শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


একজন ইমামের দায়-দায়িত্ব

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

0urislam-imamড. মাওলানা মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক

এক. ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব : ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের শুরুতেই আসে একজন ইমামের অধ্যয়ন, মুতালায়া, ও পড়া-শোনা করার বিষয়টি; কেননা ইমাম হচ্ছেন নিদেনপক্ষে ধর্মীয় নেতা_ বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামাজিক নেতা নাই বা বললাম _ আর একজন নেতাকে তার নিজস্ব বলয়ে যথার্থ যোগ্যতার প্রমাণ রাখা খুবই জরুরি। একজন ইমামের অধ্যয়ন-পঠনের আকার প্রকৃতি কী হবে তা ইমামের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বলয় নির্ধারণের পর পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে আশা রাখি। তবু এখানে, এ-সংক্রান্ত একটা প্রাথমিক ছক আঁকা যায়। আর তা হল নিম্নরূপ:

১. নামাজের মাসআলা-মাসায়েল বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞানার্জন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থ ও ফেকার কিতাবসমূহের সালাত অধ্যায় রপ্ত করে রাখা জরুরি। নামাজ বিষয়ক জ্ঞানের প্রবাহ ধরে রাখার জন্য মাঝে মাঝে এসব অধ্যায় মুতালাআ-অধ্যয়ন আবশ্যক বলে মনে করি। তাছাড়াও বিশেষভাবে রচিত নামাজ বিষয়ক গ্রন্থগুলোও সংগ্রহে রাখা প্রয়োজন।

২. নামাজের হুকুম আহকাম মাসায়েল বিষয়ক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ইসলামের সামগ্রিক জীবনাচার, পথ ও পদ্ধতি, বিধি-বিধান সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ অধ্যয়ন করা একজন ইমামের জন্য আবশ্যক বলে মনে করি; কেননা একজন ইমামের দায়-দায়িত্ব কেবল ইমামতিতেই শেষ হয়ে যায় না, তাকে বরং মুখোমুখি হতে হয় নানাধর্মী প্রশ্নের, যার শরিয়তসিদ্ধ উপযুক্ত সমাধান বের করা অতীব জরুরি।

৩. আমল আখলাকে দৃঢ়তা আনার জন্য প্রতিদিনই তাফসিরসহ আল কুরআনুল কারিম সাধ্যমত অধ্যয়ন, রিয়াজুসসালেহীন ও অন্যান্য হাদিসগ্রন্থসমূহ থেকে প্রতিদিনই দুএকটি হাদিস অধ্যয়ন করা ইমামদের জন্য আবশ্যক বলে মনে করি।
ব্যক্তিত্বগঠন বিষয়ক নানামুখী বইপুস্তক ও গবেষণা সংগ্রহে রাখা ও অধ্যয়ন করাও ইমামদের জন্য জরুরি বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে।

৪. জীবনে সফলতা অর্জন কীভাবে সম্ভব এ বিষয়ে গবেষণাধর্মী ও উৎসাহবেঞ্জক বইপুস্তক অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ড. আয়েজ আল কারনীর ( لا تحزن (,مفتاح النجاح) ) মাওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খানের (زار حيات) এবং ডেল কার্নেগির রচনাসমগ্র বিশেষভাবে অধ্যায়নের পরামর্শ দিচ্ছি।

৫. সময় নিয়ন্ত্রণের কৌশল বিষয়ক বইপুস্তক অধ্যয়ন করা আবশ্যক; কেননা একজন ইমামের প্রতিটি মুহূর্ত সৃজনশীল ও গঠনমূলক কাজে ব্যয় হতে হবে। শুধু জীবিকানির্বাহ নয়, বরং ইসলাম, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য একজন ইমামকে উল্লেখযোগ্য কিছু করে যেতে হবে, যা কঠিনভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত সম্ভবপর নয়। অবশ্য এ বিষয়ে অনেকেরই উৎসাহ-আগ্রহ রয়েছে নিশ্চিতরূপেরই, তবে পথ ও পদ্ধতি না জানা থাকায় চেষ্টা সত্ত্বেও ব্যর্থ হচ্ছেন অনেকেই। তাই এ বিষয়ে সহায়ক গ্রন্থসমূহের অধ্যয়ন আবশ্যক বলে মনে করি।

৬. পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বিষয়ক সহায়ক বইপুস্তক অধ্যয়ন ইমামের জন্য জরুরি; কেননা অপরিকল্পিত জীবন ব্যর্থ হতে বাধ্য। পরিকল্পনা- সফল মানুষের আচ্ছাদন, তাই এ বিষয়টিকেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিতে হবে এবং সহায়ক গ্রন্থ, ট্রেনিং কোর্স ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেকে সফল পরিকল্পক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

৭. বক্তৃতা কখনো কখনো যাদুর কাজ করে, হাদিসে এসেছে إن من البيان لسحرا [ হায়ছামি, মাজমাউযাওয়ায়েদ:৮/১১৯] বড় বড় আন্দোলন বক্তৃতার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে বলে একটা কথা আছে। বাস্তবতার সাক্ষীও তাই। সে হিসেবে একজন ইমামের জন্য বক্তৃতায় সিদ্ধহস্ত হওয়া খুবই জরুরি। তবে বক্তৃতার মাধ্যমে শ্রোতাকে প্রভাবিত করার জন্য সুরের মূর্ছনা প্রবাহিত করা আবশ্যক নয়, এর জন্য বরং প্রয়োজন কিছু কলাকৌশল রপ্ত করার এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ঐকান্তিকভাবে চেষ্টা করে যাওয়ার। এ ক্ষেত্রে ডেল কার্নেগির ‘ বক্তৃতা শিখবেন কীভাবে’ খুবই উপকারী একটি গ্রন্থ। বক্তৃতার কলাকৌশল শেখার পাশাপাশি কথা বলার কৌশলও ইমামদের রপ্ত করা উচিত। বর্তমানে আমাদের দেশেও এসব ব্যাপারে প্রশিক্ষণ হচ্ছে যাতে অংশ নেওয়া ইমামদের জন্য উপকারী হবে বলে বিশ্বাস।

৮. ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ের প্রতি একজন ইমামকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে আর তা হল, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, মসজিদভিত্তিক ও সামাজিক দায়-দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। নিজের ছেলেমেয়ের ব্যাপারে অযত্নবান থেকে সারাক্ষণ সামাজিক ও দাওয়াতি কার্যক্রমে নিজেকে নিবিষ্ট রাখা যেমন উচিত নয়, তেমনি নিজের পরিবার ও সন্তানকে ঘিরেই সকল দৌড়ঝাঁপ সম্পন্ন করাও উচিত নয়। ইমামকে বরং, এ ক্ষেত্রে, ভারসাম্য রক্ষা করে সকল ক্ষেত্রে সমান সফলতার ছাপ রাখতে হবে।

৯. সামাজিক ক্ষেত্রে ইমামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নানাবিধ সামাজিক সমস্যা ইমামের সামনে প্রায়শঃ হাজির করা হয়। তাই সমাজ ও সামাজিক সমস্যা বিষয়ে একজন ইমামের যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান থাকা জরুরি। ইসলামের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি সকল সমস্যার জন্য দায়ী, এ কথা যেমন শতভাগ সত্য, তদ্রুপভাবে এটাও সত্য যে আধুনিক সমাজের গতিপ্রকৃতি, অবকাঠামো, সামাজিক সম্পর্কের জটিলতা, আকার প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা অর্জিত না হলে ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে একটি সুস্থ সমাজের বিনির্মাণ কার্যক্রমের পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন, কেবল একটি দিবাস্বপ্নই থেকে যাবে। এমনকী মসজিদের আওতাধীন সমাজভুক্ত মানুষদের সমস্যাগুলো যথার্থরূপে নিরীক্ষণ করাও অনেকটা কঠিন হবে বই কি। তাই একজন ইমামের সমাজবিজ্ঞান বিষয়েও যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান অর্জন জরুরি বলে মনে করি।

১০. ইমাম যেহেতু ইসলাহি ও দাওয়াতি কাজের সাথে জড়িত থাকেন, তাই মানুষের মনমানসিকতা বোঝা, এবং সে অনুসারে প্রতিটি মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের আওতায় নিয়ে আসার পদক্ষেপসমূহ নির্ধারণের তাগিদে প্রত্যেক ইমামের জন্য মনোবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যয়ন ও কমপক্ষে প্রাথমিক কিছু ধারণা অর্জন আবশ্যক বলে মনে করি।

১১. যুগের ভাষায় ইসলামি মূল্যবোধের নবতর উপস্থাপনের প্রয়োজনে আয়েম্মায়ে কেরামদেরকে আরো যেসব বিষয় অধ্যয়ন-মুতালাআর আওতায় আনতে হবে এবং নিদেনপক্ষে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করতে হবে তা হল: আধুনিক তর্কশাস্ত্র, আধুনিক দর্শনশাস্ত্র, ইতিহাস, রাজনীতি বিজ্ঞান, সাংবাদিকতা, প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞান, এডুকেশনাল সাইন্স, জীব বিজ্ঞান, সৌর বিজ্ঞান, বংশানুগতি বিজ্ঞান, কম্পিউটার বিজ্ঞান, অর্থনীতি বিজ্ঞান ইত্যাদি।

এছাড়া ভাষাগত দক্ষতা অর্জন
ক. আরবি ভাষা : আরবি ভাষায় লিখিত কিতাবাদি বোঝার উপযোগী ভাষাগত জ্ঞান রাখা প্রত্যেক ইমামেরই কর্তব্য। কুরআন, কুরআনের তাফাসির; হাদিস, হাদিসের শুরুহাত, ফেকাহ, উসুলে ফেকাহ ইত্যাদির মৌলিক গ্রন্থগ্রলো আরবি ভাষায়। সে হিসেবে আরবি ভাষা বোঝার মতো দক্ষতা অর্জন খুবই জরুরি। অন্যথায় ইসলামি জীবনবোধের সঠিক উপস্থাপন, বিধি-বিধানের সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সর্বোপরি সঠিক অর্থে ইসলামের প্রতিনিধিত্বকরণ সম্ভব হয়ে উঠ'বে না। বাংলা অথবা ঊর্দু ভাষার আশ্রয়ে ইসলামী জবীনবোধের সঠিক ভাবোদ্ধার সবসময় নিরাপদ নয় বললে ভুল হবে না। কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের সুধারণা থাকতে পারে, কিন্তু তিনি যে সবকিছুই শ ভাগ বিশুদ্ধতার সাথে বুঝতে পেরেছেন তার গ্যারান্টি আমাদেরকে কে দেবে?

খ. বাংলা ভাষা: বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, জাতীয় ভাষা। আমাদের মুখাতাব, মুসুল্লি, শ্রোতা, পাঠক সবাই বাঙ্গালী, বাঙলা-ভাষাভাষী। তাই বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন না করলে ইসলামি আকিদা-বিশ্বাস, আদর্শ, জীবনদর্শন, স্পষ্টাকারে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, তথা البلاغ المبين(আল-বালাগুল মুবিন) এর দায়িত্ব পালন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। শুধু তাই নয় বরং বাংলা ভাষায় সিদ্ধহস্ত না হলে إعلاء كلمة الله (এলায়ে কালেমাতুল্লাহ) এর দায়িত্ব _ অন্তত আমাদের বাংলাদেশের পরিমণ্ডলে _ আঞ্জাম দেওয়া আমাদের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়েব। আর যেহেতু আমাদের মুহতারাম আয়েম্মাদের হাতে _ আমার ধারণা মতে_ যথেষ্ট সময় থাকে, তাই একটু গুরুত্ব দিলেই এ বিষয়টি সম্পন্ন হতে পারে বলে বিশ্বাস। উলামা মাশায়েখ ও আয়েম্মাদের জন্য বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লামা আবুলহ হাসান আলী আন নাদভী রা. এর একটি বক্তব্য নিবিষ্টচিত্তে, নতুন করে অনুধাবন করা আবশ্যক বলে মনে করি। ১৪ মার্চ ১৯৮৪ সালে জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোগঞ্জে সমবেত উলামা মাশায়েখদের উদ্দেশে তিনি বলেন: ( বাংলা ভাষাকে আপনারা অস্পৃশ্য মনে করবেন না। বাংলা ভাষা ও তার সাহিত্য চর্চায় কোনো পুণ্য নেই, যত পুণ্য সব আরবি আর ঊর্দূতে, এ ধারণা বর্জন করুন। এটা নিছক মূর্খতা, নিজেদেরকে বাংলা ভাষায় বিরল প্রতিভারূপে গড়ে তুলুন। আপনাদের প্রত্যেককে হতে হবে আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখক, সাহিত্যিক, ও বাগ্মী বক্তা। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় আপনাদের থাকতে হবে দৃপ্ত পদচারণা, লেখনী হতে হবে রস-সিক্ত ও সম্মোহনী শক্তির অধিকারি যেন আজকের ধর্মবিমুখ শিক্ষিত তরুণ-সমাজ ও অমুসলিম লেখক সাহিত্যিকদের লেখনী ছেড়ে আপনাদের সাহিত্য কর্ম নিয়েই মেতে উঠে, বিভোর হয়ে থাকে। ) [ প্রাচ্যের উপহার : পৃষ্ঠা ২৫ ] তিনি আরো বলেন: ( দেশের ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমরা যদি উদাসীন ও নির্লিপ্ত থাকি তবে তা স্বাভাবিকভাবেই অনৈসলামিক শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ফলে যে ভাষা ও সাহিত্য হতে পারত ইসলাম প্রচারের কার্যকর মাধ্যম, তাই হয়ে দাঁড়াবে শয়তানের শক্তিশালী বাহন। ) [ প্রাচ্যের উপহার : পৃষ্ঠা ২৯] তিনি আরো বলেন : ( আমার কথা মনে রাখবেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে নিতে হবে। দুটি শক্তির হাত থেকে নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। অমুসলিম শক্তির হাত থেকে এবং অনৈসলামি শক্তির হাত থেকে। আনৈসলামি শক্তি বলতে সেই সব নামধারী মুসলিম লেখক সাহিত্যিকদের কথাই আমি বোঝাতে চাচ্ছি যাদের মন-মগজ এবং চিন্তা ও কর্ম ইসলামি নয়। মোট কথা, এ উভয় শক্তির হাত থেকেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হবে। এমন অনবদ্য সাহিত্য গড়ে তুলুন যেন অন্য দিকে কেউ আর ফিরেও না তাকায়।) [ প্রাচ্যের উপহার : পৃষ্ঠা২৭ ] নাদভী রা. এর এ বক্তব্যের পর উলামা মাশায়েখ ও আয়েম্মাদের জন্য বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন যে কতটুকু প্রয়োজন সে ব্যাপারে নতুন কিছু বলার থাকে না।

দুই. মসজিদ কেন্দ্রিক দায়-দায়িত্ব : মসজিদে নববি, যেখানে নবী সা. আজীবন ইমামের দায়িত্ব পালন করে গেছেন, তা কেবল নামাজের স্থান ছিল না, বরং, বলা যায়, তা ছিল সমাজ ও রষ্ট্রকেন্দ্রিক সকল কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। মসজিদে নববীর সেই প্রাচীন ভূমিকার অনুবর্তন, আমাদের মসজিদগুলোতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদিও সম্ভব নয়, তবু, আমাদের সাধ্যের আওতাধীন, যতদূর সম্ভব, মসজিদের কার্যপরিধিকে সম্প্রসারিত করে প্রতিটি মসজিদকে একটি ইসলামি মার্কাযে পরিণত করা । পাশ্চাত্যবিশ্বের মসজিদগুলো এ ভূমিকা বহু আগে থেকেই পালন করে যাচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকা মসজিদ বলতেই, হোক তা ছোট, একটি ইসলামি মার্কায। সে হিসেবে একজন ইমামকে মসজিদ কেন্দ্রিক যেসব দায়-দায়িত্ব পালন করা উচিত বলে মনে করি তা হল নিম্নরূপ।

১. প্রতিটি মসজিদে একটি কল্যাণমূলক ইসলামি লাইব্রেরি স্থাপন করা এবং মসজিদের আওতাভুক্ত সকল মুসুল্লি ও তাদের স্ত্রীদেরকে এ লাইব্রেরির সদস্য করে নেওয়া। প্রত্যেক সদস্যকে নির্দিষ্ট সংখ্যক বই ক্রয় করে দেওয়ার অনুরোধ জানানো এবং পাঠাগার থেকে নিয়মিত বই সংগ্রহ করে পড়তে উৎসাহ দেওয়া, তাদেরকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য সময় সময় পুরস্কারের ব্যবস্থা করা। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা। নারীরাও ঘরোয়া পরিবেশে ইমামের দিকনির্দেশনায়, এ জাতীয় প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে পারে, করা আবশ্যক। কল্যাণমূলক লাইব্রেরির একটি কাজ হবে বিভিন্ন বিষয়ে লিফলেট তৈরি করা এবং মসজিদের একটি স্থানে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য তা রেখে দেওয়া। বিনামূ্ল্যে বিতরণের জন্য এ জাতীয় বিষয়ভিত্তিক লিফলেট বিতরণের কার্যক্রম ইউরোপ আমেরিকা ও আরব দেশের বহু মসজিদে পরিলক্ষিত হয়।

২. মসজিদের মুসল্লিদের সাথে সমন্বয় করে নির্দিষ্ট একটি নামাজের পর, হতে পারে তা এশার নামাজ _ নিয়মিত দরসের ব্যবস্থা করা। তাফসির, হাদিস, ফেকাহ ও তরবিয়তী বিভিন্ন কেতাব নিয়মিত উক্ত দরসে পঠন-পাঠন ও পর্যালোচনা করার ব্যবস্থা করা।

৩. নারীদের জন্য সাপ্তাহিক দরসের ব্যবস্থা করা, মসজিদে নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকলে ভাল। অন্যথায় দাওয়াতি প্রেরণা রাখেন এমন কোনো মুসুল্লির বাসার এ ধরনের প্রোগ্রাম করা যেতে পারে। মুসল্লীদের মাঝে সমন্বয় করে, মসজিদের অভ্যন্তরেও এ ধরনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

৪. যেসব মসজিদে জায়গা রয়েছে সেসবে _ ছোট পরিসরে হলেও _ একটি হেফয খানার ব্যবস্থা করা যা ছোট বড় সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। স্কুলে-পড়ুয়া ছাত্রদের জন্য কুরআনের বিশেষ বিশেষ অংশ হেফয করারও ব্যবস্থা থাকবে। আরব দেশের বহু মসজিদে এ ব্যবস্থা রয়েছে।

৫. সালাত কমিটি গঠন ও তদারকি: প্রতিটি মসজিদে বা-কায়দা জামাআতের সাথে নামাজ আদায়কারীদের সমন্বয়ে একটি সালাত কমিটি প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। ইমামের নেতৃত্বে এ কমিটির কাজ হবে, মসজিদের আওতাভুক্ত এলাকায় বসবাসরত প্রতিটি ব্যক্তিকে নামাজী বানাতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তিকে টার্গেট করা এবং তার পিছনে সার্বিকভাবে মেহনত করে যাওয়া। সালাত কমিটির মাধ্যমে এলাকায় মসজিদ পাঠাগারের বইপুস্তক বিতরণকর্মও সম্পন্ন হতে পারে।

৬. মিডিয়া কমিটি : মসজিদের মুসল্লীদের মধ্যে উদ্যমী কয়েকজন যুবকের সমন্বয়ে মিডিয়া কমিটি গঠন করা যেতে পারে। আমরা যেহেতু বর্তমানে মিডিয়ার আধিপত্যের যুগে বসবাস করছি, তাই মিডিয়া কমিটির গুরুত্ব অপরিসীম। ইমামের নেতৃত্বে মিডিয়া কমিটির দায়িত্ব হবে, মসজিদে পরিচালিত দাওয়াতি কার্যক্রম মিডিয়ার মাধ্যমে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা। ইমামের দরস খুতবা ইত্যাদি Paltalk এ সরাসরি সম্প্রচার করা, যেমনটি করছে ইউরোপ আমেরিকার বহু মসজিদ। আর যেহেতু এ মাধ্যমটি বিনা পয়সায়ও ব্যবহার করা যায় তাই প্রত্যেক ইমামকে, এলায়ে কালেমাতুল্লাহর স্বার্থে, এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। মিডিয়া কমিটি আরেকটি কাজ হবে, নিজ নিজ মসজিদের নামে একটি করে ওয়েব সাইট নির্মাণ করা এবং ইমামের দরস, খুতবা ও বক্তৃতাসহ ইসলামি প্রবন্ধ, বইপুস্তক ইত্যাদি তাতে স্থাপন করা। আমরা যেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি তাই এ কাজটি সম্পন্ন করতেও আয়েম্মাদের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করি। প্রাথমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে ওয়েবসাইট-ঠিকানা ও হোস্টিং এর যেসব সুযোগ পাওয়া যায় তা ব্যবহার করা যেতে পারে, googlepage, এক্ষেত্রে উপযুক্ত জায়গা হিসেবে বিবেচিত।

৭. দাওয়াতি মৌসুম, যেমনঃ রমজান, যিলহজ, ইত্যাদি যথার্থরূপে ব্যবহার করা। দাওয়াতি মৌসুমের জন্য বিশেষ প্রোগ্রাম পূর্ব থেকেই নির্ধারণ করে রাখা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য ঐকান্তিকভাবে চেষ্টা করে যাওয়া। মাহে রমজানে তারাবির জন্য অপেক্ষমাণ মুসল্লীদের উদ্দেশে প্রতিদিন বিষয়ভিত্তিক দরসের ব্যবস্থা করা। কোনো কোনো মসজিদে তারাবির নামাজে পঠিতব্য আয়াতসমুহের সারসংক্ষেপ বর্ণনা করা হয়। এ পদ্ধতিও অনুসরণযোগ্য।

৮. প্রতিটি মসজিদের পক্ষ থেকে বাৎসরিক একটি ওয়াজ মাহাফিলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে, এ ধরনের মাহফিলের দ্বারা এলাকায় একটি উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় যা, সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে মসজিদ ও দাওয়া কার্যক্রমের স্বার্থে অনেক কিছুই করা যায়।

৯. এলাকায় বসবাসরত অমুসলিমদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা, ইসলাম বিষয়ে তাদের সকল প্রশ্নের উত্তর প্রদান এবং ইসলামি আকিদা-আদর্শ বিশ্লিষ্ট আকারে তাদের সামনে উপস্থাপনের জন্য ইমাম সাহেবকে সচেষ্ট হতে হবে। ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম, যে ব্যক্তি ইসলাম ভিন্ন অন্য কোনো ধর্ম অবলম্বন করবে তাদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হবে না, এ বিষয়টি তাদেরকে ( আল বালাগুল মুবিন) এর পর্যায় পর্যন্ত বুঝাতে হবে। অন্যথায় ইমামের দাওয়াতি দায়িত্ব পালন অপূর্ণ থেকে যাবে এবং এর জন্য আল্লাহর দরবারে জবাদিহি করতে হবে।

তিন. ইমাম ও সামাজিক দায়-দায়িত্ব : ১. ব্যক্তিগত ও মসজিদ কেন্দ্রিক দায়-দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে একজন ইমামকে অন্যান্য সামাজিক দায়-দায়িত্বও যথার্থরূপে পালন করে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপগুলো খুবই উপকারী বলে প্রমাণিত হতে পারে।

২. কল্যাণ কমিটি গঠন: প্রতিটি মসজিদে, নিষ্ঠাবান ও উৎসাহী মুসল্লীদের সমন্বয়ে একটি কল্যাণ কমিটি গঠন করা আবশ্যক। ইমামের নেতৃত্বে এ কমিটির কাজ হবে, এলাকায় বসবাসরত দুঃস্থ, অভাবগ্রস্ত, অসুস্থ ব্যক্তিদের খোঁজখবর নেয়া এবং তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। মসজিদের তহবিলে জমা-হওয়া অর্থ শুধুই ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমের বেতন এবং মসজিদের উন্নয়ন কর্মে ব্যয় হতে হবে তেমন কোনো কথা নেই। বরং মসজিদে অর্থদানকারীদের যদি জানা থাকে যে তাদের দানকৃত টাকা মসজিদের প্রয়োজন মিটিয়ে অন্যান্য কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়, তাহলে যে কোনো কল্যাণমূলক কাজে এ অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে।

কল্যাণ কমিটির কাজ হবে নিম্নরূপ :
(১) এলাকার উন্নয়নে সাধ্যমত কাজ করে যাওয়া, যেমনঃ রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগ করা, বেকার যুবকদেরকে মসজিদের পক্ষ থেকে ব্যয়ভার বহন করে প্রশিক্ষিত করে তোলা এবং উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র তালাশ করে নেয়ার ব্যাপারে সাহায্য করা। মসজিদের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ করে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে নিতে পারলে আরো উত্তম যেখানে এলাকার বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।

(২) স্বাস্থ্যসেবা : এলাকায় বসবাসরতদের মাঝে স্বাস্থ্য-সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা, মসজিদের এলাকায় কোনো চিকিৎসক থাকলে তাকে সপ্তাহে একদিন এলাকাবাসীর মাঝে বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান। মসজিদের এলাকার পক্ষ থেকে অন্য দরিদ্র এলাকায় চিকিৎসা শিবিরেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

(৩) ইমামের নেতৃত্ব সামাজিক কল্যাণ কমিটির আরেকটি দায়িত্ব হবে এলাকায় অবস্থিত স্কুল মাদ্রাসাগুলোকে সাপোর্ট করা, এলাকার সকল শিশুদেরকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলা, স্কুলগামীদেরকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় ইলম আহরণের উদ্দেশে মসজিদ কর্তৃক পরিচালিত দীনি তালিম প্রোগ্রামে শরীক করার ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ।

(৪) বয়োবৃদ্ধদের সেবা: এলাকায় বসবাসরত বয়স্কদের বিশেষভাবে যত্ন নেয়া। তাদেরকে নিয়মিত জামাআতের সাথে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে তাগিদ দেয়া এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখা। মসজিদ কর্তৃক পরিচালিত নানাধর্মী দাওয়াতি ও সামাজিক কার্যক্রমের সাথে তাদেরকে সম্পৃক্ত করে রাখা।
(৫) নারী উন্নয়ন: এলাকায় বসবাসরত নারীদের ধর্মীয় অজ্ঞতা দূর করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলানো। সকল নারীই যেন শরয়ি পর্দা বজায় রেখে, শরিয়তের বিধান মোতাবেক জীবনযাপনে সচেষ্ট হয়, তার জন্য মুজাহাদা করে যাওয়া। অসহায় ও দুস্থ নারীদের সেবায় এগিয়ে যাওয়া ও ঘরোয়া পরিবেশে আঞ্জাম দিতে পারে, তাদের জন্য, এমন কাজের সুযোগ করে দেওয়া। প্রয়োজনে মসজিদের পক্ষ থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

(৬)এতিম ছেলে-মেয়েদের পাশে দাঁড়ানো: এলাকায় বসবাসরত এতিম ছেলে-মেয়েদের খোঁজ-খবর নেয়া, তাদের তালিম তরবিয়তের ব্যবস্থা করা, একজন মুমিন ও সুনাগরিক হিসেবে যাতে তারা বেড়ে উঠতে সক্ষম হয় সে ব্যাপারে যত্নবান্ হওয়া।

৩. সমাজের গণ্যমান্য ও প্রভাবশালীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি দাওয়াতি কাজে ব্যবহার করা, মসজিদ ও মসজিদকেন্দ্রিক পরিচালিত যাবতীয় কার্যক্রম বাস্তবায়নের পথ সুগম করার প্রয়োজনে এ বিষয়টি খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় সালাম ও কুশল বিনিময়, তাদেরকে হাদিয়া তোহফা দেওয়া, যেমনঃ আতর, টুপি, জায়নামাজ ইত্যাদি প্রদান একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে।

৪. এলাকায় বসবাসকারী ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আলাদা লিস্ট বানানো এবং তাদের সাথে মসজিদ, দাওয়া ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম সম্পর্কে সময় সময় মতবিনিময় করা, ও তাদের প্রত্যেককে এসব কাজের সাথে জড়িত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

৫. সরকারি অফিস ও অফিসারদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা: মসজিদ এলাকায় বিরাজমান সরকারি অফিস _ যদি থাকে_ ও অফিসারদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা জরুরি। কেননা এর দ্বারা মসজিদ ও মসজিদের আওতাভুক্ত এলাকায় বসবাসরত মানুষের, ওই অফিসকেন্দ্রিক প্রয়োজনগুলো মেটানোর পথ অনেকটাই সুগম হতে পারে।

৬. আঞ্চলিক ইমাম কমিটি: এলাকায় অবস্থিত সকল মসজিদের ইমামদের সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক ইমাম সমিতি গঠিত হওয়া প্রয়োজন যার উদ্দেশ্য হবে ইমামদের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি নজর দেওয়া, কারও প্রতি জুলুম করা হলে তা সকলে মিলে প্রতিহত করা। একজন প্রবীণ ইমামের নেতৃত্বে এ কমিটি এলাকায় সম্মিলিতভাবে দাওয়া কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাবে ।

উপসংহারে বলতে চাই, আয়েম্মায়ে কেরাম, যেহেতু এখনও সর্বজন কর্তৃক শ্রদ্ধার পাত্র, তাই ইসলামের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক যেন শিথিল না হয়ে যায় সে জন্য অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় প্রতিজন ইমামকেই কাজ করে যেতে হবে, এবং এ জন্য যেসব দায়-দায়িত্ব তাকে পালন করতে হবে সবই নিষ্ঠার সাথে যথার্থ যোগ্যতা অর্জন করে পালন করে যেতে হবে।

সূত্র : প্রিয় ইসলাম

এফএফ

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ