শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হামিদ মীর0urislam-hamid-mir-copy

বর্তমান বিশ্বে বিদ্বেষ ও অত্যাচার বেড়েই চলেছে। নির্যাতিত মজলুম মানুষেরা ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। অন্যায় অবিচার থেকে উগ্রতা জন্ম নিচ্ছে। অথচ ক্ষমতাধর গোষ্ঠীগুলোকে ওই উগ্রতার কারণগুলো নিরসনে চিন্তাশীল বিবেচক দেখা যায় না। ওই ক্ষমতাধর গোষ্ঠীগুলোর স্বার্থ থেকে জন্ম নেওয়া বিরোধিতা বিশ্বশান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। একদিকে কিছু ক্ষমতাধর পশ্চিমা দেশ সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনকারী কিছু বিদ্রোহী গ্র“পকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে ওই সভ্য দেশগুলি অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়নের ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ওই বিপরীতমুখী আচরণ এই প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে যে, যদি সিরিয়াতে সশস্ত্র আন্দোলন বৈধ হয়, তাহলে কাশ্মিরে বৈধ নয় কেন? জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবের আলোকে কাশ্মির একটি বিরোধপূর্ণ অঞ্চল। সেই বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে উপস্থিত বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলাকে কীভাবে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া যেতে পারে? জম্মু-কাশ্মিরে অব্যাহত বিক্ষোভের ব্যাপারে ভারত বিশ্বকে এ কথা বলছে যে, ওই বিক্ষোভের পেছনে পাকিস্তান রয়েছে।

পাকিস্তান অস্তিত্ব লাভ করেছে ১৯৪৭ সালে। আর জম্মু-কাশ্মিরের এই বিক্ষোভের ইতিহাস শুরু হয়েছে ১৯৩১ সাল থেকে। ভারত এই বিক্ষোভকে কিছু ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলেও অভিহিত করেছে। এটাও বলা হচ্ছে যে, পাকিস্তানে একটি বিশেষ চিন্তাধারার মানুষেরা কাশ্মিরিদের স্বাধীনতার অধিকারের সমর্থক। আর অবশিষ্ট পাকিস্তানিদের কাশ্মিরিদের নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। নিঃসন্দেহে পাকিস্তানে এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নিজেদের জন্য একটি বোঝা মনে করে এবং পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির ভুলের মাশুল হিসেবে কাশ্মির বিষয়ে চুপ থাকাকে পাকিস্তানের মঙ্গল মনে করে। অপরদিকে পাকিস্তানে এমন ব্যক্তিও রয়েছে, যারা কাশ্মিরকে নিজেদের ব্যক্তিগত জমিদারি ও কাশ্মিরবাসীকে নিজেদের গোলাম মনে করে। কাশ্মির সমস্যাকে ভূমি ও পানির ঝগড়াও ভাবা হয়। আর ওই ঝগড়ায় জয় লাভের আশায় মজলুমের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে কম দেখা যায় এবং শত্র“কে নীচ দেখানোর স্বপ্ন দেখতে বেশী দেখা যায়। কাশ্মিরিদের সৌভাগ্য যে, পাকিস্তানের শাসকশ্রেণির দ্বিমুখীনীতি ও ভুল পদক্ষেপসত্ত্বেও পাকিস্তানিদের এক বিশাল অংশ আজও তাদের সাথে রয়েছে। পাকিস্তানের সকল বড় কবি সর্বদা কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীদের সমর্থন করেছেন। এই অধম নিজে জনাব হাবীব জালেব ও জনাব আহমদ ফারাজের মুখে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করতে শুনেছি। ফারাজ সাহেব তো এই বিষয়টা নিয়েও বেশ গর্ব করতেন যে, ১৯৪৮ সালে কাশ্মিরিদের সাহায্যের জন্য গমনকারী গোত্রীয় লশকরে তিনি নিজেও শামিল হয়েছিলেন। তিনি কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।

এ বছর ঈদুল ফিতরের দিন থেকে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মিরিদের ওপর নির্যাতনের যে স্টিম রোলার চালিয়েছে সে বিষয়ে আমার মুখ দিয়েও কিছু প্রতিবাদ সোচ্চারিত হয়েছে। আমাকে এক ভারতীয় সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, যদি তারা বেলুচিস্তানে যে নিপীড়ন হয়েছে তা নিয়ে বলা শুরু করেন এবং বেলুচদের বিকৃত লাশের ছবি টুইটারে পোস্ট করা শুরু করেন তাহলে আমার কেমন লাগবে? আমি তাকে বললাম, প্রথমত বেলুচদের অধিকার নিয়ে আমরা নিজেরাই সোচ্চার। দ্বিতীয়ত বেলুচিস্তান বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের কোনো প্রস্তাব নেই। তৃতীয়ত বেলুচিস্তান সম্পর্কে পাকিস্তানের সংবিধানে কোনো ৩৭০ নং ধারা নেই। এই ৩৭০ নং ধারা আপনারাই জম্মু-কাশ্মির সম্পর্কে ভারতের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সুতরাং বেলুচিস্তান ও কাশ্মিরের মাঝে কোনো তুলনা চলে না। ভারতীয় সাংবাদিক বলেন, পাকিস্তানের প্রগতিশীল ও মডারেট ব্যক্তিরা কাশ্মিরের পরিস্থিতিতে নীরব। আমার হাসি বেরিয়ে আসে। আমি তাকে বললাম, পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রগতিশীল ও মডারেট কণ্ঠ আসমা জাহাঙ্গীর অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে ভারতের অত্যাচার ও নিপীড়নের প্রকাশ্যে নিন্দা করেছেন। যখন আমি তাকে বললাম, পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবাল থেকে শুরু করে হাবীব জালেব পর্যন্ত সকল ডান-বাম কবি কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীদের সমর্থন দিয়েছেন, তখন তিনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। ভারতীয় সাংবাদিকদের কথা বাদ দিন। আজ আমি পাকিস্তানি সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে চাই। অনেক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী কাশ্মিরের বিষয়টাকে উপেক্ষা করেন, কেননা তাদের ধারণামতে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ নিজেদের টিকে থাকার জন্য এ সমস্যাটা দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। আমি আমার সহকর্মীদের সামনে শুধু এ প্রশ্নটা করছি যে, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, হাবীব জালেব ও আহমদ ফারাজও কি ওই ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠিত প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের কথামতো কাশ্মিরিদের সমর্থন করেছিলেন? বর্তমানে এই বিতর্ক ত্যাগ করুন যে, পাকিস্তানের ক্ষমতাধর দপ্তরগুলো কাশ্মিরিদের স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্য করেছে অথবা তাদের ক্ষতি করেছে। শুধু এ বিষয়টা মাথায় রাখুন যে, ১৯৪৮ সালের ৩ জানুয়ারি লাহোরের পাকিস্তান টাইমস-এ পাকিস্তানের খ্যাতনামা চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ হয়েছিল, যেখানে কাশ্মিরিদের স্বাধিকারের পক্ষে সমর্থন করা হয়েছিল। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ও হাফিজ জলান্ধরিসহ অনেক কবি-সাহিত্যিক শামিল ছিলেন।

এই কলামের পরিসর ছোট। নতুবা এখানে আমি জোশ মালিহাবাদী, আহমদ নাদিম কাসেমী, মাজীদ আমজাদ, নাঈম সিদ্দীকী, জাফর তাহের, শানুল হক হাক্কী, জহির কাশ্মিরি, ইফতেখার আরেফ, আমজাদ ইসলাম আমজাদ ও সফদর মীরসহ অন্যান্য পাকিস্তানি কবির বক্তব্য বর্ণনা করতাম, যারা আল্লামা ইকবালের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থন করেন। ওই সব জনপ্রিয় কবির বক্তব্য মূলত পাকিস্তানের জনমতের আশা-আকাঙ্খার বহিঃপ্রকাশ ছিল। আগা শূরেশ কাশ্মিরি একবার বলেছিলেন, ম্যাঁয় কিস যুবান সে কাহুঁ ইস যামীন পে কিয়া হোগা/ মুঝে ইয়াকীন হ্যায় ইহাঁ কোয়ী মারাকা হোগা/ ফাযা মেঁ নারায়ে তাকবীর গুঁজতা হোগা/ স্রীনাগার মেঁ কিয়ামাত কা সামনা হোগা। - আমি কোন ভাষায় বলি, এ ভূখণ্ডে কী হবে?/ আমি নিশ্চিত এখানে কোনো রণক্ষেত্র হবে/ আকাশে গর্জিত হবে নারায়ে তাকবীর/ শ্রীনগরে কিয়ামত আবির্ভূত হবে।

আজ শ্রীনগরে বাস্তবিকই কিয়ামত চলছে। আর কাশ্মিরি যুবকরা বুরহান মোজাফ্ফর ওয়ানির রাস্তাকে নিজের রাস্তা বলে অভিহিত করছে। হাবীব জালেবের একটি কবিতা কাশ্মিরিদের জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে, কাশ্মীর কী ওয়াদী মেঁ লাহরা কে রাহূ পারচাম/ হার জাবের ওয়া যালেম কা কারতে হী চালো সার খাম।- কাশ্মিরের উপত্যকায় পতাকা উড়াতে থাকো/ সব উৎপীড়ক ও জালিমের মাথা অবনত করেই চলো।

নিবেদন করছি, আজ পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষ কাশ্মিরিদের পক্ষে কথা তো বলছেন, কিন্তু কার্যত তাদের আরও কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে। পরিস্থিতির দাবী হচ্ছে, পার্লামেন্টের যৌথ বৈঠকে অভিন্ন প্রস্তাবের মাধ্যমে জাতিসঙ্ঘকে তার কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেওয়া হোক এবং কাশ্মিরকে নিয়ে সর্বদলীয় কনফারেন্স ছাড়াও একটি ইন্টারন্যাশনাল কাশ্মির কনফারেন্সের আয়োজন করা হোক, যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে কাশ্মির সমস্যা ঐতিহাসিক দলীলপত্রসহ উপস্থাপন করা হবে। আমরা সাংবাদিকরা তো এটা করতে পারি যে, ইকবাল থেকে নিয়ে জালেব ও ফারাজ পর্যন্ত প্রসিদ্ধ কবিরা কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীদের জন্য যা কিছু বলেছেন, তা নিউ জেনারেশনের কাছে বারবার তুলে ধরব। জোশ মালিহাবাদী কাশ্মিরিদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, সো বাত কী ইয়ে বাত হ্যায় ইস বাত কো মানো/ জীনে কা জো আরমান হ্যায় তো মওত কী ঠানো- শত কথার এক কথা- এই কথা মানো/ বেঁচে থাকার আকাঙ্খা আছে যখন, তো মৃত্যুরও সংকল্প করো।

ভারত সরকার এই জোশকে ১৯৫৪ সালে পদ্মভূষণ প্রদান করেছিল। ১৯৫৮ সালে জোশ পাকিস্তান এসে কাশ্মিরিদের সমর্থন দেন। ভারত সরকারের কিন্তু পদ্মভূষণ ফিরিয়ে নেওয়ার দুঃসাহস হয়নি।

পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর : ইমতিয়াজ বিন মাহতাব 

ahmadimtiajdr@gmail.com

 

* হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক

এফএফ


সম্পর্কিত খবর