের জন্য নির্মিত সার্কিট হাউসটি চোখে পড়ার মত। আনাসাগর ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ট হৃদ।

সাগর নাম হলেও মূলত এটা মানবসৃষ্ট বিশালায়তনের হৃদ। তারাঘুর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এ হৃদ তৈরি করেন দিল্লী ও রাজস্থানের মহারাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানের পিতামহ আনাজি তুষার (১১৩৫-১১৫০)। তাঁর নামেই হৃদের নামকরণ। দ্বাদশ শতাব্দীতে ১৩কিলোমিটার বিস্তৃত এ হৃদ তৈরি করা হয় লুনী নদীতে বাঁধ দিয়ে অভ্যন্তরীণ পানির চাহিদা মেটানোর জন্য। হৃদের অববাহিকা অঞ্চল প্রায় ৫ কি.মি, গভীরতা ৪.৪মিটার এবং জমা পানির পরিমাণ ৫০লাখ কিউবিক মিটার। আনাসাগরের কোলঘেঁষে শতাধিক আবাসিক হোটেল ও আধুনিক স্থাপত্যশৈলীসমৃদ্ধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি রাজস্থান হাইকোর্ট আনাসাগরের তীরে নতুন কোন স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। হৃদের মাঝে রয়েছে একটি ছোট্ট দ্বীপ নৌকা ও স্পিডবোটে সেখানে যাওয়া যায়। ভারতীয় খাবারের রেস্তোরাঁ ও বিশ্রামাগার আছে। আনাসাগরের পানি এখনো বেশ স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন। আশে পাশের বর্জ্য ও ময়লা পানি যাতে হৃদে না পড়ে সেজন্য ৮টি ছোট বড় ড্রেন নির্মিত হয়েছে। তবে যে হারে মানুষ ও পশুর স্নান, কাপড় কাঁচা ও উপকূল বিধৌত কর্দমাক্ত পানি হৃদে পড়ছে কিছুদিনের মধ্যে পানি দুষিত হওয়ার আশংকা করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীগণ।

উইকিপিডয়ার ভাষ্যানুযায়ী ভারতবর্ষে ধর্মপ্রচারক ও চিশতীয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহ সূফী খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতী রহ. (১১৪১-১২৩৬) ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আজমীর আসেন। স্থানীয় জনগণ তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের হৃদের পানি ব্যবহারে বারণ করেন। তিনি হৃদের এক কাপ পানি দিতে তাঁদের অনুরোধ করলে তাঁরা সম্মত হয়ে পানি দেন। পরদিন হৃদের পানি শুকিয়ে যায়। স্থানীয় জনগণের মাঝে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তাঁরা বুঝতে পারেন হযরত খাজা সাহেব রহ. অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দরবেশ ও আল্লাহর অলি। তাঁরা কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করেন এবং ওই কাপের পানি হৃদে ফেলে দেয়ার হুকুম দেন। আল্লাহর কৃপায় পরদিন হৃদ পানিতে ভর্তি হয়ে যায়। এটা হযরত খাজা সাহেবের কারামত। এর পর থেকে তাঁর শীষ্য ও অনুসারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আজমীরের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে আনাসাগর অন্যতম।

লেখক: অধ্যাপক, ওমরগণী কলেজ চট্টগ্রাম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ